নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে রচনার একটা নমুনা তৈরি করবো আজ। এই রচনাটি আমাদের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

ভূমিকা :

শৃঙ্খলা মানবজীবনের এক ধরনের কল্যাণমুখী বন্ধন। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শৃঙ্খলার নানা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করেই মানুষ অর্জন করেছে প্রাণিজগৎ শ্রেষ্ঠত্বের আসন, গড়ে তুলেছে এই বিস্ময়কর সমাজ সভ্যতা। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে মানুষকে পালন করতে হয় নানাবিধ সামাজিক দায়িত্ব এবং মেনে চলতে হয় বহুবিধ আইন।

ব্যক্তিজীবনের সুষ্ঠু বিকাশে অনুসরণ করতে হয় সঠিক আদর্শ। তার প্রতিটি কর্মের জন্য প্রয়োজন হয় সুষম সমন্বয়ের। এভাবে ব্যক্তিজীবনে গড়ে ওঠে শৃঙ্খলাবোধ এবং তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে সুশৃঙ্খল জাতি। এমন জাতিই নিশ্চিত করতে পারে জাতীয় জীবনে ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি। পক্ষান্তরে যেখানেই নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব ঘটে সেখানেই দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা, এর ফলে ক্ষতিও অনেক হয়। অনেক সময় দিতে হয় মারাত্মক মাশুল ।

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ | নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা :

জীবনের সর্বস্তরে তথা সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে, খেলার মাঠে, কল-কারখানায়, অফিসে, দোকানে, ট্রেনে, হাসপাতালে, বিমানে প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তী হওয়া অত্যাবশ্যক। নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়ে যায়। খেলার মাঠে ও যুদ্ধের ময়দানে নিয়ম পালন না করলে পরাজয় অনিবার্য। সুতরাং নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাবোধের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। প্রকৃতিতে নিয়মানুবর্তিতা প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের সর্বত্র নিয়মের রাজত্ব চলছে। নিয়ম না মানলে প্রাণিজগৎ হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খল।

পাখিরা ভোরবেলা জেগে গান করে, দিনে খাদ্যান্বেষণে ঘুরে বেড়ায়, রাতে বিশ্রাম করে। এদের সবকিছুই রুটিনমাফিক হয়ে থাকে। আবার যারা নিশাচর প্রাণী তারা রাতকে করে তোলে জীবনবিকাশের মুহূর্ত, দিনে থাকে নিষ্ক্রিয়। মৌমাছি, পিপীলিকা দল বেঁধে তাদের নেতার নির্দেশ মেনে চলে। মৌমাছি আশ্চর্যজনক মৌচাক নির্মাণ করে সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে । গ্রহ, তারা-নীহারিকা নিয়ম মেনে নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয়। দিবা-রাত্রির সংঘটন, ঋতুচক্র সবকিছুই নিয়মের অধীন।

সমাজজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :

নিয়ম ছাড়া সামাজিক জীবন চলতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, যেমন- বিবাহ, পূজা-পার্বণ, খাওয়া-পরা সবকিছুই নিয়ম অনুযায়ী হয়ে থাকে। নিয়ম না থাকলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকে না। সমাজে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে বলেই আমরা আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারি। মোটকথা, নিয়মানুবর্তিতা সমাজজীবনকে সুন্দর করে তোলে। শৃঙ্খলাবিহীন সমাজ জীবনবিকাশের জন্য মোটেই সহায়ক নয়।

মানবজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য প্রাণী থেকে তার পার্থক্য হচ্ছে, সে বুদ্ধিমান ও নিয়মের পূজারী। নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে মানবজীবন হয়ে ওঠে নিয়ম না থাকলে অবস্থা হতো ‘জোর যার মুল্লুক তার’। নিয়মানুবর্তিতাই মানবজীবনকে সুন্দর সার্থক করে তোলে। মানুষকে আহার-বিহার, শ্রম বিশ্রাম, চাল চলন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতে হয় । যে ব্যক্তি যথানিয়মে নিজ কর্তব্য সম্পাদন করে, তার উন্নতি অবধারিত । 

ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :

ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন সর্বাধিক। নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা ও চর্চার উপযুক্ত সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন। একজন ছাত্রকে নিয়মমাফিক লেখাপড়া করতে হয়, সময়মতো পরীক্ষা দিতে হয়। এভাবে নিয়ম পালনে তাকে অভ্যস্ত হতে হয়। নিয়ম মানা ছাড়া ছাত্রজীবনে সার্থকতা লাভ করা অসম্ভব। খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়ার নিয়ম না মানলে ছাত্রজীবনে সার্থকতা আসে না।

সৈনিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতা:

নিয়মানুবর্তিতার উপযুক্ত চর্চা হয় সৈনিক জীবনে । দলনেতার হুকুম, পালন করা তাদের প্রধান কর্তব্য। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, প্যারেড করা, পাওয়া, ঘুমানো সবকিছুই তাদেরকে নিয়মমাফিক করতে হয়। নিয়মানুবর্তিতার প্রতি সৈনিক জীবনে জোর দেয়ার কারণ হচ্ছে একজনের সামান্য নিয়মভঙ্গের কারণে হাজার হাজার সৈন্যের জীবন বিনষ্ট হতে পারে। তাই নিয়মভঙ্গের কারণে তাদেরকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। ওহুদের যুদ্ধে কতিপয় সৈনিকের শৃঙ্খলাভঙ্গ মুসলিমবাহিনীর জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল ।

জাতীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা :

যে কোনো জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হচ্ছে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষা । উচ্ছৃঙ্খল ও ঐক্যহীন জাতি সংহতির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসন লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে আইনের শাসন রক্ষায় নাগরিকদের শৃঙ্খলাবোধ জরুরি। পৃথিবীর অনেক দেশ ও জাতীয় সংহতি তথা নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ | নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

সৃষ্টিমূলক কাজে নিয়মানুবর্তিতা :

সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, চিত্র, ভাস্কর্য যে কোনো সৃজনশীল কাজে নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীতা রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভার সম্ভব হয়েছে নিয়মানুবর্তিতার ফলেই। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক টলষ্টয়ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতাকে অনুসরণ করেছেন। আবার যেসব চিত্রকর জগতে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছেন তারাও চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আয়ত্ত করেছেন। এ সূত্রে রেনেসাঁস শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বা মিকেলাঞ্জেলোর নাম করা যেতে পারে।

আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা :

আধুনিক সভ্যতার নানা দিক অর্জন করা সম্ভব হয়েছে নিয়ম বা শৃঙ্খলার ফলেই । বর্তমান যুগকে বলা যায় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির মূলে রয়েছে নিয়ম। প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কঠোর নিয়মের ফলেই সম্ভব হয়েছে। যে কোনো বিজ্ঞানীর জীবনী পর্যালোচনা করলে জানা যায়, তারা কিভাবে গবেষণাগারে নিয়মের মধ্যে গবেষণায় রত ছিলেন।

অভিযানের ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা :

যেসব দুঃসাহসী অভিযাত্রী দল এই জগতকে আবিষ্কার করেছেন তারাও নিয়মের মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ এভারেস্ট বিজয়ের গৌরব যে তেনজিং ও হিলারি অর্জন করেন, এর মূলে রয়েছে নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খ লা।

যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা :

শুধু সৃষ্টিশীলতা, আবিষ্কার বা অভিযানের ক্ষেত্রে নয়, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও নিয়মের প্রয়োজন রয়েছে। সেনাবাহিনীতে যে বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলো কঠোর নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলা। এই নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলার ফলেই যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করা সম্ভব। আর এই শৃঙ্খলা ভেঙে গেলে পরাজয়ের গ্লানি অনিবার্য। পলাশীর যুদ্ধে যে যুদ্ধে বাংলার ভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয়। ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে এই শৃঙ্খলা ছিল বলেই তারা জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। অপরপক্ষে নবাব সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভেঙে যায় বলেই নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসতে হয়।

নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তরায় নয় :

অনেকের ধারণা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী। কিন্তু এ ধারণা মোটেও সত্য নয়, বরং নিয়ম মানার মাধ্যমেই নিজের অধিকার রক্ষিত হয়। নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশের পথকে সুগম করে। পক্ষান্তরে, অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতার বিকাশ ঘটায়। পরিণামে জীবন দুঃখময় হয়ে ওঠে। তাই নিয়মানুবর্তিতাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী বলার কোনো যুক্তি নেই। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিস নয়।

নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গের পরিণতি :

নিয়মভঙ্গের পরিণতি সর্বদাই অশুভ। ব্যক্তি, সমাজ কিংবা জাতীয় জীবনে যে কোনো ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এ শুধু প্রকৃতিতে নয়, মানবজীবনেও সত্য। রাসূল (স)-এর নির্দেশ অমান্য করে মুসলিমবাহিনী ওহুদের যুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। নিয়মানুবর্তিতার অভাবে প্রতিভাবান মানুষের জীবনও ব্যর্থ হয়ে যায় । খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে জীবনে ঝুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। মোটকথা, নিয়মানুবর্তিতার অভাব জীবনের গ্লানিই শুধু বাড়ায় ।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার :

সমকালীন বিশ্বের অস্থির পরিস্থিতির জন্য আজকের মানুষ শান্তিময় জীবন থেকে বিচ্যুত হয়েছে। মানুষের জীবন আজ জটিল ও সংকটযুক্ত। পুরানো মূল্যবোধ অপসৃত হয়েছে। ফলে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়েছে। মানুষের সুকুমার বৃত্তির অবলুপ্তি ঘটেছে। পরিণামে মানুষ মনের দিক থেকে রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। এতে বাঁচার আনন্দ দূর হয়ে মানুষকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য নিয়মানুবর্তিতার চর্চা করা দরকার। নিয়মানুবর্তিতাই মানবজীবনকে সুন্দর করে তুলতে পারে, জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনয়ন করতে পারে। তাই জীবনে নিয়মানুবর্তিতার চর্চাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment