দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : বর্তমানে দেশের অন্যতম আলোচ্য বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি । মূল্য বৃদ্ধির এ হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হওয়ায় তা ‘টক অব দি কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। বলগাহীন আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যে বিপর্যন্ত হয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে।
Table of Contents
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আর এ মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্নের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, পিয়াজ, রসুন, মাছ, তরকারি, চিনি, দুধ ইত্যাদি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তুলেছে। ক্ষুধায় বুভুক্ষু মানুষ দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত করছে। দ্রব্যমূল্য তাদের নাগালের মধ্যে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছ তারা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে । তবুও আশার রাজ্যে জনগণের বিশ্বাস দ্রব্যমূল্যের এই অবস্থার পরিবর্তন হবে, তাদের আশা বাস্তবে রূপ নেবে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ন্যায়সঙ্গত মূল্য বলতে বর্তমানে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায় না। অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশের অবস্থা এমন ছিল না। অতীতের সেই কথাগুলো আজ আমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়। যেমন—শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত । এখন আর সে মূল্য আশা করা যায় না। এক সের লবণ এক পয়সা, এক পয়সায় এক সের দুধ, দু আনায় এক সের তেল, একটি লুঙ্গি এক টাকা এবং একটি সুতি শাড়ি দু টাকা তা খুব বেশি দিনের কথা না হলেও এটা কেউ এখন আর আশা করে না। ব্রিটিশ শাসনামলেও আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য একটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত বিভক্ত হওয়ার পর এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও পণ্যদ্রব্যের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী আমাদের জীবনে অতর্কিত হানা দেয়। জনজীবন হয় অতিষ্ঠ। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের এই অবস্থান । বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া জনগণকে হতাশার রাজ্যে নিয়ে গেছে ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ :
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনেক কারণ রয়েছে। যেমন—
১. চাহিদা ও যোগান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা। চাহিদা তীব্র ও সরবরাহ সীমাবদ্ধ হলে পণ্যের জন্য ক্রেতার ভীড় বেড়ে যায়। পণ্য সংগ্রহের জন্য শুরু হয় প্রতিযোগিতা। ফলে অনিবার্যভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
২. অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি : আকস্মিক কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধিতে মজুতদার, মুনাফাখোর, ফটকাবাজ, চোরাচালানি ইত্যাদি অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থানেষী মিকা থাকে। এরা সুযোগ বুঝে হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে গায়েব করে গোপনে মজুত করে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। শুরু হয় কালোবাজারি। পণ্যের জন্য হা-হুতাশ শুরু হলে এই সুযোগে তারা দাম বাড়ায় এবং অল্প অল্প করে গোপন মজুত বাজারে ছাড়ে। এভাবে তারা বিপুল টাকা চোরাপথে হাতিয়ে নেয় ।
৩. বৈদেশিক রপ্তানি অনেক সময় বিদেশে পণ্য রপ্তানি লাভজনক হলে রপ্তানিকারকরা সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করে। এর ফলে দেশেও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মূল্য বাড়ে।
৪. কর বৃদ্ধি : অনেক সময় সরকারের মাথাভারি, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন চালাতে গিয়ে সরকারকে জনগণের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপাতে হয়। সে কর প্রত্যক্ষ হোক, কিংবা ভ্যাটের আকারে হোক তার ফলে পণ্যের দাম বাড়ে। এই জন্য দেখা যায়, বাজেটে কোনো পণ্যের কর বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলে তার মূল্য রাতারাতি বেড়ে যায় ।
৫. কালো টাকার দৌরাত্ম্য : নানা অবৈধ পন্থার সমাজে এক শ্রেণীর লোক বিস্তর কালো টাকার মালিক হয়েছে । কালো টাকার বদৌলতে তাদের ক্রয় ক্ষমতা সাধারণ লোকের তুলনায় অস্বাভাবিক বাড়ে । এই কালো টাকা পণ্যমূল্য রেখাকে সহজেই জনসাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। জাতীয় অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নীতি শিথিল হলে এবং আমলাতন্ত্র দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে কালো টাকা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এর অবধারিত পরিণতি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ।
৬. চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি : আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর চাঁদাবাজ ঘাটে ঘাটে জবরদস্তিমূলকভাবে পরিবহন সেক্টর থেকে ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ চাঁদা তুলছে। স্থানীয় মাস্তান, প্রতিপত্তিশালী সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ পুলিশ—সবাই চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হওয়ায় তার অশুভ প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যের ওপর ।
৭. সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বণ্টনে অব্যবস্থা : আমাদের দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতার কারণে পরিবহন ধর্মঘট, শ্রমিক ধর্মঘট, রাস্তাঘাট অবরোধ ইত্যাদি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। উন্নত রাস্তাঘাট, নিশ্চিত যাতায়াত ও পরিবহনের মাধ্যমে প্রয়োজনানুসারে নির্দিষ্ট দ্রব্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিলে জনগণকে এ অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের স্বীকার হতে হয় না।
৮. বিশ্ব বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি : পণ্যমূল্য বৃদ্ধি কেবল বাংলাদেশের একক সমস্যা নয় । আশেপাশের দেশ এমন কি আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত দেশও এ সমস্যা মোকাবিলা করছে। এক অর্থে এ এক আন্তর্জাতিক সমস্যা। এর ফলে আমাদের দেশেও আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কিছুটা পার্থক্য আছে। এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত। তাই পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
৯. জনসংখ্যা বৃদ্ধি : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু সেই রূপকথার বাংলা আর নেই। নেই গোলাভরা ধান, গাল ভরা পান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। পেটে খাবার নেই, পরনে নেই কাপড়। এসবের মূল কারণ হলো জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি। মানুষ বাড়ছে অথচ জমি বাড়ছে না, বাড়ছে না খাদ্যোৎপাদন। ফলে নিত্যনিদের জিনিসের অপ্রতুল সরবরাহের কারণে দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১০. জমির উর্বরতা হ্রাস যুগের পর যুগ ধরে আমাদের জমিগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। জমিতে একই ধরনের ফসল উৎপাদন, সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। কৃষকের প্রত্যাশা অনুযায়ী জমিতে ফসল ফলছে না। অথচ চাহিদা বাড়ছে দিনের পর দিন। বাজারে চাহিদার তুলনায় অনেক কম খাদ্যশস্য আমদানি হচ্ছে। বাধ্য হয়েই চড়া দামে ভোক্তারা তা কিনছেন। জমিতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদিত হলে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং দ্রব্যমূল্যের দামও জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
১১. অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা : যানবাহনের অব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের অভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামাল পৌছাতে নির্দিষ্ট খরচের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রংপুর, দিনাজপুর থেকে ঢাকায় পণ্য আমদানি করতে স্থানীয় দামের তুলনায় পরিবহন ব্যবস্থার সমস্যার কারণে কয়েকগুণ খরচ বেশি হয়ে থাকে। রংপুর, দিনাজপুরে যে জিনিসের দাম কেজি প্রতি ৪-৫ টাকা, ঢাকায় সেই একই জিনিস কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে । পরিবহন ব্যবস্থার ত্রুটি এবং অনেক জিনিস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্য স্থানে সরবরাহ করতে না পারার কারণে তা পচে যায়। এতে দ্রব্যের অপ্রতুলতা ঘটে। চাহিদার তুলনায় দ্রব্যের সরবরাহ বা পরিমাণ কম থাকে। ফলে দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়।
১২. চোরাচালান : প্রচুর খাদ্যশস্য চোরাচালানের ফলে দেশের খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারন করছে। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় চোরাই পথে মালামাল পাচার করে থাকে। ফলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়। এতে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পায়।
দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির নির্দিষ্ট সময় আমাদের মতো গরিব ও জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে নিত্যদিনই দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটে থাকে। তবে এ মূল্য বৃদ্ধি সারা বছর কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও প্রতি বছর রমজান মাসে এর অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়। রমজানের আগমনবার্তায় রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে উপচেপড়া ভিড়, অসাধু ব্যবসায়ীদের ফায়দা লোটা, চোরাকারবারি, নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণই এর জন্য দায়ী। প্রতি বছরই পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনা শুরু হয় লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, পানি-বিদ্যুৎ সংকট, ছিনতাই, সন্ত্রাস ও তীব্র যানজটের বিড়ম্বনা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে। রমজানের আগমনী বার্তায় পণ্যমূল্য এক ধাপ বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, পণ্যের যোগান নয় বরং অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদারি ও নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থাই এই মূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া:
মূল্যদ্রব্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। আমাদের দেশে অধিক দামে ক্রম করার সামর্থ্য আছে মুষ্টিমেয় লোকের। তাই যেসব কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে তার প্রভাব সবটাই বৃহদংশ জনগণের ওপর পড়ে। অধিক ব্যয় করার সামর্থ্য এ দেশের অধিকাংশ জনগণেরই নেই।
ফলে বাধ্য হয়ে ব্যয় কমাতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বেঁচে থাকার তাগিদে অপরিহার্য উপকরণ সংগ্রহ করতেই তারা হিমশিম খেতে যায়। সাধারণ মানুষের জীবনধারণে খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে নেমে যাচ্ছে জীবনধারণের মান, কমছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান। এর প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। শিশুরা উপযুক্ত যত্নের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। আর্থিক সংকটের ফলে ছাত্রছাত্রীদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাড়তি আয়ের জন্য অনেক অবৈধ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে। সমাজে সৃষ্টি হয় নানা অবক্ষয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার :
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। বাজারে পণ্যের দামের : অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ক্রেতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে পণ্যের মূল্য। দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ সারাদিনের ধর্মকান্ত রোজগার দিয়ে দু বেলা পেটপুরে খেতে পারছে না। অর্ধাহারে, অনাহারে তারা আজ চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে। এ পরিস্থিতির প্রতিকার করার জন্য সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের এরূপ ঊর্ধ্বগতিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে বিশেষজ্ঞ মহল ধারণা করছেন।
ক. সরকারি উদ্যোগ : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার একটি দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেন। এ আইনের আওতায় দ্রব্যমূল্যের মূল্য নির্ধারণ, চোরাকারবারি প্রতিরোধ, ফড়িয়া ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন। ব্যবসায়ীরা যাতে ইচ্ছেমতো জিনিসের দাম বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করে তাদের হাতে এ বিষয়ক দায়িত্ব ন্যস্ত করতে পারেন। ব্যবসায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে এ অবস্থার উন্নতি করা যেতে পারে।
খ. পণ্যমূল্য নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ : পণ্যমূল্য নির্ধারণে আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অথবা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ নিতে পারে। পণ্যমূল্য নির্ধারণ ও তদারকি করার জন্য পণ্যমূল্য মনিটরিং সেল নামে একটি সেল গঠন করে তার কার্যকারিতা জোরদার করা যেতে পারে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ কেনাবেচা করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এভাবে আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতি রোধ করা যেতে পারে ।
ঘ. কৃষি ভর্তুকি বাড়ানো : কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকই হচ্ছে অর্থনীতির মেরুদণ্ড। অথচ আমরা তাদের বিশাল অবদানের কথা ভুলে যাই । কিন্তু এ দেশের কৃষকরা আজ যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দেশের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ এই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও এসব কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। এর ফলে চাষী তার সর্বশক্তি দিয়ে ফসল ফলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ক্ষেতের ফসল গোলায় তোলার আগে তাকে ঋণ শোধ করতে হয়।
এমতাবস্থায় সরকারিভাবে কৃষিতে ভর্তুকি দিলে কৃষকদের অবস্থার উন্নতি হবে । অর্থাৎ কৃষিখাতে ভর্তুকির কোনো বিকল্প নেই। অবশ্য আশার কথা সরকার ২০০৪-০৫ অর্থবছরে কৃষিখাতে ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করছে। উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষকদের উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। আর উৎপাদন বাড়লে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ হবে ।
ঙ. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : দ্রব্যমূল্যের লাগামহীম ঊর্ধ্বগতিতে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য টিসিবিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে স্পর্শকাতর পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। বর্তমান আইনানুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেবে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বাজারে পণ্যমূল্যের নাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে জনগণের বিশ্বাস।
উপসংহার :
সরকার ও জনগণ সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সজাগ হয়েছে এবং চোরাকারবারি ও কালোবাজারি ইতিমধ্যেই সরকার ও জনগণের হাতে লাঞ্ছনা ও শাস্তি ভোগ করছে। ব্যবসায়ী, সরকার ও জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আমাদের এই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে অদূর ভবিষ্যতে উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এ বিশ্বাস আমাদের সকলের ।