দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার শীর্ষক আলোচনা সভার মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার শীর্ষক আলোচনা সভার মঞ্চ ভাষণ এর একটি খসড়া তৈরি করে দেয়া হলো শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের,  “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ|

দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার শীর্ষক আলোচনা সভার মঞ্চ ভাষণ

‘দুর্নীতিমুক্ত সমাজগঠনে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য আয়োজিত এই মহতী অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ— আস্সালামু আলাইকুম। সমাজের রন্ধ্রে রন্দ্রে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়া সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াল কালো থাবায় বিপন্ন আজ সমাজব্যবস্থা। এ সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধির মরণ ছোবলে বর্তমান সমাজ জর্জরিত।

 

দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার শীর্ষক আলোচনা সভার মঞ্চ ভাষণ

 

রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বত্রই চলছে দুনীর্তি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) -এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে বিগত পাঁচ বছর বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল বহু ত্যাগ-সংগ্রামের পর। কিন্তু হায়! বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের এহেন লজ্জাকর ও বিপর্যস্ত চিত্র উন্মোচিত হবার পর আমাদের বিগত ৩৮ বছরের অর্জিত সব কিছুই ম্লান হয়ে গেছে।

একবার নয়, পর পর পাঁচবার দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে এই পরিচিতি, সারাবিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, হুমকির সম্মুখীন করেছে জাতীয় অস্তিত্বকে। আমরা বিশ্ববাসীর সামনে নবপ্রজন্মের জন্য কী ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছি? আগামী প্রজন্মের জন্য কী এক অনিশ্চিত ও ভয়াবহ ভবিষ্যৎই না রচনা করেছি! সম্মানিত সুধীবৃন্দ, দুর্নীতি শব্দটি আমাদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সামাজিক জীবনে প্রতিদিনই আমরা কোন না কোন দুর্নীতির খবর জানছি, শুনছি এবং পড়ছি। আমাদের দেশের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে নি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সরকার থেকে শুরু করে আমাদের পারিবারিক জীবন এমন কি ব্যক্তি জীবনে পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে। বাংলাদেশ আজ সীমাহীন দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত। বিভিন্ন উৎসে প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে কয়েকটি খাতে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ জুলাই, ২০০৫)। এই খাতগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম, সরকারি ক্রয়, ঘুষ, বন্দর অব্যবস্থাপনা, বিমান খাত ও ব্যাকিং খাত প্রভৃতি। এছাড়া এজিবি অফিসের অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়াও দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৬০,০০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে বলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারাকাত এক গবেষণা সমীক্ষায় উল্লেখ করেছেন (বিবিসি, ২৬-০৯-০৩)। সুধী, দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলে তা দিয়ে শিশু ও প্রসূতির চিকিৎসা, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মেরামত ও জনকল্যাণে ব্যয়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে দেশটা যেমন অনেক দূর এগিয়ে যেত, তেমনি দাতাদের উপর আমাদের নির্ভরশীলতাও অনেকটা কমে আসত।

জাতীয় জীবনের গভীরে প্রোথিত এহেন জাতীয় সমস্যার সমাধানের সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা নেই। তবে সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, জাতীয় জীবনীশক্তি বিনাশকারী এই ভয়াবহ মহামারী হতে জাতিকে রক্ষা পেতে হলে ‘সামাজিক আন্দোলনে’র প্রয়োজন। সুধীবৃন্দ, বিশ্বায়নের এই তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশীরা দুর্নীতির কারণে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি না। আমাদের রয়েছে স্রষ্টা প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও জাতিকে উজ্জীবিত করার শক্তিশালী আদর্শ।

শুধু প্রয়োজন সুচিন্তিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ। ‘ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার ও ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হউক আমাদের হাজার মাইল পদযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। এছাড়াও জাতীয় সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বাসে ট্রেনে, শপিং সেন্টার, নাটক-সিনেমা, চিত্রকলা এবং অফিস-আদালত সর্বত্রই উচ্চারিত হবে আমাদের স্লোগান :

‘ঘুষ নেব না, ঘুষ দেব না, কাউকে দুর্নীতি করতে দেব না।’

সুধী, মনে রাখা চাই দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। দেশবাসী যতক্ষণ তাদের উন্নয়ন অধিকার বিষয়ে সচেতন ও সোচ্চার না হচ্ছেন ততক্ষণ লাভের ধন পিঁপড়েরা খেতেই থাকবে। তাই নাগরিকদের সচেতন ও সংগঠিত হতেই হবে। অধিকার-ভিত্তিক উন্নয়নের মূল কথাই হচ্ছে সর্বত্র নাগরিকদের পক্ষ থেকে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করা। আমরা কি এখন পর্যন্ত সেরকম নাগরিক দায়িত্ব পালনে উদযোগী হতে পেরেছি? না এখনও পর্যন্ত আমরা সে ধরনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি নি। প্রিয় সুধীসমাজ, দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি।

 

দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার শীর্ষক আলোচনা সভার মঞ্চ ভাষণ

 

তাই দুর্নীতি প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে যুব সমাজকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা হয়ে ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান-সকল পর্যায়েই বঞ্চিত, নিপীড়িত জাতিকে মুক্তির আলো দেখিয়েছে এ দেশের যুব সমাজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই দেশ বিশ্বের ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ দেশের যুব সমাজ বারবার প্রমাণ করেছে আমরা হারি নি, আমরা পেরেছি, আমরা পারবো। দেশের প্রতি তরুণদের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে দুর্নীতিবিরোধী এই সামাজিক আন্দোলনকে। সবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক প্রচারিত দুর্নীতি বিরোধী স্লোগানসমূহ স্মরণ করিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।

৷ দুর্নীতি বিরোধী স্লোগান ৷

→ দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধে সরকার সোচ্চার, দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধে আপনিও এগিয়ে আসুন। আপনার পাশেই হয়ত কোনো দুর্নীতিবাজ রয়েছে, এদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সহযোগিতা করুন। দুর্নীতিবাজরা উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের শত্রু, এদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাহায্য করুন। এ দুর্নীতিবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু- দেশের উন্নয়নে দুর্নীতিবাজরা প্রধান বাধা। এ দুর্নীতি দারিদ্র্য বাড়ায়- দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দুর্নীতি প্রতিরোধে আপনিও এগিয়ে আসুন। দুর্নীতির বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করুন, দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন।

দুর্নীতিবাজরা জনগণের সম্পদ লুটে ধনী হয়েছে, এদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। এ দুর্নীতিবাজরা জনগণের সম্পদ হরণ করে, দেশ ও জাতির শত্রু দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত করুন। দেশ ও জাতির শত্রু দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত করে সমৃদ্ধ দেশ গঠনে আপনিও অংশ নিন। আমার আপনার সম্পদ লুটে দুর্নীতিবাজরা ধনী হয়েছে, এ লুটেরাদের ঘৃণা করুন, সামাজিকভাবে বয়কট করুন।

আরও দেখুন:

Leave a Comment