দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য – ভাব-সম্প্রসারণের একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আগ্রহীরা এখন থেকে ধারণা নিয়ে নিজের ভাষায় নিজস্ব সংস্ককরণ তৈরি করবেন। কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় অনেক সময় ভাব-সংহত বাক্য বা চরণ থাকে, যার মিত-অবয়বে লুক্কায়িত থাকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত গূঢ় কথা, নিহিত থাকে ভূয়োদর্শনের শক্তি। ইতিময়, রূপকাশ্রয়ী স্বল্প-বাক উক্তিগুলো বিশ্লেষণে বের হয়ে আসে গত জীবন সম্পর্কে বৃহৎ ভাব, জীবনের অদ্ভুদর্শন। এই ধরনের ভাবগূঢ় বাক্যগুলোর ব্যাখ্যা-বিশেষণই হলো ভাবসম্প্রসারণ।
দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য। সর্পের মস্তকে মণি থাকিলেও তাহা কি ভয়ংকর নহে?
দুর্জন শব্দের আভিধানিক অর্থ দুষ্ট, দুরাত্মা, দুর্বৃত্ত, খারাপ লোক ইত্যাদি। আর বিদ্বান হল পণ্ডিত, সুশিক্ষিত, জ্ঞানী ইত্যাদি। দুর্জন বিদ্বান হলেও নিন্দনীয় এবং এরূপ ব্যক্তির সঙ্গ বর্জনীয়। দুষ্ট লোক দেশ ও সমাজের শত্রু। তারা বিদ্বান হলেও লোকে তাদের ঘৃণা করে। মানুষ যে সমাজের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে সে-সমাজে আছে নানা ধরনের লোক— জ্ঞানী-মূর্খ, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ নানারকম মানুষের সমাবেশ সেখানে। সঙ্গ নির্বাচনে একমাত্র বিবেচনার দিক হল গুণবানের বৈশিষ্ট্য— যার সহায়তায় জীবন হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। সেখানে দুর্জন বা চরিত্রহীন ব্যক্তির অনুপ্রবেশের কোন সুযোগ নেই । মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ তার চরিত্র।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘The crown and glory of life is character’. চরিত্রের গুণেই মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায়। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে অপরাপর বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটানো আবশ্যক। অপরপক্ষে, বিদ্যা মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। বিদ্যার হিরণ্ময় দীপ্তিচ্ছটায় মানুষ হয়ে ওঠে মহীয়ান। বিদ্বান সর্বত্র মর্যাদাবান এবং সম্মানের পাত্র। কিন্তু এই বিদ্বান যদি চরিত্রবান না হন, তাহলে সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ মন্দস্বভাব তার সব গুণকে ম্লান করে দেয়। মনুষ্যত্ব-বিরোধী কুপ্রবৃত্তিগুলো দুর্জন লোকের নিত্যসঙ্গী। এই ধরনের ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র দুর্বল, ব্যবহারে এরা রূঢ়, চিন্তায় তরল। দেশ, সমাজ, জাতি কেউ এদের দ্বারা উপকৃত হয় না। এরা সমাজের কলঙ্ক।
চরিত্র বিদ্যা অপেক্ষা অধিক মূল্যবান। তাই সচ্চরিত্র ব্যক্তি মূর্খ হলেও তার সংস্পর্শ উপকারী; জ্ঞানার্জনের জন্যে চরিত্রহীন জ্ঞানী ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়া কোনক্রমেই ঠিক নয় । কারণ দুর্জনের সাহচর্যে নিষ্কলুষ চরিত্রও কলুষিত হতে পারে। দুর্জন ব্যক্তি বিদ্যা-বুদ্ধিতে মহাপণ্ডিত বলে খ্যাতিমান হলেও সবার উচিত তার সঙ্গ পরিহার করা। কারণ চরিত্রহীনের বিদ্যা-বুদ্ধি কারো কোনো কাজে আসে না। তাছাড়া এরা শিক্ষিত হয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। চাতুরী ও ছলনায় আরও কূটকৌশলী হয়ে এরা সহজ-সরল মানুষকে প্রতারিত করে। এদের সাহচর্যে সততার অপমৃত্যু ঘটে। যে-কোনো মুহূর্তে এ ধরনের লোক নৃশংসতম কাজটি করতে পারে।

বিদ্যা যার চরিত্রকে সংশোধন করতে পারে নি, তাকে দিয়ে মানুষের কোনো কল্যাণ হতে পারে না। দুর্জন ব্যক্তি সাপের সঙ্গে তুলনীয় এবং তার অর্জিত বিদ্যা সাপের মাথার মণির সঙ্গে তুলনীয়। সাপকে মানুষ ভয় করে। কারণ যে-কোনো সময় সাপ তার ছোবল দিয়ে প্রাণনাশ করতে পারে। তেমনি বিদ্বান হয়েও যিনি দুর্জন, তার কাছ থেকে যে-কোনো সময় ক্ষতির আশঙ্ক্ষা থাকে। তাই দুর্জনের বিদ্যা আর বিষধর সাপের মণি উভয়েই বিপদের কারণ হতে পারে। সুন্দর জীবনের জন্যে, দুর্জনকে পরিহার করতে হবে— তার বিদ্যাবত্তা বিবেচনার যোগ্য নয়। চরিত্র মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। চরিত্র নষ্ট হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। তাই চরিত্রহীন বিদ্বানের সাহচর্য অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
আরও দেখুন: