দুঃখের মত এত বড় পরশপাথর আর নাই – ভাব-সম্প্রসারণের একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আগ্রহীরা এখন থেকে ধারণা নিয়ে নিজের ভাষায় নিজস্ব সংস্ককরণ তৈরি করবেন। সাধারণত ভাব সম্প্রসারণ করার জন্য প্রদত্ত কবিতার অংশ অথবা গদ্যের অংশ অতিসংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। আর এই ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সহস্ত্র ভাবের ইঙ্গিত।ভাব সম্প্রসারণ এর সময় সেই চরণের মূল গভীর ভাবটুকু উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় যুক্তি, বিশ্লেষণ এবং উপমা ব্যবহার করে সেইসাথে প্রয়োজন অনুসারে উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করার প্রক্রিয়া।
দুঃখের মত এত বড় পরশপাথর আর নাই
দুঃখ মানুষের কাম্য নয়। কিন্তু তাই বলে জীবন শুধু নিরবচ্ছিন্ন সুখেরও নয়। দুঃখ ও সুখ জীবনের কঠিন বাস্তবতার এপিঠ-ওপিঠ। দুঃখের স্পর্শেই মানবসত্তা জাগ্রত হয়, জীবন হয় মানবিক বোধে আলোকিত। দুঃখের পরশেই মানুষের বিবেক মহান হয় এবং মানুষ সত্যিকার মনুষ্যত্ব লাভ করে।
দুঃখের পরে সুখ আসে, দুঃখ নয়— এটাই জগতের চিরায়ত নিয়ম। দুঃখ ছাড়া প্রকৃত সুখ অর্জনের বিকল্প কোন পথ নেই। দুঃখ ও সংগ্রামের মধ্যে মানুষ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যায়, দুঃখকে জয় করে অগ্রসর হয় তার মধ্যে থাকে আনন্দ। দুঃখ যেন মানবজীবনের এক কঠিন পরীক্ষা। দুঃখের স্পর্শ মানুষকে দুঃখ জয়ী হওয়ার শিক্ষা দেয়, সাহসী হওয়ার ভরসা দেয়, জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার দীক্ষা পায়। দুঃখই মানুষের সকল দৈন্য দূর করে তাকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে। মনীষীগণ দুঃখকে পরশপাথরের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
পরশ পাথরের ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনি দুঃখরূপ পরশপাথরের ছোঁয়ায় মানুষের সব গ্লানি দূর হয়ে যায়। মানুষ লাভ করে জীবনের সার্থকতা । জগতের সব সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সীমাহীন দুঃখের মর্মান্তিক ইতিহাস । দুঃখবোধ থেকেই প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। দুঃখের দারুণ দহন শেষে যে সুখ আবির্ভূত হয়, তা অনাবিল ও অতুলনীয়। দুঃখের আগুনই মানুষের মনুষ্যত্ব ও বিবেককে খাঁটি সোনায় পরিণত করে। পৃথিবীর সব মূল্যবান সম্পদ দুঃখ-কষ্টের বিনিময়েই অর্জিত হয়েছে। বাংলা প্রবাদে আছে- ‘কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না।’ দুঃখ, কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অধ্যবসায় ছাড়া জীবনে প্রার্থিত স্বর্ণশিখরে আরোহণ অসম্ভব। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য- ‘দুঃখই জগতে একমাত্র সকল পদার্থের মূল।
মাতৃস্নেহের মূল্য দুঃখে, পাতিব্রত্যের মূল্য দুঃখে বীর্যের মূল্য দুঃখে, পুণ্যের মূল্য দুঃখে।’ বস্তুত মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ পাশাপাশি বিরাজ করে। অনেকে দুঃখে ভেঙে পড়ে। দুঃখবোধের যন্ত্রণায় কারও জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু সাহসী মানুষ দুঃখকে মোকাবিলা করে। তারা দুঃখকে দুঃখই মনে করে না। বরং দুঃখ দেখে সুখের সাধনায় নিয়োজিত হয়। বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে দুঃখকে জয় করে সুখকে ছিনিয়ে আনে। বস্তুত দুঃখ মোকাবিলা করার শক্তি দিয়েই মানুষ আপন শক্তির পরিচয় দিতে পারে। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জীবনী পর্যালোচনা করলে এ-সত্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। রুটির দোকানের নজরুল দুঃখ- দারিদ্র্যের এক বাস্তব উদাহরণ।

জীবন চলার প্রতিটি পর্যায়ে দুঃখ-দারিদ্র্য তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে। বিনিময়ে তাঁকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা। তাই তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে— ‘হে দারিদ্র্য! তুমি মোরে করেছ মহান / তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।’ পৃথিবীর বহু মনীষী দুঃখকে বরণ করে নিয়েছিলেন বলেই আজও তাঁরা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.), যিশু খ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ মহান ধর্মবেত্তা জীবনের প্রতিটি পদে দুঃখকে জয় করে সমগ্র মানব জাতির মঙ্গলের জন্যে কাজ করে গেছেন দুঃখ মানুষের সকল জড়তা ও দৈন্য দূর করে তাকে করে সুন্দর। দুঃখের ভেতর দিয়েই মানুষ জীবন-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে। সুতরাং জাগতিক সকল প্রাপ্তির পূর্বশর্ত দুঃখের পরশ।
আরও দেখুন: