তিরন্দাজ গল্প | যোগীন্দ্রনাথ সরকার | আনন্দ পাঠ

তিরন্দাজ গল্প – ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার জন্য শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত মেধা ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষায় যোগ্য করে তোলা মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষার্থীকে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত পটভূমির প্রেক্ষিতে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক করে তোলাও। মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত হয়েছে মাধ্যমিক স্তরের সকল পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তকগুলোর বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ, দেশপ্রেমবোধ, প্রকৃতি-চেতনা এবং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

তিরন্দাজ গল্প | যোগীন্দ্রনাথ সরকার | আনন্দ পাঠ

 

তিরন্দাজ গল্প

সেকালে দিল্লির কাছে হঞ্জিনা নামে এক নগর ছিল। শান্তনু সেই হঙিনায় রাজত্ব করিতেন। একদিন শান্তনু যমুনার তীরে বেড়াইতে গিয়া অপরূপ সুন্দরী একটি কন্যা দেখিতে পাইলেন। এই কন্যার নাম সত্যবতী। শিশুকাল হইতে এক ধীবর তাঁহাকে পালন করিয়াছিল। রাজা ধীবরের কাছে গিয়া তাঁহার পালিত কন্যাটিকে বিবাহ করিতে চাহিলেন।

ধীবর বলিল, ‘মহারাজ, আপনার দেবব্রতের মতো সোনার চাঁদ ছেলে থাকিতে সত্যবতীর ছেলের রাজ্য পাইবার কোনোই সম্ভাবনা নাই, কাজেই এই বিবাহে আমি মত দিতে পারি না।’ দেবব্রত একদিন ধীবরের কাছে গিয়া বলিলেন, ‘আমার পিতার সহিত আপনার কন্যার বিবাহ দিন। ভবিষ্যতে তাঁহার পুত্রই রাজা হইবেন। প্রতিজ্ঞা করিতেছি, আমি কখনো সিংহাসন দাবি করিব না।’

ধীবর বলিল, ‘কুমার, এ প্রতিজ্ঞা আপনারই যোগ্য বটে, কিন্তু সিংহাসন লইয়া পরে আপনার পুত্রেরা যে গোলযোগ করিবেন না, তাহার নিশ্চয়তা কী?’ তখন দেবব্রত বলিলেন, ‘আচ্ছা, আবার প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি বিবাহও করিব না।’ দেবব্রতের এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁহার নাম হইল ভীষ্ম।
মহাসমারোহে রাজা শান্তনু ও সত্যবতীর বিবাহ হইয়া গেল।

তারপর যথাক্রমে তাঁহাদের চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্র হইল। ভীষ্ম রাজ্যের সকল অধিকার ত্যাগ করিয়াও রাজকার্যের সমস্ত ভার আনন্দের সহিত বহন করিতে লাগিলেন। বিচিত্রবীর্য বড়ো হইলে অম্বিকা ও অম্বালিকার সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। কালক্রমে এই দুই কন্যার দুইটি পুত্র হইল।

অধিকার পুত্রের নাম হইল ধৃতরাষ্ট্র, তিনি ছিলেন জন্মান্ধ। আর অম্বালিকার পুত্রের নাম অন্ধ ছিলেন বলে ধৃতরাষ্ট্র পিতার মৃত্যুর পর রাজা হইতে পারিলেন না। দেশের লোক পাণ্ডুকেই সিংহাসনে বসাইল।

ইহাতে ধৃতরাষ্ট্র খুবই দুঃখিত হইলেন। পাণ্ডুর বড়ো ছেলের নাম যুধিষ্ঠির। ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব নামে তাঁহার আরও চারি পুত্র ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতি একশত ছেলে আর দুঃশলা নামে একটি মেয়ে ছিল। পাণ্ডু কুরুবংশের রাজা হইলেও তাঁহার ছেলেগুলিকে লোকে ‘পাণ্ডব’ বলিত আর ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের বলিত ‘কৌরব’।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বড়ো হইলে যুধিষ্ঠির হস্তিনার সিংহাসনে বসিবেন, এ দুঃখ কি আর দুর্যোধন প্রভৃতির সহ্য হয়। ছেলেবেলা হইতেই পাণ্ডবদের প্রতি হিংসায় তাহাদের বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। এদিকে পাণ্ডুর ছেলেদের সরল মিষ্ট ব্যবহারে সকলেই সুখী হইত। কিন্তু পাণ্ডবদের সুখের দিন দেখিতে দেখিতে ফুরাইয়া গেল।

অতি শিশুকালেই তাহারা পিতৃহীন হইলেন। তখন যুধিষ্ঠির, ভীম প্রভৃতি পাঁচ ভাই ধৃতরাষ্ট্রের একশত ছেলের সহিত একসঙ্গে বাস করিতে লাগিলেন। দুর্যোধন প্রভৃতির অন্তর যে কত কুটিল, পাণ্ডবেরা তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং সেই জন্য তাঁহারা বিশেষ সতর্ক হইয়া চলিতে লাগিলেন।

ক্ষত্রিয়ের ছেলেরা শাস্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যাও শিখিতে আরম্ভ করে। রাজকুমারগণ কৃপাচার্য নামে একজন শিক্ষকের নিকট ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করিতেন। ভীষ্মের কিন্তু বরাবর এই ইচ্ছা যে, ভরদ্বাজ মুনির পুত্র সুবিখ্যাত দ্রোণাচার্যের ওপর ছেলেদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দেন। ঘটনাক্রমে একদিন দ্রোণ নিজেই হস্তিনায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

শহরের বাহিরে পৌছিয়াই দ্রোণ দেখিলেন, রাজবাড়ির ছেলেরা উৎসাহের সহিত একটা লোহার গোলা লইয়া খেলা করিতেছে। খেলিতে খেলিতে গোলাটা হঠাৎ এক কুয়ার মধ্যে পড়িয়া গেল। তখন সকলেই উহা উঠাইয়া আনিবার চেষ্টা করিতে লাগিল বটে, কিন্তু কেহই কৃতকার্য হইল না। আচার্য এই ব্যাপার দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘ছি ছি! ক্ষত্রিয়ের ছেলে হইয়া তোমরা এই সামান্য কাজটা পারিলে না!

এই দেখ, আমি গোলা তুলিয়া দিতেছি’-এই বলিয়া তিনি একটা শর লইয়া ওই গোলাতে বিদ্ধ করিলেন। তারপর শরের পেছনে শর, তার পেছনে আর একটা শর-পরে পরে এইভাবে বিদ্ধ করিয়া শেষের শরটি ধরিয়া অক্লেশেই গোলা টানিয়া তুলিলেন। গোলা উঠান হইলে ব্রাহ্মণ কুয়ার মধ্যে নিজের আংটি ফেলিয়া তাহাও ওইরূপ কৌশলে উঠাইয়া আনিলেন। ব্যাপার দেখিয়া সকলে তো অবাক!

দেখিতে দেখিতে এ খবর চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণের আশ্চর্য শক্তির কথা শুনিয়া ভীষ্মের বুঝিতে বাকি রহিল না যে, স্বয়ং দ্রোণাচার্য আসিয়াছেন। কেননা, এ কাজ আর কাহারও দ্বারা সম্ভব হইতে পারে না। তিনি মনে মনে এতদিন যাহা চাহিতেছিলেন, তাহাই হইল-দ্রোণ নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

ইহার পর আচার্যকে যথেষ্ট আদর-অভ্যর্থনা করিয়া লইয়া ভীষ্ম তাঁহার ওপর ছেলেদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিলেন। এরূপ আদর-যত্ন এবং হঠাৎ এতগুলি শিষ্য পাইয়া দ্রোণের তখন কী আনন্দ! তিনি বলিলেন, ‘বৎসগণ, আমি তোমাদিগকে এমন করিয়া যুদ্ধবিদ্যা শিখাইব যে লোকের তাক লাগিয়া যাইবে। শেষে কিন্তু আমার একটি কাজ করিয়া দিতে হইবে।

আচার্যের কথা শুনিয়া আর সকলেই চুপ করিয়া রহিলেন। কেবল অর্জুন বলিলেন, ‘বলুন কী করতে হবে? আপনার আদেশ কখনও অমান্য করিব না।’
অর্জুনের কথায় প্রীত হইয়া দ্রোণ তাঁহাকে বুকে টানিয়া লইয়া আদর করিলেন। তারপর চোখের জল মুছিতে মুছিতে বলিলেন, ‘সে কথা পরে বলিব।’ সেইদিন হইতে আচার্য অর্জুনকে ঠিক নিজের ছেলের মতো ভালোবাসিতে লাগিলেন।

যথারীতি ছেলেদের অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ হইল। রাজকুমারদের সহিত আর যাহারা দ্রোণের নিকট শিক্ষা পাইত, তাহাদের মধ্যে কর্ণই প্রধান। এই কর্ণকে লোকে অধিরথ সারথির ছেলে বলিয়া জানিত। কিন্তু বাস্তবিক সে যুধিষ্ঠিরের সহোদর-কুস্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র। কর্ণের জন্মের পর কুন্তী তাহাকে পরিত্যাগ করেন। কুন্তী যে কর্ণের মা, এ কথা আর কেহই জানিত না। কর্ণ নিজেও এ কথা অনেককাল পর্যন্ত জানিতে পারে নাই।

দ্রোণের শিক্ষাগুণে কয়েক মাসের মধ্যে সকলেরই খুব উন্নতি হইল। ধনুর্বিদ্যায় অর্জুন একজন অদ্বিতীয় বীর হইয়া উঠিলেন। গদায় দুর্যোধন ও ভীম এবং খড়গে নকুল ও সহদেব খুব নাম কিনিলেন। আচার্যের মুখে অর্জুনের প্রশংসা আর ধরে না। তিনি মনে করিলেন, ‘এই প্রিয় শিষ্যটিকে এমন-সকল কৌশল শিখাইব যে, পৃথিবীতে কেহই যেন ইহার সহিত আঁটিয়া উঠিতে না পারে।’ আর সত্যই, কাজেও তিনি তাহা করিলেন।

অর্জুনের আদর দেখিয়া হিংসায় দুর্যোধন আর বাঁচে না। কর্ণ বরাবরই অর্জুনকে ঘৃণা করিত। এখন হইতে সেও দুর্যোধনের দলে যোগ দিয়া কথায় কথায় পাণ্ডবদের অপমান করিতে লাগিল।

এই সময় একদিন দ্রোণ কুমারগণের পরীক্ষার জন্য একটি নীলরঙের পাখি প্রস্তুত করিয়া গাছের ডালে বসাইয়া দিলেন। তারপর সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ওই যে পাখিটি দেখিতেছ, উহার মাথা লক্ষ্য করিয়া তির ছুড়িতে হইবে। মাথাটি কাটিয়া ফেলিতে পারিলে বুঝিব আমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে।’

এ কথায় চারিদিকেই উৎসাহের স্রোত বহিতে লাগিল। ক্রমে রাজকুমারগণ তির-ধনুক লইয়া প্রস্তুত হইলেন। তখন দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বল দেখি তুমি কী দেখিতেছ?’ যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘একটা পাখি দেখিতেছি।’ দ্রোণ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আর কী দেখিতেছ?’ যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘গাছের ডালপালা সবই দেখিতেছি, আপনাদের সকলকেও দেখিতেছি।’

এরূপ উত্তরে দ্রোণ সন্তুষ্ট হইতে পারিলেন না; বলিলেন, ‘না বাপু, এখনও তোমার নজরই ঠিক হয় নাই।’ ইহার পর তিনি এক-এক করিয়া প্রায় সকলকেই ডাকিলেন, কিন্তু কেহই তাঁহার মনের মতো উত্তর দিতে পারিল না।

শেষে অর্জুনকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি বল দেখি কী দেখিতেছ?’ অর্জুন বলিলেন, ‘আমি শুধু পাখির মাথা দেখিতেছি, আর কিছুই না।’ এইবার দ্রোণের মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা, মাথাটি কাট দেখি।’ আচার্যের মুখের কথা না-ফুরাইতেই অর্জুনের বাণে পাখির কাটা-মাথা মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।

আর একদিন দ্রোণকে কুমিরে ধরিয়াছিল। তিনি ইচ্ছা করিলেই কুমিরকে মারিতে পারিতেন, কিন্তু তাহা না-করিয়া যেন মহাবিপদেই পড়িয়াছেন, এইরূপ ভান করিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেন। কুমারেরা ভয়ে একেবারে জড়সড়, কিন্তু অর্জুনের মনে ভয়ের লেশমাত্র নেই। তিনি তখনই কয়েকটা বাণ মারিয়া কুমিরকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন।

ইহাতে দ্রোণ যে কীরূপ সন্তুষ্ট হইলেন, তাহা আর কী বলিব! তিনি অর্জুনকে আশীর্বাদ করিয়া ‘ব্রহ্মশিরা’ নামে এক অস্ত্র পুরস্কার দিলেন। সে অতি ভয়ানক অস্ত্র। তাহার তেজে স্বর্গ-মর্ত্য কাঁপিয়া ওঠে। মানুষের ওপর সে অস্ত্র ছাড়িতে আচার্য কিন্তু অর্জুনকে নিষেধ করিয়া দিলেন।

ইহার পর আরও কিছুদিন চলিয়া গেল। ক্রমে সকলেই এক-একজন বীর হইয়া উঠিলেন। এইবার দশজনের সাক্ষাতে কুমারদের রণকৌশল প্রদর্শনের সময় উপস্থিত।

দ্রোণের পরামর্শে অন্ধরাজ প্রকাণ্ড এক রঙ্গভূমি প্রস্তুত করাইলেন। উহার মাঝখানে খেলিবার স্থান এবং চারিদিকে রাজা-রাজড়া ও বড়ো বড়ো বীরদিগের বসিবার জন্য সুন্দর সুন্দর মঞ্চ। মহিলাগণের জন্য স্বতন্ত্র আসন। বিচিত্র পত্র-পুষ্পে, নিশান-ঝালরে সমুদয় রঙ্গভূমি ঝলমল করিতে লাগিল।

আগেই দেশে দেশে ঢোল পিটাইয়া এ সংবাদ ঘোষণা করা হইয়াছিল। পরীক্ষার দিন রঙ্গভূমি একেবারে লোকে লোকারণ্য। তাহাদের কোলাহলে ও বাদ্যের শব্দে সারা দেশ মাতিয়া উঠিল।

যথাসময়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং ভীষ্ম, কূপ, বিদুর প্রমুখ সভায় প্রবেশ করিলেন। তারপর মান্য ব্যক্তিগণের অভ্যর্থনা চলিতে লাগিল। ক্রমে মহিলাগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শেষে দেশ-বিদেশের ছোটো-বড়ো কেহই আর আসিতে বাকি থাকিল না। সকলে আপন আপন আসন গ্রহণ করিলে, আচার্য দ্রোণ শ্বেতবসনভূষণে সজ্জিত হইয়া রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিলেন।

কুমারগণ সারি বাঁধিয়া দলে দলে দেখা দিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সাজসজ্জা আর অস্ত্রের চাকচিক্যে চারিদিকে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। জয়ধ্বনি ও বাদ্য-কোলাহল থামিলে দুর্যোধন আর ভীম গদাহস্তে অগ্রসর হইলেন। তাঁহাদের চালচলন ও যুদ্ধের কৌশল কী সুন্দর! কিন্তু কিছুক্ষণ খেলিতে খেলিতে উভয়ে এমন উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন যে, দ্রোণাচার্য ভয় পাইয়া তাঁহাদিগকে থামাইয়া দিতে বাধ্য হইলেন।

গদা-খেলার পর কুমারগণ দুই দলে বিভক্ত হইয়া নকল যুদ্ধের অভিনয় দেখাইয়া সকলকে চমৎকৃত করিলেন। শেষে আসিলেন অর্জুন। যেমন বীরের ন্যায় চেহারা, তেমনি তাঁহার হাতের কায়দা। তিনি অগ্নিবাণে চারিদিকে আগুন জ্বালাইয়া, বরুণবাণে তখনই আবার তাহা নিভাইয়া ফেলিলেন; এক বাণে আকাশে বায়ু ও মেঘের সৃষ্টি করিলেন, এক বাণে বিশাল পর্বত গড়িলেন, এক বাণে নিজেই ভূমিতে প্রবেশ করিয়া পর-মুহূর্তেই আবার বাহিরে আসিলেন।

তাঁহার বাণে কখনও রৌদ্র, কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি-যেন বাজিকরের ভেলকি! লোকের চোখে ধাঁধা লাগিয়া গেল। শেষে অর্জুন এক বাণে আপনাকে এমন করিয়া লুকাইলেন যে, কেহ আর তাহাকে দেখিতে পাইল না। আশ্চর্য শিক্ষা!

অর্জুনের জয়ধ্বনিতে চারিদিক ভরিয়া উঠিল।

 

NCTB ম্যাধমিক ৮ম শ্রেণি আনন্দ পাঠ (বাংলা দ্রুত পঠন)

 

লেখক-পরিচিতি

যোগীন্দ্রনাথ সরকার ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক ও প্রকাশক, কিন্তু শিশুসাহিত্য রচনা ছিল তাঁর সারা জীবনের লক্ষ্য। তরুণ বয়সেই ‘সখা’, ‘সখী’, ‘মুকুল’, ‘বালকবন্ধু’, ‘বালক’ প্রভৃতি শিশুপত্রিকায় লিখে খ্যাতি লাভ করেন।

তাঁর উদ্ভট বিষয়বস্তুর ছড়াগুলো ছোটোদের আনন্দের জন্য অসাধারণ সৃষ্টি। তাঁর রচিত সচিত্র ‘হাসি ও খেলা’ বইটি বাংলায় প্রথম শিশুতোষ বই। যোগীন্দ্রনাথের অপর উল্লেখযোগ্য রচনা হচ্ছে ‘খুকুমণির ছড়া’, ‘ছবি ও গল্প’, ‘রাঙা ছবি’, ‘হাসিখুশি’, ‘হাসিরাশি’, ‘বনে জঙ্গলে’, ‘পশুপক্ষী’ ‘ছোটোদের মহাভারত’ প্রভৃতি। যোগীন্দ্রনাথ সরকার ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব

গল্পাংশটি ছোটোদের জন্য লেখা মহাভারতের ‘আদিপর্ব’ থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পের মূল বিষয় পাণ্ডু ও কুরুর সন্তানদের মধ্যকার পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ক এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা প্রদর্শন। অস্ত্রবিদ্যার গুরু দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুর এলে ভীষ্ম তাঁকে রাজকুমারদের শিক্ষক হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেন। দ্রোণাচার্যও ততোধিক স্নেহ ও সযত্নে কুমারদের যুদ্ধবিদ্যা শেখালেন। রাজকুমার অর্জুন তার কাছে সর্বাধিক প্রিয় হয়ে ওঠেন।

এতে কর্ণ ও দুর্যোধনরা পাণ্ডবদের প্রতি রুষ্ট হন। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে অর্জুনের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে আশীর্বাদ হিসেবে দ্রোণাচার্য তাঁকে ‘ব্রহ্মশিরা’ অস্ত্র পুরস্কার দেন। এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে রণক্ষেত্রে রাজকুমারদের রণকৌশল প্রদর্শনী করা হলে সবাই যুদ্ধবিদ্যা দেখিয়ে সকলকে মুগ্ধ করেন। অর্জুনের রণকৌশল সর্বাধিক প্রশংসিত হয়।

আগ্রহ, চর্চা, নিষ্ঠা ও গুরুভক্তি মানুষকে যে-কোনো কঠিন কাজে যে পারদর্শী করে তুলতে পারে, এখানে তা-ই ফুটে উঠেছে।

আরও দেখুনঃ

NCTB ম্যাধমিক ৮ম শ্রেণি আনন্দ পাঠ (বাংলা দ্রুত পঠন)

Leave a Comment