জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা সম্পর্কিত একটি ভাষণ এর একটি খসড়া করে দেয়া হলো। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ |
জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা সম্পর্কিত একটি ভাষণ
মাননীয় অধ্যক্ষ, বরেণ্য প্রধান অতিথি, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ, সুধী অভিভাবকবৃন্দ এবং সমবেত ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনেরা, আজকে আমরা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য এখানে সমবেত হয়েছি। ‘জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা’ বিষয়টি জাতীয় জীবনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, ছাত্ররা যদি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে আগামীদিনে তাদের কাছ থেকে তেমন কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।
জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সে সম্পর্কে তাদের অবহিত করা এবং যথাসময়ে তা পালনের জন্য ছাত্রজীবন থেকেই চর্চা করতে হবে। সুধীবৃন্দ, ছাত্র শব্দটির বিশ্লেষণে যে মূল্যায়ন করা হয়, তাতে একজন ছাত্রের মধ্যে মানুষের সামগ্রিক মহৎ গুণাবলিই প্রতিফলিত হয়। সততা, আদর্শবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা, উদ্যম, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ইত্যাদি বহুবিধ গুণাবলি একজন প্রকৃত ছাত্রের চরিত্রে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।
সুতরাং যে-কোনো জাতির সেরা সম্পদ তরুণসমাজ তথা ছাত্রসমাজ। তবে ছাত্ররা যথোপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠলেই জাতির জন্য তারা সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। ছাত্ররা নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলেই জাতি গঠনে তাদের অবদান কার্যকর হবে। একটি জাতির সমৃদ্ধি, সম্মান আর মর্যাদার সঙ্গে আজকের ছাত্রসমাজ একদিন সম্পৃক্ত হবে। জাতির গৌরব বৃদ্ধির সুমহান দায়িত্ব একদিন তাদের ওপর বর্তাবে। তাদের কৃতকর্মের সফলতার ওপরই নির্ভর করবে জাতির ভবিষ্যৎ। সংগ্রাম ত্যাগ তিতিক্ষা এবং দেশপ্রেমের আদর্শে আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে, নব নব আবিষ্কারের অফুরন্ত সম্ভাবনায় এই ছাত্ররাই পারে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে।
বস্তুত একটি দেশগঠনে যে-কোনো দেশের ছাত্রসমাজ রাখতে পারে যুগোপযোগী বাস্তব ভূমিকা। সুধী, বিশ্বের যে-কোনো দেশে ছাত্রসমাজ তাদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকেই নির্ধারণ করে তাদের দেশগঠনের কার্যক্রম। জাতিগঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা দুদিক থেকে বিবেচ্য। প্রথমত ছাত্ররা নিজের জীবন গঠনে তৎপরতা দেখিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে যোগ্যতা অর্জন করে। দ্বিতীয়ত, তারা প্রত্যক্ষভাবে জাতিগঠনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। সুধীবৃন্দ, দেশের গঠনমূলক কাজে ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকার অধিককরী, কারণ তারা হচ্ছে চিরসবুজ আর তারুণ্যের প্রতীক।
সমাজ, দেশ ও জাতির সমস্যাসমূহ দূর করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশ গঠনের সুমহান কার্যক্রম। এসব সমস্য দূরীকরণে ছাত্রসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন দেশপ্রেম। ছাত্রসমাজই পারে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হতে এবং সেই সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে মহান ঐক্য ও সংহতির পক্ষপাতহীন মন্ত্রবাণী। সুধী, আপনারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, দেশের মূল সমস্যাগুলোর অন্যতম নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার কাজে ছাত্রসমাজের ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর।

ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের বহু অন্যায় উচ্ছেদ করে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছে। অতীত ইতিহাসে এর একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। আর আজকের ছাত্রই আগামী দিনে রাষ্ট্রপরিচালনার এক একটি অংশ। সুতরাং ছাত্ররা যদি ঘুষ-দুর্নীতিসহ সকল প্রকার নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেরাও সততার অনুশীলন করে, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হতে পারে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ। আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা হল জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। ছাত্রসমাজ দেশের অশিক্ষিত লোকজনকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারে। তারা নিজ নিজ পরিবার বা সমাজের লোকজনকে পরিবার-পরিকল্পনার কথা জানাতে পারে।
এছাড়া অসচেতন ও অশিক্ষিত জনগণকে স্বাস্থ্যরক্ষার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে সচেতন করার দায়িত্বও নিতে পারে। সচেতন সুধীবৃন্দ, আপনারা জানেন, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস আজ দেশ গড়ার পথে এক মারাত্মক অন্তরায় হয়ে আছে। সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ আজ বিনষ্ট হতে চলেছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নিরসনে সরকারি উদ্যোগ যেমন প্রয়োজন, ততোধিক প্রায়োজন ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। অধ্যয়ন অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে একজন ছাত্র দেশের প্রতি তার সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্যবোধের প্রকাশ ঘটাতে পারে। সুধী, দারিদ্র্য-পীড়িত মাতৃভূমিকে গড়ে তোলার কাজে ছাত্রসমাজই রাখতে পারে সর্বোচ্চ অবদান।
আমাদের মতো অশিক্ষিতের দেশে ছাত্রসমাজই শিক্ষার মাধ্যমে নবজীবনের চেতনার সঞ্চার করে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজই পারে বলিষ্ঠতম ভূমিকা পালন করতে। নিজ নিজ এলাকায় ছাত্ররা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষাদান করতে পারে। তাছাড়া গ্রামের নিরক্ষর ও অসচেতন জনগোষ্ঠীকে কৃষিকাজ, কুটিরশিল্প, মৎস্য ও পশুপালনে দক্ষ করে তুলতে পারে দেশের ছাত্রসমাজ। একই সঙ্গে ছাত্রসমাজ যদি নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের পন্থা উদ্ভাবন করতে পারে, তা হলে বেকারত্বের অভিশাপ অনেকখানি দূর হবে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে ছাত্রসমাজই দেশকে গড়ে তুলতে সক্ষম।
ছাত্রসমাজ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়ানো, জনগণকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, সামাজিক কুসংস্কার দূর করা, সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ নেয়া— এসব কাজে তারা আত্মনিয়োগ করে জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারে তাই দেশের কল্যাণসাধনে ছাত্রসমাজকে জাগ্রত হতে হবে। ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা এবং অজ্ঞতার বাধাকে অতিক্রম করে চিরন্তন কল্যাণবোধে উৎসারিত করতে হবে বিবেকশক্তিকে। দেশের কল্যাণ কামনায় কবিগুরুর এ কথাটি হতে পারে তাদের জীবন পথের পাথেয় : ‘চিত্তের গহনে যেথা দুরন্ত কামনা লোভ ক্রোধ
আত্মঘাতী মত্ততায় করিছে মুক্তির দ্বার রোধ
অন্ধতার অন্ধকারে উঠে সেথা মানবের বাণী / ‘বাধা নাহি মানি। ‘
সুধী, ছাত্রসমাজ একটি অমিত সম্ভাবনাময় প্রবল শক্তি। এ শক্তিকে সুসংঘটিত করে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। জাতির অগ্রগতিতে শক্তি ও প্রেরণা যোগাবে ছাত্রসমাজ। সেই প্রত্যাশা নিয়েই আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
আরও দেখুন: