জাগো তবে অরণ্য কন্যারা । সুফিয়া কামাল

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ জাগো তবে অরণ্য কন্যারা । যা সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি সুফিয়া কামাল রচিত কবিতা।’জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতাটি সুফিয়া কামালের ‘উদাত্ত পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত।

 

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা । সুফিয়া কামাল

 

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা । সুফিয়া কামাল

মৌসুমি ফুলের গান মোর কন্ঠে জাগে নাকো আর

চারিদিকে শুনি হাহাকার ।

ফুলের ফসল নেই, নেই কারও কণ্ঠে আর গান

ক্ষুধার্ত ভয়ার্ত দৃষ্টি প্রাণহীন সব মুখ স্নান ।

মাটি অরণ্যের পানে চায়

সেখানে ক্ষরিছে স্নেহ পল্লবের নিবিড় ছায়ায়।

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা। জাগো আজি,

মর্মরে মর্মরে ওঠে বাজি

বৃক্ষের বক্ষের বহ্নিজ্বালা

মেলি লেলিহান শিখা তোমরা জাগিয়া ওঠো বালা!

কঙ্কণে তুলিয়া ছন্দ তান

জাগাও মুমূর্ষু ধরা-প্রাণ

ফুলের ফসল আনো, খাদ্য আনো ক্ষুধার্তের লাগি

আত্মার আনন্দ আনো, আনো যারা রহিয়াছে জাগি

তিমির প্রহর ভরি অতন্দ্র নয়ন, তার তরে

ছড়াও প্রভাত আলো তোমাদের মুঠি ভরে ভরে।

[সংক্ষেপিত]

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

শব্দার্থ ও টীকা

ক্ষুধার্ত ভয়ার্ত দৃষ্টি — প্রকৃতিতে ফুল ও ফসলের সম্ভার কমে যাওয়ায় মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় মানুষ ভীত।

ম্লান – মলিন ।

ক্ষরিছে – চুয়ে চুয়ে পড়ছে।

পল্লব – গাছের নতুন পাতা। ডালের নতুন পাতাযুক্ত আগা ।

সেখানে ক্ষরিছে স্নেহ পল্লবের
নিবিড় ছায়ায় – মাটির মমতা রস পেয়ে বৃক্ষ শাখায় নতুন পাতা গজিয়েছে।

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা – কবি বৃক্ষ-কন্যাদের জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছেন প্রকৃতিকে আবার
শ্যামল সবুজে ফলে-ফুলে ভরিয়ে তোলার জন্যে ।

বৃক্ষের বক্ষের বহ্নিজ্বালা – মানুষ প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করায় বন উজাড় হচ্ছে। বৃক্ষনিধন বাড়ছে। বৃক্ষের বুকে তাই যন্ত্রণার আগুন।

মেলি লেলিহান শিখা – কবি তরু কন্যাকে আহ্বান জানাচ্ছেন তার শাখায় শাখায় আগুন রঙা ফুল ফুটিয়ে আকাশে শাখা বিস্তার করতে।

কঙ্কণ – কাঁকন, নারীর হাতের অলঙ্কার বিশেষ।

মুমূর্ষু – মৃতপ্রায়। মরণাপন্ন। মরে যাচ্ছে এমন।

ধরা-প্রাণ –  পৃথিবীর জীবন।

অতন্দ্র – তন্দ্রাহীন । ঘুমহীন । নির্ঘুম। নিদ্রাহীন ।

নয়ন – চোখ ।

পাঠের উদ্দেশ্য

এ কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি জগতের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে আগ্রহী হবে এবং প্রকৃতির ঐশ্বর্য রক্ষায় সচেতন হবে।

 

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা । সুফিয়া কামাল

 

পাঠ-পরিচিতি

‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতাটি সুফিয়া কামালের ‘উদাত্ত পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। প্রকৃতির রূপ-সচেতন কবি চারপাশের অরণ্য-নিধন লক্ষ্য করে ব্যথিত। তাই মৌসুমি ফুলের গান আর তার কন্ঠে জাগে না। বরং চারপাশে সবুজ প্রকৃতির বিলীন হওয়া দেখে তাঁর মন হাহাকার করে ওঠে। কবি তাই অরণ্য-কন্যাদের জাগরণ প্রত্যাশা করেন। তিনি চান দিকে দিকে আবার সবুজ বৃক্ষের সমারোহের সৃষ্টি হোক; ফুলে ও ফসলে ভরে উঠুক পৃথিবী; মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা পাক বিপন্নতার হাত থেকে।

কবি-পরিচিতি

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০শে জুন বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল কুমিল্লায়। সে আমলে মেয়েদের লেখাপড়ার মোটেই সুযোগ ছিল না। তিনি নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখে ছোটবেলা থেকেই কবিতাচর্চা শুরু করেছিলেন। কিছুকাল তিনি কলকাতার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সুদীর্ঘকাল ধরে সাহিত্যচর্চা, সমাজসেবা ও নারীকল্যাণমূলক নানা কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর কবিতা সহজ, ভাষা সুললিত, ছন্দ ব্যঞ্জনাময়।

কবি সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো : ‘সাঁঝের মায়া’, ‘মায়া কাজল’, ‘মোর যাদুদের সমাধি পরে’। তাঁর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘একাত্তরের ডাইরি’; শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘ইতল বিতল’ ও ‘নওল কিশোরের দরবারে।

কবি সুফিয়া কামাল তাঁর কবি প্রতিভার জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। সেসব হলো : বাংলা একাডেমি পুরস্কার, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, একুশে পদক, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার, মুক্তধারা ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি। তিনি ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।

কৰ্ম-অনুশীলন

ক. প্রকৃতিতে রক্ষার ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন উক্তি যুক্ত করে পোস্টার তৈরি কর (একক কাজ)।

খ. বাড়িতে একটি গাছ লাগাও এবং এই ছবি শ্রেণিকক্ষে প্রদর্শনের ব্যবস্থা কর ।

 

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা । সুফিয়া কামাল

 

নমুনা প্রশ্ন

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. মৌসুমে ফুলের গান কার কণ্ঠে আর জাগে না ?

ক. সাধারণ মানুষের

খ. সুফিয়া কামালের

গ. অরণ্যের

ঘ. পাখির

২. কবি কেন ব্যথিত হন ?

ক. ফুল-ফল না থাকায়

খ. মৌসুমি গান না শোনায়

গ. অরণ্য-নিধন লক্ষ্য করে

ঘ. বৃক্ষের বহ্নিজ্বালা দেখে

৩. কবি অরণ্য-কন্যাদের জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন কেন ?

ক. পৃথিবীতে সবুজের বিস্তারের জন্য

খ. মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য

গ. ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য

ঘ. মৌসুমি ফুল দেখার জন্য

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও :

পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে। এ বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রতিনিয়ত কমছে আবাদি জমি, বন, জঙ্গল। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা — ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়। বিষয়টি উপলব্ধি করে মফিজ খাঁ এবং আমিনা বেগম বৃক্ষমেলা থেকে প্রচুর চারা কিনে এনে এলাকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু করেন ।

8. উদ্দীপকে বর্ণিত বাড়তি জনসংখ্যার ফলে সৃষ্ট সমস্যাটি ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতার কোন অবস্থাকে নির্দেশ করে ?

ক. ফুল-ফলশূন্য পৃথিবী

খ. বৃক্ষ-শূন্য পৃথিবী

গ. নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন

ঘ. বৃক্ষের সমারোহ সৃষ্টি

৫. এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতায় যে নির্দেশনা রয়েছে তা হলো—

i. লাগাও গাছ, বাঁচাও দেশ

ii. বৃক্ষ মাটির মুক্তিদাতা

iii. চারিদিকে সবুজের সমারোহ সৃষ্টি হোক

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i ও ii

খ. i ও iii

গ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. দোয়েল পাখি বাসা বেঁধেছে জবা গাছে। সোহেল তার নতুন ঘর তোলার জন্য আঙ্গিনার অন্যান্য গাছের সাথে জবা গাছও কেটে ফেলে। দোয়েলের চোখে-মুখে বাসা হারানোর বেদনা। দোয়েল আর গান গায় না। ফুলের সাথে খেলা করে না। অন্যদিকে নিলয় তার বাড়ির আঙ্গিনার খালি জায়গায় ফুল, ফল ও অন্যান্য গাছ লাগায় । গাছগুলোকে সে নিজের মতো ভালোবাসে। তার বাগান দেখে সকলের চোখ জুড়ায় পাখিরা তার বাগানে চলে আসে। তারা গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন ফলের গাছ থেকে খাদ্য জোগাড় করে, ফুলের সাথে খেলা করে, গান গায়। দিনের শেষে নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরে ঘুমায় । নিলয়কে দেখে অনেকেই গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ হয়।

ক. গাছের নতুন পাতাকে কী বলে?

খ. ‘বৃক্ষের বক্ষের বহ্নিজ্বালা’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে ?

গ. দোয়েলের অভিব্যক্তিতে ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতার কোন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে? ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. উদ্দীপকের নিলয়ের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই কবির প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। বক্তব্যটি মূল্যায়ন কর।

২. সিডরের খবর শুনে মিথিয়ার ভীষণ মন খারাপ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ঘর-বাড়ি হারা, খাবার নেই। কী ভীষণ বিপন্ন মানুষ। অথচ এর জন্য মানুষই অনেকটা দায়ী। মানুষ গাছ কেটে বন উজাড় করছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। এসব দেখে মিথিয়া অনুভব করে একটা কিছু করবে। সে তার বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির খালি আঙ্গিনায়, ছাদে গাছ লাগানোর জন্য মানুষকে সচেতন করে তোলে। তাছাড়া গাছ কেটে বন উজাড় করার বিরুদ্ধে সে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে ভাবে এই সুন্দর বনই অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। মিথিয়া স্বপ্ন দেখে ফুলে-ফলে ভরা সতেজ-সবুজ প্রকৃতির।

ক. কবি সুফিয়া কামাল এখন আর কীসের গান শুনতে পান না ?

খ. ‘ক্ষুধার্ত ভয়ার্ত দৃষ্টি’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ?

গ. মিথিয়ার মন খারাপের বিষয়টির সাথে ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতার কোন দিকটির মিল খুঁজে পাওয়া যায় ? ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. মিথিয়া যেন কবির সেই অরণ্য-কন্যা—উক্তিটির যথার্থতা মূল্যায়ন কর।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment