জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার

জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন | অর্থনীতি, উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে জনশক্তি আমদানি ও রপ্তানির বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় জনসংখ্যার অসম বণ্টনের কারণে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত কিছু দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সে দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। এ সকল দেশ সীমিত অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দ্বারা বিপুল পরিমাণ জনশক্তির কর্মসংস্থান করতে পারে না।

জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার

জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, জার্মানিসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ বিভিন্ন দেশ এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলো তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মহা আয়োজন সামলাতে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের যোগান দিতে পারে না। এমতাবস্থায় তাদের অতিরিক্ত শ্রমশক্তির দেশগুলো থেকে জনশক্তি আমদানি করতে হয়। এতে একদিকে আমদানিকারক এ সকল দেশ তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে পারে, অন্যদিকে রপ্তানিকারক দেশসমূহও তাদের অতিরিক্ত জনশক্তি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।

জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার

 

বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশ একটি উদ্বৃত্ত জনশক্তির দেশ। শিল্পায়নের নিম্নহার হেতু বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত জনশক্তি কৃষি খাতে নিয়োজিত। এমতাবস্থায় কর্মক্ষম অথচ বেকার এ জনশক্তির কর্মসংস্থান জাতির সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। অথচ এদের বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক বেশি ত্বরান্বিত হতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমশক্তি এবং জনশক্তি রপ্তানির চালচিত্র : বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪ শতাংশ। ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার বাংলাদেশী কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ গমন করেছে। ২০০১-২০০২ অর্থবছরে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৩৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এক্সচেঞ্জ হাউস এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রেমিটেন্স সেল খোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির নিম্নগতির ফলে দেশের মোট জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পায়। তবে বর্তমানে কি পরিমাণ লোক বিদেশে কর্মরত তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন । কারণ সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কেবল কি পরিমাণ জনশক্তি প্রতি বছর কর্মের খোঁজে দেশত্যাগ করে তারই হিসাব রাখে; ফিরে আসা শ্রমিকদের হিসাব রাখা হয় না। তবে প্রবাসে কর্মরত  বাংলাদেশীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর গুণগত পরিবর্তনও লক্ষণীয়।

১৯৯৯, ২০০০, ২০০১ ও ২০০২ সালে দক্ষ, আধাদক্ষ ও পেশাগত কাজে নিয়োজিত ছিল মোট শ্রম রপ্তানির ৫৬.৪৬ শতাংশ, ৬১.৪০ শতাংশ, ৪২.০১ শতাংশ ও ৪৭.৩৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, প্রবাসী জনশক্তির অধিকাংশই সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে কর্মরত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, মরিশাস, ইতালি, লেবাননসহ অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশী কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনশক্তি রপ্তানির ভূমিকা : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনসংখ্যা একটি অন্যতম বিচার্য বিষয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ জাতীয় অর্থনীতিতে জনসংখ্যার ইতিবাচক ভূমিকার নজিরও বিরল নয়। মানবপুঁজি (Human Capital ) গড়ার মাধ্যমে চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের অবস্থানকে যেভাবে উন্নত করেছে তা আমাদের দেশেও সম্ভব। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী না হওয়ায় এ বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় দেশে শিল্পায়ন ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি অতিরিক্ত জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করেও আমরা অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনসংখ্যা রপ্তানির ভূমিকাকে নিম্নরূপ চিহ্নিত করা যায় :

জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত জনশক্তির অধিকাংশই গ্রামীণ জনগণ। এ বিপুল পরিমাণ জনশক্তির প্রেরিত অর্থ গ্রামীণ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে এসব পরিবারের অন্যান্য কর্মক্ষম সদস্যদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় পুঁজি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, কৃষিতে বিনিয়োগ প্রভৃতি বৃদ্ধি পায় এবং সার্বিকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটে। তাছাড়া এসব শ্রমিক দেশে ফেরার পথে যেসব দ্রব্যসামগ্রী, যেমন—টিভি, রেডিও, টু-ইন ওয়ান, কাপড়-চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রীসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে আসে তাতে তাদের পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের জীবনেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

যেমন ১৯৯১ সালে বিআইডিএস পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিদেশগামী পরিবারগুলোর ২২ শতাংশের রেডিও, ৭৮ শতাংশের টু-ইন ওয়ান, ২৪ শতাংশের টেলিভিশন, ২৪ শতাংশের বৈদ্যুতিক পাখা এবং ৩০ শতাংশের ক্যামেরা রয়েছে। অথচ বিদেশে যাওয়ার পূর্বে এদের কারোরই টু-ইন ওয়ান, টেলিভিশন, ফ্যান বা ক্যামেরা ছিল না (Islam, 1991)। তাছাড়া একই জরিপে দেখা যায়, আগে মাত্র ১০ শতাংশ লোকের সোফাসেট ছিল, অথচ বিদেশে চাকরি লাভের পরে এর পরিমাণ ৬০ শতাংশে বৃদ্ধি পায়।

কৃষি উন্নয়ন : দেশের কৃষি খাতে বর্তমানে অতিরিক্ত জনশক্তি নিয়োজিত রয়েছে। অন্যদিকে কৃষিতে নিয়োজিত এসব অতিরিক্ত শ্রমিককে শিল্পখাতে স্থানান্তরের কারণে প্রয়োজনীয় শিল্পায়ন হচ্ছে না। এমতাবস্থায় অতিরিক্ত এ শ্রমশক্তি কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা না রেখে বরং শ্রমিকের মজুরি হ্রাসসহ মাথাপিছু উৎপাদনশীলতার হার হ্রাস করছে এবং শ্রমের অপচয় হচ্ছে। তাছাড়া কৃষক পরিবারগুলো কৃষিতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সরবরাহকৃত ঋণও পর্যাপ্ত নয়।

এমতাবস্থায় বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ কৃষক পরিবারগুলোর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে অতিরিক্ত অর্থের এ যোগান সার্বিক কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া পূর্বের ভূমিহীন কৃষক পরিবারগুলোও বিভিন্নভাবে বিদেশে চাকরি পাওয়ার সুবাদে ন্যূনতম কৃষিজমির মালিক হচ্ছে। যেমন—১৯৯১ সালের বিআইডিএস পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী এসব পরিবারের মধ্যে পূর্বে ২৮ শতাংশ ছিল ভূমিহীন, যা পরবর্তীতে ৬ শতাংশে নেমে আসে।

বিনিয়োগ : বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ দেশের বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ অর্থ যোগানের ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত ও বিনিয়োগের বিভিন্ন স্কিমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেদের জন্য লাভজনক করমুক্ত সুদ/মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি স্বদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন এ জাতীয় স্কিমের উল্লেখযোগ্য দিক হলো :

ক. অনিবাসী বৈদেশিক মুদ্রা মেয়াদি আমানত (Non-resident Foreign Currency Deposit NFCD),

খ. ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড,

গ. পোর্টফোলিও বিনিয়োগের জন্য অনিবাসী বিনিয়োগ টাকা হিসাবে (Non-resident Investors Taka Account-NITA) ।

এ সকল সুবিধা গ্রহণ করে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, যা একই সাথে তাদের নিজের এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক হয়ে থাকে। কেননা জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের একটা বিরাট অংশ এ খাত থেকে আসে। যেমন—- ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তাদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ছিল মোট জাতীয় সঞ্চয়ের ২৯.৫ শতাংশ (Bangladesh Ministry of Finance, Bang, Economic Review 1997 Annex Table-43) ।

দারিদ্র্য বিমোচন : বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা এ সকল জনশক্তির অধিকাংশই গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যাদের প্রেরিত অর্থ তাদের নিম্নবিত্ত দরিদ্র পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের জন্য অন্যতম অনুঘটক (Catalyst) হিসেবে কাজ করে।

তাছাড়া এ পরিবর্তন প্রথমত গুটি কয়েক পরিবারের মধ্যে এলেও তা সার্বিক দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তখন তাদের পরিবারগুলো গ্রামীণ মহাজন কিংবা এনজিও নামক আধুনিক পরিবর্তিত মহাজনদের অশুভ শিকারে পরিণত হওয়া থেকে রেহাই পায় । তাছাড়া তাদের এ অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিতে আগমনের ফলে গ্রামীণ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি তথা তাদের পরিবারের সদস্যদের উন্নয়নে এবং দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য দূরীকরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাস : বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি রয়েছে এ জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করে তা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো । বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি বহুলাংশে বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর, যার কোনো ইতিবাচক ফল বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিসরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, বরং এ ঋণের বোঝা বহন করে জাতীয় অর্থনীতি আজ ভীষণভাবে ন্যুব্জ। এমতাবস্থায় বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ এ নির্ভরতা হ্রাস করে স্বনির্ভর অর্থনীতির ভিত নির্মাণে সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ শোধের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস জনশক্তি রপ্তানি ।

আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্য রক্ষা : বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অর্থ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় যে ভূমিকা রাখে তা হলো এ অর্থ দেশের আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্য রক্ষায় অতার গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। কেননা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এটি একটি বিরাট খাত। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৩৬.৬৫ শতাংশ এ খাত থেকে আসে যা মোট আমদানি বায়ের ২০.৫২ শতাংশের সমান (Chowdhury, 1997-77)।

বর্তমানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, যা শীর্ষস্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত তা-ও হুমকির মুখে এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় বাস্তব হলে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও নিশ্চিত। এমতাবস্থায় দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করার পাশাপাশি বিপর্যস্ত জনশক্তি রপ্তানি খাতের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। তাছাড়া পূর্বতন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শীর্ষ খাত পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানিও আজ বিপর্যস্ত। সুতরাং দেশের বিদ্যমান জনশক্তিকে বিশ্ব শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাতে পরিণত করার সম্ভবনা খুবই উজ্জ্বল |

তাছাড়া দেশ বর্তমানে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য মেশিনারি ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং শিল্পায়নেও জনশক্তি রপ্তানি থেকে আসা রেমিটেন্স ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : দেশীয় অর্থনীতিতে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির প্রত্যক্ষ ফল লক্ষ্য করা যায়। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। এর প্রতিফলন দুভাবে ঘটে : ক. বেকার জনগোষ্ঠী বিদেশে স্থানান্তর, খ. তাদের প্রেরিত অর্থে দেশে কমংসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ।

ক.  বাংলাদেশে বর্তমানে জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ বেকার। দেশের বর্তমানে প্রায় পনের লক্ষ লোক বেকার রয়েছে। অন্যদিকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় আড়াই লাখ লোক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাচ্ছে, যা দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষ করে দেশে যেসব শিক্ষিত বেকার নিম্নমানের কাজ করতে রাজি হতো না তারাও বিদেশে গিয়ে অনুরূপ কাজ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগাচ্ছে। এতে বেকারত্ব হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তির ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তাছাড়া নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতায় পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদেরও বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। যেমন – ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের প্রায় ৫৪.৬ শতাংশই তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত জনের সহযোগিতায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় (Siddiqui, 1998-9)। এ প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা থাকলেও পারস্পরিক সহযোগিতায় অনেক ভূমিহীন লোক পর্যন্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।

খ. বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা নিজেদের বেকারত্ব ঘোচানোর পাশাপাশি পরিবারের অন্যদের বেকারত্ব ঘোচানোর ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কেননা তাদের প্রেরিত অর্থ তাদের পরিবারের অন্যান্য পূর্ণ ও মৌসুমী বেকারদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রেরিত অর্থে গড়া প্রতিষ্ঠানে বাইরের অনেক শ্রমিকেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে।

নেতিবাচক দিক: বৃহত্তর অর্থে জনশক্তি রপ্তানি দেশের অর্থনৈতিক উন্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন-

আয় বৈষম্য: জনশক্তি রপ্তানি থেকে অর্জিত আয় যে সকল পরিবারে আসে তাদের সংখ অল্প সময়ে এসব পরিবারে অন্যদের আয়ের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ আসায় সমাজে আর বৈষম্য হয়। কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্যান্য পরিবারের সীমিত আয় একই হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় সামাজিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আসে, যা অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি: বিদেশে কর্মরতদের প্রেরিত অর্থ আয়-ব্যয় ও মূল্যের স্বাভাবিক মাত্রার ওপরেও প্রভাব ফেলে। কেননা অর্থের অতিরিক্ত যোগানের ফলে বিদেশগামী পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়। এবং তা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে ত্বরান্বিত করে। এর ফলে অন্যরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পুনর্বাসন সমস্যা: বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশেরই চাকরি স্থায়ী নয় বরং চুক্তিভিত্তিক। তাই চুক্তি শেষে এসব শ্রমিক যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করে তখন তাদের পুনর্বাসনের সমস্যা দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে তাদের পেশা ও দেশের নতুন পেশার অমিল এবং সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিগত অনীহার কারণে পূর্বতন কাজ না করা, অর্থের অদক্ষ ব্যবহার প্রভৃতি কারণে তারা নতুনভাবে বেকারত্ব সৃষ্টি করে।

সামাজিক অস্থিরতা: বিশ্ব শ্রমবাজারে বিভিন্ন সময়ের বিপর্যয়, রিত্রুটিং এজেন্সি ও দালালদের প্রতারণা, বিদেশী নিয়োগকারীদের দুর্ব্যাবহার ও হয়রানি এবং অন্যান্য কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেও বিদেশে যেতে ব্যর্থ হওয়া বা অল্প সময়ের ব্যবধানে ফিরে আসা প্রভৃতি কারণে অনেক পরিবারই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে রাস্তায় নামে। এতে সংশ্লিষ্ট পরিবার ও তাকে অর্থ নিয়ে সাহায্যকারীরাও ক্ষতিরান্ত হয়। ফলে প্রায়ই চাকরিপ্রার্থী বনাম দালাল, দালাল বনাম এজেন্সি, চাকরিপ্রার্থী বনাম অর্থ দিয়ে সাহায্যকারী এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যদের মাঝেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হতে দেখা দেয়।

তবে এসব নেতিবাচক দিক বিবেচনায় আনার অর্থ এ নয় যে, জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করতে হবে, বরং এগুলোর যথোপযুক্ত সমাধানের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানি থেকে পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার ব্যবস্থা করাটাই সময়েরে দাবি ।

জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা : বাংলাদেশে রপ্তানি খাতের অন্যান্য উপখাতের মতো

জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও সমস্যা বিদ্যমান। যেমন—

শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা শ্রমিকের দক্ষতার অভাব : আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বর্তমানে প্রতিযোগিতা ব্যাপক। এ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদাই বেশি। অথচ আমাদের শ্রমিকদের প্রায় ৬৮ শতাংশ আধাদক্ষ এবং অদক্ষ। এমতাবস্থায় নিয়োজিত অদক্ষ শ্রমিকরা কম মঞ্জুরিতে কাজ করছে এবং নতুন শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রেও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে কাঙ্ক্ষিত বাজারে টিকে থাকা যাচ্ছে না এবং আমদানিকারক দেশগুলো আমাদের ব্যাপারে ক্রমশ আগ্রহ হারাচ্ছে।

অবৈধ উপায়ে লোক প্রেরণ : বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে অবৈধ পন্থা অবলমনের ফলে অনেক শ্রমিকই বিদেশে গিয়ে অবৈধ শ্রমিকে পরিণত হয় এবং নিয়োগকর্তা, পুলিশ ও ইমিমোশন কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের শিকার হয়েও কোনো আইনগত সহায়তা নিতে পারে না। ফলে সেসব শ্রমিক নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি শ্রমবাজারে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়।

শ্রমবাজার সম্পর্কে ধারণার অভাব : জনশক্তি রপ্তানি সংক্রান্ত সরকারের সুষ্ঠু নীতিমালা না থাকার ফলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ অধিকাংশই নিম্ন মজুরির অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করে থাকে। এর প্রমাণ হলো গত ১০-১৫ বছরে যেখানে অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস পেয়েছে, সেখানে আধাদক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকার এ বাস্তবতাটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে যে বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা করছে। অথচ বাজারে চাহিদা মোতাবেক শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশ প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে এরূপ পদক্ষেপের অভাবেই আজ বাংলাদেশ ক্রমে বাজার হারাচ্ছে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো, সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশকে ১৫ হাজার শ্রমিক আমদানির প্রস্তাব দিলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায় বাংলাদেশের এ সুযোগ হাতছাড়া হয় এবং ভারত তা লুফে নেয় (বাংলাবাজার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০১)।

বিদেশে বাংলাদেশী মিশনগুলোর অসহযোগিতা: শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিদেশে বাংলাদেশী মিশনগুলোর অসহযোগিতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মিশনগুলোর উদাসীনতা, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাব প্রভৃতির পাশাপাশি শ্রমিকদের অজ্ঞতা ও যোগাযোগের অভাবও দায়ী।

প্রেরিত অর্থের অদক্ষ ব্যবহার : অভিবাসী শ্রমিকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ প্রেরণে তাদের অনাগ্রহ থেকে যেমন প্রেরিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস পায় তেমনি প্রেরিত অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা, অতিরিক্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্র কিনে আনা, পারিবারিক ও আচার-অনুষ্ঠানে বেহিসেবি খরচ প্রভৃতি কারণে এ টাকার বিপুল অংশই অপচয় হয়। ফলে চুক্তি শেষে দেশে ফিরে শ্রমিকদের পুনরায় সংকটে পড়তে হয়।

দক্ষতার প্রমাণপত্রের অভাব : আমাদের দেশে অনেক লোক আছে যারা বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ কিন্তু তাদের কোনো সার্টিফিকেট নেই। এমতাবস্থায় দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট শ্রমিক তার কাঙ্ক্ষিত চাকরি পায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারি এমন কোনো ব্যবস্থাও নেই যাতে সহজেই সে তার প্রয়োজনীয় দক্ষতার প্রত্যয়নপত্র পেতে পারে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বৈদেশিক নিয়োগকারীদের প্রদেয় বৈদেশিক মুদ্রা : বিদেশে আমাদের দেশের শ্রমিকরা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তার একটা বিরাট অংশ পুনরায় বৈদেশিক নিয়োগকারী এজেন্টদের কাছে চলে যায়। কেননা প্রতিটি শ্রমিকপিছু এদের বৈদেশিক মুদ্রার বেশ বড় অঙ্কের ফি দিতে হয়। ফলে কষ্টার্জিত বৈদিশিক মুদ্রার পরিপূর্ণ ফল আমরা ভোগ করতে পারি না।

বিদেশে নিয়োগকারীদের হয়রানি: বিদেশে নিয়োগকারীরা শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করে। শ্রমিকদের কাগজপত্র জব্দ করে নেয়া, মূল চুক্তি বাতিল করা, অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি এর অন্যতম। ফলে অনেক শ্রমিকই সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফেরে কিংবা অবৈধ শ্রমিক হিসেবে নির্যাতনের শিকার হয়।

সুপারিশসমূহ: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে দেশের অবস্থান সুদৃদ্ধ করতে জনশক্তি রপ্তানির মতো বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি, বেসরকারি ও নাগরিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সেজন্য যেসব বিষয়গুলোতে নজর দেয়া আবশ্যক তা হলো :

১. উপযুক্ত সরকারি নীতি : ১৯৮২ সালের অভিবাসী আইনের (Immigration Ordinance) সংস্কার করে এতে শ্রমিকদের জন্য সহায়ক প্রয়োজনীয় নীতির সংযোজন ও সংস্করণ আবশ্যক। এছাড়া বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ভূমিকার স্বীকৃতি ও অর্জিত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা জাতীয় নীতি প্রণয়ন আবশ্যক।

২. মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা: দেশে এবং বিদেশে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম মনিটরিং করার ব্যবস্থাকে আরো দক্ষ ও জোরদার করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে BMET-এর মনিটরিং ইউনিটকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা প্রদানও জরুরি।

৩. যোগ্য ব্যক্তিদের সার্টিফিকেট প্রদান : যেসব শ্রমিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ সরকারের উচিত তাদের

যথাযথ সার্টিফিকেট প্রদান করা।

৪. উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দক্ষতাবর্ধক কর্মসূচি : জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি কেবল শ্রমিকদের নিজেদের চেষ্টা ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ব্যবস্থার কাছে ছেড়ে না দিয়ে সরকারের উচিত এ খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। সেজন্য সরকারের উচিত :

-দেশত্যাগপূর্ব সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ (Pre-departure awareness building training) গ্রহণকে সকল শ্রমিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা। এতে বিদেশে তাদের অধিকার ও কর্তব্য, নিয়োগকারী দেশের আইন- কানুন, দূতাবাসের ঠিকানা ও জরুরি যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকর্তার তথ্য প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদান করা হবে।

-প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে টিকে থাকার জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা জরুরি। সেজন্য কম খরচে বাজার গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণের সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও চাহিদার ধরন নির্ণয় আবশ্যক। অতঃপর চাহিদামাফিক শ্রমিক সরবরাহের নিমিত্তে ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক।

-যেসব দক্ষ শ্রমিক তাদের সংশ্লিষ্ট Informal sector-এ রয়েছে সরকারের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান ও হিসাব-নিকাশের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সার্টিফিকেট দেয়া।

৫. পুনর্বাসন: দেশে ফেরত শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য বাপক কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তাদের ক্ষুদ্র ব্যবসা উন্নয়ন ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজ, ব্যাংকিং সুবিধা, ঋণ সুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা আবশ্যক, যাতে তারা তাদের অর্জিত সম্পদ ও অভিজ্ঞাতা এবং দক্ষতার যথাযথ ব্যবহার করতে পারে।

৬. বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের নেটওয়ার্ক সৃষ্টি : বিদেশ ফেরত শ্রমিক ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের দাবিদাওয়া ও সমস্যাবলী গ্রন্থিকরণ ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করার জন্য একটি সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক আবশ্যক |

 ৭. আমানত বিনিয়োগ স্কিম : সহজ ও দক্ষ বিনিয়োগ স্কিমের মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের অর্থ খাটানো এবং সঞ্চয়ের ব্যবস্থাকে আরো জোরদার ও উৎসাহব্যঞ্জক করা আবশ্যক, যেন দেশে ফিরে তাদের পুনর্বাসন সহজ হয়।

৮. দূতাবাসের সক্রিয় ভূমিকা : বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোকে শ্রমিকদের প্রয়োজনে সাড়াদানের উপযোগী করতে হবে। সেজন্য—

প্রথমত, সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের Labour Attache-কে শ্রমিকদেরসমস্যা সম্পর্কে সচেতন ও তাদের অধিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, দূতাবাসকে শ্রমিকদের আইনগত অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সরবরাহ এবং দূতাবাসে তাদের নাম অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে উৎসাহী করতে হবে।

তৃতীয়ত, শ্রমিকদের আইনগত বৈধতা-অবৈধতা নির্বিশেষে সকল শ্রমিককে প্রয়োজনীয় সহায়তা পানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চতুর্থত, শ্রমিকদের যাবতীয় অভিযোগ দূতাবাসকে অবহিত করার ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহী করতে হবে।

৯. কার্যকর দ্বিপাক্ষিক বহুপাক্ষিক চুক্তি সংস্থা: জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটা আঞ্চলিক ফোরাম থাকা আবশ্যক এবং এক্ষেত্রে সার্ককে ভিত্তি করেই তা গড়ে তোলা যেতে পারে। তাছাড়া সম্ভাব্য শ্রমিক আমদানিকারক দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পাদন ও গুরুত্বপূর্ণ।

১০. ডাক ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংস্কার: ডাক ও ব্যাংক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে এতে স্বচ্ছতা আনা আবশ্যক, যাতে প্রবাসী শ্রমিকরা এ সকল বৈধ মাধ্যমে তাদের অর্থ প্রেরণ করতে পারে এবং সরকারও মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত না হয়।

১১. শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার: বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করে তাকে কর্মমুখী করা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে মাধ্যমিক পর্যায়ে ট্রেড কোর্স চালু এবং উচ্চতর পর্যায়ে কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় জোর দেয়া জরুরি

১২. প্রেরিত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ: শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের এ ব্যাপারে নাগরিক পর্যায়ে উৎসাহী করতে হবে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের অর্থকে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার : সবশেষে আমরা বলতে পারি, গণতান্ত্রিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পথে ধাবমান বাংলাদেশকে এ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হলে এর ১৪ কোটি মানবসন্তানকে মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে এবং এর মানবসম্পদই মানব পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে সুদৃঢ় অবস্থান গড়ে নেবে। এ জন্য সর্বার্থে যা প্রয়োজন তাহলো মানগণকে শিক্ষার মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রমিক প্রেরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment