ছাত্র রাজনীতির একাল ও সেকাল সেমিনারে মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা ‘ছাত্র রাজনীতির একাল ও সেকাল’ শীর্ষক আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত আলোচকবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা। আজকের এই আলোচনা আমাদের নাগরিক সচেতনতারই নিদর্শন। আজ সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতাদানের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এজন্য সভার আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
ছাত্র রাজনীতির একাল ও সেকাল সেমিনারে মঞ্চ ভাষণ
সুধীবৃন্দ,
নানা কারণে ছাত্র রাজনীতি আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে অনভিপ্রেত সন্ত্রাস, বোমাবাজি, হানাহানি, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, জোরজুলুম, মাস্তানি ইত্যাদি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্র রাজনীতির নামে স্বার্থান্বেষী এই হীনতৎপরতা ও বর্বরতা, ছাত্র রাজনীতির অতীত ঐতিহ্য এবং গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি বরং ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়ারও দাবি ওঠেছে নানা মহল থেকে। অতি প্রসঙ্গিক ভাবেই অদ্যকার সেমিনারে ‘ছাত্র রাজনীতির একাল ও সেকাল’ নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে।
সুধী,
আপনারা জানেন যে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। বিশ শতকের প্রথম পাদে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে। পর্যায়গতভাবে একটু অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে যে, ১৯৬৮-১৯৭১ সময়কাল ছিল ছাত্র রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন, এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে সমগ্র বাঙালি জাতি আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং চিরকালই মনে রাখবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী গোড়ার দিকের বছরগুলোতেও ছাত্রদের ভূমিকার মধ্যে স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রসমাজের সুচিহ্নিত ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ১৯৯০ সালে তার পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের কৃত্বিপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যদিও ছাত্র রাজনীতির অতুচ্চ ভাবমূর্তিটি তখনও অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। সুধীবৃন্দ, নব্বই দশকের দিকে নানা কারণে ছাত্র রাজনীতির দ্রুত অবক্ষয় ঘটতে থাকে। এর প্রথম কারণ ছিল ছাত্ররাজনীতিতে স্বকীয়তার অভাব। ছাত্রসংগটনগুলো ক্রমেই পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের উপাঙ্গ হয়ে উঠতে থাকে।

অপরদিকে ছাত্রদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টায় সবগুলো প্রধান রাজনৈতিক দল ও উপদল ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে অ- ছাত্রদের অনুপ্রবেশ ঘটায়। এবং নানা ছাত্রসংগঠনের অ-ছাত্র নেতারা নিজ দল ও অন্যান্য দলের মধ্যেকার কোন্দলে ছাত্রদের ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে ছাত্ররাজনীতি ক্রমেই কলুষিত হয়ে পড়ে। সুধী, আপনারা অবগত যে, বিশ শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকের ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়, যা পরবর্তী সময়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অদ্যাবধি তা অব্যাহত আছে।
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সশস্ত্র কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত রাজনৈতিক হত্যা ও অন্যান্য অপরাধের খবর প্রায়শই আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই। এসব কারণে ছাত্ররাজনীতির ভাবমূর্তি ক্রমশ ক্ষুণ্ন হতে শুরু করে। বর্তমান ছাত্ররাজনীতির অনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাত্ররাজনীতির সেকালের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে ম্লান করে দিয়েছে। সুধীবৃন্দ, আরিস্তোতল বলেছেন, মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষকেই তাই রাজনৈতিক সচেতন হওয়া অপরিহার্য। আধুনিব বিশ্বে রাজনীতি বিশ্বের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এমনকি শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও রাজনীতি সর্বব্যাপী প্রভাব ফেলছে। আজকের বিশ্বের কেবল যে উন্নয়নশীল দেশের ছাত্ররা রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছে তাও নয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশের ছাত্ররা রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অবশ্য তাদের সঙ্গে আমাদের ছাত্র রাজনীতির কিছুটা পার্থক্য আছে। ইংল্যান্ড-আমেরিকায় ছাত্রদের রাজনীতিতে মূখ্য স্থান নিয়েছে যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী ভূমিকা। ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ইত্যাদি দেশে ছাত্র আন্দোলনে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে সমাজ বিপ্লবের ভাবাদর্শ।
দুঃখের বিষয় যে আমাদের দেশে ছাত্রসমাজ এখন সুস্থ দেশগঠনমূলক আদর্শবাদী রাজনীতির পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নীতিহীন, উচ্ছৃঙ্খলতা, অনভিপ্রেত অনাচার, দুর্নীতি, অপরাধ, বিকৃত ও অশ্লীল অপসংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। স্বাধীনভাবে, দেশব্রতী ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুস্থ-সবল উদ্দীপনাময় দিক-নির্দেশনা এখন ছাত্রসমাজের সামনে নেই বললেই চলে। উপযুক্ত দিক নির্দেশনার অভাবেই ছাত্র রাজনীতির এই বেহাল অবস্থা। এরকম নীতি বর্জিত লক্ষ্যভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতি কারও কাম্য হতে পারে না।
গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে বর্তমান ছাত্রসমাজ তার অতীত ঐতিহ্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনবে এবং দেশ ও জাতি গঠনে গৌরবোজ্জবল ভূমিকা রাখবে এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বিদায় নিচ্ছি। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন— আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।