গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও উন্নয়নের সম্পর্ক এতই নিবিড় যে, একটি ছাড়া অন্যটি নিরর্থক। গণতন্ত্র না থাকলে যেমন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তা নিশ্চিত করা যায় না, তেমনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব। কেবল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লালন ও অনুশীলনের মধ্য দিয়েই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। যে দেশে গণতন্ত্র নেই সে দেশের জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অপরপক্ষে মানবাধিকারের নিশ্চিয়তা বিধান করতে না পারলে সংবিধানের গণতন্ত্রও অর্থহীন। এমতাবস্থায় অর্থবহ উন্নয়ন প্রত্যাশাও মরিচীকার মতো।

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন

গণতন্ত্র : গণতন্ত্র এমন একটি আদর্শ ব্যবস্থার নাম যেখানে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারসহ সর্বপ্রকার অধিকার সুনিশ্চিতভাবে বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘Government of the people, by the people, for the people’-এর মর্মবাণীই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল এবং প্রধান উপজীব্য বিষয়।

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ গণতন্ত্রকে ‘সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত সরকারব্যবস্থা, প্রশাসনের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, মত ও চিন্তার উদারনৈতিক স্বাধীনতা, নির্বাচনে শাসক দল পরাজিত হলে বিজয়ী দলের হাতে দ্বিধাহীন ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্মতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন এবং সর্বোপরি সামরিক বাহিনীর ওপর বেসামরিক কর্তৃত্বে নিরঙ্কুশ আধিপত্য’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বর্তমানে গণতন্ত্র বিশ্বে সর্বজনস্বীকৃত ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা।

মানবাধিকার : সকল মৌলিক অধিকারই মানবাধিকার। কিন্তু মানবধিকারসমূহ মৌলিক অধিকারের মতো ভিন্নভাবে সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে না। মানবাধিকারের উৎস হলো আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন বিষয় এবং এর পরিধি খুবই ব্যাপক। মানবাধিকারগুলোর কোনো সাংবিধানিক নিশ্চয়তা নেই অর্থাৎ এগুলো আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। মানবাধিকারগুলো কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত এবং প্রতিটি দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য ।

উন্নয়ন : উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি চলমান প্রক্রিয়া যা সমাজের অসামঞ্জস্য দূর করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধান করে। প্রখ্যাত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ Young (1989)-এর মতে,  “উন্নয়ন হলো কোনো ব্যক্তি বা সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির একটি জটিল প্রক্রিয়া। অগ্রগতি এই অর্থে যে, এর ফলে ব্যক্তি ও সমাজের জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক . চাহিদা পূরণ হয় এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ ঘটে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন-এর মতে, ‘উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনযাত্র মানের উন্নয়ন, যে মান তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা আয়ু এবং আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে । তিনি আরো বলেন, কেবল উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধিনির্ভর অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্থহীন উন্নয়নে পর্যবসিত হতে বাধ্য, যদি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তার সুফল না পায়। অর্থাৎ উন্নয়ন হলো সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতিসহ সামগ্রিক উন্নয়ন।

সামগ্রিক আলোচনা : পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে গণতন্ত্র এমন একটি আদর্শ ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারসহ সর্বপ্রকার অধিকার সুনিশ্চিতভাবে বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার রয়েছে। অপরদিকে মানবাধিকার বলতে মানুষের অধিকারকেই বোঝায়, যা একটি মানুষের সামগ্রিক পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের অঙ্গীভূত। আর এই সনদ শুধু একটি দলিলই নয়, বরং সারা বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ঘোষণা স্বাক্ষরকারীদের জন্য একটি নীলনকশা হিসেবেও কাজ করছে। কিন্তু নির্বাচিত সরকারপ্রধান এই সনদ না মানার জন্য হয় স্বৈরাচার।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বাংলাদেশে আইয়ুবশাহীর আমল থেকে এরশাদশাহীর আমল পর্যন্ত সামরিক শাসনের জন্য এ দেশের মানুষ জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ভিত্তিতে রচিত পবিত্র সংবিধানের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। সামরিক শাসনের ফলে এ দেশে স্বৈরশাসনের জন্ম হয়েছিল। অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে। কিন্তু সমাজ থেকে সন্ত্রাস উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। আর এই সন্ত্রাসই পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধাস্বরূপ। তাই দেশের প্রচলিত আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে সন্ত্রাস নির্মূল করতে পারলে একদিকে সমাজে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে, অন্যদিকে সামগ্রিক উন্নয়ন প্রবাহ ত্বরান্বিত হবে। অন্যথায় জাতিকে যে এর জন্য চরম খেসারত দিতে হবে তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য প্রচলিত আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগই যথেষ্ট। এর জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করলে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগের সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এমনকি বাংলাদেশ কার্যবিধির ৫৪ ধারাসহ দণ্ডবিধির ৩৯২, ৩৯৫, ৩৯৭ ধারায় পূর্ব আক্রোশ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কিছু সংখ্যক পুলিশের যোগসাজশে এই সকল ধারার অপব্যবহারের ফলে আইনের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে অপরাধীরা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে সমগ্র জাতিকে জিম্মি করে ফেলেছে। সমাজে সন্ত্রাস বেড়ে চলছে এবং পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ বাহিনী দ্বারা সাংবাদিক নির্যাতন, শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধাদান, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাত-পা কেটে দেয়া, ধর্ষণ, নির্যাতনমূলক আচরণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। তাই সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে গণতন্ত্র অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র জন্ম নিয়েছে ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্রের স্বাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন  রোধ করার জন্য এখনো আমাদের অনেক কিছু করার বাকি রয়ে গেছে। তাই দেশে বিদ্যমান সকল কালো আইন বাতিল করে নির্দোষ মানুষদের অযথা হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে দেশে বিগত সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের রিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার শিশুপুত্র ও আত্মীয়স্বজনদের হত্যার বিচার প্রক্রিয়া সংসদে ইনডেমনিটি বিল রদ করে শুরু হয়েছিল, যা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এ বিচার প্রক্রিয়া যাতে কোনো হীন রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । এই বিচারকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এ দেশে যেমন চিরতরে নিশ্চিহ্ন হবে, তেমনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি জাতীয় চার নেতা, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। অন্যথায় রাজনৈতিক অঙ্গনে হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা থেকেই যাবে এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না।

অন্যদিকে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ পরিহার করতে না পারলে গণতন্ত্রের স্বাদ দেশের সকল জনগণ ভোগ করতে পারবে না। তাই হরতালের নামে জাতীয় সম্পদ বা দেশের যে কোনো ধরনের সম্পদ ধ্বংস করা যাবে না। এই জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড উন্নয়নমুখী এবং গঠনমূলক হতে হবে। বর্তমানে দেশের উন্নয়ন, মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অধিকতর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। সরকারি দলের অন্যায় কাজের জন্য যেমন প্রতিবাদ, সভা, মিছিল করা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যক, তেমনি প্রতিবাদের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপও বর্জন করা উচিত।

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার: একটি উন্নয়নকামী রাষ্ট্রে যে সকল সমস্যা থাকে বাংলাদেশেও সে সকল সমস্যা বিদ্যমান। তাই সে সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সচেতনতা সৃষ্টি, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ইত্যাদি। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট, দল, ছাত্রসমাজ, শ্রমিক, মানবাধিকার কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, পেশাজীবীসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের আরো অধিক গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment