খুদে গল্প লিখন | গল্প লিখন | ভাষা ও শিক্ষা ,জীবনানুভূতির মূর্তমান ও শিল্পময় প্রকাশই হচ্ছে গল্প। কথার পর কথা সাজিয়ে আমরা জীবনানুভূতিকে প্রকাশ করি অর্থাৎ ভাব বিনিময় করি। ভাষার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো পরস্পর ভাব বিনিময় করা। একের ভাবকে অন্যের মনে সঞ্চারিত করা এবং পারস্পরিক অনুভাবনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ জীবন-জগতে প্রবেশ করে অনুভূত জীবনকে ভাষায় মূর্তমান করে তোলা।
Table of Contents
খুদে গল্প লিখন | গল্প লিখন | ভাষা ও শিক্ষা
ভাষা কীভাবে মূর্তমান হয়ে ওঠে? ভাষার সঙ্গে যখন জীবনের সংযোগ ও সংশ্রব ঘটে; প্রাত্যহিক জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে বর্ণন করে বাস্তব রূপ দান করে; কাহিনীর বর্ণনায় বাস্তবরূপ যখন শিল্পসত্যে পরিণত হয়; জীবনানুভূতির স্পর্শে ভাষা সজীব হয়ে ওঠে। ব্যক্তির ভাব-চিন্তার ও অনুভূতি-উপলব্ধির শিল্পময় প্রকাশই তখন হয়ে ওঠে গল্প।
আমরা শুধু কথাই বলি না, একটু লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে, আমরা কথার চেয়ে গল্পই বেশি করি। গল্প বলতে ও শুনতে কে না ভালোবাসে। সব কালের সব বয়সের মানুষ গল্পপ্রিয়। পারিপার্শ্বিক জগৎ-জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে আমরা গল্প বলি। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনের নানা ঘটনা ও কাহিনী আমাদের মনে-প্রাণে দোলা দেয়। সুখে-দুঃখে মনপ্রাণ জেগে ওঠে। অনুভূত ও উপলব্ধিগত জগৎ-জীবনকে আমরা পরস্পরের কাছে রসময় করে বর্ণনা করি। কোনো ঘটনা বা কাহিনীর রসানুভূতির এই বর্ণনার নামই গল্প। কালের প্রবাহের সঙ্গে যুগ পরিবর্তনে গল্পের আঙ্গিক গঠন-প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
আগেকার দিনে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিছু কল্পনা মিশিয়ে সরস বর্ণনাই ছিল তখনকার গল্প। তারপর কালের অগ্রগমনে সভ্যতার যত বিকাশ হল, গল্প-সাহিত্য শিল্পকর্মের বিষয়ীভূত হয়ে তত বিভিন্ন আঙ্গিক, প্রকৃতি, রূপ-রস ও স্বদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত হতে লাগল। রূপকথার গল্প, আরব্য রজনীর গল্প, গ্রীক পুরাণের গল্প, রামায়ন-মহাভারতের গল্প, নীতি গল্প, ঈশপের গল্প, হিতোপদেশমূলক গল্প, বৌদ্ধ-জাতকের গল্প, কথামৃতের গল্প— আরও কত কি। রূপকথার গল্প বাদ দিলে বাকি গল্পের কাহিনী-পরিবেশ-চরিত্র ও প্রকাশ-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যে কোনোরকম পার্থক্যই থাক না কেন, উপদেশ বিতরণ ছিল মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়।
আধুনিক যুগে গল্প নিছক কল্পনাশ্রয়ী না হয়ে বাস্তবধর্মী হল। মানুষ শিক্ষায় ও জ্ঞানে-বিজ্ঞানে যত উন্নত হল, সে তত যুক্তিবাদী হল, তার কল্পনার অলীক স্বপ্নমিনারের মিথ্যা মোহ গেল কেটে। সাহিত্য-শিল্পে সে দেখতে চাইল বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই তাগিদে গল্পের কাহিনী পরিবেশ-চরিত্র প্রভৃতি উপাদানকে বাস্তবসম্মত করে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। গল্প বাস্তব-যোগ্যতার অধিকারী না হলে পাঠকের কাছে গ্রহণীয় হওয়া দুষ্কর হল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাস্তব ঘটনার বিবৃতিই গল্প নয়। একই কারণে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঘটনার বিবরণ গল্প হতে পারে না। গল্পের বাস্তব যোগ্যতা বলতে কাহিনীর সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ যে থাকবে না তা নয়, বরং কল্পনার প্রলেপে কাহিনী রসোত্তীর্ণ বাস্তব অনুসারী হয়ে পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হওয়া চাই।

বিষয়-বিন্যাস, প্রকাশ-ভঙ্গি, রূপ ও শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বড়গল্প ও ছোটগল্প প্রধানত এই দুই শ্রেণিতে গল্প বিভক্ত। খুদে গল্প বলতে প্রকারান্তরে ছোট গল্পকেই বোঝানো হয়েছে। নবীন শিক্ষার্থীরা সবেমাত্র গল্প লেখার অনুশীলন করছে বলে তাদের সম্ভাষণ করা হচ্ছে সহজ কথায়; সহজ কথা সাজিয়ে শিক্ষার্থীরা লিখবে ‘খুদে গল্প’। গল্প লেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক এই প্রচেষ্টাকে বলা হচ্ছে ‘খুদে গল্প লিখন’। খুদে গল্প লিখতে লিখতেই শিক্ষার্থীরা একসময় শিল্পোত্তীর্ণ রসময় ছোটগল্প লিখবে, লিখবে বড় গল্প, উপন্যাস, নাটক। রচনা করবে কালোত্তীর্ণ শিল্প-সাহিত্য।
গল্প রচনার কাজটি কিন্তু সহজ নয়। গল্প রচনার আগে ছোটগল্প সম্পর্কে আরও দু-চার কথা জেনে নিই। সব ধরনের গল্পের মধ্যে ছোটগল্প শিল্প-উৎকর্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশ্বজোড়া এর জনপ্রিয়তা। ছোটগল্প কেবল আয়তনগত দিক থেকেই ছোট নয়, কাহিনীর স্বল্পতম পরিসরে ভাবের একমুখী অখণ্ড প্রবাহ ও গূঢ়তম সত্যের ব্যঞ্জনাই ছোটগল্পের শিল্প- নৈপুণ্যগত সার্থকতা। ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য
‘নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ; অনএতর অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ। ‘
ছোটগল্পের এমন নিগূঢ়তম তত্ত্ব-তথ্য ও ব্যঞ্জনা অনুধাবন করা বেশ কঠিন। এজন্যেই বলা হয়েছে ‘খুদে গল্প লিখন । অর্থাৎ প্রথমেই শিল্পসমৃদ্ধ ছোটগল্প লেখা যাবে এমনটা আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। গল্প লেখার প্রাথমিক প্রচেষ্টা ও অনুশীলনে অর্থাৎ খুদে গল্প লেখার মধ্য দিয়ে নবীন শিক্ষার্থীটি ক্রমেই পরিপক্ক হয়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করে একদিন সার্থক গল্পকার হয়ে ওঠবে তাতে আর সন্দেহ কি। গল্প লিখতে বসার আগে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে- ব্যক্তি-জীবনের বা মানুষের জীবনের কোনো একটি অংশকে অর্থাৎ জীবনের কোনো ঘটনা বা কাহিনীকে পরিস্ফুট করাই খুদে গল্পের কাজ। গল্পকারও কথার পর কথা সাজিয়েই গল্প লিখেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ কথা থেকে গল্পের কথার পার্থক্য কোথায়, গল্প লেখার ক্ষেত্রে সেটি মনে রেখে গল্প লেখা শুরু করতে হবে।
ক্ষুদে গল্প লিখনের অনুশীলন কীভাবে আমরা করতে পারি সেটিই এ-অধ্যায়ের আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয়। গল্প রচনায় অভ্যস্ত হওয়ার জন্যে শিক্ষার্থীর প্রথমে জানা দরকার গল্পের উপাদানগত দিক। যেহেতু গল্প রচনার বিশেষ কোনো ব্যাকরণ নেই তথাপি কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গল্পকারকে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। এগুলো হল : ১. কাহিনী, ২. ঘটনা-বিন্যাস ও পরিবেশ রচনা, ৩. চরিত্রসৃষ্টি, ৪. সংলাপ, ৫. ভাষা ও রচনাশৈলী।
১. কাহিনি :
গল্পে একটি কাহিনে বা ঘটনা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কাহিনিই গল্পের অবয়ব। এর উপস্থাপনা, ক্রমবিকাশ ও পূর্ণতা বা সমাপ্তির মধ্য দিয়ে একটি গল্পের পূর্ণাঙ্গ চেহারা পরিস্ফূট হয়, সেজন্য গল্পের সাধারণত তিনটি সুস্পষ্ট অংশ থাকে- ১. সূচনা, ২. বিস্তার, ৩. সমাপ্তি। সূচনা অংশ সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সূচনায় গল্পের পঠভূমি তৈরি হয়ে কাহিনির ধারাবাহিকতাকে বিস্তারের অভিমুখী করে। মধ্যপর্যায়ে কাহিনি বিস্তৃত হয়ে ধীরে ধীরে সমাপ্তির দিকে এগোয়।
২. ঘটনা :
বিন্যাস ও পরিবেশ রচনা : আগেই বলা হয়েছে যে, গল্পকার কথার পরে কথা সাজিয়ে গল্প করেন বা লেখেন। ঘটনার বিন্যাস বলতে গল্পের কাহিনিটির বিন্যাসকে বোঝায়। অর্থাৎ গল্পের সূচনা পর্বের সঙ্গে কাহিনির যোগসূত্র তৈরি করে ঘটনাটিকে এমনভাবে বর্ণনা করতে হবে যেন কাহিনিটি বাস্তব সত্যে রূপ লাভ করে। সার্থখ পরিবেশ রচনার গুণে সাধারণ কাহিনিও অসামান্য হয়ে উঠতে পারে। কাহিনি ও পরিবেশের সঙ্গতির মধ্যেই গল্প বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে— গল্পরস ঘনীভূত হয়। যেমন— ভৌতিক গল্পের কাহিনি কোনো নির্জন পরিবেশে বা রাতের নির্জনতায় যেমন পরিস্ফুট হয়, তেমনি হাসির গল্পের জন্যে চাই ভিন্নতর পরিবেশ।
গল্পের কাহিনির সঙ্গে পরিবেশ-পরিস্থিতির বর্ণনা বা রূপদান করা গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও অপরিহার্য উপাদান। গল্পের ঘটনা ও চরিত্র শহরের হলে শহুরে পরিবেশ, গ্রামের হলে গ্রামীণ পরিবেশ, ইতিহাসের হলে ইতিহাসের সেই বিশেষ যুগের পরিবেশ, কলকারখানা বা শিল্পাঞ্চল হলে শিল্পাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন পরিবেশ চেনা অপরিহার্য। পরিবেশ রচনার জন্যে লেখকের সেই বিষয়ক অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান একান্ত প্রয়োজন। মোদ্দাকথা হল- লেখকের উপস্থাপন-গুণে ও বিন্যাস-দক্ষতায় গল্পের কাহিনি রসমণ্ডিত ও সার্থক হয়ে ওঠে।
৩. চরিত্র সৃষ্টি :
গল্পের ঘটনা ও যথার্থ চরিত্র সৃষ্টি করা গল্পের অন্যতম উপাদান। চরিত্রের স্বভাব-প্রকৃতি, ভাবনা-চিন্তা, কাজ-কর্ম, চলা-ফেরা অনুযায়ী কাহিনি ও ঘটনার গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। চরিত্র রক্ত-মাংসের অস্তিত্ব নিয়ে সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে কাহিনির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে পাঠকের কাছে সে গল্প বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। গল্পে এক বা একাধিক চরিত্র থাকে। মূল চরিত্রটিকে ঘিরে অন্যান্য চরিত্রগুলো যেন আবর্তিত হয়। মূল চরিত্রকে নায়ক চরিত্র বলা হয়। অন্যান্য চরিত্রগুলোকে অপ্রধান চরিত্র বলে। মূল চরিত্রকে উপলক্ষ করে এবং অন্যান্য চরিত্রের সমন্বয়ে কাহিনি বা ঘটনার মূল বিষয়টিকে তুলে ধরার উপরই গল্পের সার্থকতা নির্ভর করে।
৪. সংলাপ :
গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো সংলাপ। সংলাপের উপর নির্ভর করেই চরিত্রগুলো সজীব ও বাস্তব রূপ লাভ করে। গল্পের রস ও শিল্প দুই-ই নির্ভর করে উৎকৃষ্ট সংলাপের উপর। সেজন্য চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ রচনার কৌশল গল্পকারকে আয়ত্ত করতে হয়। যে যেমন চরিত্রের মানুষ, তার কথাবার্তাও হয় সেরকম। ক্রিয়াকলাপ ও কথাবার্তার ভিতর দিয়েই মানুষের স্বভাবচরিত্রের প্রকাশ ঘটে। তাই গল্পকে রসসমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় করতে হলে উপযুক্ত সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।
৫. ভাষা ও রচনাশৈলী :
গল্পের ভাষা সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর হবে। কিন্তু সরল ভাষা বলতে তরল ভাষা বোঝায় না। যেমন, আবেগ বলতে বোঝায় না উচ্ছ্বাস। ভাষা সম্পূর্ণ নিরাবেগ হবে, এমন দাবি অনুচিত। কেননা, যা নিতান্ত নিরাবেগ, সেই শুকনো ‘কেঠো’ ভাষা একই জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে থাকে, আবেগের ছোঁয়া না লাগা পর্যন্ত তাতে গতির স্পন্দন জাগে না। কিন্তু আবেগ নামক ব্যাপারটাকে যে সংযমের লাগাম পরিয়ে রাখা চাই, সেটা মনে রাখতে হবে। আবেগ সংযত না হয়ে উচ্ছ্বসিত হলে ভাষাকে তা অনর্থক আবিল করে মাত্র। রচনার স্বচ্ছতা তাতে নষ্ট হয়; লেখকের যা বক্তব্য, তা উচ্ছ্বাসের ফেনার তলায় চাপা পড়ে যায়। বাক্য জটিল হলে ভাষা দুর্বোধ্য হয়।
যে-ভাষা দুর্বোধ্য, তা অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। গল্প বলার সহজ ভাষাভঙ্গি পাঠকের কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় হয়। ভাব অনুযায়ী ভাষা-প্রয়োগই উৎকৃষ্ট রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রচনাশৈলীর পার্থক্যহেতু একই গল্প বিভিন্ন লেখকের হাতে রূপে-স্বাদে ভিন্নতর হয়। রচনাশৈলী বা স্টাইল রচনাকে শিল্পগুণে সমৃদ্ধ করে। সর্বোপরি ভাষার পরিমিতিবোধ ও পরিচ্ছন্ন স্টাইলের সংযোগে গল্প সার্থক হয়ে ওঠে।
আরও দেখুনঃ