Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

খাদ্যে ভেজাল তার কারণ ও প্রতিকার আলোচনা সভায় মঞ্চভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলা সাহিত্যে ও বাঙালির জীবনে নববর্ষ | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

খাদ্যে ভেজাল তার কারণ ও প্রতিকার আলোচনা সভায় মঞ্চভাষণ এর একটি খসড়া তৈরি করে দেয়া হলো শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের,  “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ|

খাদ্যে ভেজাল তার কারণ ও প্রতিকার আলোচনা সভায় মঞ্চভাষণ

‘খাদ্যে ভেজাল : তার কারণ ও প্রতিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা। ‘খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল’ এ সংবাদটি আজ আর নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই এ নিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ। সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাকে ‘জনস্বাস্থ্য ও প্রজন্ম হুমকির মুখে ॥ ঢাকায় ৭০ শতাংশ, দেশে ৫০ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য ভেজাল’ শীর্ষক একটি সংবাদ নিশ্চয়ই আপনাদের দৃষ্টি এড়ায় নি।

এ সংবাদের প্রধান বক্তব্য ছিল যে ‘বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ভেজালমুক্ত বিশুদ্ধ খাদ্য অনেকটা সোনার হরিণের মতো দুর্লভ। মাছ, মাংস, চিনি, লবণ, চাল, আটা, দুধ, ঘি, মিষ্টি, ওষুধ— ভেজাল সর্বত্রই। এমনকি মিনারেল ওয়াটার নামে বোতলবন্দি ‘বিশুদ্ধ’ পানিতেও ভেজাল।” সুধী, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এ-সব নকল ও ভেজাল খাদ্য সামগ্রীই বিশুদ্ধ বা খাঁটি লেবেল লাগিয়ে অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এরূপ খাঁটি ঘি, খাঁটি মধু, খাঁটি দুধ, খাঁটি তেলের প্রচার ও সরবরাহের অভাব নেই। আসলে এ-সব খাঁটি লেবেলের আড়ালে আসল জিনিসটাই বোধ হয় হারিয়ে গেছে।

নকল-ভেজালের দৌরাত্ম্যে ‘খাঁটি’ কথাটাই কথার কথায় পরিণত হয়েছে। সকলেই জানে ‘খাঁটি’ মোটেও খাঁটি নয়। সুধীবৃন্দ, দেশের এই ভেজালের দৌরাত্ম্যের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু ভয়ের কথা যে ভেজালের আওতার মধ্যে প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন ‘আইটেম’ যুক্ত হচ্ছে। হাসের ডিমকে মুরগির ডিম বানানোর জন্য রঙের ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। বস্তুত নিত্য নতুন প্রক্রিয়া ও উপাদান বা পদার্থ ব্যবহার করে যেভাবে খাদ্যদ্রব্য ভেজাল করা হচ্ছে তা নির্ণয় করার ব্যবস্থা ও উদ্যোগ না থাকায় প্রকৃত ভেজালের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা প্রতিনিয়ত বাজার থেকে কিনে যেসব খাদ্যদ্রব্য খেয়ে থাকি, এদের মধ্যে কত শতাংশ ভেজাল তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এক সূত্র থেকে জানা যায় রাজধানীতে বিক্রিত খাদ্যসামগ্রীর শতকরা সত্তর ভাগ ভেজালযুক্ত।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অন্যদিকে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ-এর সূত্র মতে, দেশের পঞ্চাশ শতাংশ খাদ্যদ্রব্যই ভেজাল মিশ্রিত করে বিক্রি করা হয়। তারা একটি পরিসংখ্যান করে দেখিয়েছেন যে, ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাইশ হাজার সাতশত উনিশটি খাদ্যদ্রব্য বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ওই সব খাদ্যদ্রব্যের প্রায় পঞ্চাশ (৪৯.২২%) শতাংশ ভেজাল। এদিকে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর হিসেবেও বাজারে বিক্রয় হচ্ছে এমন খাদ্যদ্রব্যের পঞ্চাশ শতাংশ ভেজাল । সুধী, আজকাল তরল দুধে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন আর শিশুর গুঁড়ো দুধে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক মেলামাইন।

ভাবতে কষ্ট হয়— মানবতা আজ কত বিপন্ন। অসহায় শিশু, অসহায় রোগী তাদের নিয়ে চলছে কত ষড়যন্ত্র। ভাবা যায়— জীবনরক্ষাকারী ওষুধে ট্যালকম পাউডার, আটা-ময়দা? প্রাণঘাতী হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা হিসেবে পুশ করা হয়েছে মিনারেল ওয়াটার। কী ভয়াবহ— কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কোন জগতে বসবাস করছি? আমরা কি মনুষ্য সমাজে বাস করছি? আসলেই কি আমরা মানুষ? নাকি মানুষ নামের পশু? মানুষ কি পশুকে অতিক্রম করে যাচ্ছে? পশুত্ব কি মনুষ্যত্বকে গ্রাস করছে? যারা কোনোরকমে কোনোরকম সুস্থ আছি তাদের সুস্থতা ধ্বংস করতে কী গভীর, কী কুটিল কল্পনা-জল্পনা, ষড়যন্ত্রই না চলছে দিবানিশি।

তাই বলছিলাম— আমরা আসলে কোথায় আছি— যাচ্ছিই বা কোথায়? আমাদের ভবিষ্যৎ কী? আগামী প্রজন্মের আগামী কতোটা শংকামুক্ত এবং নির্বিঘ্ন? অপরাধ করা, অপরাধ এবং অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়া সমান অপরাধ একথা শুধু জানলে চলবে না— প্রতিবাদ করে প্রতিরোধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। সুধী, খুব কম মানুষই আছে যারা অসচেতনভাবে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয় তথা অন্যকে প্রতারিত করে। প্রায় সবক্ষেত্রেই জেনে-শুনে এবং সচেতনভাবেই এই গর্হিত ও সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয় অপকর্মটি একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ও বিক্রেতা করে থাকে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অপরাধ জগতে খুবই প্রাচীন এবং বলার জন্যে অত্যন্ত মুখরোচক কারবারের নাম প্রতারণা। সাধারণ লোকে বলে ঠগবাজি।

 

 

এরা অতীতে ছিল, এখনো আছে এবং আছে জগৎ জুড়ে, প্রায় সবদেশে। পৈতৃক সম্পত্তি বলে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারও নাকি বিক্রি করে দিয়েছিল এক মহা ধড়িবাজ। কাজেই তাদের ওয়াজ-নসিহত করে বিরত রাখা যাবে না, শক্ত হাতে দমন করতে হবে। দেশের সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে।’ বাজার যেখানে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্যে পূর্ণ সেখানে জনগণের ‘পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন’ করতে হলেও রাষ্ট্রকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য এবং এসবের জোগানদাতাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে হবে। জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।

সুধী, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো ও তার প্রতিকার সম্পর্কে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে—

(১) বাংলাদেশে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য বিল ২০০৫’ নামে একটি আইন করা হয়েছে। এ আইনে সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ১১ জুলাই ২০০৫ প্রথমবারের মতো ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির জন্য হোটেল মালিককে সাজা প্রদান ও জরিমানা করা হয়। এ ধারা বেগবান করা উচিত।

(২) ভেজালবিরোধী আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

(৩) খাদ্যনমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেক জেলায় এবং সম্ভব হলে বড় বড় বাজারগুলোতে পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে।

(৪) বিএসটিআইকে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। ভেজালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং বাজার তদারকির জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে।

(৫) সর্বোপরি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের প্যাকেটের গায়ে কোম্পানির লাইসেন্স নম্বর, ট্রেড মার্ক, পণ্যের উৎপাদন সময়সহ এমন সব কৌশল ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ক্রেতা সাধারণ সহজেই খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল বুঝতে পারে।

(৬) ভেজালের প্রতিকারের লক্ষ্যে ক্রেতা স্বার্থ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

(৭) ভেজালরোধে সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

(৮) প্রচারমাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের নানারকম প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।

(৯) সমাজে ভেজালকারীকে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে, প্রয়োজনে লোকসমক্ষে তাকে লজ্জা দিতে হবে এবং ব্যবসায় থেকে তাকে বিতাড়িত করতে হবে।

(১০) ব্যবসায়িদের খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের ভয়াবহ দিক সম্পর্কে জানিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। আশা করা যায়, সরকারের সদিচ্ছা এবং আইন প্রয়োগকারীদের সততা অটুট থাকলে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের পরিমাণ কমবে। আশার কথা দীর্ঘদিন থেকে সরকারি উদ্‌যোগে ভেজাল বিরোধী অভিজান পরিচালিত হচ্ছে। এতে কিছুটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ অভিজানকে আরো জোরদার করতে হবে। সরকারের কাছে এ প্রত্যাশা রেখে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। সকলকে ধন্যবাদ ।

আরও দেখুন:

Exit mobile version