Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

যৌতুকের অভিশাপ বিষয়ে একটি ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

পহেলা বৈশাখ | উৎসব-লোকাচার-লোকশিল্প | বাংলা রচনা সম্ভার

যৌতুকের অভিশাপ বিষয়ে একটি ভাষণ এর একটি খসড়া তৈরি করে দেয়া হলো শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের,  “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ|

যৌতুকের অভিশাপ বিষয়ে একটি ভাষণ

মাননীয় সভাপতি, শ্রদ্ধেয় প্রধান অতিথি এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ,

আপনারা জানেন একটি মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি। আমাদের সমাজদেহে কিছু দুষ্ট ব্যাধির ক্ষত দীর্ঘদিন ধরে অনারোগ্য আছে। শুধু আছে নয়, বীভৎস চেহারায় আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত। তাদেরই অন্যতম হল নারী নির্যাতন ও যৌতুকপ্রথা। আপনারা জানেন, যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুকের অভিশাপ এ দেশের সমাজ জীবনের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। এর জন্যে মর্যাদাহীন জাতি হিসেবে চিহ্নিত হতে হয় আমাদের। আনন্দের কথা আমরা তার পথানুসন্ধান করতে এক শুভকর অভীপ্সায় এখানে মিলিত হয়েছি।

 

 

আপনাদের সঙ্গে এমন একটি মহৎ ভাবনার শরিক হতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। সুধীবৃন্দ, আজ নবযুগের নবীন প্রভাতে দিকে দিকে নারীপ্রগতির জয়ধ্বনি বিঘোষিত হচ্ছে। অথচ খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক যে, সাম্প্রতিককালে নারীনির্যাতন লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে- খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, এসিড নিক্ষেপ, আগুনে পোড়ানোর মতো বর্বরোচিত নারীনির্যাতনের ভয়ানক চিত্র আমরা দেখতে পাই। বর্তমান গণতান্ত্রিক যুগে পুরুষের মতো নারীও পরিপূর্ণরূপে নাগরিক অধিকার লাভ করেছে। কিন্তু আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীনির্যাতন একটি নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সভ্যসমাজে নারীসম্প্রদায়ের প্রতি এই নির্মম উৎপীড়ন, অত্যাচার, অবিচার পুরুষ জাতির দুরপনের কলঙ্ক।

সুধী, আপনারা জানেন, কারণ ছাড়া কাজ হয় না। আমরা কারণ অন্বেষণে উদ্যোগী হলে দেখব, নারী-নিগ্রহের অধিকাংশ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে যৌতুক বা পণপ্রথার বিষময় কুফল। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত, এই ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় আছে ঋকবেদে কক্ষীবানের কন্যা-সম্প্রদানের ঘটনায়, মহাভারতে সুভ্রর উপাখ্যানে। আমাদের বঙ্গভূমিতে রাজা বল্লাল সেনের আমল থেকে কৌলীন্য প্রথার ফলে কুলীন পাত্রের চাহিদা বিয়ের বাজারে বেড়েছিল অস্বাভাবিক রকম। কন্যা অরক্ষণীয়া হওয়ার আগে পাত্রস্থ করে সামাজিক নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইতেন পিতামাতা। মোটা অর্থ প্রাপ্তির চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ছাতনা তলায় টোপর মাথায় দাঁড়াতেন কুলীন বংশীয় তনয়। এ হল আমাদের পণ ও যৌতুক প্রথার ইতিহাস। সচেতন সুধীসমাজ, আমরা তো আজ শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায় অনেক এগিয়ে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কিন্তু দুঃখের কথা, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সমাজে প্রাচীন মানসিকতার অনুবর্তন চলছে অদ্যাবধি। শুভ পরিণয়ের মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই শুরু হয় দোকানদারি— দেনা-পাওনার দর-কষাকষি। ভেবে দেখুন যৌতুকের টাকার ওপর নির্ভর করে নববধূর গুণাগুণের মূল্যায়ন। রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর নির্মম পরিণতির কথা কে না জানেন। অসহায় পিতা তার কন্যার সুখের আশায় যৌতুক দিতে গিয়ে পথে বসে। পরিবারের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে কন্যার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে চায়। লোভী বর কথামতো সবকিছু পেয়েও ঠকে গেেেছ বলে মনে করে।

এ থেকে শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত এক সময় চরম রূপ ধারণ করে এবং কন্যার জীবনে নেমে আসে করুণ মৃত্যুর ছায়া। আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি, তাদের সবার কাছেই এ সব অতি পরিচিত ঘটনা। নতুন করে জানাবার বা জানানোর প্রয়োজন নেই বলে মনে করি। সবের প্রতিকারের চিন্তা-ভাবনা নিয়েই আমরা এখানে সমবেত । সুধীবৃন্দ, ক্রমবর্ধমান ভোগ-লালসা, অজ্ঞতা-লালিত কূপমণ্ডুকতায় মানুষের সত্যদৃষ্টি আজ অবরুদ্ধ হয়ে গেছে।

কারণ এ সমাজের লোভী ও আত্মকেন্দ্রিক বিষয় কীটদের এক ভয়াবহ অবদান এই নারীনির্যাতন। আজকের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, শাসক-শোষক নির্বিশেষে, সবাই কম বেশি বর্বরোচিত এই হীন কাজটির সঙ্গে জড়িত এটি আজ একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যৌতুক প্রথার অভিশাপ মর্মান্তিক পরিণতি নিয়ে আসে অনেক নারীর জীবনে। এমন একটি অবমাননাকর প্রথার কবল থেকে নারীদের মুক্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের দেশে নারীনির্যাতন নিরসনকল্পে আইন রয়েছে।

কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, বিবেক- বুদ্ধিকে কবর দিয়ে সঙ্গোপনে অনেকেই এই হীন কর্মটি চালিয়ে যাচ্ছে। আইনে অপরাধীদের শাস্তির বিধান থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হচ্ছে না ফলে নারীনির্যাতনকে ঘিরে মনুষ্যত্বের নিদারুণ অবমাননা চলছে। আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পৃথিবীতে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে— সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের বর্বর চরিত্রের তেমন রূপ বদলায় নি। চৌদ্দ শ হিজরিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহম্মদ (স.) নারীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

 

 

তাঁর দিকনির্দেশনা বর্তমান সভ্যসমাজ যদি গ্রহণ করত তাহলে আজ এই নিপীড়নের চিত্র কাউকে দেখতে হত না। সুধী, আসলে যা দরকার তা হল সুস্থ মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজকল্যাণমূলক প্রকৃত গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। প্রয়োজনে দিকে দিকে নারীমুক্তি আন্দোলনের ডাক ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে আমাদের সমাজে চিহ্নিত নারীনির্যাতনের বিষাক্ত ক্ষতের চিহ্ন ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে পড়বে। নারীনির্যাতন বিরোধী আন্দোলনে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

আরও দেখুন:

Exit mobile version