কবি শামসুর রাহমানের কবিতা

কবি শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে আজকের আলোচনা। কবি শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার ৪৬ নম্বর মাহুতটুলীতে জন্মগ্রহণ করেন। শামসুর রাহমান এর পৈত্রিক বাড়ি ঢাকা জেলার রায়পুর থানার পাড়াতলী গ্রামে। তার পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা আমেনা খাতুন। শামসুর রহমান বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হিসেবে খ্যাত। শামসুর রাহমান ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। তবে তিনি ১৯৫৩ সালে বি.এ (পাস কোর্স) পাস করেন।

 

কবি শামসুর রাহমানের কবিতা - কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আঠারো বছর বয়সে শামসুর রাহমান প্রথম কবিতা লেখা আরম্ভ করেন। ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘উনিশ শ’উনপঞ্চাশ’ প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোরগুহ সম্পাদিত সোনার বাংলা পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ১৩জন তরুণ কবির কবিতার সঙ্কলন, নতুন কবিতা-য় তাঁর পাঁচটি কবিতাতাঁর কবি পরিচয়কে সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Table of Contents

কবি শামসুর রাহমানের কবিতা

 

১৪০০ সালের সূচনায় – শামসুর রাহমান

জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে সারারাত সহবাস করে
বেদনা ভুলতে গিয়ে আরো বেশি বেদনার্ত হই।
১৪০০ সালের আশা সত্তাময় মেখে নিতে চেয়ে
ক্রামগত বুনো অন্ধকারে ডুবে যাই।

ক’দিন দু’চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই, চর্তুদিকে বিভীষিকা
নানান মুখোশ পরে নাচ জুড়ে দেয়, অন্ধকারে
আমার একান্ত পাশে মৃত্যু শুয়ে তাকে,
হিয়ায়িত মিসাইল যেন।

হায়, সোমালিয়ায় মরছে কারা? মানুষ, মানুষ।
হায়, বসনিয়ায় মরছে কারা? মানুষ, মানুষ।
হায়, বসনিয়ায় ধর্ষিতা কারা? মায়েরা, বোনেরা।
বোম্বে, আর দিল্লী নগরীতে খুন হলো কারা? মানুষ, মানুষ।
ভোলায় আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরেছিল কারা? মানুষ, মানুষ।
প্রচ্ছন্ন মানিকগঞ্জে ধর্ষিতা হয়েছে কারা? মায়েরা বোনেরা।
সেখানে লুণ্ঠিত কারা? মানুষ, মানুষ।
এখানে লুণ্ঠিত কারা? মানুষ, মানুষ।

‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়’-
মানবতা প্রায়শই ব্যধভূমিতে চলেছে, হায়।

মৃত্যু প্রতিদিন খবরের কাগজে নিজের মুখ
পাখি-ডাকা সকালে দেখতে পেয়ে নিজেই আঁৎকে ওঠে খুব;
তবু মৃত্যু নিজেকে সাজিয়ে রাখে কম্পিউটারের
ঝকঝকে হরফে এবং বিজ্ঞাপিত হয় ভাঙনপ্রবণ বিশ্বময়।

আমরা কি মৃত্যুর ফরমাশ খেটে নিত্যদিন মনুষ্যত্ব
শ্মশানে ও গোরস্থানে ফেলে রেখে মানুষের প্রাণ
লুটে নেবে? ১৪০০ সালের সূচনায় বিশ্ববাসী
এসো আজ আমরা সবাই হৃদয়ের গানে গানে
গোধূলির মেঘ থেকে রক্তচিহ্ন আর ষড়যন্ত্রকারীদের
কালো খাতা থেকে সব আতঙ্কের নকশা মুছে ফোলি।
চারণ কবিরা সুরে দশ দিগন্তে রটিয়ে দিন-
‘সকল মানুষ, বৃক্ষ-লতাগুল্ম, পশুপাশি শান্তিতে থাকুক।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

তুমি ফিরে এসো – শামসুর রাহমান

স্বপ্নের ভেতরে পেয়েছি একটি সংখ্যা, তিনশো তের,
হীরের লকেটের মতো দোলে
সারাক্ষণ দৃষ্টিপথে, মায়াবী।
এই সংখ্যা দুলে উঠলেই অজস্র ময়ূর পেখম মেলে
আমার একলা ঘরে, অবিস্মরণীভাবে
গোলাপ বাগান উন্মীলিত হয় মেঝে ফুঁড়ে হঠাৎ,
দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসে সিংহাসন।
এই সংখ্যা দুলে উঠলেই
একজন তৃষ্ণার্ত পথিককে দেখি আঁজলা ভ’রে ঝরনা তুলে নিতে,

প্রাচীন গীতে গুঞ্জরিত হয় সত্তা,
নাবিকের নিরাপত্তাময় জলপথে নামে গোধূলি বেলা,
প্রেমিকের ওষ্ঠে ঝরে শত চুম্বন, মধুর, মদির,
বারবার ফিরে আসে বিয়ে বাড়ির চিত্রিত কুলো
আর রঙিন মাটির প্রদীপ।

এই স্বপ্নাদ্য সংখ্যা
কিসের যোগফল কিংবা গুণফল, জানিনা;
অবশ্যই পুণ্যফল মানি।

যখন রবাবের মতো বাজে
এই শহরের সকল মূকের কণ্ঠ থেকে ঝরে দিব্য সঙ্গীত,
যখন  একটি বাক্যশোভা,
এই শহরের ব্যর্থতম কবির লেখনী হয় সকল কবিতার উৎস,
যখন নীল নক্ষত্রের মতো জ্বলে,
প্রতিটি পথভ্রষ্ট পাত্থজন তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়,
যখন হাতের মতো প্রসারিত হয়,
হতচ্ছাড়া তীরভূমি হয়ে যায় সবচেয়ে সম্পন্ন বন্দর,
নাবিকের গানে আর সুন্দরীদের গুঞ্জনে মুখর,
যখন মসলিনের রুমালের মতো ওড়ে,
বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্যসমূহ যায় থেমে,
যখন চোখের তারার মতো কাঁপে,
এই শহরের অন্ধ সম্প্রদায় একসঙ্গে ফিরে পায় দৃষ্টি,
এই শহরের সকল নৈরাশ্যবাদী বুকের ভেতর
গান গায় জলকন্যা,
যখন দরবেশের তসবিহ,
ধাবমান ক্ষুধার্ত বাঘ হরিণকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দেয়
সীমাহীন নিস্পৃহতায়,
নিষ্ঠুরতম জল্লাদের হত বেহালা হ’য়ে বাজে,
সবচেয়ে বিপজ্জনক চোরাবালি বদলে যায় পার্কে,
ভয়াল ময়াল রঙধনুর বর্ণচ্ছটায়।

এই যে আমি স্বপ্নাদ্য একটি সংখ্যা নিয়ে মেতে আছি,
এই সংখ্যাটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে
অনেক খানাখন্দে পড়েছি কাঁটাতারে আটকে আমার
হাত-পা হয়েছে জখম, তবু কোনো
কূলকিনারা হয়নি, শুধু রূপসীর হাসির মতো
একটা মরীচিকা আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে বারংবার।

কে আমি? কী-ই বা আমি? সেই
চিরকেলে প্রশ্ন করি নিরন্তর নিজেকেই। এখানে
এসেছি কেন? কী কর্তব্য আমার?
আখেরে কোথায় যাবো? এই যে ব’সে থাকি নিশ্চুপ,
চোখ রাখি গাছের মগডালে, শুনি টিকটিকির ধ্বনি,
মাঝে-মধ্যে ভাবি ঐ গাছের বাকল এসে লাগবে আমার শরীরে,
হয়তো আমাকে দেয়াল ভেবে জন্মান্ধজন
উন্নয়নশীল দেশে ঘনিয়ে-আসা দুর্নীতির মতো অন্ধকারে
পথ চলবে। স্বরূপ অন্বেষায় ক্লান্ত আমি
পথের নকশা হারিয়ে ফেলেছি-
কেউ কি আমাকে বলে দেবে অনেক আমির ভিড়ে
কোন্‌ আমি বাস্তবিকই আমি?
বলে দেবেন কি কোনো যীশু কিংবা শাক্যমুণি?

একপালে ডালকুত্তা-তাড়িত কয়েদী যেমন
ভুলুন্ঠিত হয়ে খিম্‌চে ধরে মাটি কিংবা শেকড়বাকড়
তেমনি আমি হাত বাড়িয়েছি সেই আমার
স্বপ্নাদ্য সংখ্যাটির দিকে স্বপ্নাদিষ্ট পুরুষের মতো।

যখন কোনো গুণীর সর্বদা-তরুণ কণ্ঠের তান,
রাজবন্দীগণ দেবদূতের মতো উড়ে যান নীলিমায়
জন্মান্ধ সেল ছেড়ে
লাঞ্ছিত, নির্যাতিত জননেতা ভূষিত হন জয়মাল্যে,
স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জে জনগণ বাক-স্বাধীনতা ফিরে পান
অবলীলায়।

তুমি ফিরে এসো আমার চোখের পাতায়,
ফিরে এসো করতলে, ফিরে এসো আমার
স্বপ্নে জাগরণে, যেমন শস্য ফিরে আসে
ভাগ ভাষীর ভাবনায়, দুঃসহ জীবন যাপনে, বুকের ভেতরে,
তুমি ফিরে এসো।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

 

অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া – শামসুর রাহমান

গভীর রাতে অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া উন্মুক্ত প্রান্তরে বেধড়ক
দৌড়ুতে থাকে এদিক সেদিক। কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক,
সেদিকে বন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই তার। তার এই দৌড়ে ছন্দ আছে কি
নেই, এ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। ছুটতে তো ছুটছেই।

কখন যে সে নিখুঁত চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে মোহন
এক বাগানের পাশে, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। এই ঘোরাতেই
সে আনন্দের ঝিলিক উপভোগ করছে প্রতিটি মুহূর্তে।
সে কি ইতিমধ্যে ক্লান্তির কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি?
ওর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কি ব্যথা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না?
সে কি এই মুহূর্তেই স্বেদাক্ত শরীরে লুটিয়ে পড়বে না ধুলোয়?

না, তার তেজী আকাঙ্ক্ষাকে এখনও ম্লান করতে পারেনি
এই শ্রম। যতই স্বেদ ঝরুক ওর শরীর থেকে, ক্লান্তি যতই
থাবা সবাক ওর সত্তায়, দমে কুঁকড়ে যাওয়ার পাত্র সে
নয়। এখনও ওর শরীরে প্রতিটি রন্ধ্রে ঘোরার বাসনা চঞ্চল।

অন্ধকার নয়, আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের সঞ্জীবনী আলো ঘোড়াকে
টগবগে করে তোলে আরও। মৃত্তিকাবিহারী অশ্ব মুহূর্তে
চলে যায় আসমানে তারার মেলায়। সেখানে মহানন্দে
বেশ কিছুক্ষণ উড়ে বেড়ানোর পর মাটির টান তাকে নিচে
নেমে আসার জন্যে উতলা করে তোলে। টগবগে ঘোড়া মর্ত্যে নেমে আসে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অঙ্গীকার – শামসুর রাহমান

ফিরে যাবো? কেন ফিরে যাবো বারবার?
জানি সিংহদ্বার
পেরুলেই পেয়ে যাবো আকাঙ্ক্ষিত সব
উপচার, যার জন্যে ভীষণের স্তব
করেছি সকালসন্ধ্যা, পেরিয়েছি ঝড়মত্ত নদী, কতো সিঁড়ি,
রক্তাপ্লুত, বারংবার নেমেছি খনিতে। আজো ফিরি
পথে পথে কেইনের মতো। ফিরে যাবো? প্রহরীর
রক্তচক্ষু দেখে ফিরে যাবো? তুমি তবুও বধির
হ’য়ে থাকবে সর্বক্ষণ? ডাকবে না সেখানে, যেখানে
আমার ব্যাকুল পদচ্ছাপ পড়েছিলো স্বপ্নে, মানে
অলৌকিক অভ্যন্তরে। এই রুদ্ধ সিংহদ্বার থেকে
হতাশায় ভগ্নরথ ফেলে রুক্ষ ক্লান্ত মুখ ঢেকে
গেছেন আমার পিতামহগণ ফিরে। আমার শপথ,
প্রাপ্য ছাড়া আমিতো যাবো না ফিরে, থামাবো না রথ।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অঙ্গুরি এসেছ তুমি – শামসুর রাহমান

অঙ্গুরি এসেছ তুমি ফিরে অজ্ঞাতবাসের পর
আমার এ ঘরে আজ। বহুদিন ছিলে অন্ধকারে
বস্তুত গা ঢাকা দিয়ে; তোমাকে ভেবেছি বারে বারে,
দেখেছি তোমার স্বপ্ন কত, ইতিমধ্যে বহু ঝড়
ঝাপ্টা গ্যাছে, বিস্মৃতির এক্কা দোক্কা তোমার খবর
সহজে ফেলেছে মুছে কখনো সখনো। কোন্‌ তারে
কখন লেগেছে সুর পুনরায় কোমল গান্ধারে,
আমিতো পাইনি টের; ছিল খুব হৃদয়ের জ্বর!

হে অঙ্গুরি, তোমার শরীরে লতাগুল্ম, বুনো ঘাস,
গৃহত্যাগী যুবকের স্বেদ, ধুলো ইত্যাদির ঘ্রাণ
লেগে আছে, সবচেয়ে বেশি আছে ভালোবাসবার
সাধ ও ক্ষমতা যা সহজে মুমূর্ষুকে পারে প্রাণ-
শক্তি ধার দিতে আর লহমায় দূরের আকাশ
বুকে এনে স্বপ্ন দেখাতেও পারে ঘর বাঁধবার।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অচেনা নয় – শামসুর রাহমান

নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি
করতে পারি কি এই বয়সেও? যদি
বলি, দু’তিনটি
ভাষার কতক বাক্য অর্থসমেত বলতে পারি,
লিখতেও পারি, মিথ্যা উক্তি হবে না তা। সমাজের
কোনও কোনও স্তরে সম্মানের কিছু উপঢৌকন মিলবে বটে

অথচ আমার প্রতিবেশী না হ’লেও
অচেনাও নয় যে পাখিটা
আমার নিঝুম বারান্দায় এসে বসে, চিড়া মুড়ি
দিলে মুখে তুলে নেয়, উড়ে চলে যায়
আমার অজানা কোনও জায়গায়। গায়ক পাখির
গীতসুধা পান করে তৃপ্ত হই, যদিও সুরের ভাষা নেই।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অজানা পথের ধুলোবালি – শামসুর রাহমান

কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা পথের
ধুলোবালি চোখে-মুখে ছড়িয়ে সন্ধ্যায়?
কেন যাচ্ছি? কী হবে সেখানে
গিয়ে? জানা নেই। মাঝে-মাঝে
বিছানায় শুয়ে সাত-পাঁচ ভেবে চলি। অতীতের
কিছু কথা স্মৃতিপটে ভাসে।

হঠাৎ ভীষণ শব্দ আমাকে কামড়ে ধরে যেন-
ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। অন্ধকার যেন
আরও বেশি গাঢ় হয়ে যায়, এমনকি নিজ হাত
এতটুকু পড়ছে না স্বদৃষ্টিতে। থেকে
যেতে হ’ল আখেরে সেখানে, যে-স্থানের
সবকিছু বেজায় অজানা!

আজকাল প্রায়শই জানাশোনা লোকের মৃত্যুর
খবর বিষণ্ন করে অতিশয় টেলিফোন,
কখনও সংবাদপত্র কিংবা রেডিওর মারফত।
কোনও-কোনও আত্মীয়স্বজন যারা অতি
সাধারণ, নামের জৌলুসহীন, আড়ালেই থাকে।
লক্ষ, কোটি মানুষের মতো।

কখনও কখনও আয়নায় নিজের চেহারা দেখে
সহসা চমকে ওঠে। এই আমি আজ
আমার আপনজনদের মাঝে হেসে, খেলে
থাকি; একদিন আচানক মুছে যাব
ধুলো-তখন সত্তা, পদ্য এবং আপনজন-সবই
শুধু অর্থহীন, হাহাকার!

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অত্যন্ত অস্পষ্ট থেকে যায় – শামসুর রাহমান

অক্ষর সাজিয়ে আমি অক্ষরের রূপে মজে আছি
সারা দিনমান আজো, কত নিদ্রাহীন রাত কাটে
প্রতিমা বানিয়ে অক্ষরের। ক্যালেন্ডারময় শাদা
দেয়ালের মুখোমুখি বসে থাকি প্রহরে প্রহরে।
কখনো হঠাৎ, যেন বিদ্যুতের স্পর্শে বিচলিত,
দাঁড়াই সটান ঘুরে। দেখেছি কি হরিণের লাফ,
অথবা চিতার দৌড় নাকি বলেভিয়ার জঙ্গলে
যে গুয়েভারার কাদামাখা হাত, অস্ত্রহীন, একা,
চির অস্তাচলে! বুঝি তাই বহু দেশে এখনো তো
হয়নি প্রকৃত সূর্যোদয়; স্বাধীনতা ফাঁসিকাঠে
ঝোলে দিকে দিএক, পিঠে চাবুকের কালশিটে
দাগ নিয়ে কুঁজো হয়ে পথ হাঁটে আহত বিবেক।

অক্ষর সাজিয়ে আমি, মনে হয়, রৌদেজ্যোৎস্নাময়
স্বাস্থ্যনিবাসের মতো কি একটা স্থাপন করেছি
আমার নিজের বাম পাশে। যে যাই বলুক আজ
এমন কন্টকময় পথে সোজা শিরদাঁড়া আর
যিশুর চোখের মতো গৌরবের আভাই সম্বল
আমার এবং দ্রুত শ্মশানের আগুন নেভাই।

অনেক সুন্দর নৌকো গহীন নদীর চোরা টানে।
দূর নিরুদ্দেশে ভেসে যায়, দেখেছি কি দেয়ালের
শূন্য বুকে? মাঝে-মধ্যে নাগলতা আমাকে জড়িয়ে
ধরে আর অন্ধকারে স্বপ্নের মতই নিরিবিলি
আলখাল্লা কম্পমান। আয় তুই আমার হৃদয়ে।
ব’লে গাঢ় কণ্ঠস্বর আমাকে স্বপ্নের শুভ্রতায়
ডাকেন মৌলানা রুমি নাকি হো চি মিন, বোঝা দায়;
স্বপ্নে কিছু স্পষ্ট কিছু অত্যন্ত অস্পষ্ট থেকে যায়।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অথচ তোমার মধ্যে – শামসুর রাহমান

ছায়াতেই থেকো তুমি, বাইরে যেও না। ইদানীং
রোদ্রে বড় বেশি আঁচ, উপরন্তু পাজীর পা ঝাড়া
এ সময়, কী বেয়াড়া লোকজন। এ পাড়া ও পাড়া
সর্বত্র লুটেরা ঘোরে, আর কত যে পার্টি মিটিং,
বশ্‌ম্বদ, কবন্ধ তো বটে, চলে বিরামবিহীন।
আড়ালে থাকবে তুমি নির্বিবাদে, কোমল রাত্তিরে
বলবো তোমার কানে কানে কথা, জোনাকির ভিড়ে,
মল্লিকার কাছে যাবো, স্বপ্ন-মসলিনে হবো লীন!

অথচ তোমার মধ্যে কী-যে এক বিদ্যুৎ চমক
খেলে যায় বারংবার, বুঝি তাই গোলাপে, জবায়
খোঁজো তুমি জীবনের ভিন্নরূপ, চিরচেনা ছক
ছেড়ে সহজেই চলে আসো, বলো আমার উদ্দেশে-
থাকবো তোমারই পাশে রৌদ্রদগ্ধ পথে, যাবো ভেসে
জাগর জোয়ারে দীপ্র, যাবো রুদ্র মিছিলে, সভায়।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

 

অথচ নিজেই আমি – শামসুর রাহমান

একদিন সন্ধ্যেবেলা ফ্ল্যাটে ফিরে দেখি
থমকে-দাঁড়ানো অন্ধকার বারান্দায়
দাঁড়ের সবুজ টিয়ে পাখিটার ঘাড় কী নিখুঁত
মটকে পালিয়ে যাচ্ছে একজন লোক, তাকে খুব চেনা চেনা
লাগল আমার। কিছুদিন
শুধু সবুজাভ ছোপ চারপাশে বারংবার ভেসে
বেড়াল আমাকে ঘিরে। খুন হয়ে যাওয়া টিয়েটার
কথা ভেবে মন ভারি খারাপ থাকল কিছুকাল।
এই তো সেদিন
মাঝ রাত্তিরের বুক শিল্পিত আঁচড়ে চিরে চিরে
বিলায়েত খান
ক্যাসেটে নিশুত দরবারি কানাড়া হচ্ছেন ক্রমে,
হঠাৎ আমার পোষা বেড়ালের, যে আমার
চেয়ারে শয্যায় আর কখনো সখনো
লেখার টেবিলে ঘুমে থাকে, কান্না শুনে
ছুটে গিয়ে দেখি গলা টিপে আক্রোশে মারছে একজন
লোক, হাতে নাতে তাকে ধরে ফেলতেই
সে তাকাল আমার চোখের দিকে, ওর চোখ দুটো
দেখে ভয়ে পেছিয়ে গেলাম
তিন হাত। লোকটা নিহত বেড়ালের
শব ঝুল বারান্দায় ফেলে
চলে গেল অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে। বাষ্পাকুল চোখে
সে রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকলাম
উঠোনে মাটির নিচে নিষ্প্রাণ বেড়ালটিকে
গুপ্তধনের মতন চুপিসারে
গচ্ছিত রাখার পর।
অন্যদিন আমার সবচেয়ে প্রিয় দেশ-বিদেশের
কবিতার বইগুলো দিয়ে
সাজালো জ্বলন্ত চিতা সেই একই লোক। অসহায় চক্ষুদ্বয়
অসহ্য আটকে থাকে ভস্মীভূত অক্ষরমালার দিকে, যেন
অপরূপ একটি সভ্যতা লুপ্ত হলো
আমার চোখের নিচে ঘটা করে। কেমন নিশ্চুপ বসে থাকি
পোড়া গন্ধময়
একলা ঘরের মধ্যে অতিশয় বিস্ফোরিত চোখে।

আকাশ যাচ্ছিল ভেসে চাঁদের যৌবনে আর আমি
ছিলাম নিবিষ্ট ঝুঁকে লেখার টেবিলে।
অকস্মাৎ অমাবস্যা গ্রাস
করে আকাশকে, সে লোকটা
বলা কওয়া নেই
ঘরে ঢুকে আমার নিজস্ব কবিতার খাতা কেড়ে
নিয়ে কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে
সবগুলো পাতা, তার ক্রূর ক্রিয়াপরায়ণ হাত
থেকে খাতা ছিনিয়ে নেয়ার
সাহস হলো না, আমি শুধু নির্বাসিত
কবির মতন
অশ্রুপাত করি ধু-ধু বিদেশ বিভুঁইয়ে।

পড়েছি ভীষণ ধন্দে লোকটাকে নিয়ে; একে একে
আমার সকল প্রিয় বস্তু নষ্ট করে
সে এখন ভয়ানক উল্লাসে প্রমত্ত আর আমি নামহীন
আতঙ্কে সেঁধিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর ক্রমাগত। মনে হয়,
যে কোনো মুহূর্তে এসে লোকটা আমার
মুখের ভেতর ঠেসে দেবে অসংখ্য ঘুমের বড়ি। বড় ভয়ে
ভয়ে থাকি, হে দীপিতা, যদি
আমাদের আর দেখা না হয় কখনো কোনো দিন।
পদধ্বনি শুনি, কার? লোকটা কি আসছে আবার? রোমকূপ
কাঁটা হয়; অথচ নিজেই আমি বানিয়েছি তাকে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অথচ বেলা-অবেলায় – শামসুর রাহমান

রাতে চাঁদটা হঠাৎ যেন বেজায়
বেঁকে বসল। বলা যেতে পারে, মেজাজ তার
হয়তো
অকারণেই বিগড়ে গেছে। হয়তো
এখনই সে ছিটকে মিলিয়ে যাবে জলের ঢেউয়ে।
হঠাৎ আকাশটাকে কেন যেন বেখাপ্পা
ঠেকছে। বস্তুত যেন আকাশকে কেউ ভীষণ
চড় কষিয়ে তার সৌন্দর্যকে নির্দয়ের ধরনে
ধ্বংস করে ফেলেছে। যে-জলাশয় আমার অনেক
সময়কে সাজিয়ে দিয়েছে বিচিত্র সব
চিত্রের আবদানে তার এই বর্তমান চেহারা
কেন জানি আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছি না।
কোনও মুহূর্তেই। এই জলাশয় ছুঁতে পারছি না কিছুতে।
তবু কেন যেন আমি প্রায়শ এই জলাশয়ের
কাছে চলে যাই কখনও ভোরবেলা, কখনওবা
জ্যোৎস্নারাতে; কখনও কখনও ছুঁই তার করুণ
জলরাশি। কিছুতেই তার আকর্ষণ পুরোপুরি ছুড়তে
পারি না বাতিলের নর্দমায়। এত অপছন্দের পরেও
তার দিকেই তাকাই তাকে এত আকর্ষণীয় কেন যে
মনে হয়!
ভাবি কখনও আর যাব না কিছুতেই
সেই বিচ্ছিরি জলাশয়ের কাছে নষ্ট করতে
সময়। কী লাভ ক্ষণে-ক্ষণে বেহায়া ব্যাঙের
লাফ দেখে, পচা জলরাশির দুর্গন্ধ শোঁকা?
প্রতিজ্ঞা করি কখনও এদিকে পা ফেলব না কিছুতে,
অথচ বেলা অবেলায় চ’লে আসি; শুনি বাঁকা হাসি!

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অদৃশ্য ছোরা – শামসুর রাহমান

পর্যটনে কেটেছে সময়; হেঁটে হেঁটে কায়ক্লেশে
নিঃসঙ্গ ধূসরপ্রান্তে এসে গেছি। বসে থাকি একা,
অতীতের হাত কাঁধে, আমার চোখের জ্যোতি নিভে
যেতে চায়। সম্প্রতি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিশুত
রাতের গহন বাণী অক্ষরের আড়ম্বরহীন
আয়োজন ধরে রাখি। প্রাতঃকালে আকর্ষণ কমে
রচিত বাক্যের প্রতি। যেন আমি সম্পর্ক রহিত
কবিতার সঙ্গে, ছন্নছাড়া আচরণে মেতে থাকি

কিছুক্ষণ, স্বাভাবিক মানুষের মতো পুনরায়
সমাজে প্রবেশ করে সমাজের বাইরের কেউ
হয়ে যাই খোলা আকাশের নিচে কিংবা বন্ধ ঘরে।
ভয়ঙ্কর চাদর আমাকে ঢাকে, অদৃশ্য ছোরার
ফলা থেকে রক্ত ঝরে, লুট হয় আমার নিঃশ্বাস;
খাতার পাতার সব অক্ষরে শোণিত চিহ্ন ফোটে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অনেক শতাব্দী জুড়ে – শামসুর রাহমান

অনেক শতাব্দী জুড়ে প্রতিক্ষণ আমার হৃদয়
বস্তুত স্পন্দিত হচ্ছে তোমার জন্যেই। বিষণ্নতা
প্রত্যহ আমাকে ঘাট থেকে ঘাটান্তরে নানা কথা
জপিয়েছে, চেয়েছে ফেলতে মুছে ধ্যানের সময়,
যাতে ভুলে থাকি তোমাকেই, তবু আমি সুনিশ্চয়
ভ্রমের গোলকধাঁধা আর বহুরূপী বিরূপতা
উজিয়ে বিস্ময়ে দেখি গোধূলিতে তুমি অবনতা
বঙ্গোপসাগর তীরে আমার জন্যেই, মনে হয়।

কখনো মহেঞ্জোদারো অথবা কখনো মথুরায়
ছিলে, পায়ে মল বেজে উঠতো মধুর নিশাকালে,
কখনো সমরখন্দে, কখনো বা বোখারায় জানি
সুরতের রোশ্‌নি তোমার শায়েরের তারানায়
ঝলসাতো বারবার। কখনো বাংলার মত্ত খালে
বাইতে মহুয়ারূপে আমারই উদ্দেশে তরীখানি।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অন্ধকার থেকে আলোয় – শামসুর রাহমান

মধ্যরাতে কোনার ছোট ঘরে টেবিল ল্যাম্প
জ্বলতেই আমার কলম বিরক্তিতে
বেজায় খুসখুস করতে লাগল
ডান হাতের তিন আঙুলের চাপে।
কলমটিকে যত রাখতে চাই টেবিলে
ততই যেন ওর জেদ চেপে যায়, সরে না
কিছুতেই। কে যেন জেদ ধরেছে
শূন্য পাতাটি ভ’রে তুলবেই অক্ষরে।

যতই কলমটিকে লুকিয়ে রাখতে চাই চোখের
আড়ালে টেবিলের ড্রয়ারে, কিছু
বইপত্রের নিচে কবর দিয়ে তত বেশি লাফিয়ে
ওঠে সে আমার হাতে। মুচকি হাসে যেন বেজায়
পেয়েছে মজা। কলমের কাণ্ড দেখে হাসব
নাকি কাঁদব ঠিক করা মুশকিল ভীষণ। মনে হল,
অদূরে গাছের ডালে এক হলদে পাখি আমার
দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে কৌতুকী হাসি।

পাখিটি কি ভাবছে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া লোকটা
জীবনের প্রায় শেষ সীমানায় পৌঁছে ভীষণ
হাবুডুবু খাচ্ছে? গাছতলায় এসে গলায়
দেবে কি দড়িঃ কে জানে? আবার আনন্দের
কত মেলা বসে নানা দিকে আলোর ফোয়ারা ফোটে।
এই তো আরও আচানক দিগ্বিদিক যুবক, যুবতী
জ্বলজ্বলে নিশান কাঁধে নিয়ে হতাশার তিমির
তাড়িয়ে বালক, বালিকা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধার মুখে ফোটায় হাসি।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অন্ধকারের কেল্লা হবে বিলীন – শামসুর রাহমান

তা হলে আমি কি আমার একালা ছেড়ে একলা
কোথাও চলে যাবো? বহুদূরে
খোলা মাঠে কিংবা উপবনে? গাছপালা দেখে,
পাখির গান শুনে কাটিয়ে দেবো সারা বেলা?

এভাবেই কি মানুষের মুখ না দেখে প্রকৃতির
সৌন্দর্যে মজে থাকতে পারবো ? কী ক’রে আমার
ছয় বছরের দৌহিত্রীর মুখ না দেখে থাকবো
বহুকাল? না, এই শহরের ভিড়ভাট্টা, চুরি-চামারি, ডাকাতি
যতই হোক এই স্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও।
ভুলেও কোনও আস্তানা বাঁধবো না কখনও।

কখনও কখনও ক্লান্তির সবগুলো নাছোড়
আঙুল চেপে ধরে গলা রাত দুপুরে,
যখন আমি তখনকার মতো লেখার পাট চুকিয়ে তিমিরে
শয্যায় আশ্রয় খুঁজি। দম বন্ধ হয়ে আসতে

চায়; উঠে বসে স্যুইচবোর্ড হাতড়াতে থাকি। সাইচ
চকিতে আঙুলের দখলে আসে, আলোকিত হয় কামরা।

কে বা কারা আমার পথে বিস্তর কাটা বিছিয়ে
আমাকে রক্তাক্ত দেখে বিকট
ভঙ্গিতে নাচতে থাকে, ছড়া কাটে, থুতু ছিটোয়
আমার দিকে। নিশ্চুপ আমি হেঁটে যেতে থাকি উঁচিয়ে
মাথা অন্য কোনওখানে। অন্ধকারের কেল্লা নিশ্চিত
একদিন সুশীল, সুগঠিত, বিশাল মিছিলের স্লোগানে হবে বিলীন।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অভিমানী বাংলা ভাষা – শামসুর রাহমান

মানুষের অবয়ব থেকে, নিসর্গের চোখ থেকে
এমনকি শাকসব্জি, আসবাব ইত্যাদি থেকেও
স্মৃতি ঝরে অবিরল। রাজপথ এবং পলাশ
যখন চমকে উঠেছিলো পদধ্বনি, বন্দুকের
শব্দে ঘন ঘন, স্মৃতি নিজস্ব বুননে অন্তরালে
করেছে রচনা কিছু গল্প গাথা, সত্যের চেয়েও
বেশি দীপ্র। কান্তিমান মোরগের মতো মাথা তুলে
কখনো একটি দিন দেয় ডাক, পারিপার্শ্ব দোলে,
মানুষ তাকায় চতুর্দিকে, কেউ কৌতুহলে, কেউ
গভীর তাগিদে কোনো, যেন কিছু করবার আছে,
সত্তার চাঞ্চল্য আসে । করতলে স্বপ্নের নিভৃতে
স্বপ্ন জাগে, প্রত্যেকটি পথ কেমন উত্সব হয়।
মনে পড়ে, দিকচিন্হ, গেরস্থালি, নক্ষত্র দুলিয়ে
অভিমানী বাংলা ভাষা সে কবে বিদ্রোহ করেছিলো ।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

 

অভিলাষ – শামসুর রাহমান

লোকটা ক্ষয়েছে খুব, বেশিদিন বাঁচবে না আর,
বড় জোর টিকে যাবে দু’তিন বছর। ঘুণ ধরা
ফুসফুস নিয়ে পথ হাঁটে, পুরনো কালের ঘড়া,
মেঘের, হাওয়ার সঙ্গে কথা বলে এবং পাহাড়
সহজে ডিঙিয়ে যায়, নদী পার হয়, দীর্ঘ রাত
জেগে পদ্য লেখে ভাবে কাগজের বুকে হীরে
জ্বলজ্বল করে; লোকে তাকে উপেক্ষার রুক্ষ তীরে
ঠেলে দেয়, কাটে তাকে বার বার কষ্টের করাত।

ভীষণ কেউটে তার নিকটেই থাকে, তোলে ফণা,
খেলা করে বৃক্ষতলে, নদীতীরে। ব্যাপক মড়ক
চেটে নেয় খর জিভে মেধা ও মনন, ওড়ে ছাই
সভ্যতার; খৃষ্টের মাথার জ্যোতিমণ্ডলের কণা
মৰ্চে-পড়া, লোকটা নিভৃতে বলে, ‘হে দীপ্র হীরক,
ও বৃক্ষ ও নারী আমি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে চাই।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অভিশাপ দিচ্ছি – শামসুর রাহমান

না আমি আসিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই, তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা পুঁতেছিল
আমাদেরই আপন জনেরই লাশ দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।

ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,

অভিশাপ দিচ্ছি প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে দশ হাত দূরে সর্বদাই।

অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।

অভিশাপ দিচ্ছি স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এ পাড়া ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না চিনতে কখনো;
অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা। প্রেতায়িত সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি…
অভিশাপ দিচ্ছি,….
অভিশাপ দিচ্ছি….

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অমন তাকাও যদি – শামসুর রাহমান

অমন তাকাও যদি একবিন্দু অনন্তের মতো চোখ মেলে,
আমি বারবার
তোমার দিকেই ছুটে আসবো প্রত্যহ।
যেখানে তোমার দৃষ্টি নেই,
তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না যেখানে কেনোদিন
সেখানে কী করে থাকি?
তোমাকে দেখার জন্যে আমি
যশের মুকুট
ছুঁড়ে দেবো ধূলায় হেলায়, তাকাবো না ফিরে ভুলে
কস্মিনকালেও আর। মেনে নেবো হার, এই খর
মধ্যাহ্নেই হয়ে যাবো স্বেচ্ছায় সূর্যাস্ত; জেনে রাখো,
তোমাকে দেখার জন্যে বেহেস্তী আঙুর আর কয়েক ডজন
হুরীর লালচ আমি সামলাতে পারবো নিশ্চিত।
তোমার নিদ্রার ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাবো বেয়ে ছিপ নৌকো
এবং লাফিয়ে প’ড়ে তোমার স্বপ্নের তটে আবিষ্কারকের
মতো দেবো পুঁতে
আমার নিঃশ্বাসে আন্দোলিত এক পবিত্র নিশান।
কখনো নিদ্রার রাজপথে, কখনো-বা জাগরণে
বাগানে কি পার্কে
সড়কে ট্রাফিক দ্বীপে, বাসে
গোলাপ শ্লোগান হাঁকে একরাশ, উড়ন্ত কপোত
অকস্মাৎ দিগ্বিদিক লুটোয় নিষিদ্ধ
ইস্তাহার হ’য়ে,
পড়ি, ‘নরকেও ভালোবাসা ম্যানিফেস্টো হিরন্ময়।
অমন দাঁড়াও যদি নিরিবিলি পা রেখে চৌকাঠে,
সমর্পণ করতে পারি আমার সমস্ত আয়ুষ্কাল
তোমারই আঁচলে।
যদি পাপ তোমার শরীর হ’য়ে নত নয়, হয় উন্মোচিত,
দ্বিধাহীন তাকে খাবো চুমো গাঢ়, বাঁধবো ব্যাকুল আলিঙ্গনে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অর্ফিয়ূস – শামসুর রাহমান

কোথায় ফেলেছি বীণা, মনে নেই। মোটর বাইকে চেপে
দূটো মূর্তি দ্রুত ছুটে যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
আহত তরুণ কবি। আমি আর গেরস্তের ঘরে
পারিনা থাকতে, ছুটে যাই, চতুর্দিকে আসে ব্যেপে
লোকজন, আসবাবপত্র তছনছ আর কেঁপে
ওঠে রাজপথ, গূঢ় রহস্যের সচকিত স্তরে
হেঁটে যায় কে মোহিনী, গুহাহিত ক্ষুধিত প্রস্তরে
বারবার এলোমেলো মাথা কুটি কী কৃষ্ণ আক্ষেপে।

আমার ইউরিদিকে হাসপাতালের কাছে এসে
মূর্ছা যায়, বীণা একপাশে মৃত পাখির মতন
পড়ে আছে। ইউরিদিকের চেয়ে বেশি ভালোবেসে
মৃত্যুরই গেয়েছি গান। নইলে কেন তাকালাম ফিরে?
এলোকেশী নারীসংঘ এসে আমাকে আক্রোশে ছিঁড়ে
ফেলে; দর্পণেরে করি আলিঙ্গন, স্বচ্ছ আলিঙ্গন।

 

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অলীক আশার বাণী – শামসুর রাহমান

অলীক আশার বাণী শোনাতে আসি নি। গেছি ভুলে
সেই মায়াবৃক্ষ, আশা যার নাম; টুপ টাপ ফল
পড়বে না, যত ইচ্ছে ঝাঁকি দাও। যা-কিছু সম্বল
জমেছিল পুরুষানুক্রমে গ্যাছে সবই, মর্মমূলে
দুর্মর কীটের বাসা; আত্মা বন্দী কুহকিনী-চুলে।
সঙ্গীরা খোঁয়াড়ে তৃপ্ত; ড্রাগ-অয়াডিক্টের আচরণ
কী ক’রে দখল করে সবাইকে? কোথায় শরণ
নেব আজ? থাকবো কি হরদম শূন্যতায় ঝুলে?

সবখানে চন্দ্রবোড়া, শঙ্খিণী, দাঁড়াশ; পথ নেই
পালাবার; পক্ষীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে মেঘে
উড়ে যাবে? রূপকথা শুয়োরের ক্লিন্ন চোয়ালেই
জীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। দিনরাত্রি চরম উদ্বেগে
কন্টকিত; দশদিকে শুধু মধ্যযুগের বিস্তার,
এরকম ব্যাপক সংকটে নেই কারুরই নিস্তার।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অশনি সঙ্কেত – শামসুর রাহমান

চাঁদের আংশিক ক্ষয় আর নক্ষত্রের ত্রস্তরূপ
দেখে বুড়ো শিরিষের ডালে রাতজাগা প্যাঁচা বলে
‘কবি আর বুদ্ধিজীবী হননের কাল ফের শুরু
হলো বুঝি! জেনেছি, সদর স্ট্রিটে ক’জন সন্ত্রাসী
ক্রোধে জ্বলে একজন দীপ্ত বুদ্ধিজীবীকে শাসায়
সতেজ জীবনকে প্রাণহীন ধূলায় লুটিয়ে দেবে
বলে ক্ষিপ্র বুলেটে, আরেকজন অপহৃত হতে
হতে কোনোমতে জীবনের কণ্ঠলগ্ন থেকে যান।

কী কসুর তাঁদের? বস্তুত যারা অন্যের ভিটায়
প্রায়শ চড়ায় ঘুঘু, ছড়ায় আন্ধার চতুর্দিকে
শহরকে জঙ্গল বানাতে চায় ক্রুরতায় মজে,
ওদের বিপক্ষে দৃঢ়চিত্ত কবি আর বুদ্ধিজীবী
আমজনতাকে বাগানের, অন্ধ হুয়ো নয়, নীল
সমুদ্রের স্বপ্ন আর ঠিক পথ দেখান সর্বদা।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অসামান্য তিথি – শামসুর রাহমান

অনেক বছর আগে আমি ভালোবেসেছিলাম যাদের
তারা আজ অতিশয় আবছা বিবর্ণ ফ্রীজ শটে।
অকস্মাৎ কোনো কোনোদিন ওরা স্মৃতির নিকটে
চাঞ্চল্য প্রার্থনা করে গূঢ় ইন্দ্রজালে শরীরের
খুব কাছে এসে। অশরীরী ছায়ার মতন ফের
করে ব্যবহার নিমেষেই। দৃশ্যপটে কী-যে ঘটে,
ওরা মিশে যায় বায়ুস্তরে; শোনো, বলি অকপটে
চিরদিন কিছু ছায়ামোহ থেকে যায় মানুষের।

কিন্তু তুমি ছায়া নও, নও তুমি অশরীরী কেউ
তোমার বেদেনী-চোখ, ক্ষীণ কটি আর স্তনভার
নিয়ে তুমি আজো কী সজীব জ্বলজ্বলে উপস্থিতি।
যেখানেই থাকো, যতদূরে বিস্মৃতির ক্রুর ঢেউ
তোমাকে সরিয়ে নিতে পারে না কখনো; বারবার
ফিরে আসে আমাদের কী মদির অসামান্য তিথি।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অসিত উত্থানে – শামসুর রাহমান

চতুষ্পার্শ্বে যাচ্ছে শোনা মুহুর্মুহু পিশাচের হল্লা,
ওদের শরীরে পচা মাংসের উৎকট গন্ধ, বুনো
অন্ধকারে পদশব্দ এলোমেলো, ক্ষুধার্ত শকুনও
পালায় সে দৃশ্য দেখে; অতিশয় সন্ত্রস্ত মহল্লা।
প্রতিটি মুহূর্ত কাটে, যেন কোনো ভীষণ দস্তুর
নেকড়ে ছিড়ছে খরগোশ। সর্বব্যাপী ভয়ংকর
অসিত উত্থানে বুঝি না কে শত্রু মিত্র কেবা।
খর ছলনায় খল মাতে, হতবুদ্ধি বান্ধবও জন্তুর

মতোই আমার দিকে আসে ধেয়ে। আজ ছদ্মবেশ
করেছি ধারণ, নইলে আত্মরক্ষা দায়। প্রেমিকার
সঙ্গেও ট্রাজিক চতুরালি চলে, বোঝে না সে কারা
ক্রীড়নক বানিয়েছে ওকে, তার রুক্ষ এলোকেশ
ভাসবে নদীর জলে, ভাঁড় হবে মুক, আমি পরিখার
পাশে করোটির সঙ্গে জুড়বো আলাপ দিশেহারা।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অসুখ – শামসুর রাহমান

অসুখ আগেও ছিল, কিন্তু আজকাল কষ্ট হয়
খুব, নষ্ট হয় ক্ষয়া শরীরের স্থিতিস্থাপকতা
প্রায়শই। বৃদ্ধ কবিরাজ আয়ুর্বেদীয় ধারায়
ওষুধ দিলেন, যাতে ফুসফুস থাকে ঠিকঠাক।
কৌটো যত্নহীন এক কোণে পুরু ধুলোময়তায়
ঝিমায়, কবিতা আসে অমাবস্যার রাতে, শুষে নেয়
মেদমজ্জা, গড়ে থাকি অবসন্ন; অক্ষয়ের দ্যুতি
পূর্বস্মৃতি হঠাৎ জাগিয়ে তোলে, বাড়ে অসুস্থতা।
নিজের কবিতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়ার সাধ আজ
স্তিমিত, এমনকি বন্ধুর কাছেও পদ্য টদ্য |
এগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা বনবাসে গেছে। যতদিন
আয়ু জ্বলে ধিকি ধিকি, ততদিন অন্তরালে বসে
কবিতার মুখ দেখে নিতে চাই গোধূলি বেলায়,
মধ্যরাতে, সভা সমিতিতে গরহাজির থাকব।
খারাপ ভাবছ বুঝি? এখন কী করি আর? এই
অসুখের ধরণই এমন করে কর্তব্যবিমুখ।

 

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অসুস্থ ঈগল নীলিমায় – শামসুর রাহমান

অসুস্থ ঈগল নীলিমায় তার পক্ষ বিস্তারের
স্মৃতি নিয়ে যেমন অনেক নিচে সময়ের ভার
ব’য়ে চলে, ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে দূর নীলিমায়র
দিকে দ্যাখে মাঝে মাঝে, কখনোর পাহাড়ের
চড়ার সৌন্দর্যভাবে, তেমনি আমিও হাহাকারের
প্রতিমূর্তি হয়ে রুক্ষ ধুলায় ছিলাম পড়ে ধার
ছিলোনা অস্তিত্বে প্রায়, আতংকিত বিধ্বস্ত ডানার
প্রতিটি পালকে চিহ্ন নিষাদের ক্রুর প্রহারের।

সহসা ধুলায় কী সুন্দর ফুলের সম্ভার জাগে,
আর রুক্ষ কৃষ্ণপথে বসন্তবাহার মুখরিত,
তোমাকে দেখেই রোগা ঈগলের আর্ত চক্ষুদ্বয়
যৌবনের মতো জ্বলজ্বলে হয়, দীপ্র অনুরাগে
বুকের ভেতর হ্রদ দুলে ওঠে, পুনরায় ভীত
সন্ত্রস্ত সত্তায় তার উদ্ভাসিত বাঁচার বিস্ময়।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই – শামসুর রাহমান

কস্মিনকালেও অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই।
না ছোরা, না ভোজালি, না সড়কি না বল্লম
না তলোয়ার না বন্দুক-
কোনা কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার।
আমি মারমুখো কোনো লোক নই।
বালক বয়সেও আমি কোনো ফড়িং-এর
পাখনা ছিঁড়িনি,
প্রজাপতিকে আলপিন দিয়ে
আটকে রাখিনি কাগজে।
কখনো উড়ন্ত কিংবা গাছের ডালে বসে-থাকা
কোনো পাখির প্রতি তাক করিনি
বন্দুকের চকচকে নল।

ছায়াময় আশ্রয়ে সময়-পোহানো
পাখি,
বিকেলের আবীর মেখে দাঁড়ানো তন্বীর মতো
গাছ,
পলায়নপর সূর্যের চুমো-খাওয়া
নদী,
ইতস্তত ছড়িয়ে-থাকা খুচরো সিকি আধুলির মতো
তারা,
প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাষায়
গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে শান্তির পাঁচালিতে।
দুই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
আমি কান পাতি গোলাপ আর চন্দনের ব্রতকথায়।
যতদূর মনে করতে পারি,
কোনোদিন আমার ওষ্ঠ অস্ত্রবন্দনায়
স্ফুরিত হয়নি।
কিন্তু আমার ঘরে কেউ আগুন দিতে এলে,
আমার ভায়ের বুক কেউ বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলে,
আমার বোনের রওশন চৌকি
কেউ তছনছ করে দিতে এলে,
নিরস্ত্র আমি নিমেষে হয়ে উঠি দুরন্ত লড়াকু।

আমার লড়াইয়ের রীতি
নদীর ফেরীর মতো; ফুল আর সুরের মতো
পবিত্র।
আমার কোমর কালো বেল্টে শোভিত হোক আর নাই হোক,
শেষ অব্দি লড়ে যাবো
অস্ত্রের প্রশ্রয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন।
না ছোরা, না ভোজালি, সড়কি না বল্লম,
না তলোয়ার না বন্দুক-
কিছুই নেই আমার,
এই আমি নিজেই আমার অস্ত্র।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আকাশ আসবে নেমে – শামসুর রাহমান

বিচলিত হয়ো না এখন, স্থির হও সমুদ্রতলের
মতো, ধাক্কা খাবে, খেতে হবে বহুদিন, ভেঙচি
কেটে চলে যাবে বহু লোক, কেউ কেউ
হানবে আঘাত, সয়ে যাও সবকিছু ধৈর্য ধরে।

তোমার হৃৎপিণ্ড ঠুকরে ঠুকরে খাবে বিশাল শকুন,
খেতে দাও; এরকমই হয় চিরদিন,
পাথরে থাকবে বন্দি তুমি বহুকাল। কেননা তোমার কাছে
মুক্তিবাণী আছে, বয়ে যাও যন্ত্রণার শুরুভার হে নীরবে।

দেবতারা খুব ঈর্ষাকাতর তোমার সাহসের
দীপ্তি দেখে, তোমাকে পোড়ায় তাই উহাদের ক্রোধা
এভাবে পুড়তে হবে দিনরত্রি, জ্যোৎস্নার প্রলেপ
সহজে পাবে না তুমি মরবার আগে।

বিচলিত হয়ো না এখন, গলা ছেড়ে গাও গান
প্রহরে প্রহরে, পাখি আর লতাপাতা কীট পতঙ্গ শুনুক
কী অমর্ত্য সুর বাজে মর্ত্যবাসীর গলায় বেদনায়;
আকাশ আসবে নেমে শৃংখলিত দু’পায়ে তোমার।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আকাশ এমন দ্রুত কেন কালো – শামসুর রাহমান

আকাশ এমন দ্রুত কেন কালো হয়ে
গ্রাম আর শহরের অধিবাসীদের
ভীষণ কাঁপিয়ে দিচ্ছে? দৃষ্টি জুড়ে
কী দেখছে তারা আকাশের কালিমায়? ঝাঁক ঝাঁক
ঢের কালো দীর্ঘদেহী শকুন উড়ছে কাঁটাময়
অনাহারে হিংস্র ওষ্ঠ নিয়ে। ওরা ছিঁড়ে খেতে চায়
পথে-হেঁটে-যাওয়া আর বারান্দায় দাঁড়ানো অনেক
নারী পুরুষকে যেন। অকস্মাৎ একত্রে সবাই
লাঠিসোঁটা আর কেউ-কেউ স্টেনগান নিয়ে খুনি
পাখিদের মেরে প্রিয় শহরের আর গ্রামের বাশিন্দা মিলে
তাড়াল নিমেষে দূরে অজানায়। শান্তি এল ফিরে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আকাশে অনেক মুখ – শামসুর রাহমান

এ কেমন সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমার
প্রিয় এই শহরকে আজ। চতুর্দিকে
গুঁড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। নরনারী, শিশুদের
বুকফাটা কান্নায় কাঁপছে পথঘাট, গাছপালা।

এই তো নিজেকে আমি ইট, পাথরের
স্তূপ থেকে আহত শরীর তুলে দেখি আশেপাশে,
সবদিকে অগণিত লাশ, কোনও কোনও
স্থানে ভাঙা পুতুল-জড়ানো হাতে নিষ্প্রাণ বালিকা।

আমাদের ছোট ঘরবাড়ি খুঁজে খুঁজে
আখেরে অধিকতর ক্লান্ত শরীরে অজানা
জায়গায় ভগ্নস্তূপে বসে পড়ি। হঠাৎ সমুখে
একটি ধূসর খাতা দেখে দ্রুত হাতে তুলে দিই।

আবিষ্কৃত খাতার প্রথম দুটি পাতা
গায়েব হলেও অবশিষ্ট বেশ কটি পাতা জুড়ে
রয়েছে কবিতা, সত্যি বলতে কী, কতিপয় পদ্য
পড়তেই উদ্ভাসিত প্রকৃত কবির পরিচয়।

কখন যে রাত ওর কোমল শরীর
নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, অদূরে গাছের
পাতাময় ডাল থেকে পাখির নিঝুম গান ঝরে
জ্যোৎস্নার ধরনে। ভেসে ওঠে আকাশে অনেক মুখ।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

সর্বত্র সে আগন্তুক – শামসুর রাহমান

বুঝি না কেন যে কোনও কোনওদিন মনে হয়, যেন
বহুকাল পর ফিরে এসেছি নিজেরই
নিবাসে বেগানা আগন্তুক একজন। এটাই কি
ঠিক বাড়ি? ভুল করিনি তো? দ্বিধান্বিত
বাজাই কলিংবেল; মনে হ’ল কাজের লোকটি
গেট খুলবে কি খুলবে না, ইতস্তত করছিল।

আখেরে আমার পরিচিত কেউ ভেবে
প্রবেশাধিকার দেয় আমাকে নীরবে। যারা ছিল
আমার আপনজন, তারা এল চোখে মুখে নিয়ে
সংশয়ের ছায়া, ওরা কেউ
বস্তুত চেনে না এই অতিথিকে, যদিও আমার
কোণের পড়ার ঘরে ঢোকার আবছা
অনুমতি দেয় ইশারায়। এই যে চেয়ার, এই
লেখার টেবিল, বই, খাতা
আমারই তো? না কি অন্য কারও? বুক শেলফ
থেকে বই টেনে নিয়ে খুলে দেখি আমার নিজেরই
স্বাক্ষর বাদামি পাতাটির এক কোণে উপস্থিত
তারিখ সমেত আর বিষণ্ন দেয়াল যেন অশ্রুপাত করে।

এ বাড়ির সবার কাছেই
কেমন অচেনা আমি এবং আমিও
স্মৃতি বিস্মৃতির গোধূলিতে ব্যথিত দাঁড়িয়ে একা
অচেনার ভিড়ে আর দেয়ালে ঝোলানো
ফটোগ্রাফে ঐ যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে মধুর
হাসছেন, তিনিও আমাকে
অপরিচয়ের রুক্ষ বলয়ে রাখার অকম্পিত
শপথ আউড়ে চলেছেন নিত্যদিন!

এখন আপন ঘরে বই হাতে বেগানার মতো
বসে আছি, তবু মনে হয়-
ধ্বনিহীন অগণিত ভায়োলিন-বিছানো পথের
মাঝখানে থেমে দূর দিগন্তের দিকে
বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি; হঠাৎ শ্যাওলা-ঢাকা এক
পথচারী আমার নিকটে এসে জেনে নিতে চায়
জটিল ঠিকানা, নিরুত্তর
আমি শ্যাওলার ঘ্রাণে কেমন সবুজ হতে থাকি।
আমার নিজেরই কোনও ঠিক
ঠিকানা নেই যে জানা কী ক’রে বোঝাই লোকটিকে?

মুখের ভেতর নিশান্তের হাওয়া খেলা করে আর
গিলে ফেলি নক্ষত্রের কণা; বিবমিষা জাগে, বমি করি কিছু
রঙধনু-রেণু, আর বিস্তর বমিতে ভাসি, কারা
হেসে ওঠে দিকগুলি বিপুল ফাটিয়ে। আমি এই শহরের
কোথাও কাউকে আদৌ চিনি না এবং
আমাকেও হাটে বাটে ঘরে বাইরে চেনে না কেউ।

 

 

আজ কার কাছে – শামসুর রাহমান

আজ কার কাছে উন্মোচন করি আমার হৃদয়?
এই যে বাড়ির কাছে গাছপালা দাঁড়ানো সেগুলো
এখন সবুজ মনে হচ্ছে না তেমন, আকাশের
নীলিমা, নক্ষত্র আকর্ষণহারা, যে গায়ক পাখি
রেলিঙে বসলো এসে তার শিস কেমন বেসুরো
লাগে আর মহান দান্তের কাব্যগ্রন্থ ‘নরক’-এর
মাত্র দু’তিনটি পঙ্‌ক্তি পড়ার পরেই রেখে দিই,
রবীন্দ্রনাথের গানও আন্দোলিত করে না আমাকে।
এ শহর থেকে তুমি বিদায় নেওয়ার পর এই
অত্যন্ত করুণ হাল হয়েছে আমার, প্রিয়তমা।
হৈ-হৈ বইমেলা, মানুষের ভিড়, আড্ডা, মদ্যপান-
কিছুই লাগে না ভালো। একা একা থাকি, নিজেকেই
ছন্নছাড়া প্রেতপ্রায় মনে হয়। নিভৃতে হৃদয়
খুঁড়ি, ঘুরি, খুঁজি আমাদের অন্তরঙ্গ ক্ষণগুলি।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার কোনো তাড়া নেই – শামসুর রাহমান

জাভেদ, তোমাকে আমি ডাকছি এই সাতসকালে,
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে,
তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
জাভেদ তুমি টইটম্বুর বাসে
বাদুড়ের ধরনে ঝুলে যাচ্ছ।
কী দরকার ছিল এত কষ্ট করার,
পরের বাসে গেলেই তো পারতে!

তোমার কি এতই তাড়া ছিল?
আর ক’টি মিনিট
অপেক্ষা করতে পারলে না।

জাভেদ তুমি কোথায় চলেছ সবুর বিহনে?
জাভেদ, আমি তোমাকে মনে করে
অন্য কাউকে ডাক দিইনিতো? ইদানীং
এ এক দারণ মুশকিল, বুঝেছ জাভেদ,
চট্‌জলদি একজনের সঙ্গে
আরেকজনের তেমন তফাৎ
খুঁজে পাওয়া যায় না, যেমন ঝানু নিকেরির ঝাঁকায়
একটি মাছকে খুব আলাদা ভাবা যায় না।

আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি জাভেদ,
ঐ চোখ, ঐ কপাল আর ঢেউখেলানো চুল-
কী করে ভুল হবে আমার?
তুমি আমাকে, এই উনিশশো তেরাশির আমাকে
চিনতে পারনি হয়ত।
আমি কি খুব বেশি বদলে গিয়েছি?
নইলে কেন তুমি একটু
থমকে দাঁড়ালে না, করলে না অপেক্ষা? নাকি
চিনতে পেরেও

পড়ি মরি করে বাদুড়ের ধরনে
ঝুলে পড়েছ বাসের হাতলে। জিম্‌নাসটিকে
এত ভাল তুমি, আমার জানা ছিল না।

যাদের খুব তাড়া থাকে, তারা আশেপাশে
ভাল করে তাকায় না; উপরন্তু
চেনা মানুষকে ওরা অচেনা বানাতে পারে
চোখের পলকে।

জাভেদ, নিমেষের জন্যে তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে,
মনে হল। তারপর কী যে হল, পাকা অভিনেতার মতো
তুমি আমাকে না চেনার ভান করলে। আমিও সাহস করে
ছুটে যাইনি তোমার দিকে,
পাছে বিব্রত হতে হয় আমাকে।

জাভেদ, আমি তোমার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
অপেক্ষা করে থাকব।
তোমাকে দেখে আমি কারো পা মাড়িয়ে,
কাউকে গুঁতিয়ে অমন ঠেলেঠুলে
চলন্ত বাসে উঠে পড়ব না অথবা
চিনতে পেরেও বেমালুম না চেনার ভান করব না।

আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করার পারব।
আমি অপেক্ষা করতে পারি
একটি গোলাপ কুঁড়ির উন্মীলন দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
পক্ষীশাবকের প্রথম ওড়া দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
শিশুর কচি মুখের প্রথম বুলি শোনার জন্যে;
কোনো মুমূর্ষুর চোখের তারার নিভে- যাওয়া দেখার জন্যে,
কবিতার হারানো পংক্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে
আমি অপেক্ষা করতে পারি।

 

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আন্ধারে হারিয়ে পথ – শামসুর রাহমান

আন্ধারে হারিয়ে পথ বেদিশা ঘুরেছি কতকাল
জটিল অরণ্যে, গণকবরের বিরানায়; খাদে
আর চোরাবালিতে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যেতে
যেতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি। রক্তপায়ী বাদুড়ের
ডানার আঘাতে, চিতাবাঘের থাবার হামলায়
সন্ত্রস্ত ছিলাম বহুকাল। কখনো কখনো পথ
খোঁজার উদ্যম লুপ্ত হয়েছে, মোহিনী রূপে কত
ডাকিনী নিয়েছে ডেকে গুহায় সংহারে অবিচল।

হতাশায় চুল ছিঁড়ে, মাথা কুটে শ্মশান ঘাটের
কাছে, গোরস্তানে পথক্লেশে পরিশ্রান্ত ঘুমিয়েছি
সর্পিনীর ফণার ছায়ায়। অকস্মাৎ তুমি এসে
আমাকে প্রকৃত পথ দেখিয়ে সম্মুখে নিয়ে গিয়ে
বললে, দ্যাখো, আমাদের গন্তব্যের স্বর্ণচূড়া কাছে
এসে গ্যাছে, এইতো অদূরে বেজে ওঠে নহবৎ।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আবার এসেছো তুমি – শামসুর রাহমান

আবার এসেছো তুমি বৃক্ষতলে খর পুর্ণিমায়
নিঃশব্দে পেরিয়ে ডোরাকাটা পথ, শাড়ির হিল্লোল
তুলে নিরিবিলি, দেখলাম। মোহন ছন্দের দোল
তোমার সত্তায়, তুমি জোৎস্নাময় হেসে নিরালায়
চলো যাই বলে উঠে গেলে যানে, আস্তে পুনরায়
বসেছি তোমার পাশে আগেকার মতো, ডামাডোল
চতুর্দিকে, পুলিশের হুইসিল, কারো রাগী বোল
ভেসে আসে, কখনোবা রবীন্দ্রসংগীত বয়ে যায়।

জ্যোৎস্নায় তোমার চোখ খৃষ্টপূর্ব শতকের হীরকের
মতো জ্বলে, আবার তোমার হাত মাছ হয়ে খেলা
করে একাকিনী আমার এ হাতে, আমরা পরস্পর
মুখোমুখি চেয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের দুজনের
এই রাত্রি সত্য নয়। এতো কুহকের ভুল বেলা-
নিমেষেই অস্তমিত; তারপর কী শূন্য প্রহর!

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার অজ্ঞতা নিয়ে – শামসুর রাহমান

এখন মাঝরাস্তায় আমি; দমবন্ধ-করা নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালিতে,
বুকে, ঊরুতে আর
বেদেনীর ভলা যৌবন হয়ে
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠেছে আমার চারপাশে।

অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয়
এখানে কোথাও তুমি আছ, ডাকলেই
সাড়া দেবে নিমেষে। তলোয়ার মাছের মতো তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।
অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।

কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আর কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখব বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা
আর ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।

অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না, যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।

এখানে কোথাও তুমি আছ, কখনোসখনো এই বিশ্বাস
আমাকে বাঁচায়
অক্‌টোপাস-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করব যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে? উৎপীড়িত মুতাজিলা-মন
আমাকে নিয়ে গেছে সংশয়ের সৈকতে। নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে
জেনেছি জ্ঞান আমার উদ্ধার; তারই অন্বেষণে
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার
উজিয়ে চলেছি। এ জন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখির পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে চলে যাব
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার অসমাপ্ত কবিতা – শামসুর রাহমান

আকাশের কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ পাড়ার নার্সারির কচি ঘাস
চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের চোখে তৃপ্তির কুয়াশা আর গোলাপগুলি
ঈষৎ লাজনম্র আর ভয়কাতর। এখানে তোমার দৃষ্টি পড়েনি ক’দিন।
আকাশ থেকে এক অতিকায় পাখি এসে নামলে, তুমি তার জঠর থেকে
বেরিয়ে আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে। মনের চোখে দেখব তোমাকে।
তুমি কি এলে বহু যুগের স্মৃতি জড়িয়ে তোমার সত্তায়? তোমার চোখে যেন
সুদূরতার ছায়ানিঝুম আত্মপ্রকাশ। জানলার শার্সি ধরে সেই কবে থেকে
দাঁড়িয়ে আছি। ঘণ্টা দেড়েক আগে বৃষ্টি এক পশলা চুমো ঝরিয়ে
গেছে আশেপাশে দরদালানে, গলিতে, নার্সারিতে। কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ,
যেগুলি চরছিল নার্সারিতে, চিবোচ্ছিল কচি ঘাস, এখন উধাও। তুমি তোমার
ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছ মধ্যরাত্রির শয্যায়। আমার বাসনাগুলি পুরুষ
মৌমাছি হয়ে উঠছে তোমার ক্লান্ত যৌবনের মৌচাক ঘিরে, তুমি না
জেনেই ঘুমিয়ে পড়বে।

এখন আমার অসমাপ্ত কবিতা তোমাকে ভাবছে কয়েকটি সড়ক, বইয়ের
দোকান, ট্রাফিক-লাইট, মসজিদ, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান
আর সিনেমা হলের ওপার থেকে। আমার অসমাপ্ত কবিতার রঙিন মাছগুলি
ডুবসাঁতার দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তোমার মেহগলি কাঠের খাটের কিনারে
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোমল নিদ্রায় তোমার শরীর অন্যায়বিহীন আর
কী নির্মল। অন্য কোনও পুরুষের স্পর্শের কালো কখনও তোমার শরীরে
ছড়িয়েছে কি না, এ নিয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা এখন তেমন ভাবিত নয়।
সে এখন গাঢ় অনুরাগে এই নিঝুম প্রহরে তোমার অধরে, গালে, স্তনযুগলে
আর নাভিমূলে মন্দিরে পুরোহিতের মতো প্রসাদ-রেণু ছিটিয়ে দিচ্ছে অবিরল।
রাত্রির টাইম-পিসে এই মুহূর্তে কটা বাজে, খেয়াল নেই। তোমার ঘুম, একটি
রাতজাগা পাখি, হাওয়ো-মাতাল গাছ, জনহীন গলি, এতিমখানার অন্ধ নীরবতা
আমার মধ্যে কী এক অস্থিরতা ডেকে আনে। অন্ধকারের আড়ালে ঢাকা-পড়া
নক্ষত্র আর ভাসমান মেঘের গলা জড়িয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা গন্তব্যের
প্রায় সীমান্তে পৌঁছে যায়। দ্রুত হতে থাকে বুকের স্পন্দন। এই যাত্রা কে জানে
কোথায় থামবে? কোনও পুরানো কবরস্তানে নাকি নতুন কোনও পুষ্পল উদ্যানে?

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয় – শামসুর রাহমান

এখন বাইরে রাত্রি তপোক্লিষ্ট বিমর্ষ নানের
পোশাকের মতো আর সুদূর কোথাও সন্ন্যাসীর
অস্থায়ী ধুমল আস্তানায় আস্তে ঝরছে শিশির,
প’ড়ে থাকে কতিপয় চিহ্ন উদাস অন্তর্ধানের।
নিশীথ রপ্তানি করে প্রসিদ্ধ সুরভি বাগানের
দূর-দূরান্তরে, ক্লান্ত মগজের ভেতরে রাত্তির
ডোরাকাটা বাঘ, জেব্রা, ঝিলঘেঁষা হরিণের ভিড়
নিয়ে গাঢ়, শিহরিত ঘাস পুরানো গোরস্তানের।

ঘুমন্ত পৃথিবী মধ্যরাতে, আমি ধুধু অনিদ্রায়
কাটাই প্রহর একা ঘরে আর তুমি দেশান্তরে
সুখান্বেষী তোমার শরীরে মিলনের চন্দ্রোদয়;
না, আমি মানিনা এই দূরত্বের ক্রুর অন্তরায়।
যদিও দুস্তর ব্যবধান, তবু প্রতিটি প্রহরে
তোমারই শিয়রে জ্বলে আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয়।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার তৃষ্ণার জল – শামসুর রাহমান

তুমিও ফিরিয়ে নিলে মুখ কম্পিত দ্বিধায়, নাকি
ঘৃণায় গিয়েছো সরে। কতকাল, বলো কতকাল
এমন সুদূরে তুমি সীমাহীন ঔদাস্যের জাল
ছড়িয়ে থাকবে সর্বক্ষণ? আমি কী ব্যাকুল ডাকি
তোমাকেই, আজ আর এমন প্রান্তর নেই বাকি,
নেই কোন নদীতীর কিংবা পথ, অথবা পাতাল
যেখানে যাইনি আমি তোমার সন্ধানে। অন্তরাল
নিজেই করেছো সৃষ্টি, আজ আমি ভীষণ একাকী।

তোমার কার্পণ্য কেন মেনে নেবো? কেন যাবো ফিরে
ধূমল তৃষ্ণায় প্রস্রবণ থেকে জলপান বিনা?
এখনতো অন্য কেউ নগ্ন তোমার সত্তার তীরে
তুলছে ফেনিল ঢেউ নিরন্তর, তুমি সে উচ্ছল
আদিমতা বুনো অন্ধকারে উপভোগ করো কিনা
জানতে চাই না, শুধু চাই আমার তৃষ্ণার জল।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার নিঃসঙ্গ চঞ্চু – শামসুর রাহমান

জাভেদ এখন তুমি ভীষণ একাকী
আবেদনপত্রের মতন ঝুলে আছো মেঘের কেশর ধরে
জাভেদ তোমার গলা ফুঁড়ে
বেলফুল ঝরে রাশি রাশি
বুকে
বিশাল চোখের মতো ঘড়ি

জাভেদ কখনো তুমি সর্ষক্ষেতে একজন অশ্বারোহী হয়ে
সবুজ লাগাম হাতে ছুটছো কেবল
ঘোড়ার জ্বলন্ত চোখ রণধ্বস্ত শহরের নিরালা জানালা
পা দগ্ধ মিনার আর গ্রীবা
খয়েরি গীটার
তুমি সেই গীটার আঁকড়ে ধরে অতল পাতালে
যাচ্ছো স্বপ্নবৎ মাছের সন্ধানে নাকি
তার খোঁজে যে একদা কোনো মধ্যরাতে
জলকন্যা হতে চেয়েছিল

জাভেদ নিঃসঙ্গ বন্ধু হে আমার তুমি
ফিরে আসো মুঠো মুঠো হীরে জহরত
মাথায় নীলচে জলচর পাখি আর
শিশ্নে লতাগুল্ম নিয়ে তুমি ফিরে আসো
জলকুমারীর মাছরাঙা স্মৃতি তোমাকে নিয়ত ঠোকরায়

তোমার জামার নাম বিষাদ জাভেদ
ট্রাউজার বিচ্ছিন্নতা গেঞ্জি বিবমিষা
তোমার জুতার ফিতা কখনো কখনো ম্রিয়মাণ
লাউয়ের ডগার মতো ঝুলে থাকে

আকাশে একটি পাখি যেন
উড্ডীন পেরেক
তুমি সে পাখির তীক্ষ্ণ চঞ্চুর উদ্দেশে
অক্ষর ছিটিয়ে খুব নিরাসক্ত চেয়ে থাকো আর
পাখিটির বুকের ভেতর থেকে সজীব পাতার
মতো হাত চকিতে বেরিয়ে আসে তুমি সেই হাত
হাতে নিয়ে শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের
নিঃসঙ্গ চূড়ায়
ঈগলের মতো বসে আছো।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার প্রেমের মধ্যদিনে – শামসুর রাহমান

তোমার চুলের রাত্রি, শিখা-জিত আমাকে জড়ায়
গনগনে দ্বিপ্রহরে। তোমার ব্যাকুল বাহুদ্বয়
আমার বন্দর হয়, কী নিঃশব্দ, দীপ্র গীতময়
হয়ে ওঠে নিমেষেই কম্পমান তোমার অধর
আমার তৃষিত ওষ্ঠে আর ছোট ছায়াচ্ছন্ন ঘর
রূপান্তরে ছলোচ্ছল জলপুরী, থর থর তুমি
তরঙ্গিত নদী, কখনো বা গাঢ় বেদনার ভুমি,
তোমার চোখের জল আমার আত্মায় ঝরে যায়।

চুম্বনের পূর্ণতায় সত্তাময় বিষাদের সুর
বুনে দাও নিরুপায়, তুমি হয়ে যাও কী সুদূর।
আমার প্রেমের মধ্যদিনে তোমার চোখের জল
নিবিড় আষাঢ় আনে সত্তায় খরায়, অবিরল
হাওয়া বয় হৃদয়ের ঝোপেঝাড়ে। থামে সব কথা,
তোমার অধর থেকে আমাকেই ছোঁয় অমরতা।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

কখনো আমার মাকে – শামসুর রাহমান

কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।

যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর

সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।

যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমার মৃত্যুর পরেও যদি – শামসুর রাহমান

একটি পাখী রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।

পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনো তাঁর ঠোটে হয়তো গচ্ছিত।

কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো সেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।

যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।

আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমি আমার স্বপ্নগুলি – শামসুর রাহমান

আমি আমার স্বপ্নগুলি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
কৃষক যেমন চায় বাঁচাতে ধানের চারা,
পক্ষী যেমন শাবকগুলো দেয় পাহারা,
তেমনি আমি স্বপ্নগুলি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

সকল স্বপ্ন এক নাগাড়ে হয়ে যাবে ছাই?
জমি জিরেত নেইতো কিছু, আমার কাছে
নেই তো কড়ি, শুধু কিছু স্বপ্ন আছে।
সেসব স্বপ্ন এক নাগাড়ে হয়ে যাবে ছাই?

এমন বিশ্বে স্বপ্নগুলি কী করে বাঁচাই?
দাও বেচে দাও স্বপ্ন তুমি, বলছে ওরা,
‘নইলে পিঠে পড়বে হাজার হিংস্র কোড়া।
এমন বিশ্বে স্বপ্নগুলি কী করে বাঁচাই?

স্বপ্ন দেখায় তেমন কোনো নতুনত্ব নাই।
কিন্তু একলা বুকের ভেতর স্বপ্নগুলি
লালন ক’রে ঘোরা ফেরা নয় মামুলি।
স্বীকার করি, স্বপ্ন দেখায় নতুনত্ব নাই।

স্বপ্নে আছে উল্টাপাল্টা স্মরণের রোশনাই।
পাথর টাথর, গাছের পাতা, এসব নিয়ে
কে যেন এই স্বপ্নগুলি দেয় বানিয়ে।
স্বপ্নে আছে উল্টাপাল্টা স্মরণের রোশনাই।

এত স্বপ্ন করবো বলো কী করে বাছাই?
উজান ঠেলে তাদের কেবল বাঁচিয়ে রাখতে চাই!

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমি কোথায় এসে পড়েছি – শামসুর রাহমান

আমার জীবন কখন যে আচমকা
মুছে যাবে, জানা নেই। হোক না যখনই,
দৈবক্রমে যদি দুনিয়ায় ফিরে আসি
হাজার বছর পর শ্যামলীতে, তখন কি খুঁজে
পাবো এই আমার নিজের বাড়িটিকে? কিছুতেই
পড়বে না দৃষ্টিতে বিনীত সেই বাড়ি। বহুতল
শৌখিন মহল কোনও করবে বিরাজ সেই স্থানে। হয়তো-বা
আগেকার চেনা জায়গাটা, মাথা কুটে মরলেও, চিনবো না।

আমার নিজের বংশধর কেউ চিনে নিয়ে এই
আমাকে স্বাগত
জানিয়ে শ্রদ্ধাত আভা ছড়িয়ে সানন্দে বসাবে না
অপরূপ আসনে এবং
আমার দু’চোখ ভিজে যাবে কি তখন ঠিক মানুষের
মতো নয়, অথচ মানব-সন্তানের
বিকৃত ধরনের গড়ে-ওঠা জীব যেন নিয়মিত
ওঠে বসে, হাঁটে আর দরজা, জানালা বন্ধ করে, খুলে দেয়

সম্ভবত বিলুপ্ত আমার বংশধর। বৃথা আমি
উঠবো সন্ধানে মেতে তাদের কাউকে
এবং হাঁটবো ডানে বামে। প্রশ কি করবো
কখনও সখনও পথচারীদের? নিরুত্তর চলে যাবে ওরা
যে যার গন্তব্যে। প্রকৃতই আছে কি গন্তব্য কোনও?
‘নেই, নেই’ ধ্বনি শুধু কানে এসে ঝরে যায় নির্বাক ধুলায়।

এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখি শুধু পাথরের
ঘরবাড়ি, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, হায়,
নেই কোনও গাছ-গাছালির
এতটুকু চিহ্ন কোনওখানে। মাঝে মাঝে
চোখে পড়ে পাথরের মূর্তি কিছু সাজানো, গোছানো;
দোকানে পসরা ঢের, অথচ কোথাও এক রত্তি ফুল নেই।

এ আমি কোথায় এসে পড়েছি হঠাৎ? বৃষ্টিধারা
কস্মিনকালেও স্নান করিয়ে দেয় না
এই শহরকে, শুধু ধু ধু তাপে বেঁচে আছে এই
নগরের বাসিন্দারা সব, পুতুলের মতো ওরা
পারে না ওঠাতে মাথা কিছুতেই মহীয়ান
লৌহমানবের প্রিয় হুকুমবরদারদের ত্রাসে
দিনরাত। বেহেস্তে করছে বসবাস, সদা মেনে নিতে হয়।

মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখি সারাটা শরীর
ঘামে ভেজা, রাতের স্বপ্নের দানে ভীষণ কাতর হয়ে পড়ি।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা – শামসুর রাহমান


লিখি আর না-ই লিখি, প্রতিদিন কবিতার খাতা
খুলে বসি পুনারায়, তাকে
টেবিলে সযত্নে রাখি মঠবাসী সন্ন্যাসীর মতো
ব্যবহারে। কবিতার খাতা, মনে হয়,
দূর অতীতের তাম্রলিপি,
কখনো প্রবাল-দ্বীপ। কবিতার খাতাটির স্মৃতি
নিয়ে একা একা পথ হাটি সারাদিনমান, বেলাশেষে
পৌছে যাই
সে-দেশে, যেখানে আজ হরিণ হরিণ নয় আর,
যেখানে পাখিরা নয় পাখি। তবু আমি
হরিণের বর্ণিল ভঙ্গিমা,
পাখির গানের ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসি, নিয়ে আসি
কবন্ধের হাত থেকে ময়ূর-ময়ূরী।
যাবতীয় অনিন্দ্য গোলাপ, বিদ্যুল্লতাময় মেঘ,
বৃষ্টিভেজা মুখ আর মায়াবৃক্ষসহ
সেসব অর্পণ করি পুণ্যার্থীর মতো
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতাটির বুকে।


সুদূর বৃটিশ যুগে পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
রবরবা মুসলিম লীগের আমলে কত কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
বায়ান্নোর রক্তাপ্লুত ভাষা-আন্দোলন থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
ভাসানীর সন্তোষের কুটিরের আর তাঁর পদযাত্রা থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
রাজবন্দিদের নির্যাতিত জ্বলজ্বলে চোখ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
শেখ মুজিবের স্বাধীনতা-ঝলসিত উদ্যত তর্জনী থেকে,
বজ্রমুষ্টি থেকে
কিছু শিখে নিই

আমি আর কবিতার খাতা।
সতত ভূতলবাসী তরুণ সিরাজ সিকদার আর তাঁর
সহযাত্রীদের কাছ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
মুক্তিযোদ্ধা, হুইল চেয়ার আর ক্রাচ থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
জীবনানন্দীয় পাতা থেকে আস্তে সুস্থে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
কমল মজুমদার পাঠ করে চণ্ডালের হাঁড়ি, শ্মশানের
তন্বী সতী, তার বানভেজা স্তন আর
গোলাপ সুন্দরী আর শ্যাম নৌকার নিকট থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
পথিকের মধ্যহ্নভোজন আর ভগ্ন পান্থ নিবাসে কাছ
থেকে কিছু
পিছুটান শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
এবং বৈচিত্র্যময় উপজাতীয় সংস্কৃতি থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
বাথরুমে-রাখা বালতির পানি আর কৈশোরের
নদীটির কাছ থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
মেয়েদের হস্টেল এবং মাতৃসদনের কাছ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
স্বপ্নপ্রসূ কম্যুনিস্টো থেকে,
পরাবাস্তবের সূর্যমুখী থেকে কিছু শিখে নেয়
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।
রৌদ্রদগ্ধ শস্যক্ষেতে কৃষকের অবস্থান থেকে,
বিবাহ বাসন আর কবরের বাতি থেকে কিছু শিখে নেয়
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আরাগঁ তোমার কাছে – শামসুর রাহমান

আরাগঁ তোমার কাছে কোনোদিন পরিণামহীন
এই পংক্তিমালা
জানিনা পৌঁছবে কিনা, তবু
তোমারই উদ্দেশে এই শব্দাবলী উড়ে যাক পেরিয়ে পাহাড়
অনেক পুরনো হ্রদ বনরাজি এবং প্রান্তর।
আমার এলসা আজ যৌবনের মধ্যদিনে একা
জীবনকে ফুলের একটি তোড়া ভেবে টেবে আর
গানের গুঞ্জনে ভরে কোথায় আয়নার সামনে চুল আঁচড়ায়,
দীর্ঘ কালো চুল, পা দোলায় কোন সে চত্বরে ব’সে অপরাহ্নে
কিংবা পড়ে ম্লান মলাটের কবিতার বই কিংবা কোনো
পাখির বাসার দিকে চোখ রেখে কী-যে দ্যাখে, ভাবে
আমি তা’ জানিনা, শুধু তার স্বপ্নের ফোঁটার মতো
গাঢ় দু’টি আর সুরাইয়ের গ্রীবার মতন
গ্রীবা মনে পড়ে।

আরাগঁ আমার চোখে ইদানীং চালশে
এবং আমার নৌকো নোঙরবিহীন, তবু দেখি কম্পমান
একটি মাস্তুল দূরে, কেমন সোনালি।
অস্থিচর্মসার মাল্লা কবে ভুলে গেছে গান, কারো কারো
মাথায় অসুখ, ওরা বিড় বিড় ক’রে আওড়ায়
একটি অদ্ভুত ভাষা, মাঝে-মধ্যে দূর হ দূর ব’লে ঘুমের ভেতরে
কাদের তাড়ায় যেন, আমি শুধু দেখি
একটি মাস্তুল দূরে, কেমন সোনালি।
তরমুজ ক্ষেতের রৌদ্রে নগ্ন পদ সে থাকে দাঁড়িয়ে-
আমার কবিতা।
কখনো আমাকে ডেকে নিয়ে যায় বনবাদাড়ে যেখানে
সাপের সংগম দ্যাখে স্তম্ভিত হুতোম প্যাঁচা, যেখানে অজস্র
স্বপ্নের রঙের মতো ঘোড়া খুরে খুরে ছিন্ন ভিন্ন করে ঘাস ফুল
কখনো আমাকে ডাকে শহরতলীর বর্ষাগাঢ় বাসস্টপে
কখনো বা সিনেমার জনময়তায়,
আমার স্তিমিত জন্মস্থানে

এবং আমার ঘরে খেলাচ্ছলে আঙুলে ঘোরায়
একটি রুপালি চাবি, বাদামি টেবিল ক্লথ খোঁটে
চকচকে নখ দিয়ে-আমার কবিতা।
আবার কখনো তার সুপ্রাচীন তরবারির মতন বাহু
অত্যন্ত বিষণ্ন মেঘ, তার দুটি চোখ
ভয়ংকর অগ্নিদগ্ধ তৃণভূমি হয়।

যে-বাড়ি আমার নয়, অথচ যেখানে আমি থাকি
তার দরোজায়
কে যেন লিখেছে নাম কৃষ্ণাক্ষরে-অসুস্থ ঈগল।
পাড়াপড়শিরা বলে, মাঝে-মধ্যে মধ্যরাতে জীর্ণ
বাড়িটার ছাদ আর প্রাচীন দেয়াল থেকে তীব্র ভেসে আসে
নিদ্রাছুট রোগা ঈগলের গান, কী বিষণ্ণ-গর্বিত গান।
আরাগঁ তোমার মতো আমিও একদা
শক্রুপরিবৃত শহরের হৃদয়ে স্পন্দিত হ’য়ে
লিখেছি কবিতা রুদ্ধশ্বাস ঘরে মৃত্যুর ছায়ায়
আর স্বাধীনতার রক্তাক্ত পথে দিয়েছি বিছিয়ে কত রক্তিম গোলাপ।

আরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে, যেখানে সুর্যের
চুম্বনে ফসল পাকে, রাঙা হয় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল,
সজীব মুখের ত্বক রুটির মতোই ঝলসে যায়,
যেখানে বিশদ খরা, কখনো বা ভীষণ নির্দয় বানভাসি,
যেখানে শহুরে লোক, গ্রাম্যজন অনেকেই শাদাসিধে,
প্রায় বেচারাই, বলা যায়; আমাদের হালচাল
সাধারণ, চাল-চুলো অনেকের নেই।
আমাদের মাস ফুরোবার অনেক আগেই হাঁড়ি
মড়ার খুলির মতো ফাঁকা হ’য়ে যায়, দীর্ঘ দূরন্ত বর্ষায়
গর্তময় জুতো পায়ে পথ চলি, অনেকের জুতো নেই।

ধুতামি জানিনা, মোটামুটি
শাদাসিধে লোকজন আশেপাশে চরকি ঘোরে
এবং দু’মুঠো মোটা চালের ডালের জন্যে ক্ষুধার্ত আমরা।
ক্ষুধার্ত সত্তার পূর্ণ সূর্যোদয়, ভালোবাসা নান্মী লাল
গোলাপের জন্যে

আরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে আজ,
যেখানে দানেশমন্দ ব’সে থাকে অন্ধকার গৃহকোণে বুরবক সেজে
জরাগ্রস্ত মনে, অবসাদ-কবলিত কখনো তাড়ায় আস্তে
অস্তিত্বের পচা মাংসে উপবিষ্ট মাছি।
আরাগঁ তবুও জ্বলে গ্রীষ্মে কি শীতে
আমাদের স্বপ্ন জ্বলে খনি-শ্রমিকের ল্যাম্পের মতো

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আসাদের শার্ট – শামসুর রাহমান

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।

ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

ইকারুশের আকাশ – শামসুর রাহমান

গোড়াতেই নিষেধের তর্জনী উদ্যত ছিলো, ছিলে
সুপ্রাচীন শকুনের কর্কশ আওয়াজে
নিশ্চিত মুদ্রিত
আমার নিজস্ব পরিণাম। যেন ধু ধু মরুভূমি
কিংবা কোনো পানা পুকুরে কি জন্মান্ধ ডোবায়
অস্তিত্ব বিলীন হবে কিংবা হবো সেই জলমগ্ন ভুল প্রত্ন
পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, উদ্যমপ্রবণ ধীবরের জাল যাকে
ব্যাকুল আনবে টেনে নৌকোর গলুইয়ে-
এইমতো ভয়ংকর সংকেত চকিতে
উঠেছিলো কেঁপে রুদ্ধ গোলকধাঁধায়।

আমিতো বারণ মেনে বিশ্রুত স্থপতি
ধীমান পিতার
পারতাম জলপাই আর বৃষমাংস খেয়ে,
পান ক’রে চামড়ার থলে থেকে উজ্জ্বল মদিরা
এবং নিভৃত কুঞ্জে তরুণীকে আলিঙ্গনে মোহাবিষ্ট ক’রে,
ধারালো ক্ষুরের স্পর্শসুখ নিয়ে প্রত্যহ সকালে
সাধারণ মানুষের মতো গোচারণ, শষ্যক্ষেত আর
সন্তান লালন ক’রে কাটাতে সময়।
পারতাম সুহৃদের সঙ্গে প্রীতি বিনিময়ে
খুশি হতে, তৃপ্তি পেতে পাতার মর্মরে,
বনদোয়েলের গানে, তামাটে দুপুরে
পদরেখা লাঞ্ছিত জঙ্গলে
নিজেকে বিযুক্ত ক’রে মধু আহরণে।
কী-যে হলো, অকস্মাৎ পেরিয়ে গোলকধাঁধা পিতৃদত্ত ডান।
ভর ক’রে কিছুক্ষণ ওড়ার পরেই
রৌদ্রের সোনালি মদ আমার শিরার
ধরালো স্পর্ধার নেশা। শৈশবে কৈশোরে কতদিন
দেখেছি পাখির ওড়া উদার আকাশে। ঈগলের
দুর্নিবার ঊর্ধচারী ডানার চাঞ্চল্যে ছিলো সায়
সর্বদা আমার, তাই কামোদ্দীপ্তা যুবতীর মতো
প্রবল অপ্রতিরোধ্য আমার উচ্চাভিলাষ আমাকে অনেক
উঁচুতে মেঘের স্তরে স্তরে
রৌদ্রের সমুদ্রে নিয়ে গেলো। দ্বিধাহীন আমি উড়ে
গেলাম সূর্যের ঠোঁটে কোনো রক্ষাকবচবিহীন
প্রার্থনার মতো।

কখনো মৃত্যুর আগে মানুষ জানে না
নিজের সঠিক পরিণতি। পালকের ভাঁজে
সর্বনাশ নিতেছে নিশ্বাস
জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয়
পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ
নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ?
তবে কি আমার নাম স্মৃতির মতন
কখনো উঠতো বেজে রৌদ্রময় পথে জ্যোৎস্নালোকে
চারণের নৈসর্গিক, স্বপ্নজীবী সান্দ্র উচ্চারণে?
সমগ্র জাতির কোন কাজে লাগবে না
এই বলিদান, শুধু অভীপ্সার ক্ষণিকের গান
গেলাম নিভৃতে রেখে ঝাঁ ঝাঁ শূন্যতায়।
অর্জন করেছি আমি অকাল লুপ্তির বিনিময়ে
সবার কীর্তনযোগ্য গাথা,
যেহেতু স্বেচ্ছায়
করেছি অমোঘ নির্বাচন
ব্যাপ্ত, জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন রুদ্র নিজস্ব আকাশ।

 

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

তোমার নালিশের পরে – শামসুর রাহমান

আজকাল মাঝে মাঝে সকালে কি সাঁঝে আমাকে ঘিরে
বেহাগের করুণ সুরের মতো বাজে তোমার নালিশ। আমার
কথা না কি এখন আগেকার মতো তোমার হৃদয়ে সরোবর
তৈরি করতে পারে না, পারে না লাল নীল পদ্ম ফোটাতে
হাওয়ায় ঈষৎ দুলে-ওঠা মানস সরোবরে আমার কথার
মুখ এখন তোমাকে লতাগুল্ম, ফুল, ফলমূল, আর
রঙ বেরঙের পাখির গানে গুঞ্জরিত দ্বীপে পৌঁছে দিতে না
পারার ব্যর্থতার কালি মেখে নিশ্চুপ থাকে প্রায়শ,
এইটুকু তুমি স্পষ্টতই উচ্চারণ করেছ। কস্মিনকালেও বাকপটু
নই আমি, প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারিনি কোনও চারুবাকের।
এই দড় কথা গুছিয়ে বলার খেলায়। তুমি যথার্থই বলেছি আমি
লোকটা ঘোর স্বার্থপর। স্বীকার করি, অনেক কথাই সযত্নে
সঞ্চিত রাখি কবিতার জন্যে। কথোপকথনের মুহূর্তে কথা পাখির
কোন্‌ পালক কখন ছোঁব, বুঝতেই পারি না। পরিণামে কিছু
অনাবশ্যক, বেসুরো কথা অথবা দীর্ঘ নীরবতা।

থাক এসব বকুনি। এই যে আমি আমার ভালোবাসার
মঞ্জরী সাজিয়ে রাখি তোমাকে বুকে, তোমার কালো
চুলের ঢালে, তোমার আসা-যাওয়ার পথে, সেগুলো
তুমি কুড়িয়ে নাও না কেন?

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর – শামসুর রাহমান

কী ক’রে যে এত দ্রুত কণ্টকিত আঁধারে
ঢুকে পড়েছি, টের পাইনি।
পথে ক’জন অন্ধ পথিক আমাকে
স্বেচ্ছায় দিব্যি কথা বলার ভঙ্গিতে
মুগ্ধ করে ফেললো, টের পাইনি। ওরা
কখন যে আমাকে ছেড়ে দিলো, বুঝিনি।

আমার কাপড়ে অনেক কাঁটা জড়িয়ে গেলো
কখন, টেরই পাইনি। হঠাৎ এক
কর্কশ আওয়াজ আমাকে কামড়ে ধরছে
বারবার। এদিক-সেদিক তাকাতেই দূরের
এক গাছের ডালে অসামান্য এক পাখিকে
দেখি, যার কণ্ঠস্বর কখনও কর্কশ আর কখনও
মধুর সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে অচেনা, নির্জন
বুনো জায়গায়। আমার যাত্রা থামে না।

সূর্যের তেজ ম্লান হতেই প্রশান্ত অদূরে
গাছতলায় একজন বুজুর্গকে দেখতে পাই। কী যেন
আমাকে তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। পক্ক কেশ আলেম
তাকান আমার দিকে অপরূপ
দৃষ্টি মেলে। হাতে তাঁর এক অজানা কেতাব।
ইচ্ছে হলো তাঁর পা ছুঁয়ে অবনত হই। পরক্ষণে
দৃশ্য মুছে যায়। আমি মেঘমালার দিকে তাকিয়ে
নতুন এক কবিতার প্রতিমা পেয়ে যাই। আড়াল ফোটে
আসমানে ভাসমান কার্পেট প্রবীণ যাত্রী
তাকান আমার দিকে হাসিস্নাত দৃষ্টিতে।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

প্রত্যাশার বাইরেই ছিল – শামসুর রাহমান

প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।

বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তো

একজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

স্বপ্নগুলো অবিন্যস্ত টেবিলে – শামসুর রাহমান

স্বপ্নগুলো অবিন্যস্ত টেবিলে টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না;
জ্যোৎস্নায় উড়ে এসে পড়ে
পোড়া ঘরের ছাই। ধুলোবালি খিলখিলিয়ে হেসে
ঢেকে দেয় তাকে, যে সবেমাত্র তার
স্বপ্নগুলোকে গুছিয়ে রাখছিল চায়ের পেয়ালায়;
সে এখন পুরনো কালের বিকৃত মূর্তির মতো।

এখানে প্রতি মিনিটে জন্ম নিচ্ছে হাজার হাজার
প্রেত, লহমায় বেড়ে উঠে গিলে ফেলছে
ঘড়ির মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটাগুলো।
সময় এখানে ভারি পাথরের মতো, প্রেতবাহিনী
হাতে গোণা কয়েকটি প্রকৃত মানুষকে
ঘরছাড়া করে ঠা ঠা রোদ্দুরে
বজ্রপাতের দরনে হাসছে। ওদের মুখ-গহ্বর থেকে
গলগল করে বেরোয় রক্ত।

লোকগুলো প্রেতবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায় মহা আহলাদে,
জুড়ে দেয় খোশগল্প, কী এক
রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ওরা একটু-একটু করে
প্রেত-প্রেত হ’য়ে উঠছে খেদহীন। রাতের
তৃতীয় প্রহরে তাড়া-খাওয়া কবিগণ ভয়ার্ত
ভাঙা গলায় আর্তনাদ করছেন
তাঁদের পাণ্ডুলিপিসমূহ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে বলে নয়,
নাগরিকদের মুখগুলো ক্রমাগত নিজস্ব
মানুষের চামড়া ত্যাগ করে
বিচিত্র জীবজন্তুর রূপ ধারণ করছে বলে।

অবিন্যস্ত টেবিলে স্বপ্নগুলো পেরেকময় মাথার
দুঃস্বপ্নের সঙ্গে জায়গা বদল করে নিচ্ছে। স্বপ্নচারীর
সারা শরীরে পেরেক গাঁথা, শুধু চোখ দুটো
জলপায়রার পালকের স্পর্শ পাওয়ার আশায় জাগ্রত, তৃষিত।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল – শামসুর রাহমান

হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল হয়ে কেঁদেছে ক’দিন তার
খবর রাখেনি কেউ। শূন্যতায় বেড়িয়েছি ভেসে,
যেন আমি কাটা ঘুড়ি, অনেক কষ্টেও মৃদু হেসে
সহজে নিয়েছি মেনে সামাজিকতার অত্যাচার।

আমাকে নিষণ্ন পেয়ে গৌরী প্রশ্ন করে, ‘কবি তুমি
এমন নিষ্পৃহ কেন আজকাল, এমন শীতল
উচ্চারণে, আচরণে? আমি কি ঢেলেছি ঠাণ্ডা জল
তোমার উদ্দীপনায়? ভাবাচ্ছে সন্ত্রন্ত জন্মভূমি?

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কী দেবো উত্তর আমি? নিজেই জানি না, শুধু জানি
অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরি দিনরাত কেঁপে
উঠি ঘন ঘন একা ঘরে, ছায়াচ্ছন্ন এক প্রাণী
শিঙ নাড়ে, কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে, আসে ব্যেপে
কুঞ্জটিকা হৃদয়ে আমার, তবু তোমাকেই খুঁজি
প্রতিক্ষণ, এদিকে ফুরায় দ্রুত পরমায়ু-পুঁজি।

কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]
কবি শামসুর রাহমান [ Shamsur Rahman ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment