Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

একদিন রিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

একদিন রিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা ,

একদিন রিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতা

দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে সহজলভ্য বাহনটির নাম রিক্সা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে বাজার-হাট এবং সকল প্রকার কর্মকাণ্ডে রিক্সা ছাড়া আমরা যেন ভাবতেই পারি না। যদিও যানজটের অন্যতম কারণ এই রিক্সা। রাত কিংবা দিন, শীত কিংবা গরম নেই— রিক্সা বাংলাদেশে সবসময়েই পাওয়া যায়। ঝর-ঝর বর্ষার শত সহস্র বৃষ্টি ধারায় যখন সমস্ত প্রকৃতি নিবিড় নৈঃসঙ্গে নীরব নতজানু হয়ে যায় কিংবা ডিসেম্বর-জানুয়ারির হাড় কাঁপানো শীতে ঘন কুয়াশায় যখন চারদিক রহস্যমণ্ডিত হয়ে উঠে তখনও শহরে রিক্সা চলে, যাত্রীর আশায় রিক্সাওয়ালারা মোড়ে রিক্সা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিংবা দাঁড়িয়ে থাকে।

 

 

রিক্সাওয়ালার জীবন-ইতিহাস নিয়ে রচিত হতে পারে মহাকাব্য। এ মুহূর্তে সে মহাকাব্য রচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আসল কথা বলতে গিয়ে রিক্সার গল্প বলতে শুরু করেছিলাম। তবে ভূমিকার একটু প্রয়োজন ছিল। কেননা ভূমিকা ছাড়া বলা বা লেখা কোনোটাই সার্থক হয়ে ওঠে না। আর রিক্সাওয়ালার অভিজ্ঞতাটাও আমার কাছে একেবারে নতুন। অভিজ্ঞতা সবসময়ই নতুনই হয়। তবুও কোথায় যেন একটু ব্যতিক্রম আছে, বাড়তি কিছু শেখার আছে। সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে যে রিক্সায় চড়লাম তার সঙ্গে আর ভাড়া মিটিয়ে উঠিনি।

একরকম দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে ওঠে বললাম— এই রিক্সা যাবে? কোথায়, কোনদিকে যেতে হবে তা জিজ্ঞেস না করেই রিক্সাওয়ালা আমাকে নিয়ে চালাতে শুরু করলো। সাধারণত রিক্সা ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি থেকে শুরু করে অসোভন আচরণ, এমনকী মারামারি পর্যন্ত গড়ায়— এমন অভিজ্ঞতা সবারই কমবেশি আছে। এই রিক্সাওয়ালাকে সেরকম কিছু মনে হলো না। তার অপ্রকাশিত আচরণ আমাকে মুগ্ধ ও কৌতূহলী করে তুললো। বাসায় ফেরার যে তাড়া ছিল তা উবে গেল কয়েক সেকেন্ডে।

আমি রিক্সাওয়ালাকে নমনীয় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম- এই তোমার নাম কী ? রিক্সাওয়ালা মুখে মৃদু হাসি মাখিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল- আবদুল ওয়াহাব। সঙ্গে সঙ্গেই ফের প্রশ্ন করলাম তোমার বাড়ি কোথায়? এবার সে আর পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালো না, বলল- জামালপুর। কিছুটা এগুতেই রিক্সা গেল থেমে। কারণ নিত্যকার যানজট, স্কুল-কলেজ ছুটি হলে এসময়ে যানজট থাকে বেশি। অন্যান্য দিন যানজট বেশি হলে আমি রিক্সা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরি। আজ আর নামতে ইচ্ছে হলো না। আবদুল ওয়াহাব সম্পর্কে জানার একটা অদম্য ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসল। ওয়াহাব তার ড্রাইভিং সিটে আরাম করে বসে আমার সঙ্গে কথায় মনোযোগ দিল।

 

 

সে তার জীবনের গল্প খণ্ড-ক্ষুদ্র ভাগে এক-আধটু ছিড়ে ছিড়ে বলতে লাগল। ওয়াহাব চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছিল। বাবা মারা গেলে মায়ের সাথে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে রিক্সা চালাতে শুরু করেছিলো এখন থেকে বিশ বছর আগে। তখন তার বয়স ছিল দশ-বারো। এবং আরও অনেক ঘটনার অংশ বিশেষ আমাকে শুনালো। আরও কিছু ঘটনা যা একান্তই তার ব্যক্তিগত সেসব ব্যর্থতা ও দুখের কথা আমাকে জানাতে চাইলো না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে এলো। হাড় জির জিরে লম্বা পাতলা রিকসাওয়ালা মার্জিত ভাষায় পুরো শিক্ষিত লোকের মতোই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এবারকার কলেজ ম্যাগাজিন দেখেছেন? গেটাপ একদম বাজে।

এত বড় একটা কলেজ। একজন রিক্সাওয়ালার মুখে কলেজ ম্যাগাজিনের গেটাপ সম্পর্কিত বাক্য শুনে চমকে উঠেছিলাম। সেদিনই জেনেছিলাম আবদুল ওয়াহাব দিনমজুর হলেও রুচিতে কেতাদুরস্ত। সে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মতোই রাজনীতি সচেতন। কথায় কথায় ওয়াহাব সেদিনকার সংবাদ পত্রের নানা খবরসহ সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলো নিয়েও কথা বললো। বড় বড় পত্রিকার সম্পাদকদের নামও সে জানে। দেশের উন্নতি হচ্ছে এবং আরও হবে, এমন আশা আবদুল ওয়াহাবের। আমার কথা গেল থেমে। আমি এখন আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে ভাবছি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মুহূর্তেই অনেক ভাবনা এসে জট পাকিয়ে গেল। কোনো কথাই আর গুছিয়ে বলতে পারলাম না। অবথব হয়ে ওয়াহাবকে ভাড়াটা দিয়ে দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে পা ফেললাম। ত্রিশ টাকার ভাড়া কিন্তু পঞ্চাশ টাকার নোট গোটাটাই ওহাবকে দিয়ে দিলাম। আরও থাকলে আরও দিতাম। ওয়াহাবের দেশপ্রেম আমাকে শিখিয়ে দিলো কী করে দেশকে ভালোবাসতে হয়, মনুষ্যত্বের সাধনা যে সদাচারী হওয়ার সাধনা ছাড়া অন্য কিছু নয়, তাও শিখে নিলাম একজন রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে। রিক্সা চালকদের জীবন নিয়ে গান, কবিতা-কাহিনী-নাটক, থিয়েটার, সিনেমা কম হয় নি, কিন্তু রিক্সাওয়ালার জীবনে উন্নতি ঘটেনি।

তাদের জীবন-জীবিকা যেমন বিপদসঙ্কুল, কঠিন; সে তুলনায় কায়িক শ্রম বিক্রির প্রাপ্তিটা তেমনি ক্লেশকর। ‘গরীবের সুখ নাই দুঃখও নাই’- কথাটা ওয়াহাবই বলেছিল কিন্তু কষ্ট-ক্লেদাক্ত জীবনসংগ্রামের মাঝে দেশকে নিয়ে এমন সুন্দর আশার কথা কী করে বলে, আমি সে-কথা ভেবেই পাচ্ছি না। আমার হৃদয়তন্ত্রীতে কেবলই বাজতে লাগল তার শেষ কথাটকু— ‘দেশের উন্নতি হচ্ছে এবং আরও হবে, বিদেশের মতো বাংলাদেশ সুন্দর হবে’…। আমার মনে চিরদিনের জন্যে ওয়াহাবের এই আশা গেঁথে গেলো, একজন রিক্সাওয়ালা আমার হৃদয়মনের গভীরে চিরকালের জন্যে দেশপ্রেমের বীজ পোঁতে দিল…।

আরও দেখুন:

Exit mobile version