এইডস কী ? বাঁচতে হলে জানতে হবে আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

এইডস কী ? বাঁচতে হলে জানতে হবে আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

এইডস কী ? বাঁচতে হলে জানতে হবে আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ

সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা।

আজকের এই আলোচনা আমাদের নাগরিক সচেতনতারই নিদর্শন। আজ সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতাদানের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এজন্য সভার আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সুধীবৃন্দ, একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের মাঝেও বিশ্বব্যাপী এইডস মানবজাতির জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। ১৯৮১ সালে আমেরিকায় প্রথম এইডস রোগ ধরা পড়ে। এরপরই জানা যায় যে ইতোমধ্যে এইডস পৃথিবীর বহু দেশেই ঢুকে পড়েছে।

 

এইডস কী ? বাঁচতে হলে জানতে হবে আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ

 

ঢুকে পড়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে এবং এখনো ব্যাপক না হলেও আমাদের দেশেও এইডস রোগের বিস্তার ঘটছে। বর্তমানে অনেকেই এইচআইভি/এইডস্ সম্পর্কে অবগত আছে— সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বিপনি কেন্দ্র, রাস্তার মোড় সর্বত্রই এটি অন্যতম একটি আলোচ্য বিষয়। তবে এইচআইভি/এইডস্ বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায় তা এখনো অনেকেই জানে না। এ থেকে নিজেকে সঠিকভাবে রক্ষা করার উপায়ও অনেকের অজানা। তাছাড়া এইচআইভি/এইডস্ সম্পর্কে সমাজে এখনো প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। এইচআইভি/এইডস্ এর বিরুদ্ধে সৃজনশীল এবং কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে, এই রোগ সম্পর্কে মৌলিক তথ্যাবলি সঠিকভাবে অবগত হতে হবে।

এইচআইভি সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সুধী, আমাদের প্রথমেই জানতে হবে এবং খুব সুস্পষ্ট ধারণা থাকা চাই যে, এইচআইভি/এইডস্ কী? এইচআইভি “হিউম্যান ইম্যিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (Human Immuno Deficiency Virus, HIV)”। সংক্ষেপে HIV ঘাতক ব্যাধি। এই ভাইরাস শরীরের প্রতিরোধ কোষগুলোকে ক্রমাগত ধ্বংস করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রমণ এবং রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ওষুধ আবিষ্কার হয় নি বলে এইডস হওয়া মানেই মৃত্যু।’ সুতরাং – ১ ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে।’

কী জানব?

জানব— এইডস রোগ কীভাবে বিস্তার লাভ করছে? এ-রোগের লক্ষণ কী? এর প্রতিকার কীভাবে করা যায় ।

সুধীমণ্ডলী, এইডস-এর মরণছোবল একদিকে যেমন লক্ষ লক্ষ মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তেমনি অন্যদিকে আক্রান্ত দেশসমূহের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে এদেশে এইডস-এর প্রকোপ তেমন একটা বেশি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে এইডস-এর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ বেড়ে যাওয়ায় এই রোগ আজ ধীর অথচ নিশ্চিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

বাংলাদেশে ১৯৮০-এর দশকের শেষ এবং নব্বই দশকের গোড়ার দিকে যে এইডস রোগীদের সনাক্ত করা হয় তারা সবাই ছিলো বিদেশ প্রত্যাগত বাঙালি।; অর্থাৎ প্রবাসীদের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে এই রোগের জীবাণু আমদানি হয়। কিন্তু ধীর ধীরে এখন রোগটি এই দেশে বসবাসকারি মানুষের দ্বারা এবং তাদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে। এইচআইভি সংক্রমণ সনাক্ত করার ব্যর্থতা, এইআইভি টেস্টের সুযোগের অপর্যাপ্ততা ও বিপুল ব্যয়, সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, মাঠ পর্যায়ের তথ্যের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে এইচআইভি জীবাণুবাহী রোগীর সঠিক সংখ্যা নির্ণয় কিংবা এইডস বিস্তারের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করা খুবই কঠিন।

আমাদের সমাজে সেক্স বা এইডস সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা অপছন্দনীয় হওয়ায় মানুষ এ সংক্রান্ত সমস্যা বা তথ্য গোপন করে। সম্ভবত এই প্রবণতাই এইডস-এর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএনএইডসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০০৩ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৩,০০০ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত বা পজেটিভ। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে নতুন করে ১,১০০ জন এইচআইভি আক্রান্ত হচ্ছে এবং এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শিক্ষার দিক থেকে অনগ্রসর এবং দরিদ্রতম একটি দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

দারিদ্র্যের কারণে এখানে অনেক নারীই পতিতাবৃত্তির পথ বেছে নেয়। নগর-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব যৌনকর্মী। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এইডস রোগের ভয়াবহতা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এসব দেশে কাজের উদ্দেশ্যে বা আনন্দ-বিনোদন ও ভ্রমণের জন্য অনেকেই যাতায়াত করে। ভিনদেশি যৌনকর্মীদের সংসর্গে অনেকেই এইচআইভি ভাইরাস নিয়ে দেশে ফিরছেন। নিজেরা কিন্তু চট করে সেটা বুঝতে পারছেন না। কারণ এইচআইভি মানুষের শরীরে দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশ বছর এইচআইভি থাকবে ঘুমন্ত। এইচআইভি ঘুমন্ত থাকলেও এইচআইভি বহন করা মানুষরা তো ঘুমন্ত না।

তারা মহানন্দে তাদের শরীরে এইচআইভি ছড়িয়ে বেড়াবেন। জাতি অগ্রসর হবে ভবিষ্যৎহীন অন্ধকারের দিকে আমাদের দেশে সুচ দিয়ে শরীরে মাদকের বিষ নিচ্ছে অনেক বিপথগামী তরুণ-তরুণী। এই সুচ একজনের পর আরেকজনও ব্যবহার করছে। এভাবে অনেকেই সংক্রমিত হচ্ছে এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা। আবার এখানকার অনেক অসহায় মানুষ শরীরের রক্ত বিক্রি করে বেঁচে থাকে। এদেরই কারো এইচআইভি পজিটিভ রক্ত অন্য কারো শরীরে দেওয়া হলে সংক্রমণ হবে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণীদের বিশেষত মেয়েদের মধ্যে যৌনশিক্ষার ভীষণ অভাব।

ফলে সহজেই এরা অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের সঁপে দিতে পারে। অনেক শিক্ষিত আধুনিক তরুণ-তরুণীর মধ্যে সামাজিক বা নৈতিক অনুশাসনবোধ নেই। অবাধ মেলামেশাকে তারা আধুনিকতার অংশ মনে করছে। সে সুযোগে এইচআইভি ভাইরাস যাতায়াতও অবাধ হচ্ছে। সুধী, এ পর্যায়ে আমরা এইডস রোগের লক্ষণগুলো জেনে নিই— এইডস রোগের লক্ষণ খুব সাধারণই থাকে। দুর্বলতা, জ্বর, ডায়রিয়া, লসিকা গ্রন্থির ফুলে যাওয়ার মতো সাধারণ লক্ষণের অসুখ একসময় সংহারকমূর্তি ধারণ করে। বস্তুত এইডস আক্রান্ত মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে যায়।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে এ রোগে আক্রান্ত মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মানুষের শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের অবস্থান তিন জাতীয় তরল পদার্থে। বীর্যে, রক্তে এবং মায়ের দুধে। কাজেই রোগ ছড়াবে তিন জাতীয় তরলের আদান-প্রদানে। ক. এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলনে। অনিরাপদ যৌন মিলনের অর্থ কনডমবিহীন যৌন মিলন। খ. রক্ত আদান-প্রদান। এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর রক্ত শরীরে নেওয়া। গ. শিশুরা এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয় মায়ের দুধ পানে সুধীসমাজ, চলুন আমরা জেনে নিই এইডস রোগের প্রতিকার কীভাবে করা যায়— © অনিরাপদ যৌন মিলন এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান উপায়।

তাই অনিরাপদ যৌন সংসর্গ এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে কনডম ব্যবহার করতে হবে। © রক্ত দেওয়া-নেওয়ার সময় ব্যবহৃত সুই এবং রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করে নিতে হবে। © নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা- এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে সবচেয়ে উত্তম পন্থা। এই পদ্ধতি অনিরাপদ যৌন মিলনের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক। তাই মাদকদ্রব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। © আমাদের সমাজের ছেলেমেয়েদের যৌনসম্পর্ক বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। © শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে অল্পবয়সিদের মধ্যে স্বপ্ন ও দীর্ঘ মেয়াদি উভয় প্রকার প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

জ্ঞান অর্জন, নৈতিক মূল্যবোধ, দক্ষতা অর্জন প্রভৃতি বিষয়ে মানুষ অল্প বয়সে যে শিক্ষা গ্রহণ করে আজীবন তাকে তা পথ নির্দেশ করে। © এইচআইভি/এইডস্ বিষয়ক জ্ঞান এবং জীবনমুখী শিক্ষার জন্য শিক্ষা গ্রহণ এবং প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত উপকরণ প্রস্তুত করতে হবে। যা বিদ্যালয়ের বাইরেও ব্যবহৃত হতে পারে। বিষয়সমূহ শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং এই বিষয়গুলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সচেতন সুধীসমাজ, বিশ্বব্যাপী এইচআইভি ভাইরাসের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে। তথ্য পরিসংখ্যানে এখনও খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি মনে না হলেও আমাদের দেশেও সর্বমহলে সচেতনতা গড়ে তোলার এখনই সময়।

 

এইডস কী ? বাঁচতে হলে জানতে হবে আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ

 

কার্যকর প্রতিরোধ কার্যক্রমের মাধ্যমে এইচআইভি মহামারিকে দমন করা যেতে পারে। যদি কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে দ্রুত গতিতে এইচআইভি/এইডস্ ছড়িয়ে পড়বে। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাই এখনই এইডস-এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষা এবং সচেতনতা ব্যাপকভাবে জোরদার করা উচিত।

সচেতনতা বৃদ্ধি এইডস প্রতিরোধে খুবই কার্যকর পন্থা। তবে শুধু সচেতনতা সৃষ্টিই নয়, সবাই যাতে এইডস প্রতিরোধের জন্য করণীয়গুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের এ ধরনের সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন- আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment