আদিম দেবতারা — কবি জীবনানন্দ দাশের একটি গভীর দর্শনসম্পন্ন এবং প্রতীকধর্মী কবিতা। এই কবিতাটি তাঁর কাব্যপ্রতিভার এক অনন্য প্রকাশ, যেখানে অতীত, স্মৃতি, প্রকৃতি এবং মানুষের আদিম অনুভবগুলো এক রহস্যময় ছায়ার মধ্যে ধরা পড়ে।
“আদিম দেবতারা” কবিতায় কবি ফিরে তাকিয়েছেন ইতিহাসের অতলে—মানুষের প্রাথমিক বিশ্বাস, জীবনের গভীরতর অর্থ খোঁজার চেষ্টার দিকে। এখানে ‘আদিম দেবতারা’ প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় সেইসব বিস্মৃত প্রাচীন শক্তির, যারা একসময় মানুষের জীবন, প্রকৃতি, ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। কবিতায় এই দেবতারা যেন অস্তিত্বের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোন নিঃশব্দ সত্তা, যাঁরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেছেন, কিন্তু এখনও তাঁদের প্রভাব টিকে আছে মানুষের মনোজগত ও সংস্কৃতিতে।
জীবনানন্দ তাঁর নিজস্ব ধীর, ধ্যানমগ্ন, অথচ বিমূর্ত ভাষাশৈলীতে তুলে ধরেছেন—আধুনিক জীবনের শূন্যতা ও ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে যাওয়া সেই আদিম অনুভবকে। কবিতার ভাষা স্বপ্নময়, বিমূর্ত এবং প্রতীকভিত্তিক, যা পাঠকের মনকে নিয়ে যায় এক ধ্যানমগ্ন অভিজ্ঞতায়।
এই কবিতাটি কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বর্তমান সময়ে মানুষের আত্মিক বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলনও—যেখানে মানুষ, প্রযুক্তি ও নগরায়নের মাঝে হারিয়ে ফেলে নিজের শিকড়, নিজের ভয়, নিজের বিশ্বাস।
সংক্ষেপে, “আদিম দেবতারা” জীবনানন্দ দাশের সময় ও চেতনাপ্রবাহে এক অনুপম কবিতা—যা আমাদের আমিত্ব, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির গভীরতর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

আদিম দেবতারা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পারিহাসে
তোমাকে দিল রূপ-
কী ভয়াবহ নির্জণ রূপ তোমাকে দিল তারা ;
তোমার সংস্পর্শের মানুষের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা।
আগুন বাতাস জল: আদিম দেবাতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
আমাকে দিল লিপি রচনা করবার আবেগ:
যেন আমিও আগুন বাতাস জল,
যেন তোমাকেও সৃষ্টি করছি।
তোমার মুখের রূপ রক্ত নয়, মাংস নয় কামনা নয়,
নিশীথ দেবদারু দ্বীপ;
কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপ;
স্থুল হাতে ব্যবহৃত হয়ে তবু
আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দীপের নক্ষত্রের ছায়ায় ভিতর;
আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
রূপের বীজ ছড়িয়ে চলে পৃথিবীতে,
ছড়িয়ে চলে স্বপ্নের বীজ।
অবাক হযে ভাবি, আজ রাতে কোথায় তুমি?
রূপ কেন নির্জন দেবদারু দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না–
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
স্থুল হাতে ব্যবহৃত হয়ে ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে
ব্যবহৃত–ব্যবহৃত–
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো হো করে হেসে উঠল;
‘ব্যবহৃত–ব্যবহৃত হয়ে শুয়ারের মাংস হয়ে যায়?’
হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!–
চারদিককার অট্টহাসির ভিতর একটা বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে
অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হয়ে উঠল যেন;
পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতদেহের দুর্গন্ধের মতো,
যেখানেই যাই আমি সেই সব সমুদ্রের উল্কায় উল্কায়
কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক!
