অব্দ বা বর্ষ গণনা | সংখ্যাবাচক শব্দ | ভাষা ও শিক্ষা

অব্দ বা বর্ষ গণনা | সংখ্যাবাচক শব্দ | ভাষা ও শিক্ষা , মানুষ আপন প্রয়োজন অনুসারে বিপুল পৃথিবীকে পরিমাপ করেছে— ক্ষুদ্র, বৃহৎ নানাভাবে। ভৌগোলিক সীমারেখায় পৃথিবীকে যেমন নানাভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, তেমনি নিরবধি কালকেও নানা কালপরিমাণ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাচীণকাল থেকেই কালপরিমাপের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এককরূপে বর্ষ গণনার প্রথা প্রচলিত হয়ে আসছে। বর্ষ গণনা প্রধানত তিনটি পদ্ধতিকে অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছে : (১) সৌর বর্ষ, (২) চান্দ্র বর্ষ এবং (৩) নাক্ষত্র বর্ষ। সৌর বর্ষ নির্ণীত হয়েছে সূর্যের বার্ষিক গতি অনুসারে। ৩৬৫ দিনে এক সৌর বর্ষ।

অব্দ বা বর্ষ গণনা | সংখ্যাবাচক শব্দ | ভাষা ও শিক্ষা

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই সৌরবর্ষ গণনা করা হয় । চন্দ্রের গতি অনুসারে চান্দ্র মাস এবং বর্ষ গণনা করার রীতি প্রচলিত। চন্দ্রের সংক্রমণ প্রাতকালে হলে ৩৫৪ দিনে এবং রাত্রিকালে সংক্রমণ হলে ৩৫৫ দিনে এক চান্দ্র বর্ষ ধরা হয়। সাধারণত মুসলিম দেশগুলোতে চান্দ্র বর্ষ গণনার রীতি অনুসৃত হয়। নক্ষত্র অনুসারে যে বর্ষ গণনা করা হয় তা নাক্ষত্র ‘বর্ষ। ৩৬০ নক্ষত্র দিনে এক নাক্ষত্র মাস।

আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অব্দ প্রচলিত ছিল। কয়েকটি অব্দের প্রচলন এখন পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও কোন কোন অব্দ ইতোমধ্যে কালের অতলে হারিয়ে গেছে। প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে বা শিলালিপিতে অধুনা অপ্রচলিত অনেক অব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টাব্দ বা আন্তর্জাতিক অব্দ : খ্রিস্টাব্দ সৌর-বর্ষ। যীশু খ্রিস্টের জন্মের তিন বছর পর থেকে খ্রিস্টাব্দ গণনা করা হয়।

 

অব্দ বা বর্ষ গণনা | সংখ্যাবাচক শব্দ | ভাষা ও শিক্ষা

 

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এই অব্দ প্রচলিত। খ্রিস্টাব্দ এখন একটি আন্তর্জাতিক অব্দ। হিজরী অব্দ : হিজরী অব্দের গণনারীতি চান্দ্র মাস অনুযায়ী। হজরত মুহাম্মদ (স) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাস (৬২২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে এই অব্দ গণনা করা হয়। হজরত ওমর (রা.) হিজরী সন প্রবর্তন করেন।

বাংলা দেশে মুসলিম বিজয়ের পর হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়। ‘খ্রিস্টাব্দ’ সৌরবৎসর এবং ‘হিজরী’ চান্দ্রবৎসর। যেহেতু ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে এক চান্দ্র বর্ষ গণনা করা হয়, সনের প্রচলন শুরু হওয়া থেকে প্রতি বছরই খ্রিস্টাব্দের তুলনায় হিজরী সন ১০/১১ দিন করে কমে যায়। এ কারণেই হিজরীর সঙ্গে খ্রিস্টাব্দের সম্পর্ক নির্ণয় বেশ দুরূহ।

তাই হিজরী শকাব্দ ও কবি শকাব্দ : শকাব্দের প্রচলন কে করেন সে সম্পর্কে পণ্ডিতগণ কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন নি। কারও কারও মতে শক রাজা শালিবাহনের মৃত্যুর পর থেকে শকাব্দের সূচনা হয়েছে। তবে, একথা নিশ্চিত যে বঙ্গাব্দের ৫১৫ বৎসর পূর্ব থেকে অথবা খ্রিস্টাব্দ সূচনার ৭৮ বৎসর পর থেকে শকাব্দের গণনা চলে আসছে। সুতরাং শকাব্দ + ৭৮ = খ্রিস্টাব্দ, শকাব্দ – ৫১৫ = বঙ্গাব্দ। অনেকে অনুমান করেন— কুষাণ রাজা কনিষ্ক শকাব্দের প্রবর্তক। কনিষ্ক একটি নতুন অব্দ প্রচলন করেছিলেন তা ঠিক, কিন্তু সে অব্দই আসলে শকাব্দ কিনা তা আলাদা প্রশ্ন, তবে এ গণনারীতি যে .. শেষ পর্যন্ত কুষাণ সম্রাট বসুদেব পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

 

অব্দ বা বর্ষ গণনা | সংখ্যাবাচক শব্দ | ভাষা ও শিক্ষা

 

এমন প্রমাণও পাওয়া যায় যে, নেপাল এবং গঙ্গা উপত্যকার নৃপতিরাও এ অব্দ ব্যবহার করত। কিন্তু এই তারিখ গণনার ঠিক কী প্রণালী ছিল সে সম্মন্ধে পণ্ডিতরা একমাত হতে পারেন নি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কবিগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রচনাকাল শকাব্দে লিপিবদ্ধ করেছেন। রচনাকাল স্পষ্টভাষায় নির্দেশ না করে তাঁরা যে সংখ্যাবাচক হেঁয়ালীতে রচনাকাল প্রকাশ করতেন তা ‘কবি শকাব্দ’ নামে পরিচিত। কবি .শকাব্দের একটি উদাহরণ ‘সিন্ধু ইন্দু বেদ শশী শক পরিসাণ’ (বিপ্রদাস) = ১৪১৭ শকাব্দ । বঙ্গাব্দ : সম্রাট আকবর এই সৌর সনের প্রচলন করেন।

তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সনের প্রচলন ছিল। যেমন- লক্ষ্মণাব্দ, বিক্রমাব্দ, শালিবাহন সন, জালালী সন, সেকান্দর সন, শকাব্দ, গুপ্তাব্দ ইত্যাদি। এই সনগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র প্রচলিত ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সন প্রচলিত থাকায় কোনটিই সার্বিক স্বীকৃতি পায় নি। তাছাড়া কোন কোন সন চান্দ্র মাসের হিসাবে গণনা করা হত। শাহী লেনদেন এবং প্রজাসাধারণের সুবিধার্থে একটি সৌর সন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্বভাবতই দেখা দেয়। রাজদরবারে বহুদিন ধরেই হিজরী সনের ব্যবহার ছিল। কিন্তু হিজরীও চান্দ্র অব্দ। তাই আকবর একটি নতুন সৌর বৎসর প্রবর্তনের আদেশ জারি করেন। মোগল সাম্রাজ্যের আর্যাবর্তে এবং দাক্ষিণাত্যে নতুন সনটি ‘ফসলী সন’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে এ সনটি বাংলাদেশে এসে ‘বঙ্গাব্দ’ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়।

 

অব্দ বা বর্ষ গণনা | সংখ্যাবাচক শব্দ | ভাষা ও শিক্ষা

 

উড়িষ্যায় এ সনের নাম ছিল ‘বিলায়েতী’ বা “আমলী’। বঙ্গাব্দ বা ফসলী সনের মূল ভিত্তি হিজরী সাল। আকবরের সিংহাসন লাভের কাল ৯৬৩ হিজরী। ৯৬৩ হিজরীর পরবর্তী বৎসরগুলো সৌরবৎসর অনুসারে ৯৬৪, ৯৬৫ ইত্যাদি হিসেবে সন গণনা করা হয়েছে। এই সনই ফসলী সন বা বঙ্গাব্দ। আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুতরাং বঙ্গাব্দের সঙ্গে খ্রিস্টাব্দের পার্থক্য ৫৯৩ (১৫৫৬ – ৯৬৩ = )। বঙ্গাব্দ বা ফসলী সন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালে প্রচলিত স্থানীয় চান্দ্র মাসগুলোকেও সৌর মাসে পরিণত করা হয়।

ফলে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি নামও বঙ্গাব্দের বিভিন্ন মাসের নামরূপে গৃহীত হয়। এই উপমহাদেশের অন্যান্য অনেক সনে আজ পর্যন্ত এ সকল মাসের নাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্মরণযোগ্য যে, আরও অনেক অব্দ রয়েছে; যেমন : মল্লাব্দ, সম্বৎ, মঘী অব্দ, পরগণাতি অব্দ, লক্ষ্মণাব্দ, পালাব্দ, ত্রিপুরাব্দ, চৈতন্যাব্দ, নসরত শাহী সন, নেপাল সংবৎ, দানিশাব্দ, জমিদারি সন, নৃপ শক, বিশ্বসিংহ শক, রাজসন, বিষ্ণুপুরী, সদর সন ইত্যাদি।

আরও দেখুন :

Leave a Comment