১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিউলের অন্বেষণ

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (সায়েন্স ফিকশন)– আইজাক আসিমভ
অনুবাদ : নাজমুছ ছাকিব

ভূমিকা

ভেঙে যাচ্ছে দশ হাজার বছরের ফার্স্ট গ্যালাকটিক এম্পায়ার। গ্যালাক্সির প্রতিটা গ্রহ নক্ষত্র ছিল এই এম্পায়ারের অন্তর্ভুক্ত। মানব জাতি প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে অন্য কোনো ধরনের শাসন ব্যবস্থা ছিল বা থাকতে পারে।

এক মাত্র হ্যারি সেলডন বুঝতে পেরেছিলেন।

হ্যারি সেলডন ছিলেন ফাস্ট গ্যালাকটিক এম্পায়ারের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ। তার হাতেই সায়েন্স অব সাইকোহিস্টোরি পরিপূর্ণ বিকশিত হয়। সাইকো হিস্টোরি সমাজ বিজ্ঞানেরই অতি উন্নত একটি শাখা। এর সাহায্যে মানুষের আচরণকে গণিতের সূত্রে প্রকাশ করা যায়।

একজন মানুষের আচরণ ব্যখ্যা করা কঠিন, কিন্তু সেলডন দেখতে পেলেন যে দলবদ্ধ একটি বিশাল মানবগোষ্ঠীর আচরণ পরিসংখ্যানিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জনগোষ্ঠী যত বৃহৎ হবে ফলাফল হবে তত বেশী নিখুঁত। আর সেলডন যে সময়ে তার সাইকোহিস্টোরি নিয়ে গবেষণা করেন সেই সময় গ্যালাক্সির জনসংখ্যা হিসাব করা হতো কুইন্টিলিয়ন্স-এ।

হ্যারি সেলডন, একমাত্র তিনিই প্রচলিত ধ্যান ধারণার উর্ধ্বে উঠে বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষের হাতে গড়ে উঠা সবচেয়ে জটিল এবং শক্তিশালী সংগঠন, ধারণা করা হতো যা কখনো ধ্বংস হবেনা-পচন ধরেছে তার ভেতর, ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে। তিনি অনুমান করতে পারলেন (বা তার সমীকরণগুলো সমাধান করে এ-ধরনেরই কোনো ফলাফল পেলেন) যে আরেকটা নতুন সমন্বিত শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠার আগে গ্যালাক্সিতে যে সিমাহীন অরাজকতা, বর্বরতা এবং অশান্তি তৈরি হবে তার স্থায়িত্ব হবে ত্রিশ হাজার বছর।

মানব জাতিকে রক্ষার উপায় তিনি বাতলে দিলেন, মাত্র একহাজার বছরের মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি করলেন মহাপরিকল্পনা। সতর্কতার সাথে গ্যালাক্সির দুই বিপরীত দিকের সুদূরতম প্রান্তে ফাউণ্ডেশন’ নামে বিজ্ঞানীদের দুটো কলোনি স্থাপন করলেন। একটি ফাউণ্ডেশন তিনি স্থাপন করেন প্রকাশ্য দিবালোকে। অর্থাৎ গ্যালাক্সির সবাই এই ফাউণ্ডেশনের কথা জানত। অন্য ফাউণ্ডেশনের কথা তিনি গোপন করে যান। ফলে ওই ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব ও উদ্দেশ্য থেকে যায় অজানা।

ফাউণ্ডেশন এবং ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার এ ফাস্ট ফাউণ্ডেশনের প্রথম তিন শতাব্দীর ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল গ্যালাক্সির আউটার পেরিফেরির ছোট এক গ্রহে এনসাইক্লোপেডিস্টদের ছোট লোকালয় হিসেবে। ধারাবাহিকভাবে তারা একটা একটা করে ক্রাইসিসের মুখোমুখি হয় যেখানে মানুষের আন্তঃসম্পর্ক এবং সময় উপযোগী সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবাহের সমন্বয় ঘটে। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পথে চলার স্বাধীনতা ছিল এবং সেই পথে চলার ফলে প্রথম ফাউণ্ডেশন দ্রুত উন্নতি লাভ করে। সবকিছুই হ্যারি সেলডন ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছিলেন।

প্রথম ফাউণ্ডেশন উৎকৃষ্ট বিজ্ঞানের সাহায্যে আশেপাশের অনুন্নত গ্রহগুলো দখল করে। এম্পায়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অত্যাচারী ওয়ারলর্ডদের পরাজিত করে। শেষপর্যন্ত এম্পায়ারের শেষ শক্তিশালী সম্রাট এবং শেষ শক্তিশালী জেনারেলদের সাথে ফাউণ্ডেশনের যুদ্ধে এম্পায়ারের পুরোপুরি পতন ঘটে।

কিন্তু তারপর ফাউণ্ডেশন এমন এক বিপদের মুখোমুখি হয় যে বিপদের কথা এমনকি হ্যারি সেলডন নিজেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। তিনি অনুমানও করতে পারেননি একজন মানুষের অতিমানবিক ক্ষমতা কত ভয়াবহ হতে পারে। তার নাম ছিল মিউল–একটা মিউট্যান্ট। মানুষের ইমোশন এবং মাইণ্ড কন্ট্রোল করার জন্মগত ক্ষমতা ছিল তার। কোনো সামরিক বাহিনীই তার সামনে টিকতে পারেনি এবং পারছিল না। তার ক্ষমতার কাছে প্রথম ফাউণ্ডেশন পরাজিত হয় এবং সেলডনস প্ল্যান আংশিক ধ্বংস হয়ে যায়।

আর সবার অগোচরে রয়েছে রহস্যময় “দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন”-যাদের মিউলের মতো ক্ষমতা রয়েছে। সবাই খুঁজছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন। গ্যালাক্সির দখল সম্পূর্ণ করতে হলে মিউলকে অবশ্যই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজে বের করতে হবে। প্রথম ফাউণ্ডেশনের রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণ।

কিন্তু কোথায় দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন? কেউ জানে না।

এই কাহিনী হচ্ছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন অনুসন্ধানের কাহিনী।

*

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

প্রথম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ

১.১ পুরোনো প্রাসাদ

মিউল… প্রথম ফাউণ্ডেশনের পতনের পর মিউল শাসন ব্যবস্থার গঠনতান্ত্রিক বিষয়সমূহ স্পষ্ট হতে থাকে। প্রথম গ্যালাকটিক এম্পায়ারের পরিপূর্ণ ভাঙনের পর ইতিহাসে মিউলই সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে গ্যালাক্সির বিশাল অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ফাউণ্ডেশনের বাণিজ্যিক সম্রাটেরা ছিল বিভিন্ন মতে বিশ্বাসী এবং সাইকোহিস্টোরির অস্পর্শনীয় বন্ধন থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। তার সাথে মিউলের দক্ষ ও শক্ত নিয়ন্ত্রণে থাকা “পৃথিবীসমূহের ইউনিয়নের” কোনো তুলনাই হয় না যে ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল গ্যালাক্সির এক দশমাংশ অঞ্চল এবং এক পঞ্চদশমাংশ জনসংখ্যা। বিশেষ করে তথাকথিত অনুসন্ধানের সময়…

–এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা*

[*এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকার সকল উদ্ধৃতি “এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা পাবলিশিং কোং, টার্মিনাস”-এর আদেশক্রমে ১০২০ এফ. ই-তে প্রকাশিত ১১৬তম সংখ্যা থেকে নেওয়া হয়েছে।]

.

মিউল এবং তার এম্পায়ার সম্বন্ধে এনসাইক্লোপেডিয়ায় আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে তবে তা আমাদের বর্তমান কাহিনীর জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং এর অধিকাংশই আমাদের উদ্দেশ্যের জন্য নীরস। মূলত এই অনুচ্ছেদে “ফার্স্ট সিটিজেন অব দ্য ইউনিয়ন” (মিউল এর অফিসিয়াল উপাধি) এর উত্থানের পিছনে যে অর্থনৈতিক শর্ত আছে সেগুলো বিবেচনা করা হয়েছে।

যদিও অনুচ্ছেদটির লেখক, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শূন্য থেকে শুরু করে মিউলের বিশাল আধিপত্য বিস্তার এবং পাঁচ বছর শেষে এই আধিপত্য বিস্তার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অবাক হয়েও থাকেন, তিনি তা গোপন করে গেছেন।

যাই হোক, এনসাইক্লোপেডিয়া বাদ দিয়ে আমরা বরং মিউলের পাঁচ বছরের আগ্রাসন শেষে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ারের মধ্যবর্তী সময়ে যে বিশাল অরাজকতা তৈরি হয়েছিল, সেই ইতিহাসের দিকে কাহিনীকে নিয়ে যাব।

রাজনৈতিকভাবে ইউনিয়ন অত্যন্ত স্থিতিশীল। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সম্ভাবনাময়। মিউলের দৃঢ় শাসনে যে শান্তি বজায় ছিল সেটা বাদ দিয়ে পূর্বের বিশৃঙ্খল সময়ে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা কোনো মানুষেরই ছিল না। পাঁচ বছর পূর্বে যে গ্রহগুলো ফাউণ্ডেশনের অংশ বলে পরিচিত ছিল, সেখানে কোনো কোনো মানুষের স্মৃতিতে হঠাৎ কখনো ফাউণ্ডেশনের কথা মনে হয় তবে মনে হওয়া পর্যন্তই। এর বেশি কিছু নয়। ফাউণ্ডেশন নেতাদের যাদের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না তারা মারা গেছে। যাদের প্রয়োজন ছিল, তাদের কনভার্ট করা হয়।

এবং এই কনভার্টদের মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে হ্যান প্রিচার, বর্তমানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল।

.

ফাউণ্ডেশনের যুগে হ্যান প্রিচার ছিল একজন ক্যাপ্টেন এবং বিরোধী আণ্ডারগ্রাউণ্ড ডেমোক্রেটিক পার্টির সক্রিয় সদস্য। মিউলের নিকট ফাউণ্ডেশনের বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণের পরেও প্রিচার মিউলের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কনভার্সন হয়।

হ্যান প্রিচার জানে তার কনভার্সন কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। সে কনভার্টেড হয়েছে কারণ মিউল একটা মিউট্যান্ট যার সাধারণ মানুষকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করার দুর্লভ গুণাবলী রয়েছে। সে অবশ্য সন্তুষ্ট। এরকমই হয়। মিউল কর্তৃক কনভার্সনের এটাই প্রধান লক্ষণ, যদিও হ্যান প্রিচার এই ব্যাপারে কোনো কৌতূহলই নেই।

এই মুহূর্তে প্রিচার ইউনিয়নের বাইরের সীমাহীন গ্যালাক্সিতে তার পঞ্চম অভিযান শেষে ফিরতি পথে রয়েছে। তার কঠোর মুখ দেখে মনে হয় বাটালি দিয়ে কাঠ খোদাই করার মতো মসৃণভাবে তৈরি করা। সেখানে ভাবের কোনো প্রকাশ নেই। বাহ্যিক ভাব প্রকাশের কোনো প্রয়োজনও হয় না। কারণ একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে ভুরুর কল্পন দেখতে পারে, সেভাবেই মিউল মনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অনুভূতিকেও ধরতে পারে।

পুরাতন রাজকীয় হ্যাঁঙ্গারে বায়ুন রেখে প্রিচার বরাবরের মতো পায়ে হেঁটে প্রাসাদ চত্বরে প্রবেশ করল। তীরচিহ্নিত নীরব নির্জন মহাসড়ক ধরে এক মাইল হেঁটে গেল। প্রিচার জানে গোটা প্রাসাদ চত্বরে একজনও গার্ড নেই, একজনও সৈনিক নেই, একজনও সশস্ত্র লোক নেই।

মিউলের কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।

মিউল নিজেই তার সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষক।

নিজের পায়ের শব্দ প্রিচারের কানে মৃদু আঘাত করছে। প্রাসাদের চকচকে ভাব এখনও রয়েছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুঃসাহসীর মতো অত্যন্ত অনুজ্জ্বল এবং শক্তিশালী ধাতব দেওয়াল, পুরাতন, গাঢ়লাল খিলান যা বিগত সাম্রাজ্যের স্মৃতি বহন করে চলেছে। মনে হয় নির্জন প্রান্তর এবং দিগন্তের জনবহুল নগরীর সবকিছু সে লক্ষ্য করছে শক্তভাবে।

প্রাসাদে শুধু একজন লোক–সে নিজে–যার অমানবিক সম্মোহনী শক্তির উপর নতুন অভিজাত শ্রেণী এবং সমস্ত ইউনিয়ন নির্ভর করে।

জেনারেল সামনে দাঁড়াতেই বিশাল মসৃণ দরজা বিকট হাঁ করে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে সে উপর দিকে চলমান র‍্যাপে চড়ল। শব্দহীন এলিভেটরে করে প্রাসাদের সর্বোচ্চ চূড়ায় মিউলের আলো ঝলমলে ব্যক্তিগত কক্ষের ছোট দরজার সামনে এসে থামল।

বেইল চ্যানিশ বয়সে তরুণ এবং তাকে কনভার্ট করা হয়নি। অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে গেলে নিজের অনুগত রাখার জন্য মিউল তার ইমোশনাল প্যাটার্ন এডজাস্ট করেনি। তার ব্যক্তিত্ব চারদিকের পরিবেশ ও বংশগত ধারা অনুযায়ী যেভাবে গড়ে উঠেছে ঠিক সেরকমই রয়েছে।

ত্রিশ পূর্ণ হবার আগেই রাজধানীতে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। দেখতে সুদর্শন ও চটপটে–তাই সামাজিকভাবে সফল। সে বুদ্ধিমান এবং ধৈর্যশীল–মিউলের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক। দুই ধরনের সাফল্যই তাকে তৃপ্তি দেয়।

এই প্রথম মিউল তাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যে.মহাসড়ক ধরে সে হেঁটে যাচ্ছে সেটি সরাসরি চলে গেছে স্পঞ্জ এলুমিনিয়ামের তৈরি মোচাকৃতি চূড়ার দিকে যা একসময় কালগানের ভাইসরয়ের বাসস্থান ছিল, যারা সম্রাটের অধীনে থেকে শাসন করত; পরবর্তীতে কালগানের স্বাধীন প্রিন্সেরা এটিকে নিজেদের বাসস্থান হিসাবে ব্যবহার করে। এবং বর্তমানে এটি ফার্স্ট সিটিজেন অব দ্য ইউনিয়নের বাসস্থান, যে নিজের একটি বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করে।

চ্যানিশ নিজের মনে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন। সেই অস্বস্তিকর কাল্পনিক ভয়, যার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে মিউল তার সীমাহীন রাজ্যবিস্তারের নীতি থেকে দূরে সরে গেছে, তার সাম্রাজ্য বিস্তারনীতির অফিসিয়াল প্রতিশব্দ “কনসলিডেশন।”

এই মুহূর্তে বিভিন্ন গুজব তৈরি হচ্ছে–গুজব কখনো বন্ধ হয় না। শোনা যাচ্ছে মিউল পুনরায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। মিউল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে এবং যে কোনো মুহূর্তে হামলা চালাবে। মিউল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সাথে চুক্তি করে গ্যালাক্সি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। মিউল সিদ্ধান্তে এসেছে যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং পুরো গ্যালাক্সিতে তার আধিপত্য বিস্তার করবে।

গুজবের কোনো শেষ নেই। শুধু প্রথমবারের মতোই এ ধরনের গুজব ছড়ায়নি। বেইল চ্যানিশের মনে অবশ্য রহস্যময় দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ব্যাপারে কোনো দ্বিধা বা ভয়। নেই। আবার মিউলকেও সে ভয় পায় না এবং এটা নিয়ে তার কিছুটা অহঙ্কারও রয়েছে।

নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছল সে।

বিশাল মসৃণ দরজা বিকট হা করে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে সে উপরদিকে চলমান র‍্যাল্পে চড়ল। শব্দহীন এলিভেটরে করে প্রাসাদের সর্বোচ্চ চূড়ায় মিউলের আলো ঝলমলে ব্যক্তিগত কক্ষের ছোট দরজার সামনে এসে থামল।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিউল-তার অন্য কোনো নাম নেই এবং অফিসিয়ালি তার উপাধি ফার্স্ট সিটিজেন’–একমুখী স্বচ্ছ দেওয়ালের ভিতর দিয়ে দিগন্তের আলো ঝলমলে সুউচ্চ নগরীর দিকে তাকিয়ে আছে।

দিনের আলো নিভে যাওয়ায় নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে এবং সবগুলোই তার নিকট আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য।

এই চিন্তাটা তার মুখে ক্ষীণ একটু তিক্ত হাসি ফুটিয়ে তুলল। আসলে তারা আনুগত্য স্বীকার করেছে এমন একটি ক্ষমতার কাছে যা কেউ আগে কখনো দেখেনি।

তাকিয়ে থাকার মতো সুদর্শন সে নয়। মিউল–অবহেলার দৃষ্টিতেই সবাই তার দিকে তাকাবে। লম্বায় পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি এবং ওজন একশ বিশ পাউণ্ড। তার কংকালসার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো হাড্ডিসার দেহ থেকে অশোভনভাবে বেরিয়ে রয়েছে। শুকনো মুখ থেকে মাংসল মোটা ঠোঁট উকটভাবে ঝুলে আছে প্রায় তিন ইঞ্চি।

তার চোখের দিকে তাকালে কেউ ধারণাই করতে পারবে না যে সে মিউল। তার চোখে রয়েছে শান্ত নরম দৃষ্টি–যা গ্যালাক্সির সর্বশ্রেষ্ঠ দখলদারের জন্য একেবারেই বেমানান– সেই সাথে কিছুটা বিষণ্ণতাও মেশানো রয়েছে।

নগরীতে বিলাসবহুল পৃথিবীর বিলাসবহুল রাজধানীর সকল আমোদপ্রমোদের ব্যবস্থা আছে। সে তার সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ ফাউণ্ডেশনে রাজধানী স্থাপন করতে পারত, কিন্তু ফাউণ্ডেশন গ্যালাক্সির একেবারে প্রান্তে অবস্থিত। কালগান অনেকটা কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং অভিজাত শাসকদের ভূমি হিসাবে এর রয়েছে আলাদা ঐতিহ্য। কৌশলগত দিক দিয়ে কালগানই রাজধানী হিসাবে উৎকৃষ্ট।

তারপরেও সে শান্তি পায়নি।

তারা তাকে ভয় করে, মান্য করে, এমনকি শ্রদ্ধাও করে কিন্তু একটা দূরত্ব বজায় রেখে, অবজ্ঞা ছাড়া কেইবা তার দিকে তাকাবে? শুধু তারাই যাদেরকে সে কনভার্ট করেছে। কিন্তু তাদের কৃত্রিম আনুগত্যের কী মূল্য রয়েছে। এতে কোনো আনন্দ নেই। ইচ্ছা করলে সে অনেক উপাধি ধারণ করতে পারে, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান আরোপ করতে পারে, কিন্তু তাতেও অবস্থার পরিবর্তন হবে না। বরং ভাল বা বলা যায় যে খারাপ কিছু ঘটবে না যদি শুধুমাত্র ফার্স্ট সিটিজেন হয়ে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে।

হঠাৎ করে তার ভিতরে তীব্র ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল। গ্যালাক্সির সামান্যতম অংশও তাকে অস্বীকার করতে পারবে না। গত পাঁচ বছর ধরে সে নিজেকে চুপচাপ কালগানে কবর দিয়ে রেখেছে শুধুমাত্র না দেখা, শোনা, না জানা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অন্তহীন, রহস্যময় হুমকির কারণে। তার বয়স বত্রিশ। যদিও বৃদ্ধ বয়স নয় কিন্তু সে নিজেকে বৃদ্ধ মনে করে। তার যতই তীব্র মেন্টাল পাওয়ার থাকুক, শারীরিকভাবে সে দুর্বল।

প্রতিটি নক্ষত্র! যতগুলি নক্ষত্র সে দেখতে পারে এবং যতগুলি নক্ষত্র সে দেখতে পারে না সবই তার।

প্রতিশোধ। এমন একটি মানবসভ্যতার উপর যেখানে তার কোনো অংশ নেই। এমন একটি গ্যালাক্সির উপর যেখানে তার যোগ্যতার কোনো স্বীকৃতি নেই।

মাথার উপরের ঠাণ্ডা সবুজ ওয়ার্নিং লাইট জ্বলে উঠল। যে লোকটি প্রাসাদে প্রবেশ করেছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ সে অনুভব করতে পারছে এবং যেহেতু সন্ধ্যার ম্লান আলোয় তার মিউট্যান্ট অনুভূতি আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে, সেহেতু আগন্তুকের মস্তিষ্কের ভিতরে ঢুকে সমস্ত আবেগ বুঝতে পারছে।

কোনো চেষ্টা ছাড়াই সে আগন্তুককে চিনতে পারল। প্রিচার।

ফাউণ্ডেশনের এক সময়ের ক্যাপ্টেন, সেই ক্যাপ্টেন প্রিচার যে তঙ্কালীন ক্ষয়িষ্ণু শাসনব্যবস্থার অবহেলার স্বীকার। ক্যাপ্টেন প্রিচারের কাজ ছিল একজন সাধারণ পাই এর। সেখান থেকে তাকে সে উদ্ধার করে প্রথমে কর্নেল এবং পরে জেনারেল পদে উন্নীত করে; পুরো গ্যালাক্সিতে তার কাজের পরিধি বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

বর্তমানের জেনারেল প্রিচার সম্পূর্ণ অনুগত, যদিও শুরুতে সে ছিল প্রচণ্ড বিদ্রোহী। তাকে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে বা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বা প্রতিদানের উদ্দেশ্যে সে মিউলের প্রতি অনুগত নয়–বরং শুধুমাত্র কৃত্রিম কনভার্সনের কারণেই সে অনুগত।

মিউল পাঁচ বছর আগে তার মেন্টাল পাওয়ারের মাধ্যমে হ্যান প্রিচারকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। তার মনে আনুগত্য ও শ্রদ্ধার আবরণ তৈরি করে দেয়। ফলে প্রিচারের নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা, আদর্শ মিউলের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধার নিচে চাপা পড়ে গেছে।

পিছনে দরজা খোলার শব্দে সে ঘুরে দাঁড়াল, দেওয়ালের স্বচ্ছতা মুছে গিয়ে অস্বচ্ছ ভাব দেখা দিল। সন্ধ্যার ধূসর আলোর বদলে জ্বলে উঠল সাদাটে এটমিক আলো।

কক্ষে ঢুকে সোজা তার নির্ধারিত আসনে বসল প্রিচার। মিউলকে কোনো প্রকার কুর্নিশ, স্যালুট বা সম্মানসূচক সম্বোধন করার প্রয়োজন নেই। সে শুধুই ফার্স্ট সিটিজেন’। শুধু স্যার’ বলে সম্বোধন করলেই চলে। তার সামনে যে কেউ বসতে পারবে, এমনকি পিছন ফিরতেও পারবে।

হ্যান প্রিচারের কাছে এগুলো একজন নিশ্চিত, আত্মবিশ্বাসী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির আচরণ বলে মনে হয়।

মিউল বলল, ‘তোমার চূড়ান্ত রিপোর্ট গতকাল আমার কাছে পৌঁছেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই সব বিষয় আমি পরিষ্কার বুঝতে পারিনি।”

জেনারেলের ভুরু কুঁচকে গেল, হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি–কিন্তু এছাড়া আর কিছু বলার নেই। আসলে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কোনো অস্তিত্বই নেই, স্যার।

গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা ঝকাল মিউল, ‘এবলিং মিস’-এর দেওয়া কিছু তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এই তথ্য প্রমাণগুলোকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

‘নতুন কোনো গল্প নয়।’ প্রিচার আগের সুরেই বলে গেল ‘মিস ফাউণ্ডেশনের সেরা সাইকোলজিস্ট হতে পারে, কিন্তু হ্যারি সেলডনের তুলনায় সে দুগ্ধপোষ্য শিশু। যখন সে সেলডনের বিষয়ে গবেষণা করছিল সেই সময়ে মিস আপনার কৃত্রিম ব্রেইন কন্ট্রোলের অধীনে ছিল। আপনি হয়তো বেশি চাপ প্রয়োগ করেছেন, যার ফলে সে ভুল করেছে। স্যার, আমার মতে তার অবশ্যই ভুল হয়েছে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিউল, পাতলা ঘাড় থেকে তার বিষণ্ণ মুখ আচমকা সামনে এগিয়ে এল। যদি সে আর একটা মিনিট বেঁচে থাকত। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেই আমাকে বলতে চেয়েছিল কোথায় রয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন। আমি বলছি, সে জানত। আমার পিছানোর প্রয়োজন নেই, অপেক্ষা করারও প্রয়োজন নেই। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। বিনা লাভে পাঁচ বছর চলে গেছে।

প্রিচার তার শাসনকর্তার এই ব্যাকুল আচরণের জন্য কিছু বলতে পারল না; তার নিয়ন্ত্রিত মেন্টাল গঠন তাতে বাধা প্রদান করল। তবে সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল, অস্বস্তিও বোধ করতে লাগল। কিন্তু এ ছাড়া আর কী বিকল্প ব্যাখ্যা রয়েছে স্যার, সে বলল, ‘পাঁচ পাঁচবার আপনার চিহ্নিত পথে আমি অনুসন্ধান চালিয়েছি। এবং আমি এমনকি প্রতিটি গ্রহাণু পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ধরা যাক তিনশ বছর পূর্বে হ্যারি সেলডন পুরোনো ধ্বংসপ্রায় সাম্রাজ্যের বদলে নতুন সাম্রাজ্য গঠনের ভিত্তি হিসাবে দুটি ফাউণ্ডেশন স্থাপন করেন। সেলডনের মৃত্যুর এক শ বছরের মধ্যে প্রথম ফাউণ্ডেশন’ যাদের আমরা ভালো মতোই চিনি–তার নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে পরিচিতি লাভ করে। সেলডনের মৃত্যুর দেড়শ বছরের মধ্যে এম্পায়ারের সাথে শেষ লড়াইয়ের সময় এটি পুরো গ্যালাক্সিতে পরিচিতি লাভ করে। আর এখন তিন শ বছর পর কোথায় রয়েছে সেই রহস্যময় দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন? গ্যালাক্সির কোথাও এর নাম শোনা যায়নি।

‘এবলিং মিস বলেছিল তারা নিজেদের অস্তিত্ব গোপন রেখেছে। গোপনীয়তাই তাদের মূল শক্তি।‘

‘এতই গভীর গোপনীয়তা, যার ফলে মনে হয় যে কোনো অস্তিত্বই নেই।‘

মিউল তার তীক্ষ্ণ চোখ তুলে তাকাল। ‘না তাদের অস্তিত্ব আছে।‘ হাড্ডিসার আঙুল তুলে বলল, ‘কৌশলগত কিছুটা পরিবর্তন আনা হবে।‘

প্রিচার কুটি করল। ‘আপনি কী নিজে যেতে চান? আমার মতে সেটা ভাল হবে না।‘

‘না, অবশ্যই না। তোমাকে আরেকবার যেতে হবে–শেষবারের মতো। কিন্তু অন্য একজনের সাথে যৌথভাবে।‘

কিছুক্ষণের নীরবতা, প্রিচার শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কে, স্যার?’

‘কালগানেরই এক তরুণ। বেইল চ্যানিশ।‘

‘কখনো নাম শুনিনি।‘

‘না, আমার মনে হয় না। তবে সে সপ্রতিভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তাকে আমার ক্ষমতা দিয়ে কনভার্ট করা হয়নি।’

প্রিচারের দীর্ঘ চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, ‘আমি এখনও বুঝতে পারছি না এতে কী লাভ হবে।’

‘একটা লাভ হবে, প্রিচার। তুমি দক্ষ এবং অভিজ্ঞ লোক। তুমি আমাকে যথেষ্ট সার্ভিস দিয়েছ। কিন্তু তোমার অনুপ্রেরণা আরোপিত এবং আমার প্রতি রয়েছে অসহায় আনুগত্য। যখন তোমার নিজস্ব অনুপ্রেরণাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়, তোমার ভিতর থেকে সুক্ষ্ম কিছু অনুভূতি হারিয়ে যায়, যা আমি প্রতিস্থাপন করতে পারি না।’

‘আমার সেরকম মনে হয় না, স্যার।’ প্রিচার হাসি মুখে বলল। যখন আমি আপনার বিরোধী ছিলাম তখনকার কথা আমার ভালই মনে আছে। কোনোটাকেই কম জোড়ালো মনে হয় না।’

‘হবেও না।’ মিউলের মুখে হাসি ফুটল। এই ব্যাপারে তোমার বিশ্লেষণ কিছুটা বাস্তববাদী। চ্যানিশ উচ্চাকাঙ্খী। পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য। শুধুমাত্র নিজের কাছেই অনুগত। সে ভালমতোই জানে যে আমার সাথে থাকলেই সে উপরে উঠতে পারবে এবং আমার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সবকিছু করবে, যাতে সে অনেক উপরে উঠতে পারে। যদি সে তোমার সাথে যায়, তার একটাই কারণ–নিজের উন্নতি।

‘তা হলে’ প্রিচার বলল আপনি আমার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিচ্ছেন না কেন, যদি আপনি মনে করেন যে এতে আমার ভালো হবে। আমাকে এখন অবিশ্বাস করার দরকার নেই।

কখনোই না, প্রিচার। যেহেতু তুমি যে-কোনো মুহূর্তে আমার এক হাতের মধ্যে পৌঁছতে পারবে তাই তোমাকে কনভার্সনে রাখাই ভালো। এই মুহূর্তে তোমার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিলে পরমুহূর্তে তুমি আমাকে খুন করবে।

জেনারেলের নাকের পাটা ফুলে গেল। ‘আমি ভাবতেও পারি না আপনি এরকম চিন্তা করবেন।‘

‘আমি তোমাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য বলিনি। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় তোমার অনুভূতি কেমন হবে, তা তুমি আন্দাজ করতে পারবে না। মানুষের মন যে-কোনো শাসনে বাধা দেয়। তাই সাধারণ সম্মোহনকারী কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্মোহিত করতে পারে না, আমি পারি। কারণ আমি সম্মোহনকারী নই এবং বিশ্বাস কর, তোমার ভিতরে তোমার অজান্তে যে-আক্রোশ রয়েছে আমি তার মুখোমুখি হতে চাই না।’

প্রিচার মাথা নিচু করল। নিজেকে অন্তঃসারশূন্য মনে হচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর সে কথা বলতে পারল তাহলে এই লোককে আপনি কীভাবে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন।

‘আমার মনে হয় পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। সেই কারণেই তুমি তার সাথে যাবে। দেখ, প্রিচার’ বলেই মিউল গদিমোড়া আর্মচেয়ারে এমনভাবে বসল, দেখে মনে হয় জীবন্ত টুথপিক, যদি সে দৈবাৎ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের খোঁজ পায়–যদি তার কাছে মনে হয় যে আমার সাথে থাকার চেয়ে তাদের দলে যোগ দেওয়াই বুদ্ধিমানের–তুমি বুঝতে পারছ?

প্রিচারের চোখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটল। খুব ভাল, স্যার। ‘অবশ্যই। কিন্তু মনে রাখবে তাকে যতদূর সম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে। নিশ্চয়ই।

‘আর…হ্যাঁ…প্রিচার। বেইল চ্যানিশ সুশ্রী এবং আকর্ষণীয় সুপুরুষ। সে যেন তোমাকে বোকা বানাতে না পারে। সে বিবেকবর্জিত ভয়ঙ্কর লোক। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া কখনো তার মোকাবেলা করো না। এই পর্যন্তই।‘

.

আবার একা হয়ে পড়ল মিউল, কক্ষের বাতি বন্ধ করে দিয়ে সে স্বচ্ছ দেওয়ালের ভিতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আকাশ এই মুহূর্তে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দিগন্তে নগরীতে বয়ে চলেছে আলোর বন্যা।

কেন এসব করতে হবে? এবং যদি সে সবকিছুর উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তাহলেই বা কী হবে। এর ফলে কী প্রিচারের মতো লোকদের শক্তিশালী এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠা বন্ধ হবে? বেইল চ্যানিশের সুদর্শন চেহারা কী নষ্ট হয়ে যাবে? সে নিজে কী মিউল ছাড়া অন্য কিছু হতে পারবে?

নিজেকে মৃদু ধমক দিল। আসলে সে কী চায়?

মাথার উপরের ওয়ার্নিং লাইট একবার জ্বলল নিভল। প্রাসাদে যে প্রবেশ করেছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ সে এখানে বসেই টের পাচ্ছে এবং প্রায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ব্রেইন ওয়েভের প্রতিটি তরঙ্গ ধরতে পারছে।

অনায়াসেই লোকটিকে চিনতে পারল সে। চ্যানিশ। তার মাইণ্ডে ধারাবাহিকতা না থাকলেও সনাতন, গতিশীল ও শক্ত একটি মাইণ্ড রয়েছে যা মহাজগতের নিজস্ব প্রভাব ছাড়া অন্য কোনো প্রভাব থেকে মুক্ত। সে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে। তার ভিতরে খুব সামান্য হলেও সতর্কতা রয়েছে, কিছুটা অশ্লীলতাও রয়েছে। সবকিছুর পরও তার মধ্যে রয়েছে অহংবোধ ও নিজের প্রতি ভালবাসার অন্তহীন প্রবাহ, তার সাথে রয়েছে নিষ্ঠুর কৌতুকপ্রবণতা এবং উচ্চাকাঙ্খ।

মিউল জানে ইচ্ছা করলেই সে চ্যানিশের ব্রেইন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। তাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিতে পারে। নিজের ইচ্ছামতো চালাতে পারে। কিন্তু কী হবে তাতে। যদি সে চ্যানিশের অহংকারী মাথা তার কাছে নিচু করতে বাধ্য করে তাতে কী তার নিজস্ব হাস্যকর অবস্থার পরিবর্তন হবে, যে কারণে সে দিনকে ঘৃণা করে ও রাতের অন্ধকারকে ভালবাসে, যে কারণে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও সে একাকী, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছে।

পিছনে দরজা খোলার শব্দে সে ঘুরল। দেওয়ালের স্বচ্ছ ভাব মুছে গিয়ে আণবিক আলো কক্ষের অন্ধকার দূর করে দিল।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

বেইল চ্যানিশ হালকাভাবে চেয়ারে বসল, আমার কাছে এই সম্মান আশাতীত নয়, স্যার।

চার আঙুলে মুখ ঘষে বিরক্তির সাথে বলল মিউল, ‘কেন নয়?’

আমার মনে হয় যদি না স্বীকার করতে চাই যে আমি গুজব শুনছি।

‘গুজব? বিশেষ করে কোনটার কথা তুমি বলছ?’

‘আবার গ্যালাক্সিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের যে কথাগুলো শোনা যাচ্ছে। আমি আশা করি কথাগুলো সত্যি হবে এবং এতে নিজেও যথাযথভাবে অংশ নিতে পারব।’

‘তাহলে তুমি মনে কর যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব আছে।‘

‘কেন নয়? এর ফলে পুরো ব্যাপারটিই মজাদার হয়ে উঠছে।‘

‘এবং এতে তুমি মজাও খুঁজে পাচ্ছ?’

‘নিশ্চয়ই। তাদের অতিরিক্ত রহস্যময়তার কারণেই। অনুমান করার জন্য এর চেয়ে ভাল বিষয় আর আছে কী? সংবাদপত্রগুলো আজেবাজে খবরে ভরা থাকে তবে একটা খবরের কিছুটা গুরুত্ব থাকতে পারে। দি কসমস-এর একজন ফিচার লেখক তার প্রতিবেদনে এমন একটি পৃথিবীর কথা বলেছে যেখানে মেন্টাল পাওয়ারের অধিকারী লোকেরা বাস করে–দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন বুঝতেই পারছেন–যারা বাস্তব বিজ্ঞানের মোকাবেলা করার জন্য তাদের মেন্টাল ফোর্সকে শক্তিতে পরিণত করেছে। এই শক্তির দ্বারা লাইট ইয়ার দূরে থাকতেই মহাকাশযান ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব, গ্রহগুলোকে তাদের কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব–’

‘মজার ব্যাপার, কিন্তু এই বিষয়ে তোমার ধারণা কতটুকু? এই মাইণ্ড পাওয়ারের ধারণার কথা অন্য কারো কাছে বলেছ?”

‘গ্যালাক্সি, না! আপনি কী মনে করেন তারা শুধু নিজেদের গ্রহেই বসে থাকবে। না স্যার। আমি মনে করি আমরা যতটুকু জানি তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল বলে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে।‘

‘সেই ক্ষেত্রে, ব্যাপারটি সহজ করে বলি। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে খুঁজে বের করার একটা অভিযানে নেতৃত্ব দিতে তোমার কেমন লাগবে।‘

মুহূর্তের জন্য মনে হল ধারণার চেয়েও দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ায় চ্যানিশ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় সে চুপ করে রইল।

মিউল শুষ্কভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘তো?’

কপালে ভাঁজ পড়ল চ্যানিশের। ‘নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাকে কোথায় যেতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ আপনার কাছে আছে।‘

‘জেনারেল প্রিচার তোমার সাথে যাবে–’

‘অর্থাৎ আমি প্রধান ব্যক্তি নই?

কাজ শেষে নিজেকে বিচার করো। শোনো, তুমি ফাউণ্ডেশন থেকে আসনি। কালগানের স্থানীয় অধিবাসী, তাই না? তাহলে সেলডন প্ল্যান সম্পর্কে তোমার ধারণা খুবই সীমিত। যখন প্রথম গ্যালাকটিক এম্পায়ারের পতন ঘটছে, সেই সময় হ্যারি সেলডন এবং কয়েকজন সাইকোহিস্টোরিয়ান গণিতের সূত্রের মাধ্যমে ইতিহাসের ভবিষ্যৎ ধারা বিশ্লেষণ করে গ্যালাক্সির দুই শেষপ্রান্তে দুটো ফাউণ্ডেশন স্থাপন করেন। তিনি এমনভাবে পরিকল্পনা করেন যাতে দ্বিতীয় এম্পায়ারের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিধারা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। হ্যারি সেলডন পরিকল্পনা সম্পন্ন করতে এক হাজার বছর সময় নির্ধারণ করেছেন–এবং ফাউণ্ডেশন ছাড়া সময় নেবে ত্রিশ হাজার বছর। কিন্তু তিনি আমার বিষয় বিবেচনা করেননি। আমি একজন মিউট্যান্ট এবং সাইকোহিস্টোরির মাধ্যমে আমাকে প্রতিরোধ করা যাবে না। তুমি বুঝতে পারছ?’

‘পুরোপুরি স্যার। কিন্তু এর সাথে আমার সম্পর্ক কোথায়?’

‘এখনি বুঝে যাবে। আমি গ্যালাক্সিকে একত্র করতে চাই–এবং সেলডনের এক হাজার বছরের উদ্দেশ্য মাত্র তিনশ বছরে অর্জন করতে চাই। প্রথম ফাউণ্ডেশন–পদার্থবিজ্ঞানীদের কলোনি–আমার অধীনে থেকে আরও সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে। ইউনিয়নের অগ্রযাত্রা এবং আদেশে তাদের তৈরি যে কোনো অস্ত্র আমার হাতে পৌঁছবে– দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন ছাড়া। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সম্বন্ধে আমাকে আরও বেশি করে জানতে হবে। জেনারেল প্রিচার পুরোপুরি নিশ্চিত যে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আমি জানি আছে।’

‘কীভাবে জানেন স্যার’, চ্যানিশ জিজ্ঞেস করল।

মিউল হঠাৎ রাগের সাথে বলল, আমি যাদের মাইণ্ড কন্ট্রোল করি, তাদের কন্ট্রোল্ড মাইণ্ডে ইন্টারফেয়ার করা হয়েছে। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। এ ধরনের ইন্টারফেয়ারেন্স ক্রমেই বাড়ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকদের আঘাত করছে।

‘এখানেই তোমার গুরুত্ব। জেনারেল প্রিচার আমার অনুগতদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা, তাই সেও নিরাপদ নয়। অবশ্যই সে কিছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু তোমার কনভার্সন হয়নি, তাই আমার লোক বলে সহজে কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না। আমার যে কোনো অনুগতের চেয়ে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে তুমি অনেক বেশি সময় বোকা বানাতে পারো। বুঝেছ?’।

হুমম-ম-ম। হ্যাঁ। কিন্তু আপনার লোকদের কীভাবে পরিবর্তন করা হচ্ছে, যাতে জেনারেল প্রিচারের কোনো পরিবর্তন হলে আমি ধরতে পারি। তারা কী আপনার উপর আনুগত্য হারিয়ে ফেলে?

‘না আমি তোমাকে বলেছি ব্যাপারটি ঘটে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। এর চেয়েও বেশি। বিপজ্জনক কারণ পরিবর্তন ধরা খুব কঠিন এবং কখনো কখনো আমাকে গুরুত্বপূর্ণ লোকদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হয় যে তারা কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কিনা। তাদের আনুগত্য আগের মতোই থাকে, কিন্তু উদ্যোগ এবং অকৃত্রিম আচরণ তাদের মধ্যে থেকে মুছে ফেলা হয়। তারা সবাই পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু কোনো কাজে আসে না। গতবছর সেরা ছয়জনের এই অবস্থা হয়েছিল। মিউলের মুখের এককোনা বেঁকে গেল।

‘ধরুন, স্যার…ধরুন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন এই কাজগুলো করছে না, তাহলে কী অন্য কেউ যেমন আপনার নিজের মতো, আরেকজন মিউট্যান্ট।‘

‘ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে সতর্ক ও দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে। একজন মাত্র লোক হলে অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করত তাই না, এরা পুরো একটি পৃথিবী এবং তুমিই হবে তাদের বিরুদ্ধে আমার অস্ত্র।’

চ্যানিশের চোখে আলো ফুটে উঠল, ‘এই সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।‘

তার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করল মিউল। সে বলল, ‘হ্যাঁ অবশ্যই এই সুযোগ তোমার প্রাপ্য, যেন তুমি বিশেষ কিছু করতে পার, যার জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার। এমনকী আমার উত্তরসূরিও নির্বাচন করতে পারি তোমাকে। কিন্তু বিশেষ শাস্তিরও ব্যবস্থা রয়েছে। আমার ক্ষমতা শুধুমাত্র মানুষকে আমার প্রতি অনুগত করেই রাখে না।‘

ভয়ে চ্যানিশ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মুহূর্তের জন্য, আলোর এক ঝলকের মতো চ্যানিশ অনুভব করল তীব্র ব্যথার একটি প্রবাহ তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে। প্রচণ্ড শারীরিক ব্যথা তাকে বিধ্বস্ত করে দিল, তারপর ব্যথাটা চলে গেল। এখন তার মাইণ্ড কোনো ব্যথা অনুভব করছে না, শুধু প্রচণ্ড রাগের প্রবাহ অনুভব করছে।

মিউল বলল, রাগ করে লাভ নেই… তুমি লুকোচ্ছ, তাই না? কিন্তু আমি সব দেখতে পারছি। তাই শুধু মনে রাখবে এ ধরনের ঘটনা আবারও ঘটবে এবং বারবার ঘটতে থাকবে। আমার মেন্টাল পাওয়ার দিয়ে অনেক মানুষ মেরেছি এবং এর চেয়ে কষ্টকর মৃত্যু আর নেই।

থামল সে, ‘এই পর্যন্তই।‘

.

মিউল আবার একা হল। আলো বন্ধ করে সে সামনের দেওয়ালের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনল। আকাশ এখন কালো, আর মহাকাশের মসৃণ গহ্বরে গ্যালাকটিক লেন্সের প্রসারমান অবয়ব চুমকীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে।

নিহারিকার পাতলা কুয়াশার মতো যা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি পরস্পরের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে মনে হয় একটি আলোর মেঘ।

এবং এর সবকিছুই তার-–

আর শুধু একটা কাজ সারতে হবে, তারপর ঘুমাতে যাবে সে।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

প্রথম সম্মেলন

তাদেরকে বলা হয় সাইকোলজিস্ট-এবং তাতেও সবটুকু ব্যাখ্যা হয় না। বরং বলা উচিৎ “সায়েন্টিস্ট উইথ সাইকোলজিক্যাল অরিয়েন্টেশন।” অর্থাৎ এই মানুষগুলোর বৈজ্ঞানিক দর্শন আমাদের পরিচিত বৈজ্ঞানিক দর্শন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। প্রচলিত সাইকোলজির অনুমিতির সাথে এই সাইকোলজির কোনো মিল নেই।

বিষয়টা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন-অনেকটা একদল অন্ধলোকের নিকট আরেকজন অন্ধলোকের রং এর বর্ণনা দেওয়ার মতো।

মোট কথা এখানে যারা আছেন তাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মাইণ্ড গঠন এবং কার্যপ্রণালী বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারেন। শুধু তাত্ত্বিক ভাবেই নয় বহুদিন ধরে এই তত্ত্বগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন তারা। আমাদের কাছে যা দীর্ঘ বক্তব্য হিসেবে পরিচিত এখানে সেটা অপ্রয়োজনীয়। বাক্যের কোনো একটি ছোট অংশও এখানে বাহুল্য। ইশারা, ইঙ্গিত-এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের নীরবতা থেকেও পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্যের আদান প্রদান হয়।

যাই হোক আশৈশব সাইকোলজিক্যাল অরিয়েন্টেশনে বেড়ে উঠা এই মানুষগুলোর সম্মেলনের ক্ষুদ্র একটি অংশ শব্দ এবং বাক্যের সমন্বয়ে প্রকাশ করা হলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য। যদিও সূক্ষ্ম তারতম্যের কিছুটা ভয় আছে।

প্রধান ‘কণ্ঠস্বর’ সবাই তাকে জানে শুধুমাত্র ফার্স্ট স্পিকার হিসেবে, তিনি বলছিলেন ‘স্পষ্টতই এখন বোঝা যাচ্ছে মিউল তার প্রথম আগ্রাসন থামাতে কেন বাধ্য হয়েছিল। মিউল তার কৃত্রিম ব্রেইন এনার্জি বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের অবস্থান প্রায় জেনে ফেলেছিল। সেই লোক, প্রথম ফাউণ্ডেশন যাকে “সাইকোলজিস্ট” বলে জানত, মিউলের কাছে তার আবিষ্কারের কথা বলার আগ মুহূর্তে তাকে হত্যা করা হয়। ফেজ থ্রি অনুযায়ী এটি একটি আকস্মিক ঘটনা। এবার তুমি বল।‘

ফার্স্ট স্পিকার, পঞ্চম বক্তাকে নির্দেশ করলেন, সে সূক্ষ্ম কাঠিন্যের সাথে বলা শুরু করল, ‘এটা নিশ্চিত যে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, বিশেষ করে যে-আক্রমণ পরিচালিত হয় মিউলের মতো তীক্ষ্ণ মেন্টাল পাওয়ারের অধিকারী একজনের দ্বারা, প্রথম ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করার কিছুদিন পরে, সঠিক হিসাবে ছয়মাস পড়ে সে ট্রানটরে এসেছিল। ছয়মাসের মধ্যে আবার সে এখানে আসবে এবং সমস্ত সম্ভাবনা আমাদের প্রতিকুলে–৯৬.৩ প্লাস অথবা ০.০৫%, যথার্থ হিসাবে। যে-শক্তি মিউলকে থামতে বাধ্য করেছিল তার বিশ্লেষণ করতে আমাদের প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। আমরা জানি কোন অনুভূতি তাকে পরিচালিত করেছে। শারীরিক খুঁতের কারণে তার ভিতরে তৈরি জটিলতা এবং মানসিক বিশেষত্ব আমাদের জানা। যাই হোক, ফেজ থ্রি দ্বারা সমস্ত ঘটনা বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করা গেছে যে–তার এই নিয়ম-বহির্ভূত আচরণের প্রধান কারণ হচ্ছে তার প্রতি সত্যিকার অনুভূতি রয়েছে এমন একজন ব্যক্তির উপস্থিতি।

‘এবং যেহেতু এই নিয়ম-বহির্ভূত আচরণ সঠিক সময়ে আরেকজন হিউম্যান বিয়িং এর উপর নির্ভর করে, তাই শুধু এই ঘটনাই আকস্মিক। আমাদের এজেন্ট নিশ্চিত যে এক তরুণী মিউলের সাইকোলজিস্টকে হত্যা করে। এই মেয়েটিকে মিউল বিশ্বাস করত এবং তাই তাকে সে মেন্টালি কন্ট্রোল করেনি–কারণ মেয়েটি তাকে পছন্দ করত।

‘সেই ঘটনার পর, পুরো বিষয়টির একটি গাণিতিক বিশ্লেষণ করা হয়–যার বিস্তারিত বর্ণনা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে রয়েছে। এই বিশ্লেষণ আমাদের সতর্ক করে তুলেছে। কারণ আমরা মিউলকে থামিয়েছি অপ্রচলিত পদ্ধতিতে যার ফলে সেলডনের সমস্ত পরিকল্পনা প্রতিদিন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।‘ এই বলে সে শেষ করল।

ফার্স্ট স্পিকার বলার পূর্বে প্রত্যেককে বিষয়টি অনুধাবন করানোর জন্য কিছুক্ষণ থেমে থাকলেন। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সেলডনের মুল পরিকল্পনা প্রায় ধ্বংসের মুখে এবং সেই সাথে আমি এও বলব যে, আমাদের দূরদৃষ্টির অভাবে ব্যাপারটি আরও জটিল হয়ে পড়ছে। সময় চলে যাচ্ছে। আমার মতে আমাদের হাতে একটাই সমাধান রয়েছে–যদিও সেটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

‘আমাদের খুঁজে বের করার জন্য মিউলকে সুযোগ দেব–আপাতদৃষ্টিতে।‘

আবার কিছুক্ষণ থামলেন, এই সুযোগে সকলের অনুভূতি বুঝে নিলেন, তারপর আমি আবারও বলছি–আপাতদৃষ্টিতে।

১.২ মহাশূন্য

মহাকাশযান যাত্রার জন্য প্রায় তৈরি। কোনো কিছুর অভাব নেই, শুধু গন্তব্য ছাড়া। মিউল আবার ট্র্যানটরে ফিরে যেতে বলেছে–যা ছিল মানব সভ্যতার সর্ববৃহৎ অতুলনীয় মেট্রো পলিস–এই ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবী একসময় ছিল গ্যালাকটিক এম্পায়ারের রাজধানী।

ব্যাপারটি প্রিচারের পছন্দ হয়নি। ট্রানটরের যাত্রাপথ অত্যন্ত দীর্ঘ, নীরস।

বেইল চ্যানিশকে সে নেভিগেশন রুমে দেখতে পেল। তরুণের কোকড়ানো চুল যথেষ্ট এলোমেলো কিন্তু শুধু একগোছা চুল কপালের উপর এসে পড়েছে, যেন ইচ্ছে করেই ফেলে রাখা হয়েছে। সাথে তার মুখের হাসি মানিয়ে গেছে বেশ। প্রিচার কিছুটা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল।

চ্যানিশ স্পষ্টই উত্তেজিত, ‘প্রিচার, সত্যিই কো-ইনসিডেন্স।’

ঠাণ্ডা গলায় বলল জেনারেল, ‘বুঝতে পারছি না কিসের কথা বলছ।’

‘ওহ, ঠিক আছে, একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড় ওল্ড ম্যান, কথা বলা যাক। আমি তোমার রিপোর্টগুলো পড়ছিলাম, সত্যিই দারুণ কাজ।‘

‘খুব খুশি হলাম।’

‘কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি তুমি কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারনি বলে। তুমি কী সমস্যাটিকে যুক্তি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেছ? বলতে চাচ্ছি একের পর এক নক্ষত্র তন্নতন্ন করে খোঁজার প্রয়োজন আছে এবং গত পাঁচটি অভিযানে এই করতে গিয়ে তুমি এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রে প্রায় লাফিয়ে বেড়িয়েছ। কিন্তু হিসাব করে দেখেছ এইভাবে পরিচিত প্রতিটি নক্ষত্র খুঁজে দেখতে কী পরিমাণ সময় লাগবে।

‘হ্যাঁ, অনেকবার।‘ প্রিচার এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করল না।

‘তা হলে প্রথমেই আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কী খুঁজছি।’

‘দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন, প্রিচারের মুখে মুচকি হাসি।

‘সাইকোলজিস্টদের ফাউণ্ডেশন’ চ্যানিশ শুদ্ধ করে দিল, ‘যারা ফিজিক্যাল সায়েন্সে দুর্বল, যেমন প্রথম ফাউণ্ডেশন সাইকোলজিতে দুর্বল। আমাদেরকে এমন একটি পৃথিবী খুঁজে বের করতে হবে যা শাসন করা হয় মেন্টাল পাওয়ার দিয়ে এবং প্রযুক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে।‘

‘তোমার এই ধারণা কেন হল?’ শান্তভাবে প্রশ্ন করল প্রিচার। ‘আমাদের নিজেদের “ইউনিয়ন অব ওয়ার্ল্ড” প্রযুক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই, যদিও আমাদের শাসনকর্তার মূল শক্তি তার মেন্টাল পাওয়ার।’

‘কারণ সে প্রথম ফাউণ্ডেশনের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছে,’ গলাটা কিছুটা অধৈর্য শোনালো, ‘এবং পুরো গ্যালাক্সিতে একমাত্র তারাই জ্ঞানের ভাণ্ডার। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন অবশ্যই বিভক্ত গ্যালাকটিক এম্পায়ারের কোনো অংশে লুকিয়ে আছে।‘

‘তা হলে তুমি বলতে চাচ্ছ যে অনেকগুলো পৃথিবীকে শাসন করার মতো মেন্টাল পাওয়ার তাদের রয়েছে কিন্তু অন্যান্য দিক থেকে তারা দুর্বল।‘

‘তুলনামূলকভাবে দুর্বল। দুর্বল ক্ষয়িষ্ণু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিজেদের তারা রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু মিউলের ক্ষমতা এবং তার উন্নত এটমিক পাওয়ারের কাছে টিকতে পারবে না। নাইলে, তাদের অবস্থান এত ভালোভাবে লুকানো কেন, শুরুতে হ্যারি সেলডন তাদের অস্তিত্ব গোপন করেছেন, এখন তারা নিজেরা গোপন করছে। প্রথম ফাউণ্ডেশন নিজেদের অস্তিত্ব গোপন করেনি, এমনকি তিন শ বছর পূর্বে যখন একটি নিঃসঙ্গ গ্রহে অরক্ষিত ছোট শহরে এর গোড়াপত্তন হয়েছিল তখনও না।’

প্রিচারের মুখ ব্যঙ্গাত্মকভাবে বেঁকে গেল, ‘এই হল তোমার ধারণা, তোমার বর্ণনার সাথে মিলে যাবে এমন সবগুলো কিংডম, রিপাবলিক, প্ল্যানেট স্টেটস এবং ডিকটেটরশিপের তালিকা চাইলে আমি দিতে পারি।’

‘সব তথ্যই রয়েছে?’

‘এখানে পাবে না, কিন্তু বিরোধী পেরিফেরির প্রত্যেকটি রাজনৈতিক ইউনিটের সকল তথ্য আমাদের কাছে আছে। তুমি কী সত্যিই মনে কর মিউল “হিট অ্যাণ্ড মিস” পদ্ধতিতে কাজ করে?’

‘ঠিক আছে, তা হলে,’ তরুণের কণ্ঠে যেন নতুন শক্তি ভর করল, ‘অলিগার্কি অব জেনডার বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বল।‘

প্রিচার চিন্তিতভাবে কান চুলকাল, ‘জেনড়া’? ও মনে পড়েছে। তারা পেরিফেরির মধ্যে নয়, তাই না? আমার মনে হয় তারা গ্যালাক্সির কেন্দ্রের বাইরের একটি তৃতীয় পক্ষ।

‘হ্যাঁ, তাতে কী?’

‘আমাদের রেকর্ড অনুযায়ী দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অবস্থান অ্যাট দ্য আদার এণ্ড অব দ্য গ্যালাক্সি। স্পেস জানে এটিই একমাত্র সূত্র। কিন্তু জেনডার কথা আসছে কেন? প্রথম ফাউণ্ডেশনের রেডিয়ান থেকে এর কৌণিক দূরত্ব প্রায় এক শ দশ থেকে এক শ বিশ ডিগ্রি। এখান থেকে প্রায় এক শ আশি ডিগ্রি কাছে।‘

‘রেকর্ডে আরেকটা কথা বলা ছিল। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে “স্টারস এণ্ডে”।‘

‘গ্যালাক্সিতে এধরনের কোনো জায়গা চিহ্নিত করা যায়নি এখন পর্যন্ত।‘

কারণ এটা একটা স্থানীয় নাম, গোপনীয়তার জন্য একটি সাংকেতিক শব্দ। অথবা সেলডন ও তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আবিষ্কৃত শব্দ। তবে “স্টারস এণ্ড” এবং “জেনডার” মধ্যে কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে, তুমি কী মনে কর?’

‘শব্দের মিল? যথেষ্ট নয়।‘

‘তুমি সেখানে কখনো গিয়েছ?’

‘না।‘

‘কিন্তু তোমার রেকর্ডে উল্লেখ আছে।‘

‘কোথায়? ওহ, হ্যাঁ কিন্তু শুধু খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ঐ পৃথিবী সম্পর্কে বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই।‘

‘তুমি প্রধান গ্রহে অবতরণ করেছিলে? সরকারের কেন্দ্রবিন্দুতে?’

‘নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’

‘তাহলে, তুমি কী আমার সাথে কিছুক্ষণের জন্য লেন্সের সামনে আসবে?’

‘নিশ্চয়ই।‘

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ইন্টারস্টেলার মহাকাশযানে লেন্স নতুন সংযোজন করা হয়েছে। মূলত: এটা একটা জটিল ক্যালকুলেটিং মেশিন। এর স্ক্রিনে এক জায়গায় বসেই গ্যালাক্সির যে-কোনো স্থানের রাতের আকাশের হুবহু প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

পাইলট রুমের আলো কমিয়ে চ্যানিশ কো-অর্ডিনেটস ঠিক করতে লাগল। কন্ট্রোল বোর্ডের লাল আলোয় তার মুখে নিষ্ঠুর ভাব ফুটে উঠেছে। প্রিচার পা ভাঁজ করে পাইলটের আসনে বসেছে, মুখে হতাশা।

ধীরে ধীরে চ্যানিশের কো-অর্ডিনেটস বিন্দুগুলো স্ক্রিনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের জনবহুল সৌরজগতগুলো ফুটে উঠেছে।

‘এটা,’ চ্যানিশ ব্যাখ্যা করল ট্রানটর থেকে দেখা শীতের রাতের আকাশ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তোমার অনুসন্ধানে তুমি ট্র্যানটরকে অবহেলা করেছ। যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি ট্র্যানটরকে জিরো পয়েন্ট ধরে তার কাজ শুরু করবে। ট্র্যানটর ছিল গ্যালাকটিক এম্পায়ারের রাজধানী। এমনকি প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। সে কারণেই দশটার মধ্যে নয়টা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিকড় থাকবে ট্রানটরে। তুমি তো জানই, সেলডন হেলিকন গ্রহের অধিবাসী হয়েও তিনি ও তার সঙ্গীরা কাজ করেছেন ট্রানটরে বসে।

‘তুমি আমাকে কী দেখাতে চাইছ?’ প্রিচারের ঠাণ্ডা গলায় অপরজনের উৎসাহে ভাটা পড়ল।

‘ম্যাপই সব ব্যাখ্যা করবে। একটা কালো নেবুলা দেখতে পারছ? এর বাহুর এক অংশের ছায়া স্ক্রিনে পড়েছে, যার ফলে গ্যালাক্সির ঐ অংশটুকু অনুজ্জ্বল হয়ে আছে।‘ আঙুল দিয়ে সে ছোট একটি অংশ দেখিয়ে দিল, মনে হয় আলোর বুনটের মাঝখানে কালো গহ্বর। ‘স্টেলারগ্রাফিকেল রেকর্ডে এর নাম পিলটস নেবুলা। খেয়াল কর আমি ইমেজ বড় করছি।’

লেন্স ইমেজের কাজ প্রিচার আগেও দেখেছে। কিন্তু এখনও সে বিস্মিত হয়। অনেকটা হাইপারস্পেস ড্রাইভ ছাড়া কোটি কোটি নক্ষত্রের ভিড়ের মাঝে প্রচণ্ড গতিতে গ্যালাক্সি পাড়ি দেওয়ার সময় ভিজিপ্লেটে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। বুঝিয়ে বলা একটু কঠিন। মনে হয় স্ক্রিনের একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে নক্ষত্রগুলো তাদের দিকে ছুটে আসছে, বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনের কিনারা দিয়ে। ছোট বিন্দু একটা থেকে দুটো হচ্ছে। তারপরই হয়ে যাচ্ছে বিশাল ভূ-গোলক। ঝাপসা কুয়াশা হঠাৎ করেই হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট অসংখ্য বিন্দু।

এর মাঝখানেই কথা বলছে চ্যানিশ, আমরা ট্র্যানটর থেকে পিলটস নেবুলার দিকে সোজা পথ ধরে এগুচ্ছি। আর তাই বাইরে যা দেখছি তার সাথে ট্রানটরের মহাজাগতিক অবস্থার মিল রয়েছে। লাইট গ্র্যাভিটেশনের কারণে কিছু ভুল হয়ে থাকতে পারে তবে সেটা খুবই সামান্য।

ম্যাগনিফিকেশনের গতি কমে যাওয়ায় স্ক্রিনে অন্ধকার বাড়ছে। কিনারা দিয়ে নক্ষত্রগুলো যেন অনেকটা অনিচ্ছার সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রসারমান নেবুলার শেষ প্রান্তে অসংখ্য নক্ষত্রের মহাবিশ্ব কেমন অদ্ভুত রকম উজ্জল, কারণ সামনের কিউবিক পারসেক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সোডিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের অসংখ্য পরমানু, যেগুলো তাপ বিকীরণ করে না।

চ্যানিশ একটি অংশ চিহ্নিত করে বলল, মহাকাশের এই অংশের অধিবাসীরা একে বলে “মুখ।” গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে শুধু ট্রানটর থেকেই এটাকে মুখের মতো মনে হয়। সে যা নির্দেশ করছে সেটি নেবুলার গায়ের একটি ফাটল, দেখতে আসলেই অনেকটা অসমতল হাসি মুখের মত, নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার ফুটে আছে।’

“মুখটাকে” অনুসরণ কর,’ বলল চ্যানিশ, ‘মুখ” থেকে খাদ্যনালীর মতো সরু পথ ধরে নিচের পাতলা একসারি আলোর দিকে যাও।’

পুরো স্ক্রিন জুড়ে এখন শুধু “মুখ” রয়েছে। চ্যানিশ সরু লাইন ধরে তার আঙুল একটি বিন্দুর উপর থামাল, সেখানে শুধু একটি নক্ষত্র একা জ্বলজ্বল করছে। এবং এর পরে রয়েছে সীমাহীন অন্ধকার, যা নক্ষত্রের আলোতেও দূর হয়নি।

“স্টারস এণ্ড” তরুণ সহজ গলায় বলল। ‘নেবুলার গঠন এখানে হালকা হয়ে গেছে এবং ঐ নক্ষত্র শুধু একদিকেই আলো বিকিরণ করছে, ট্রানটরের দিকে।‘

‘তুমি বলতে চাচ্ছ–’ মিউল জেনারেলের কণ্ঠে সন্দেহ।

‘আমি কিছু বলছি না। জেনডা–স্টারস এণ্ড।’

লেন্স বন্ধ হয়ে গেল। প্রিচার তিন লাফে চ্যানিশের কাছে পৌঁছল। ‘কীভাবে জানলে?’

চ্যানিশ চেয়ারে হেলান দিল। তার মুখে দ্বিধার ভাব। ব্যাপারটা আকস্মিক। আমারও কিছুটা কৃতিত্ব রয়েছে, তারপরও ব্যাপারটা পুরোপুরি আকস্মিক। এর সাথে অনেক যুক্তি মিলে যায়। আমাদের রেফারেন্স অনুযায়ী জেনডা শাসন করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। তারা সাতাশটি বাসযোগ্য গ্রহ শাসন করে। জেনডা প্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নত নয়। সবচেয়ে বড় কথা এটা একটি রহস্যময় পৃথিবী, মহাকাশের এই অংশের স্থানীয় রাজনীতিতে শক্ত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে এবং তাদের সীমানা বৃদ্ধির কোনো আগ্রহ নেই। আমার মনে হয় গ্রহটা আমাদের দেখা দরকার।

‘মিউলকে তুমি ব্যাপারটা জানিয়েছ?’

‘না, জানাবও না। আমরা এখন মহাকাশে রয়েছি এবং প্রথম “হপ” এর প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

আকস্মিক আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে ভিজিপ্লেট এডজাস্ট করে প্রিচার ঠাণ্ডা কালো মহাশূন্য দেখতে পেল। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দৃশ্যটার দিকে। তারপর ঘুরল। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাত ব্লাস্টারের শক্ত মসৃণ বাটের উপর চলে গেছে।

‘কার আদেশে?’

‘আমার আদেশে, জেনারেল’-–প্রথমবারের মতো চ্যানিশ তাকে এইভাবে সম্বোধন করল–’তোমাকে আমি লেন্সের সামনে ব্যস্ত রেখেছিলাম। তাই তুমি কোনো গতি টের পাওনি, সন্দেহ নেই টের পেলেও ভেবেছিলে তা লেন্সে দেখা নক্ষত্রগুলোর গতি।‘

‘কেন–তুমি কী করতে চাও? জেনডা সম্পর্কে আবোলতাবোল কথা বলার অর্থ কী?’

‘আবোলতাবোল নয়। আমি সিরিয়াস। আমরা সেখানে যাচ্ছি। তিনদিন পরে যাত্রার কথা থাকলেও আমরা আজকেই যাত্রা করেছি। জেনারেল তুমি বিশ্বাস করো না যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আছে। কিন্তু আমি করি, তুমি শুধু অন্ধের মতো মিউলের আদেশ পালন কর; আমি অনেক বিপদ দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন প্রস্তুত হওয়ার জন্য পাঁচবছর সময় পেয়েছে। তারা কীভাবে তৈরি হচ্ছে আমি জানি না, কিন্তু কালগানে তাদের এজেন্ট থাকতে পারে। যদি আমার মাইণ্ডে তাদের অস্তিত্বের কথা থাকে তবে ব্যাপারটি তাদের অজানা থাকবে না। আমার জীবন হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই জেনডার কথা কাউকে জানাইনি, তোমাকে ছাড়া। তুমিও জেনেছ আমরা মহাকাশে বেরিয়ে আসার পর।‘ চ্যানিশ আবার হাসছে। সন্দেহ নেই পরিস্থিতি পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে।

ব্লাস্টার থেকে হাত সরিয়ে আনল প্রিচার। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে অস্বস্তিতে ভুগল। কিছু একটা তাকে ভিতর থেকে বাধা দিচ্ছে, দমিয়ে রাখছে। একসময় যখন সে প্রথম ফাউণ্ডেশনের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের বিদ্রোহী ক্যাপ্টেন ছিল, তখন সে চ্যানিশের চেয়েও দ্রুত ও ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছে। মিউলের কথাই কী ঠিক? তার কন্ট্রোলড মাইণ্ড কি এতই অনুগত যে সে কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না। ভিতরের হতাশা তাকে অদ্ভুত অস্বস্তিতে ফেলে দিল।

সে বলল, ‘ঠিক আছে। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার সাথে আলোচনা করে নেবে।’

মিটমিট সংকেত তার মনযোগ কেড়ে নিল।

‘ইঞ্জিন রুম’, চ্যানিশ সহজ গলায় বলল, ‘বলে রেখেছিলাম কোনো সমস্যা হলে জানাতে। দুর্গ সামলাতে চাও?’

নিঃশব্দে মাথা নাড়ল প্রিচার। একটা দুটো নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে ভিজিপ্লেটে। গ্যালাক্সির মূল অংশ একপ্রান্তে ঝাপসা হয়ে গেছে।

কী ঘটবে যদি সে মিউলের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়—

কিন্তু চিন্তাটা তার মনে ভয় ধরিয়ে দিল।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

চিফ ইঞ্জিনিয়ার হক্সলানি তীক্ষ্ণ চোখে তরুণের দিকে তাকাল। নিজেকে সে ফ্লিট অফিসার হিসাবে পরিচয় দিচ্ছে এবং দেখে মনে হয় তার হাতেই পুরো কর্তৃত্ব। হক্সলানি দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ফ্রিটম্যান হিসাবে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত সে উপরওয়ালাদের ইনসিগনিয়া ভালভাবে বুঝতে পারে না।

তবে এই লোকটিকে মিউল নিয়োগ করেছে এবং মিউলের কথাই শেষ কথা। এমনকী অবচেতন মনেও মিউল সম্বন্ধে তার কোনো সন্দেহ নেই। ইমোশনাল কন্ট্রোলের শিকড় অনেক গভীর।

সে চ্যানিশের হাতে একটা ডিম্বাকার বস্তু দিল।

সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সুন্দরভাবে হাসল চ্যানিশ।

‘তুমি ফাউণ্ডেশনের লোক, তাই না চিফ?’

‘জী, স্যার। ফার্স্ট সিটিজেন ক্ষমতা দখলের আঠারো বছর আগে থেকে আমি ফাউণ্ডেশনে কাজ করি।’

‘ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উপর ফাউণ্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছ?’

‘প্রথম শ্রেণীর কোয়ালিফাইড টেকনিশিয়ান, সেন্ট্রাল স্কুল অন এনাক্রিওন।‘

‘খুব ভালো। আর তুমি এটা পেয়েছ কমিউনিকেশন সার্কিটে যেখানে আমি দেখতে বলেছিলাম।‘

‘জী স্যার।‘

‘জিনিসটা কী সেখানে থাকার কথা?’

‘না স্যার।‘

‘তা হলে কী এটা?’

‘হাইপারট্রেসার স্যার।‘

‘বুঝিয়ে বল। আমি ফাউণ্ডেশনের লোক নই। এটার কাজ কী?’

‘এই যন্ত্র দিয়ে হাইপারস্পেসেও মহাকাশযানকে ট্রেস করা সম্ভব।’

অন্যকথায় যেখানেই যাই, আমাদের অনুসরণ করা যাবে?’

‘জী, স্যার।‘

‘আচ্ছা! এটা আধুনিক আবিষ্কার। ফার্স্ট সিটিজেনের নিজস্ব রিসার্চ ইনস্টিটিউটে এটি তৈরি হয়েছে, তাই না?’

‘আমার তাই মনে হয় স্যার।’

চ্যানিশ কয়েক সেকেণ্ড হাইপারট্রেসার মুঠ করে ধরে রাখল। তারপর চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দিকে বাড়িয়ে দিল, এটা নাও এবং যেখানে যেভাবে পেয়েছিলে ঠিক সেখানে সেইভাবে আবার রেখে এস। বুঝেছ? তারপর পুরো ব্যাপারটি ভুলে যাও।’

চিফ প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে স্যালুট করে চলে গেল।

.

গ্যালাক্সির মাঝ দিয়ে মহাকাশযান ভেসে চলেছে। স্ক্রিনে তার গতিপথ দেখা যাচ্ছে নক্ষত্রগুলোর ভিতর দিয়ে ছোট ছোট বিন্দুর একটা সরল রেখার সাহায্যে। প্রতিটি বিন্দু প্রকাশ করছে দশ থেকে ষাট লাইট সেকেণ্ড এবং এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুর দূরত্ব প্রকাশ করছে এক শ বা তার বেশি লাইট ইয়ার। বিন্দুগুলোর দূরত্বই মূলত: হাইপার স্পেশাল হপের হিসাব।

লেন্সের কন্ট্রোল প্যানেলে বসে চ্যানিশ ‘হপ’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইন্টারস্টেলার যোগাযোগের ক্ষেত্রে লেন্স প্রায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। মহাকাশ যোগাযোগের প্রথম যুগে ‘হপ’ ছিল অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ তিনটি পরিচিত নক্ষত্রের অবস্থান ও যানের নিজস্ব অবস্থান নির্ণয়ে দিন বা সপ্তাহ পর্যন্ত চলে যেত। এমনকি ফাউণ্ডেশনের যুগেও কাজটা এতটা সহজ ছিল না।

লেন্স কাজটিকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। প্রথম কারণ এখানে একটি নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করলেই চলে। দ্বিতীয় কারণ যে কোনো অনভিজ্ঞ লোক এটি চালাতে পারে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে কাছের পরিচিত নক্ষত্র হচ্ছে ভিনসেটোরি। ভিজিপ্লেটের কেন্দ্রে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। চ্যানিশ আশা করল এটাই ভিনসেটোরি হবে।

লেন্সের ফিল্ড স্ক্রিন ভিজিপ্লেটের দিকে ঘুরিয়ে চ্যানিশ সতর্কতার সাথে ভিনসেটোরির কো-অর্ডিনেটস পাঞ্চ করল। একটা রিলে বন্ধ করে দেওয়ায় স্টারফিল্ড উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এখনেও ঠিক কেন্দ্রে আরেকটা নক্ষত্র বেশি উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে লেন্স জেড এক্সিস পর্যন্ত এডজাস্ট করে নিয়ে ফিল্ড বড় করল। ফলে ফটোমিটারে সমান উজ্জ্বল দুটি নক্ষত্রের ছবি ফুটে উঠল।

ভিজিপ্লেটে ফিল্ডের নক্ষত্রের সমান উজ্জ্বল আরেকটি নক্ষত্র খুঁজে বের করল চ্যানিশ। ধীরে, স্ক্রিন সেই নক্ষত্রের দিকে ঘুরাল। মুচকি হেসে ফলাফল বাতিল করে দিল। তারপর আরেকটা নক্ষত্রের সাথে মিলিয়ে দেখল। এভাবে তিনবার পরীক্ষা করে সে সন্তুষ্ট হলো। একজন দক্ষ লোক হয়তো প্রথমবারেই সফল হতো, কিন্তু সে তিনবারের পর সফল হলো।

দুটো ফিল্ডকে একটার উপর আরেকটা স্থাপন করে চ্যানিশ এমনভাবে এডজাস্ট করল যে স্ক্রিনে দুটো ফিল্ড মিলে একটা ফিল্ড তৈরি হয়েছে। এখন ডায়াল থেকেই শিপের অবস্থান জানা যাবে। কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে মাত্র আধঘণ্টা।

প্রিচার নিজের কামরায়, শোয়ার আয়োজন করছে।

‘কোনো খবর?’

‘বিশেষ কিছু না। আরেক হপেই আমরা জেনডায় পৌঁছে যাব।’

‘আমি জানি।

‘তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু সিল করা যে ফিল্মগুলো আমরা এনেছি। সেগুলো তুমি দেখেছ?’

হ্যান প্রিচার বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে নিচু বুকশেলফের উপর পড়ে থাকা কালো বাক্সের দিকে তাকাল। ‘হ্যাঁ।‘

‘কী মনে হয় তোমার?’

‘মনে হয় বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস বলে কিছু থাকলেও গ্যালাক্সির এইপ্রান্তে এসে হারিয়ে গেছে।’

চ্যানিশ হাসল, ‘বুঝতে পারছি কী বলছ। একেবারেই নীরস, তাই না?’

‘যদি তুমি শাসকদের ব্যক্তিগত ইতিহাস উপভোগ না কর। লেখক তার ইচ্ছামত তথ্য দিয়েছে। আমার কাছে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে।’

‘কিন্তু এখানে জেনডা সম্পর্কে তথ্য আছে, সেটাই আমি তোমাকে জানাতে চাইছিলাম।’

‘ঠিক আছে, তাদের ভালো-খারাপ দুই ধরনের শাসকই ছিল। তারা কিছু গ্রহ দখল করেছে, কিছু যুদ্ধ জয় করেছে, হেরেছে কয়েকটিতে। তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। আমি তোমার থিওরি নিয়ে বেশি ভাবছি না চ্যানিশ।‘

‘কয়েকটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করোনি। তুমি লক্ষ্য করোনি যে তারা কখনো কোয়ালিশন গঠন করেনি, সবসময়ই তারা সৌরজগতের এই অংশের রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। তোমার কথা অনুযায়ী, তারা কিছু গ্রহ দখল করেছে, তারপর কোনো পরাজয় ছাড়া থেমে যায়। মনে হয় যেন নিজেদের রক্ষা করার মতো সীমানা তারা বাড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট নয় তা।‘

‘খুব ভাল, নিরাবেগ উত্তর আসল। ঐ গ্রহে অবতরণ করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিছু সময় নষ্ট হবে।‘

‘ওহ, না, পুরোপুরি হার, যদি এটা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন হয়ে থাকে। মনে রেখো একমাত্র স্পেসই বলতে পারে এই পৃথিবীতে কতজন মিউল আছে।‘

‘তোমার পরিকল্পনা কী?’

‘গুরুত্বহীন কোনো গ্রহে অবতরণ করে জেনডা সম্পর্কে যতদূর সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করব, তারপর সিদ্ধান্ত নেব।‘

‘ঠিক আছে। আমার আপত্তি নেই। যদি কিছু মনে না কর আমি আলো নিভিয়ে দেব।‘

হাত নেড়ে বিদায় নিল চ্যানিশ।

আর মহাশূন্যের নিঃসীমতায় হারিয়ে যাওয়া চলন্ত ইস্পাতের ছোট কক্ষে জেনারেল প্রিচার জেগে রইল একা।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

যদি কষ্ট করে সব কিছু সত্য বলে ধরে নেয় এবং যেভাবে ঘটনাগুলো খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে তাতে বলা যায় জেনডাই হচ্ছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে?

জেনড়া হতে পারে কি? একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যহীন পৃথিবী। সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তৃপে হারিয়ে যাওয়া একটি অনুন্নত পৃথিবী। একটি ক্ষুদ্র কণা মাত্র। পুরাতন ফাউণ্ডেশনের সাইকোলজিস্ট এবলিং মিস সম্পর্কে মিউলের বক্তব্য তার মনে পড়ল–একমাত্র সেই সম্ভবত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের রহস্য জানতে পেরেছিল।

মিউলের কণ্ঠে যে উদ্বেগ ছিল তাও প্রিচারের মনে পড়ল, মনে হচ্ছিল মিস যেন বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে পড়েছে। যেন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সম্বন্ধে সে আশাতীত কিছু পেয়েছে, তার ধারণার বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গেছে। আমি যদি তার আবেগের বদলে তার চিন্তাভাবনা বুঝতে পারতাম। তবে তার আবেগ ছিল মসৃণ এবং সবকিছু ছাপিয়ে ছিল সীমাহীন বিস্ময়। আর এখন এই হাসিখুশি তরুণ জেনডার অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে প্রিচারের মুখে নির্দয় হাসি ফুটল। হাইপারট্রেসার তার নির্দিষ্ট স্থানেই রয়েছে, চ্যানিশকে লুকিয়ে একঘণ্টা আগেই সে পরীক্ষা করে দেখেছে।

.

দ্বিতীয় সম্মেলন

কাউন্সিল চেম্বারের এন্টিরুমে এটি একটি সাধারণ মিটিং–দিনের কাজ শুরু করার পূর্বে কয়েক মুহূর্ত দ্রুত মানসিক সংকেতের আদানপ্রদান মাত্র।

‘তাহলে মিউল তার পথেই রয়েছে?’

‘আমিও সেরকমই শুনেছি। খুবই বিপজ্জনক।‘

‘সবকিছু ঠিকঠাক ঘটলে বিপদের ভয় নেই।’

‘মিউল কোনো সাধারণ লোক নয়—’

‘তার অগোচরে তার অস্ত্র নিজেদের উদ্দেশে ব্যবহার করা অত্যন্ত কঠিন। কন্ট্রোলড মাইণ্ড পরিবর্তন করা সহজ নয়।’

‘হ্যাঁ কিন্তু ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।‘

‘আনকন্ট্রোলড মাইণ্ড পরিবর্তন করা সহজ। কিন্তু তার অধীনে এধরনের লোকের সংখ্যা অত্যন্ত কম—’

তারা চেম্বারে প্রবেশ করল। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অন্যান্যরাও তাদের অনুসরণ করে ঢুকল।

.

১.৩ রোসেম

রোসেম এমন একটি পৃথিবী যা গ্যালাক্সির ইতিহাসে বরাবরই উপেক্ষিত। অন্যান্য গ্রহের বিলাসী অধিবাসীরা এর খবর খুব কমই জানে।

গ্যালাকটিক এম্পায়ারের যুগে কিছু রাজনৈতিক বন্দিদের এখানে নির্বাসন দেওয়া হয়। তখন একটি অবজারভেটরি এবং ন্যাভাল গ্যারিসন স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে এমনকি হ্যারি সেলডনের সময় পর্যন্ত, দুর্বল চিত্তের মানুষ, দীর্ঘ যুগের নিরাপত্তাহীনতা ও বিপদ মোকাবেলা করে করে ক্লান্ত, এবং স্বল্পস্থায়ী সম্রাটদের কোপানলে পড়ে হতাশ ও বিধ্বস্ত ব্যক্তিরা-–গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে পালিয়ে এই বিবর্ণ পৃথিবীতে নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।

রোসেমের ঠাণ্ডা পতিত জমির পাশ ঘেঁষে, গ্রামগুলো বিশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠেছে। এর লালবর্ণের সূর্য খুব অল্প তাপ বিকীরণ করে। ফলে বছরের নয় মাস হালকা তুষারপাত হয়। সেই সময় কঠিন খাদ্যশস্য মাটির নিচে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তারপর যখন সূর্যের তাপমাত্রা প্রায় পঞ্চাশ এ পৌঁছে তখন খাদ্যশস্য অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়।

পাতলা তিনখুরঅলা পায়ের সাহায্যে ছাগলের মতো দেখতে ছোট একপ্রকার প্রাণী পাতলা তুষার খুড়ে তৃণভূমি চাষ করতে ব্যবহার করা হয়।

কাজেই রোসেমের অধিবাসীদের খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। গ্রহের পুরো বিষুব অঞ্চল জুড়ে রয়েছে কালো অশুভ এক বনাঞ্চল। এখান থেকে তারা ঘর তৈরির জন্য শক্ত ও মসৃণ কাঠ সগ্রহ করতে পারে। এই কাঠ এবং সেইসাথে পশুর চামড়া এবং কিছু খনিজ পদার্থ তাদের মূল্যবান রপ্তানি দ্রব্য। কখনও কখনও এম্পায়ারের শিপগুলো বিনিময়ের জন্য খামারের যন্ত্রপাতি, এটমিক হিটার, এমনকি টেলিভাইজর সেট পর্যন্ত নিয়ে আসে। দীর্ঘ শীতকালের বিচেতনতা কাটানোর জন্য টেলিভাইজর বেশ কাজ দেয়।

ইম্পেরিয়াল হিস্টোরির ব্যাপারে রোসেমের কৃষকদের ধারণা খুব কম। ট্রেডিং শিপগুলো কখনো কখনো কোনো বিদ্রোহের খবর নিয়ে আসে। হঠাৎ কখনো নতুন ফেরারী আসামি আসে–একবার অনেক বড় একটা দল এসেছিল এবং তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে গ্যালাক্সির অনেক খবর ছিল।

তাদের কাছ থেকেই রোসেমের কৃষকেরা সর্বপ্রথম সুদূরপ্রসারী লড়াই, ব্যাপক গণহত্যা, নির্মম স্বৈরতান্ত্রিক স্মার্ট এবং বিদ্রোহী ভাইসরয়দের কথা জানে। এবং তারা তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকাত, শার্টের কলার দাড়ি গোফ ভরা মুখের আরও কাছে টেনে এনে গ্রামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বসে মানুষের নৃশংস মনোভাব নিয়ে দর্শন আউড়াত।

তার কিছুদিন পর থেকেই ট্রেড শিপগুলো আসা বন্ধ করে দেয়। ফলে জীবন হয়ে দাঁড়াল আরও কঠিন। বিদেশী খাদ্য, তামাক এবং যন্ত্রপাতির সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। টেলিভাইজর থেকে প্রাপ্ত টুকিটাকি সংবাদ জোড়া দিয়ে যা বোঝা গেল তাও অস্পষ্ট। তারপর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল ট্রানটরের পতন হয়েছে। সমস্ত গ্যালাক্সির অতি উন্নত ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ড, সম্রাটদের জমকালো, অগম্য, অতুলনীয় রূপকথার মতো বাসস্থান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।

অবিশ্বাস্য সংবাদ এবং রোসেমের অধিকাংশ কৃষকের মনে হল গ্যালাক্সির ধ্বংস অনিবার্য।

.

তারপর একদিন আবার একটি মহাকাশযান অবতরণ করল রোসেমে। প্রতিটি গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা জ্ঞানীর মতো মাথা নাড়ল এবং ফিসফিস করে বলল যে তাদের বাপ দাদার আমলে অনেক যান রোসেমে নেমেছে, কিন্তু ঠিক এরকম যান তারা কখনো দেখেনি।

এটা ইম্পেরিয়াল শিপ নয়। কারণ মহাকাশযানের গায়ের চকচকে ভাব এবং লেজের কাছে সম্রাটদের সূর্য চিহ্ন ছিল না। পুরোনো যানের বিভিন্ন অংশ জুড়ে এটি তৈরি হয়েছে। এর চালকেরা নিজেদের পরিচয় দিল জেনডার সৈনিক বলে।

কৃষকেরা জেনডার নাম কখনও শোনেনি। তাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তবে ঐতিহ্য অনুযায়ী সৈনিকদের আপ্যায়ন করল। সৈনিকরা গ্রহের ভূ-প্রকৃতি, অধিবাসীদের সংখ্যা, শহরের সংখ্যা–একজন কৃষক ভুল করে গ্রাম বোঝাতে শহর উচ্চারণ করেছিল–ইত্যাদি বিষয়ে খুব ভালো মতো খোঁজখবর করল।

আরও অনেক মহাকাশযান এল এবং পুরো রোসেমে ঘোষণা করা হল যে এই মুহূর্তে জেনড়া রুলিং ওয়ার্ল্ড গ্রহের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে কর আদায়ের জন্য কেন্দ্র স্থাপন করা হবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট অনুপাতে চামড়া এবং খাদ্য শস্য কর হিসেবে নেওয়া হবে।

রোসেমের অধিবাসীরা কর শব্দটা আগে কখনো শুনেনি, তাই চুপ করে থাকল। যখন সময় আসল তখন অনেকেই পরিশোধ করল, অনেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। অন্যদিকে ইউনিফর্ম পড়া সৈনিকেরা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও পশমওলা চামড়া বড় বড় গ্রাউণ্ড কারে ভরতে লাগল।

ক্ষুব্ধ কৃষকরা সংগঠিত হল প্রাচীন আমলের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। জেনডার আগন্তুকরা খুব সহজেই তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। তাদের কঠিন জীবন হয়ে উঠল কঠিনতর।

ক্রমে চালাক হয়ে উঠল রোসেমাইটরাও। জেনডিয়ান গভর্নর জেনট্রি গ্রামে তার লোকদের নিয়ে বসবাস শুরু করল। ফলে ঐ গ্রাম থেকে সকল অধিবাসীকে সরিয়ে দেওয়া হয়, রোসেমাইটদের সাথে তাদের যোগাযোগ একেবারেই নেই। জেনডার লোক নির্দিষ্ট সময়ে কর সংগ্রহ করতে আসে, কিন্তু রোসেমাইটরা জানে কীভাবে ফসল লুকাতে হয়, গবাদি পশু জঙ্গলের দিকে তাড়িয়ে দিতে হয় এবং নিজেদের কুটিরের জীর্ণ দশা বজায় রাখতে হয়। তারপর নিরাসক্ত মুখে সকল তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণের উত্তর দেওয়া তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।

এই পদ্ধতিতে করের পরিমাণ কমে গেল যেন জেনডা নিজেও এখান থেকে কর আদায় করতে করতে ক্লান্ত।

বরং বাণিজ্য করাই মনে হল লাভজনক। রোসেমের অধিবাসীরা বিনিময়ে যদিও এম্পায়ারের চকচকে জিনিস পাচ্ছে না, কিন্তু জেনডার যন্ত্রপাতি, খাদ্যদ্রব্য তাদের নিজেদের তৈরি জিনিসের চেয়ে উন্নত। এছাড়াও রয়েছে মহিলাদের জন্য কাপড়।

তাই আবার গ্যালাকটিক ইতিহাস নিরবিচ্ছিন্নভাবে বয়ে যেতে লাগল এবং কৃষকরা জীবনের উপাদান সংগ্রহ করতে লাগল শক্ত মাটি থেকে।

.

প্রথম তুষারপাত শক্ত মাটি ঢেকে দিয়েছে। নারোভী তার দাড়ি ঝাড়তে ঝাড়তে কুটিরের বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশ নিপ্ৰভ ধূসর। তবে বড় ধরনের ঝড় হবে না। কোনো ঝামেলা ছাড়াই সে জেনট্রি পর্যন্ত গিয়ে অতিরিক্ত শস্যের বিনিময়ে শীতের জন্য প্রয়োজনীয় টিনের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে।

পিছন ফিরে একটা হাক দিল, ‘গাড়িতে ফুয়েল ভরা হয়েছে, ইয়ুঙ্কার?’

নারোভীর সবচেয়ে বড় ছেলে চিৎকার করে জবাব দিল, বাপের চেয়ে কিছুটা খাটো মুখটা এখন ও বালকসুলভ, দাড়ি গোফ ভালোমতো গজায়নি।

‘গাড়িতে,’ রাগের সাথে বলল সে ‘ফুয়েল ভরা হয়েছে এবং ভালমতোই চলবে। কিন্তু নষ্ট এক্সেলের জন্য আমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমাকে বলেছি এর জন্য দক্ষ লোকের প্রয়োজন।’

ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল নারোভী। থুতনি নাচিয়ে বলল, ‘তাহলে কী আমার দোষ? কোত্থেকে, কীভাবে আমি দক্ষ লোক আনব? পাঁচবছরে ফসল কী কম হয়েছে? আমার গবাদি পশুর দল কী পালিয়ে গেছে–’

‘নারোভী!’ পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর তাকে থামিয়ে দিল মাঝপথে। সে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘ভালো, ভালো–বাপ-ছেলের মাঝখানে নাক এখন তোমার মাও গলাবে, গাড়িটা নিয়ে আসো, দেখে নিও স্টোরেজ ট্রেইল ভালোমতো লাগানো হয়েছে কিনা।‘

দস্তানা পরা হাত দুটো জড়ো করে সে আবার তাকাল আকাশের দিকে। ধূসর আকাশে হালকা-লালবর্ণের মেঘ। সূর্যের দেখা নেই।

চোখ নামিয়েই আবার সে ঝট করে আকাশের দিকে তাকাল, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার আঙুল উপর দিকে উঠে গেছে এবং ঠাণ্ডা সত্ত্বেও চিৎকার করে তার স্ত্রীকে ডাকল, ‘তাড়াতাড়ি এস।’

জানালায় একটা মাথা দেখা গেল, নারোভীর আঙুল নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে বিষম খেল মহিলা। একটা পুরোনো ব্যাপার এবং চারকোণা একটি লিনেন মাথায় জড়িয়ে দৌড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল স্বামীর পাশে।

রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘আউটার স্পেসের মহাকাশযান।’

নারোভী অধৈর্য্যের সাথে বলল, ‘এ ছাড়া আর কী? আমরা অতিথি পেয়েছি।’

ফার্মের দক্ষিণ দিকের খালি ঠাণ্ডা জমিতে মহাকাশযান অবতরণ করছে।

‘আমরা কী করব?’ মহিলা ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা কী তাদের আপ্যায়ন করব?

একহাতে স্ত্রীর কাধ জড়িয়ে সে বলল, ‘তুমি নিচের রুমে দুটি চেয়ার এনে রাখ। খাদ্য ও পানিয়ের ব্যবস্থা কর। আমি তাদের এগিয়ে আনতে চললাম।’

একটা বেসুরো শব্দ বের হল মহিলার গলা দিয়ে। নারোভী এক আঙুল তুলে বলল, ‘শোনো, এন্ডারস্ কী বলেছিল মনে নেই। বলেছিল অপরিচিত কোনো মহাকাশযান আসলে সাথে সাথে যেন তাকে খবর দেওয়া হয়। এটা গভর্নরের আদেশ।

‘শোনো ক্ষমতাশালীদের সুনজরে পড়ার সুযোগ আমি পেয়েছি। যানটাকে দেখ, এরকম আগে কখনো দেখেছ, আউটার ওয়ার্ল্ডের এই লোকেরা ধনী ও শক্তিশালী। গভর্নর নিজে খোঁজখবর করছেন, যার কারণে এল্ডাররা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ফার্মে ফার্মে ঘুরে মেসেজ পৌঁছে দিচ্ছে। সম্ভবত পুরো রোসেমে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে জেনডার লর্ডরা এদের আশা করছেন। এবং তারা ল্যাণ্ড করেছে আমার ফার্মে। সঠিকভাবে আপ্যায়ন করলেই গভর্নরের কাছে তারা আমাদের নাম বলবে।’

তার স্ত্রী হঠাৎ করেই ঘরোয়া কাপড়ের ভিতরে শীত অনুভব করল। দরজার দিকে এগোতে এগোতে চিৎকার করে বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি যাও।

কিন্তু যাকে বলল সে ততক্ষণে মহাকাশযানের দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে।

.

এই গ্রহের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বা সীমাহীন শূন্যতা হ্যান প্রিচারের চিন্তার বিষয় না। এর দারিদ্র্য অথবা সামনে দাঁড়ানো কৃষককে নিয়েও সে চিন্তা করছে না।

যা তাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তা হচ্ছে তাদের এখানে আসা ঠিক হল কিনা। সে এবং চ্যানিশ সম্পূর্ণ একা এসেছে।

মহাকাশে ছেড়ে আসা মূল যান নিরাপদেই থাকবে, তবুও সে নিরাপদ বোধ করছে না। এর জন্য চ্যানিশই দায়ী। এদিকে চ্যানিশ হাসিমুখে ফার দিয়ে আলাদা করা একটি অংশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেখানে একজন মহিলার মুখ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে, চ্যানিশ বেশ স্বাভাবিক। তবে আর বেশিক্ষণ নিজের ইচ্ছামতো খেলা চালিয়ে যেতে পারবে না।

কৃষক মাথা ঝুঁকিয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে বলল, ‘নোবল লর্ডস, আমার বড় ছেলে, দারিদ্র্যের কারণে যাকে আমি প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে পারিনি–সে আমাকে, জানিয়েছে, যে কোনো মুহূর্তে এল্ডারসগন এখানে এসে পৌঁছবেন। আশা করি আপনারা এখানে আনন্দে থাকতে পারবেন। আমি অভাবী হলেও এখানের সবাই জানে আমি সৎ ও পরিশ্রমী।’

‘এল্ডারস্?’ সহজ গলায় বলল চ্যানিশ। ‘এই অঞ্চলের চিফ?’

‘সেরকমই, নোবল লর্ডস, তারা সকলেই সৎ এবং পরিশ্রমী, যার কারণে পুরো রোসেমে আমাদের গ্রাম ন্যায়বিচার ও ভালো আচরণের জন্য বিখ্যাত–যদিও ফসলের উৎপাদন খুব কম। যদি নোবল লর্ডস আপনারা এল্ডারসদের আমার আতিথেয়তার কথা বলেন তা হলে তারা আমাকে একটি নতুন মোটর ওয়াগনের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।’

তার ব্যাকুলতা দেখে প্রিচার একজন নোবল লর্ডের চরিত্র অনুযায়ী গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।

‘তোমার আতিথেয়তার বিষয় এল্ডারদের কানে তোলা হবে। আধো ঘুমন্ত চ্যানিশকে বলল, ‘এল্ডারদের সাথে দেখা করাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। তুমি কিছু ভেবেছ?’

চ্যানিশকে অবাক দেখাল, না। তুমি চিন্তিত হচ্ছ কেন? ‘এখানে বসে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেয়ে আমাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে বলে আমি মনে করি।’

চ্যানিশ নিচু একটানা সুরে কথা বলে গেল, ‘দৃষ্টি আকর্ষণ করার ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। আমরা যাদের খুঁজছি, প্রিচার, তাদেরকে হাত বাড়ালেই খুঁজে পাব না। যারা মাইণ্ড ট্রিকসের দ্বারা শাসন করে তাদেরকে তথাকথিত ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন নেই। প্রথমত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সাইকোলজিস্টরা মোট জনসংখ্যার অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা অংশ। সাধারণ অধিবাসীরা বেশি মাত্রায় সাধারণ। সাইকোলজিস্টরা সম্ভবত নিজেদের খুব ভালোমতো লুকিয়ে রেখেছে এবং যারা শাসন করছে তারা হয়ত সত্যিই ধারণা করেছে যে তারাই সর্বময় কর্তা।‘

‘আমি সবটা বুঝতে পারিনি।’

‘কেন, দেখ এটাই স্বাভাবিক। জেনডায় শ শ মিলিয়ন মানুষ বাস করে। তাদের ভিতর থেকে আমরা কীভাবে সাইকোলজিস্টদের খুঁজে বের করব। কিন্তু এখানে, এই কৃষক পৃথিবীতে, সকল জেনডিয়ান শাসক, আমাদের হোস্টের মতে গ্রামে থাকে জেনট্রি। সেখানে মাত্র কয়েক শ জন রয়েছে এবং তাদের মধ্যে অবশ্যই একজন বা তারও বেশি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের লোক রয়েছে। আমরা অবশ্যই সেখানে যাব, তবে প্রথমে এল্ডারদের সাথে দেখা করব–সেটাই ভালো হবে।’

তাদের হোস্ট আবার ঘরে প্রবেশ করল। ‘নোবল লর্ডস, এল্ডারগণ পৌঁছেছেন। আমি আরেকবার বিনীতভাবে বলছি, আমার কথা খেয়াল রাখবেন।’ অনুগ্রহ লাভের আশায় সে প্রবল বেগে কুর্নিশ করে ফেলল।

তারা ছিল তিনজন। কথা বলল একজন। মাথা ঝুঁকিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ সম্মানের সাথে সে বলল, ‘আমরা সম্মানিত। বাহন তৈরি আছে। আশা করি মিটিং হল এ আমরা আপনাদের সঙ্গ পাব।’

.

তৃতীয় সম্মেলন

ফার্স্ট স্পিকার বিষণ্ণভাবে আকাশের দিকে তাকালেন। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ নক্ষত্রের স্নান আলোকে ঢেকে দিয়ে সোজা ছুটে চলেছে। মহাশূন্য পুরোপুরি বৈরি মনোভাবাপন্ন। সে সবসময়ই ছিল ঠাণ্ডা ও ভয়ঙ্কর। আর এখন যোগ হয়েছে মিউলের মতো বিপজ্জনক ক্রিয়েচার। ফলে অন্ধকার গহ্বরে অশুভ কিছু একটা ঘোট পাকিয়ে উঠছে।

মিটিং খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি। অনিশ্চিত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠা একটা মেন্টাল মিউট্যান্টকে দমন করার গাণিতিক সমস্যাসমূহ শুধু আলোচনা করা হয়েছে।

তারা কী এখনও নিশ্চিত। মহাশূন্যের এই অঞ্চলের কোনো এক অংশে–গ্যালাক্সির অতিক্রম্য দূরত্বের মধ্যেই রয়েছে মিউল? কী করবে সে?

তার অনুচরদের সামলানো সহজ। তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী সাড়া দেয় এবং দিচ্ছে।

কিন্তু স্বয়ং মিউলের ব্যাপারে কী হবে।

.

১.৪ এন্ডারস

রোসেম এই নির্দিষ্ট অঞ্চলের এল্ডারস। তারা যেমন আশা করেছিল ঠিক সেরকম নয়। সাধারণ কৃষকদের সাথে এল্ডারসদের অনেক পার্থক্য। বৃদ্ধ, মুখে শান্ত গাম্ভীর্য, অনেক বেশী কর্তৃত্বপরায়ণ।

ব্যবহার বন্ধুত্বপূর্ণ, আচরণ কর্তৃত্বপূর্ণ। বোঝাই যায় কর্তৃত্ব করা তাদের জন্মগত অভ্যাস।

তারা বসেছে তাদের ডিম্বাকার টেবিলের পিছনে বসেছে। অধিকাংশই যৌবন পার হয়ে এসেছেন। কারও মুখে সুন্দর করে ছাটা দাড়ি। এখনও অনেকে আসছে। যাদের বয়স চল্লিশেরও কম। তাতেই বোঝা যায় এল্ডারস্ একটি সম্মানসূচক শব্দ, বয়সের শাব্দিক প্রতিরূপ না।

আউটার স্পেস থেকে আসা দুজনকে টেবিলের মাথায় বসতে দেওয়া হয়েছে। শান্ত, গম্ভীরভাবে তারা তাদের খাবার খেল। দু-একজন এলডার অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিল। তারপরই মনে হয় কৌতূহলের কাছে হার মানল গুরুগম্ভীর স্বভাব। দুই আগন্তুককে তারা ঘিরে ধরল। শুরু হল প্রশ্নবাণ স্পেসশিপ চালানো কী খুব কঠিন, কতজন লোক লাগে, তাদের গ্রাউণ্ড কারের জন্য উন্নত মোটর তৈরি করা সম্ভব কিনা, সত্যি নাকি যে অন্যান্য গ্রহে বরফ পড়ে না, তাদের গ্রহে কতজন মানুষ বাস করে। এটি কী জেনডার মতো অনেক বড়, অনেক দুরে, কীভাবে তাদের কাপড় তৈরি হয়, তারা কী প্রত্যেকদিন শেভ করে, প্রিচারের আংটিতে কী পাথর ইত্যাদি।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

প্রায় প্রতিটি প্রশ্নই করা হল প্রিচারকে কারণ তারা ধরেই নিয়েছে সেই নেতা। প্রিচার বিস্তারিতভাবে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হল। জানার আগ্রহ তাদের অসীম।

প্রিচার ব্যাখ্যা করে বলল যে স্পেসশিপ চালানো কঠিন নয়, এর আয়তনের উপর নির্ভর করে কতজন লোক প্রয়োজন হবে। সে তাদের গ্রাউণ্ড কারের মোটর সম্বন্ধে বিস্তারিত জানে না তবে অবশ্যই উন্নত করা যাবে, তার গ্রহে কয়েক শ মিলিয়ন লোক বাস করে, তবে অবশ্যই জেনডার তুলনায় তাদের গ্রহ অনেক ছোট ও কম গুরুত্বপূর্ণ, তাদের কাপড় তৈরি করা হয় সিলিকন প্লাস্টিক দিয়ে, তারা প্রত্যেকদিন শেভ করে তার আংটির পাথর হচ্ছে এমেথিষ্ট। ক্রমেই প্রশ্নের তালিকা বড় হচ্ছে। প্রিচার লক্ষ্য করল যে সে প্রায় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর পেয়েই তারা তর্ক-বিতর্ক করছে নিজেদের মধ্যে। তাদের এই নিজস্ব আলোচনা একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ তারা আন্তঃমহাজাগতিক ভাষার এমন একটি রূপে কথা বলছে যা অনেক আগেই হয়ে পড়েছে অপ্রচলিত।

শেষ পর্যন্ত চ্যানিশ বাধা দিয়ে বলল, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমরা এখানে নতুন। তাই আপনারা এবার আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন, জেনডা সম্বন্ধে আমরা সব জানতে চাই।’

তারপরে যা ঘটল তা এককথায় অবিশ্বাস্য। সম্পূর্ণ মিটিং হল এ অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এল। যে এল্ডারসরা এতক্ষণ কথা বলছিল অনর্গল, তারা এখন একেবারেই চুপ। বক্তব্য পরিষ্কার বোঝানোর জন্য এতক্ষণ মুখের কথার সাথে নানাভাবে ও দ্রুত হাত নাড়ছিল, এখন হাতগুলো নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। চোরাচোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে, চাইছে অন্য কেউ কথা বলার দায়িত্ব নিক।

প্রিচার দ্রুত হস্তক্ষেপ করল, ‘আমার সঙ্গী বন্ধু হিসেবে এগুলো জানতে চাইছেন। জেনডার খ্যাতি গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমরা অবশ্যই গভর্নরের প্রতি অনুগত এবং এল্ডারদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।‘

কেউ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল না তবে মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একজন এলডার তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে দাড়ি সোজা করতে করতে বলল, ‘আমরা জেনডার লর্ডদের বিশ্বস্ত অনুগত।’

চ্যানিশের প্রতি প্রিচারের বিরক্তি কমল খানকটা। কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল সে। মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তে থাকি বলে আমরা জেনডার লর্ডদের অতীত সম্বন্ধে খুব বেশি জানি না। আমরা ধারণা করি তারা এখানে দীর্ঘদিন ধরে সুশাসন বজায় রেখেছেন।

পূর্বের এলডারই কথা বলল। সেই এখন মুখপাত্র। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে যে বয়োবৃদ্ধ তার বাবার বাবাও এমন কোনো সময়ের কথা বলতে পারবে না যখন লর্ডরা অনুপস্থিত ছিলেন।

‘সে সময়ে শান্তি বজায় ছিল?’

‘শান্তি ছিল! সে কিছুটা দ্বিধা করল। গভর্নর একজন বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাশালী লোক, বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দিতে দ্বিধা করেন না। অবশ্যই আমাদের কেউ বিশ্বাসঘাতক নয়।‘

‘হয়ত অতীতে সে কাউকে না কাউকে তার প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করেছে।’

আবারও দ্বিধা, ‘এখানে আমরা বা আমাদের পূর্বপুরুষরা বা তাদের পূর্বপুরুষরা পর্যন্ত কেউ কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কিন্তু অন্যান্য গ্রহে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদেরকে নগণ্য দরিদ্র কৃষক এবং রাজনীতির ব্যাপারে অজ্ঞ ভাবার কোনো কারণ নেই।‘

তাদের গলার উদ্বেগ এবং চোখের মহাজাগতিক ভাষা অতি স্বাভাবিক।

প্রিচার নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বলতে পার কীভাবে আমরা তোমাদের গভর্নরের সাথে দেখা করব।‘

কেমন হতভম্ব দেখাল সবাইকে। অনেকক্ষণ পর সেই একই এলডার বলল, ‘কেন তোমরা জান না? গভর্নর আগামীকাল এখানে আসছেন। তিনি জানতেন তোমরা আসবে। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি গভর্নরের কাছে আমাদের আনুগত্যের ব্যাপারে ভাল ভাল কথা তোমরা বলবে।‘

প্রিচারের হাসি প্রায় কেঁপে গেল। তিনি জানতেন আমরা আসব?

এল্ডারসরা অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। ‘কেন…প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।’

.

তাদেরকে দেওয়া ঘরগুলো এই গ্রহের তুলনায় যথেষ্ট বিলাসবহুল। প্রিচার এর চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকে অভ্যস্ত। আর চ্যানিশের মুখের ভাব দেখে ভালো-মন্দ বোঝার উপায় নেই।

দুজনেই ভিতরে ভিতরে টেনসনে ভুগছে। প্রিচার বুঝতে পারছে এই মুহূর্তেই নিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে হবে, কিন্তু তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কারণ প্রথমে গভর্নরের সাথে দেখা করতে হবে। এতে বিপদের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে আরও। চ্যানিশের কোঁচকানো ভুরু দেখে তার প্রচণ্ড রাগ হল। অনিশ্চয়তায় ভুগছে চ্যানিশ। উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। মনেপ্রাণে ঘটনার একটা শেষ চায়।

‘প্রিচার বলল, আমরা ধরা পড়ে গেছি।’

‘হ্যাঁ, সহজভাবে বলল চ্যানিশ।‘

‘শুধু এইটুকুই? আর কিছু বলার নেই? এখানে এসেই দেখলাম সবাই আমাদের আসার খবর জানে। মনে হয় গভর্নর এসে জানাবেন জেনড়াও আমাদের আসার খবর জানে। তা হলে আমাদের পুরো মিশনের আর গুরুত্ব কই?’

চোখ তুলল চ্যানিশ। ভিতরের উদ্বেগ লুকানোর কোনো চেষ্টা না করেই বলল, ‘আমাদের আসার খবর জেনে ফেলা এক ব্যাপার; আমরা কারা এবং কেন এসেছি সেটা জেনে ফেলা আরেক ব্যাপার।

‘তুমি কীভাবে আশা কর দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের লোকদের কাছে ব্যাপারটা গোপন রয়েছে।‘

‘সম্ভবত, কেন নয়? ধর মহাকাশে থাকতেই আমাদেরকে ডিটেক্ট করা হয়। একটা ফ্রন্টিয়ার অবজারভেশন পোস্ট থাকা কী খুব বেশি অস্বাভাবিক? এমনকি আমরা সাধারণ আগন্তুক হলেও, আমাদের প্রতি তাদের আগ্রহ থাকতে পারে।‘

‘এত বেশি আগ্রহ যে গভর্নর আমাদের ফিরিয়ে না দিয়ে নিজেই দেখা করতে আসছেন?’

চ্যানিশ কাধ ঝাঁকাল। ‘এই সমস্যাটি নিয়ে পরে কথা বলব। প্রথমেই দেখা যাক এই গভর্নর লোকটা কেমন।‘

ক্রুদ্ধভাবে হাসল প্রিচার। উদ্ভট একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

চ্যানিশ কৃত্রিমভাবে বলে যেতে লাগল, ‘একটা বিষয় নিশ্চিত। জেনডাই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আর নয়তো হাজার হাজার যুক্তি প্রমাণ একবাক্যে ভুল দিকে পরিচালিত করছে। জেনডার প্রতি স্থানীয় লোকদের যে ভয় রয়েছে সেটা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমি কোনো পলিটিক্যাল ডমিনেশন দেখতে পাচ্ছি না। এল্ডাররা তাদের সাথে অত্যন্ত সহজভাবে মিশে এবং তারা কোনো ব্যাপারেই নাক গলায় না। যে ট্যাক্সের কথা তারা বলছে তার পরিমাণ আমার কাছে খুব বেশি মনে হয়নি। স্থানীয়রা দারিদ্র্যের কথা বলে, কিন্তু মনে হয় তারা বলিষ্ঠ এবং ভাল খেতে পায়। যদিও তাদের বাড়িগুলো নিম্নমানের, গ্রামগুলো রুক্ষ।’

‘তা হলে, তুমি তাদের আদর্শে বিশ্বাসী?’

‘গ্যালাক্সি ক্ষমা করুক।’ চ্যানিশ মনে হয় প্রিচারের কথায় মজা পেল। আমি শুধু পুরো ব্যাপারটার গুরুত্ব তুলে ধরছি। স্পষ্টতই জেনডা দক্ষ প্রশাসক তাদের দক্ষতা পুরোনো সাম্রাজ্য, প্রথম ফাউণ্ডেশন এমনকি আমাদের নিজেদের ইউনিয়নের দক্ষতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এম্পায়ার, ফাউণ্ডেশন বা ইউনিয়ন সকলেই স্পর্শাতীত কিছু মূল্যবোধ বাদ দিয়ে কারিগরি দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু জেনডা সুখসমৃদ্ধি আনতে পেরেছে। তুমি দেখতে পারছ না এদের পুরো শাসন ব্যবস্থাই আলাদা ধরনের। পুরোপুরি সাইকোলজিক্যাল।’

‘সত্যি?’ শ্লেষের সুরে বলল প্রিচার, আর দয়ালু সাইকোলজিস্টদের দেওয়া শাস্তির কথা বলতে গিয়ে এল্ডারদের চোখেমুখে যে ভয় ফুটে উঠেছিল, তোমার থিওরিতে সেটা কীভাবে ফিট করবে।’

‘তারা নিজেরাই কী শাস্তির বিষয় ছিল? তারা শুধু অন্যদের শাস্তির কথা বলেছে। আসলে শাস্তির ব্যাপারটা এমনভাবে তাদের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, যে সত্যিকার শাস্তি প্রদানের প্রয়োজন হয় না। পুরো বিষয়টি তাদের মনে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আমি নিশ্চিত এই গ্রহে কোনো জেনডিয়ান সৈনিক নেই। তুমি খেয়াল করোনি?’

‘খেয়াল করব,’ প্রিচার বলল, ঠাণ্ডা গলা, ‘যখন গভর্নরের সাথে দেখা হবে এবং কথার কথা, যদি আমাদের মেন্টালি কন্ট্রোল করা হয় তাহলে কী করবে।’

চ্যানিশ নিষ্ঠুর অবজ্ঞার সাথে বলল, ‘সেই ব্যাপারে তুমি অভ্যস্ত।‘

সাদা হয়ে গেল প্রিচারের মুখ। নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করল সে। সেদিন তারা নিজেদের মধ্যে আর কোনো কথা বলল না।

.

নীরব শীতল রাত। প্রিচার ঘুমন্ত চ্যানিশের মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে। ধীরে ও নিঃশব্দে কব্জিতে বাধা ট্রান্সমিটার আন্ট্রাওয়েভ রিজিওনে এডজাস্ট করল। নখ দিয়ে চাপ দিতেই মূল যানের সাথে যোগাযোগ তৈরি হল।

ছোট ছোট বিরতিতে নিঃশব্দ স্পন্দনের মাধ্যমে উত্তর পাওয়া গেল।

দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল প্রিচার, ‘যোগাযোগ হয়েছে?’

দ্বিতীয়বার উত্তর এল, ‘না, আমরা অপেক্ষা করছি।‘

বিছানা থেকে নামল সে। রুমের ভিতর ঠাণ্ডা। পশমের কম্বল গায়ে জড়িয়ে চেয়ারে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার নিজের পেরিফেরির রাতের আকাশের তুলনায় এখানকার নক্ষত্রগুলো অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং গ্যালাক্সির স্বচ্ছতার মধ্যে এলোমেলোভাবে সাজানো।

নক্ষত্রগুলোর মাঝখানে কোথাও রয়েছে যে দুর্বোধ্য পরিস্থিতি তাকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে তার সমাধান এবং সমাধান পাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে পড়ল।

কয়েক মুহূর্তের জন্য সে আবারও অবাক হল, যদি মিউলের কথাই সত্যি হয়। আসলেই কি কনভার্সন তাকে তার আত্মবিশ্বাসের শেষপর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। নাকি এটা শুধু বয়স এবং গত কয়েক বছরের উত্থান পতন?

সে আর কেয়ার করে না।

সে ক্লান্ত।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

রোসেমের গভর্নর এলেন অতি সাধারণভাবে। তার একমাত্র সঙ্গী হল গ্রাউণ্ড কারের চালক।

গ্রাউণ্ড কারের গঠন বিশাল ও আরামদায়ক, কিন্তু প্রিচারের কাছে তেমন ভালো বলে মনে হল না, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটমিক ফুয়েলে নয় কেমিক্যালে চলে।

জেনডিয়ান গভর্নর হালকা পায়ে পাতলা বরফের উপর নামলেন এবং দুই সারি অনুগত এলডারসের মাঝখান দিয়ে হেঁটে এসে দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। তিনি কারও দিকে তাকালেন না। তাকে অনুসরণ করল সবাই।

নিজেদের ঘর থেকে মিউল ইউনিয়নের দুই ব্যক্তি সব দেখেছে। তিনি অর্থাৎ গভর্নর হালকা পাতলা গড়নের, খাটো এবং অনাকর্ষক।

কিছুই প্রমাণ হয় না।

নার্ভাস হয়ে পড়ার জন্য প্রিচার নিজেকে অভিশাপ দিল। তার মুখ, সে নিশ্চিত একেবারে শান্ত। চ্যানিশের সামনে অপদস্থ হওয়ার ভয় নেই, কিন্তু তার রক্তের গতি দ্রুত হয়ে উঠেছে এবং গলা শুকিয়ে গেছে।

শারীরিক ভয় না। অন্য ধরনের ভয়।

চ্যানিশ অলসভাবে এক হাতের নখের দিকে তাকিয়ে নখ খুঁটছে।

বড় করে শ্বাস টানল প্রিচার। গভীরভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করল মিউল তাকে কনভার্ট করার আগে কেমন ছিল সে। মনে করা কঠিন। মেন্টালি সে আগের অবস্থার সাথে নিজেকে তুলনা করতে পারল না। যে শক্ত বাধন তাকে ইমোশনালি মিউলের সাথে বেঁধে রেখেছে, সেই বাধন সে ছিঁড়তে পারল না। শুধু মনে করতে পারল যে সে একসময় মিউলকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই সময়ের প্রকৃত ইমোশন অনুভব করতে পারল না। তবে পুরোপুরি না পারলেও ঐ সময়ের ইমোশন যতটুকু সে চিন্তা করতে পারল তাতেই মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর।

যদি গভর্নর বিশেষ মেন্টাল পাওয়ারের অধিকারী কোনো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার হয়?

যদি তারা প্রিচারের মানসিক গঠনের কোনো ফাটল দিয়ে ঢুকে তাকে ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি করে–

প্রথমে কিছুই বোঝা যাবে না। কোনো ব্যথা না, মানসিক অবসাদ না। শুধু নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর তার মনে হবে সে কখনোই মিউলের অনুগত ছিল না, সে শুধু তাকে ঘৃণা করে। এই ভীতিকর কল্পনা প্রিচারকে বিব্রত করে তুলল। ভিতরের বমি বমি ভাবটাকে ঠেকাল অনেক কষ্টে।

চ্যানিশের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরল সে। একজন এলডার দরজার চৌকাঠে গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে গভর্নরের কাছে নিয়ে যাবে। চ্যানিশ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বেল্ট ঠিক করে নিল। মাথায় একটা রোসেমিয়ান হুড প্রল।

প্রিচারের চোয়াল শক্ত। আসল জুয়াখেলা শুরু হচ্ছে।

রোসেমের গভর্নর একেবারেই বৈশিষ্ট্যহীন। একটা কারণ তার মাথায় কোনো আচ্ছাদন নেই, এবং পাতলা ধূসর চুল তার প্রকৃতিতে একটা নরম ভাব এনে দিয়েছে। চোখের চারপাশে অসংখ্য বলিরেখা। তার সদ্য কামানো থুতনি মোলায়েম ও ছোট যার কারণে তাকে দুর্বল প্রকৃতির লোক বলে মনে হয়।

প্রিচার চোখের দিকে না তাকিয়ে তার থুতনির দিকে তাকিয়ে রইল। অবশ্য বিপদের সময় এতে কোনো কাজ হবে কিনা সে জানে না।

গভর্নরের কণ্ঠস্বর ভরাট, একঘেয়ে, ‘জেনডায় স্বাগতম। খাবার খেয়েছেন?’ সে দরাজ ভাবে ইউ শেপ টেবিলের উপর হাত নেড়ে দেখাল।

তারা মাথা ঝুঁকিয়ে বসল। গভর্নর ইউর বাকের বাইরের দিকে এবং দুইসারি এল্ডারস্ সহ তারা দুইজন ইউর ভিতরের দিকে বসেছে।

খেতে খেতে গভর্নর জেনডার খাবারের প্রশংসা করল, রোসেমের আবহাওয়ার সমালোচনা করতে লাগল, এমনকি একবার পেস ট্রাভেলের জটিলতা নিয়েও কথা বলার চেষ্টা করল।

চ্যানিশ দুএকটা কথা বলল। প্রিচার একেবারেই চুপ।

খাওয়া শেষ। গভর্নর চেয়ারে হেলান দিল। আমি তোমাদের মহাকাশযানের খোঁজ নিয়েছি। চেয়েছিলাম যানটা যেন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে, তোমাদের যানের অবস্থান অজানা।

‘সত্যিই, চ্যানিশ হালকাঁচালে বলল। আমরা সেটা মহাকাশে রেখে এসেছি। অনেক বড় যান, দুর্গম অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে ভ্রমণের উপযুক্ত নয় এবং এত বড় যান নিয়ে এখানে নামলে আমাদের শান্তিপূর্ণ মনোভাবের প্রতি সন্দেহ জাগতে পারে। তাই আমরা নিরস্ত্র অবস্থায় একা এসেছি।’

‘বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, গভর্নর মন্তব্য করল। তুমি বলছ, অনেক বড় যান?’

‘কোনো যুদ্ধ জাহাজ নয়, এক্সিলেন্সি।‘

‘তোমরা কোত্থেকে এসেছ?’

‘সান্তানি সেক্টরের একটি ছোট পৃথিবী থেকে, ইওর এক্সেলেন্সি, গ্রহটা এতই ছোট এবং গুরুত্বহীন যে আপনি হয়ত এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নন। আমরা বাণিজ্য করতে আগ্রহী।‘

‘বাণিজ্য? তোমাদের কাছে কী আছে?’

‘সকল ধরনের যন্ত্রপাতি, এক্সিলেন্সি, বিনিময়ে খাদ্য, কাঠ, খনিজ–’

‘হুম,’ গভর্নরকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল। ‘এই বিষয়ে আমার ধারণা খুব কম। হয়ত পারস্পরিক চুক্তি করা সম্ভব। তবে আমার সরকারের প্রচুর তথ্যের প্রয়োজন হবে। তাই তোমাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর এবং তোমাদের মহাকাশযান আমাকে দেখানোর পর জেনডার দিকে যাত্রা করাই তোমাদের জন্য ভাল হবে।‘

কেউ কোনো উত্তর দিল না, গভর্নরের আচরণ পাল্টে গেল।

‘যাই হোক, তোমাদের মহাকাশযান দেখাটা প্রয়োজন।’

চ্যানিশ নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের যানের এই মুহূর্তে মেরামতের কাজ চলছে। ইওর এক্সিলেন্সি যদি মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দেন তবে যানটিকে আমরা আপনার সেবায় হাজির করতে পারব।’

‘আমি অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত নই।‘

প্রথমবারের মতো প্রিচার প্রতিপক্ষের তীব্র দৃষ্টির মুখোমুখি হল, চোখে চোখ, ভিতরে ভিতরে দম বন্ধ হয়ে গেল তার। এক মুহূর্তের জন্য ডুবে যাওয়ার মতো অনুভূতি হল। কিন্তু তারপরই চোখ সরিয়ে নিল সে।

চ্যানিশ এর মধ্যে কোনো ইতস্তত ভাব নেই। সে বলল, আটচল্লিশ ঘণ্টার আগে আমাদের যান এখানে নামতে পারবে না, ইওর এক্সিলেন্সি। আমরা এখানে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় এসেছি। তারপরও আমাদের সৎ উদ্দেশ্যের প্রতি আপনার সন্দেহ রয়েছে?

দীর্ঘ নীরবতা, তারপর গভর্নর কর্কশভাবে বলল, ‘তোমরা যে পৃথিবী থেকে এসেছ সেটা সম্পর্কে বল।’

এভাবেই শেষ হল। আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল না। গভর্নর তার অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করে চলে গেলেন।

.

নিজেদের কক্ষে ফিরে এসে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল প্রিচার।

সতর্কতার সাথে–নিশ্বাস বন্ধ করে সে তার ইমোশন অনুভব করল। নিজের ভেতরে কোনো পরিবর্তন টের পেল না। পাওয়ার কথাও না। মিউল কনভার্ট করার পর সে কী কোনো পরিবর্তন টের পেয়েছিল? সব কিছুই কি আগের মতো ছিল না? যেন সবসময় এমনই হয়।

সে নিজেকে পরীক্ষা করল।

ঠাণ্ডা বিদ্বেষের সাথে, নিজের মনের গহীনে চিৎকার করে বলল, ‘দ্বিতীয় ফাউন্ডেশন অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে এবং ধ্বংস করতে হবে।’

এই বক্তব্যের সাথে তার ভিতরে যে ইমোশন তৈরি হল তা হচ্ছে পরিপূর্ণ ঘৃণা। কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ নেই।

তারপর ‘দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন’ শব্দের পরিবর্তে ‘মিউল’ শব্দটি ব্যবহার করে আবারও একই কাজ করল। এই মুহূর্তে আবেগে তার দম বন্ধ হয়ে এল, কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল।

ভাল, যথেষ্ট ভাল।

কিন্তু আরও সূক্ষ্ম বা ছোট কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে কী? যে ধরনের পরিবর্তন তার বিচারবুদ্ধিকে অবরুদ্ধ করে দেয়নি, ফলে ধরাও পড়বে না।

বলার কোনো উপায় নেই।

কিন্তু সে এখনও মিউলের প্রতি পুরোপুরি অনুগত বোধ করছে। যদি সেটার কোনো পরিবর্তন না হয়, অন্য কোনো কিছুকেই আর ভয় নেই।

আবার কাজের দিকে মনটাকে ফিরিয়ে আনল। কক্ষের নিজের অংশে চ্যানিশ তার নিজের কাজে ব্যস্ত। অলসভাবে কব্জির কমিউনিকেটরে বুড়ো আঙুলের নখ ছোঁয়ালো প্রিচার।

অপর প্রান্ত থেকে সারা পেতেই নিজেকে তার মনে হল ভারমুক্ত।

মুখ পুরোপুরি শান্ত, কিন্তু ভিতরে সে খুশিতে লাফাচ্ছে এবং চ্যানিশ তার মুখোমুখি হয়েই অনুভব করতে পারল যে নাটকের শেষ অঙ্কের অভিনয় শুরু হয়েছে।

.

চতুর্থ সম্মেলন

দুই স্পিকার রাস্তায় পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় একজন আরেকজনকে থামিয়ে বলল, ‘ফার্স্ট স্পিকারের কাছ থেকে খবর পেয়েছি।’

অপরজনের চোখে শঙ্কা ফুটে উঠল। ‘ইন্টারসেকশন পয়েন্ট।‘

‘হ্যা! জানি না আগামী ভোর দেখতে পারব কিনা!’

.

১.৫ মিউল

প্রিচারের ভেতর বা তাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে গেছে সে বিষয়ে চ্যানিশকে সচেতন মনে হলো না। শক্ত কাঠের বেঞ্চে হেলান দিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে বসল।

‘গভর্নরের ব্যাপারে তোমার মতামত কী?’

কাঁধ ঝাঁকাল প্রিচার, ‘কিছুই না। তাকে আমার মেন্টাল জিনিয়াস বলে মনে হয়নি। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের খুব দুর্বল নিদর্শন, যদি সে তাদের লোক হয়ে থাকে।‘

‘আমার মনে হয় না গভর্নর তাদের লোক। আমি নিশ্চিত নই। ধর তুমি একজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার।‘ চ্যানিশ চিন্তিতভাবে বলল, ‘তুমি কী করবে? ধর আমরা এখানে কেন এসেছি সেটা তুমি জান। তুমি কীভাবে আমাদের সামলাবে?’

‘অবশ্যই, কনভার্ট করে।‘

‘মিউলের মতো?’ চ্যানিশ তীক্ষ্ণ চোখ তুলে চাইল। আমরা কী করে বুঝব তারা আমাদের কনভার্ট করেছে কীনা? আর তারা যদি অত্যন্ত চালাক সাইকোলজিস্ট হয়ে থাকে?

‘সে-ক্ষেত্রে আমি দ্রুত নিজেদের শেষ করে ফেলব।‘

‘আর আমাদের মহাকাশযান? না’, চ্যানিশ তর্জনী নাচাল। ‘আমরা সবাই ভান করছি, প্রিচার, ওল্ডম্যান। শুধুই ভান। আমরা–তুমি এবং আমি হচ্ছি ঢাল। তাদের আসল লড়াই মিউলের সাথে এবং তারা ঠিক আমাদের মতোই সতর্ক। আমার মনে হয় আমাদের পরিচয় তাদের কাছে গোপন নেই।’

শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিচার। ‘তুমি এখন কী করতে চাও?’

‘অপেক্ষা।‘ চ্যানিশ দ্রুত বলল, ‘তাদেরকে আমাদের কাছে আসতে দাও। তারা উদ্বিগ্ন হতে পারে মহাকাশযানের কারণে, তবে সম্ভবত মিউলের ব্যাপারেই বেশি উদ্বিগ্ন। গভর্নরকে পাঠিয়ে আমাদের ধোকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। এরপর যে আসবে সে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার হবে এবং সে আমাদের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে চাইবে।‘

‘তখন?’

‘তখন আমরা সমঝোতা করব।’

‘আমি সেরকম মনে করি না।‘

‘কারণ তুমি মনে করছ এতে মিউলের প্রতি বেঈমানি করা হবে।‘

‘না, তুমি যদি ডাবল ক্রস করে থাক মিউল তা ঠেকাতে পারবে। তারপরেও আমি তোমার সাথে একমত নই।’

‘কারণ তোমার ধারণা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের আমরা ফাঁকি দিতে পারব না?’

‘হয়তো না। কিন্তু মূল কারণ সেটা না।’

চ্যানিশের দৃষ্টি প্রিচারের হাতের উপর স্থির হয়ে থাকল। হাসিমুখে বলল, ‘তুমি বলতে চাচ্ছ তোমার হাতের বস্তুটাই মূল কারণ।‘

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

প্রিচারের হাতে তার ব্লাস্টার বেরিয়ে এসেছে। ‘ঠিক, তোমাকে গ্রেপ্তার করা হল।‘

‘কেন?’

‘ফার্স্ট সিটিজেন অব দ্য ইউনিয়নের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে।’

চ্যানিশের ঠোঁট পরস্পরের সাথে চেপে বসল। ‘কী ঘটছে এসব?’

‘বিশ্বাসঘাতকতা এবং তা সংশোধনের চেষ্টা।‘

‘কী প্রমাণ আছে? অথবা কোনো এভিডেন্স, ধারণা? পাগল হয়ে গেলে নাকি?’

‘না, পাগল হইনি। তুমি কী মনে কর তোমার মতো আনাড়িকে মিউল এমন একটা জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই পাঠিয়েছে? আমার কাছেও ব্যাপারটা প্রথমে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। আর আমি নিজেকে সন্দেহ করে সময় নষ্ট করেছি। কেন তোমাকে পাঠানো হয়েছে? কারণ তোমার হাসি সুন্দর, পোশাক সুন্দর? নাকি তোমার বয়স আঠাশ বছর বলে?’

‘সম্ভবত কারণ আমাকে বিশ্বাস করা যায়। অথবা তোমার যুক্তিবুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে।‘

‘অথবা তোমাকে বিশ্বাস করা যায় না। যা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত।‘

‘আমরা কী ধাঁধা তৈরি করছি না শব্দের খেলা খেলছি?’

প্রিচার ব্লাস্টার তাক করে রেখে সামনে বাড়ল। চ্যানিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘উঠে দাঁড়াও।’

.

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল চ্যানিশ। ব্লাস্টারের মাজল তার বেল্টের উপর ঠেকে রয়েছে।

‘মিউল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আমিও হয়েছি। তার কারণ নিজেদের তারা খুব ভালোভাবে গোপন রেখেছে। তাই একটা পথই খোলা ছিল–এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যে আগে থেকেই গোপন তথ্যটা জানে।‘

‘সেই একজন হচ্ছি আমি?’

‘অবশ্যই। আমি আগে বুঝতে পারিনি। যদিও আমার চিন্তাভাবনা খুব ধীর, তবু ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে। কত সহজে আমরা স্টারস এণ্ড খুঁজে পেলাম! কী সুন্দরভাবে তুমি সঠিক ফিল্ড রিজিওন বের করে ফেললে! সেখান থেকে সঠিক স্থানও নির্বাচন করলে! বোকা! তুমি কী ভেবেছিলে এতগুলো অসম্ভব ঘটনা আমি একেবারে হজম করে ফেলব?’

‘তোমার মতে আমি সফল?’

‘যে কোনো অনুগত লোকের চেয়ে অর্ধেক সফল।

‘কারণ তোমার বিচারে আমার সাফল্য অনেক নিচু মানের?’

‘ব্লাস্টার দিয়ে খোঁচা দিল প্রিচার। শুধু চোখ দেখে বোঝা গেল চ্যানিশ রেগে যাচ্ছে। কারণ তুমি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের লোক।‘

‘আমি?’–অসহিষ্ণু গলা। ‘প্রমাণ কোথায়?’

‘অথবা তাদের দ্বারা মেন্টালি ইনফ্লুয়েন্সড্‌।‘

‘মিউলের অজান্তে? অসম্ভব।’

‘মিউলের জ্ঞাতসারেই। তুমি কী ভেবেছিলে তোমার খেলার জন্য তোমাকে মহাকাশযান দেওয়া হয়েছে? আসলে যা চেয়েছিলাম তুমি সেভাবেই আমাদের দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছ।‘

‘আমি শুধু ভিতরের নির্যাসটুকু বের করে নিয়েছি অথবা বলা যায় কোনো বিশাল বস্তুর খোসা ছাড়িয়েছি মাত্র। জিজ্ঞেস করতে পারি কেন আমি এরকম করব? যদি আমি বিশ্বাসঘাতক হই, আমি তোমাদেরকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কাছে নিয়ে আসব কেন? বরং গ্যালাক্সির এদিক সেদিক ঘুরে তোমাদের ভুল পথে নিয়ে যাওয়াটাই তো ছিল স্বাভাবিক?’

‘মহাকাশযানের কারণে। এবং কারণ আত্মরক্ষার জন্য দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের এটমিক ওয়রফেয়ারের প্রয়োজন।’

‘একটা মাত্র যান তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। যদি ভেবে থাক এই যান পরীক্ষা করে আগামী বছরই তারা এটমিক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করবে তা হলে আমি বলব তারা ঠিক তোমার মতো অতি অতি সাধারণ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার।’

‘তুমি এগুলো মিউলের সামনে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাবে।‘

‘আমরা কালগানে ফিরে যাচ্ছি?’

‘আমরা এখানেই থাকছি। কমবেশি পনের মিনিটের ভেতর মিউল আমাদের সাথে যোগ দেবেন। তোমার কী ধারণা আমি তার অনুগত বলে সে আমাদের অনুসরণ করে আসেনি? তুমি তোমার খেলা ঠিক মতোই খেলেছ। হয়তো তুমি শিকারকে আমাদের কাছে নিয়ে যাওনি, কিন্তু আমাদের তুমি শিকারের কাছে নিয়ে এসেছ।‘

‘আমি বসতে পারি’, চ্যানিশ বলল, এবং কিছু বিষয় তোমার কাছে ছবির মতো পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারি?’

‘তুমি দাঁড়িয়েই থাকবে।‘

‘ঠিক আছে, দাঁড়িয়েও বলতে পারব। কী মনে হয় তোমার, কমিউনিকেশন সার্কিটে বসানো হাইপারট্রেসারের মাধ্যমে মিউল আমাদের অনুসরণ করে আসছে?’

.

হাতে ধরা ব্লাষ্টার একটু কেঁপে গেল হয়তো। চ্যানিশ ঠিক নিশ্চিত নয়।

‘তোমাকে অবাক দেখাচ্ছে না।’ চ্যানিশ বলল, তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছ। হাইপারট্রেসারের কথা আমি প্রথম থেকেই জানি। এখন আমি তোমাকে এমন কিছু বলব যা আমি জানি যে তুমি জান না।’

৫০ # সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন

‘বিশ্বাসঘাতক বা শত্রু এজেন্ট, যদি এই শব্দটাই তোমার পছন্দ হয়, কিন্তু মিউল সেটা জেনেছে একটু অদ্ভুতভাবে। তার কনভার্টেড লোকদের কয়েকজনের মাইও টেম্পার করা হয়েছে।’

‘হাতের ব্লাস্টার এবার নিশ্চিতভাবেই কেঁপে গেল।’

‘সেজন্যই আমাকে তার প্রয়োজন হয়। আমাকে কনভার্ট করা হয়নি। সে তোমাকে বলেনি যে তার একজন আনকনভার্টেড লোকের প্রয়োজন। তোমাকে কী সে আসল কারণ বলেছি?’

‘অন্যভাবে চেষ্টা কর চ্যানিশ। যদি আমি মিউলের বিরুদ্ধে চলে যেতাম, আমি সেটা বুঝতে পারতাম।‘ প্রিচার দ্রুত ও নিঃশব্দে নিজের মাইণ্ড অনুভব করল। আগের মতোই আছে। চ্যানিশ অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছে।

‘অর্থাৎ তুমি এখনও মিউলের প্রতি আনুগত্য বোধ করছ। সম্ভবত আনুগত্যের কোনো পরিবর্তন করা হয় না। মিউল বলেছিল খুব সহজেই এই পরিবর্তন ডিটেক্ট করা যায়। কিন্তু মানসিকভাবে তুমি কেমন বোধ করছ? নিষ্ক্রিয়। যাত্রা শুরু করার পর থেকে কী সবসময় নিজেকে স্বাভাবিক মনে হয়েছে? অথবা অদ্ভুত কোনো অনুভূতি যেন তুমি অনেকটা নিজের ভেতরে নেই। কী চাও তুমি, ট্রিগার না টিপেই আমার শরীরে গর্ত করে ফেলবে?’

প্রিচার তার ব্লাস্টার আধা ইঞ্চি সরিয়ে আনল। ‘কী বলতে চাও?’

‘বলতে চাই তোমার মাইণ্ড টেম্পার করা হয়েছে। তুমি মিউল বা অন্য কাউকে হাইপারট্রেসার বসাতে দেখনি। তুমি শুধু জিনিসটা সেখানে পেয়েছ এবং ধরে নিয়েছ কাজটা মিউলের। তারপর থেকেই তোমার ধারণা হয়েছে মিউল আমাদের অনুসরণ করে আসছে। অবশ্য তোমার রিসিভার যে ওয়েভলেংথে মূল যানের সাথে যোগাযোগ করে আমার রিসিভার তত ভালোভাবে পারে না। তুমি ভেবেছিলে আমি কিছুই জানি না! এখন সে দ্রুত এবং রাগের সাথে কথা বলছে। তার নিঃস্পৃহ ভাব চলে গিয়ে হিংস্র আচরণ ফুটে উঠেছে, কিন্তু অনুসরণ করে মিউল আমাদের কাছে আসছে না।’

‘সে যদি না হয় তা হলে কে?’

‘তুমি কাদের আশা কর। যেদিন আমরা যাত্রা করি সেদিনই আমি হাইপারট্রেসার খুঁজে পাই। কিন্তু একবারের জন্যও চিন্তা করিনি কাজটা মিউলের। তা ছাড়া যদি আমি বিশ্বাসঘাতক হতাম তা হলে অর্ধেক গ্যালাক্সি পাড়ি দিয়ে এখানে আসার প্রয়োজন ছিল না। খুব সহজেই কনভার্ট করে মিউল আমার কাছ থেকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অবস্থান জেনে নিতে পারত। মিউলের কাছে তুমি কিছু গোপন রাখতে পারবে? আর যদি আমি নাই জানি, তা হলে কীভারে তাকে পথ দেখাব? তবে কেন আমাকে পাঠানো হয়েছে?’

‘অবশ্যই হাইপারট্রেসার বসিয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কোনো এজেন্ট। তারাই এখন আমাদের কাছে আসছে। কী চায় তারা? মহাকাশযান? একটা যান দিয়ে তারা কী করবে। আসলে তারা চায় তোমাকে। প্রিচার। মিউলের পরে ইউনিয়ন সম্পর্কে তুমিই সবচেয়ে বেশি জান এবং তাদের কাছে মিউল যতটা বিপজ্জনক, তুমি ততটা নও। আর তাই কোন পথে অনুসন্ধান করতে হবে সেটা তারা আমার মাইণ্ডে স্থাপন করে দিয়েছিল। আমি জানতাম পিছনে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন রয়েছে এবং তারাই পুরো ব্যাপার পরিচালনা করছে। আমি তাদের নিয়মেই খেলে গেছি। আমরা পরস্পরকে ধোকা দিয়েছি। তারা আমাদের চেয়েছিল, আমি তাদের অবস্থান জানতে চেয়েছিলাম। সে জানে আমরা কেউ কাউকে ধোকা দিতে পারিনি।‘

‘কিন্তু তুমি এভাবে অস্ত্র ধরে রাখলে আমরাই হেরে যাব। অবশ্যই এই পরিকল্পনা তোমার না, তাদের। ব্লাস্টার আমার হাতে দাও প্রিচার। জানি কাজটা তোমার কাছে ভুল মনে হচ্ছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার মাইও কাজ করছে না, তোমার ভিতরে থেকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কাজ করছে। ব্লাস্টার দাও, প্রিচার এবং এখন থেকে যা ঘটবে আমরা একসাথে তার মোকাবেলা করব।’

প্রিচার এক ভীতিজনক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হল। অনিশ্চয়তা! তার সব ধারণাই কী ভুল? নিজের ভেতরে এত সন্দেহ কেন? সে নিশ্চিত হতে পারছে না কেন? চ্যানিশ কী করে এত নিশ্চিত হয়?

অনিশ্চয়তা!

তার কি দুটো সত্তা রয়েছে?

একটা বিভ্রমের মধ্যে সে চ্যানিশকে দেখল হাত বাড়িয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে–এবং হঠাৎ করেই প্রিচার বুঝতে পারল যে চ্যানিশের হাতে সে ব্লাস্টার দিয়ে দিতে যাচ্ছে।

এবং ব্লাস্টার চ্যানিশের হাতে দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার পিছনে দরজা খুলে গেল, প্রায় নিঃশব্দে–ঘুরে দাঁড়াল সে।

.

মিউল কখনো বিভ্রান্ত হয় না এবং তার অভিধানে অপ্রত্যাশিত বলে কোনো ঘটনা নেই। সবকিছুই তার প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়।

শারীরিকভাবে মিউল কোনো পরিস্থিতি প্রভাবিত করতে পারে না, এখনও করছে না।

পোশাকের কারণে তার স্বাভাবিক অবয়ব ফুটে উঠেনি। মুখ ঢাকা। আলখাল্লার হুড মাথার উপর টেনে দেওয়ায় তাকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছে। তার উপস্থিতিতে প্রিচারের মানসিক যন্ত্রণা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা কমল। অন্যভাবে বলা যায় পরিস্থিতিতে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি হল।

‘ব্লাস্টার তোমার কাছেই থাক, প্রিচার।‘ মিউল বলল, তারপর চ্যানিশের দিকে ঘুরল। চ্যানিশ কাধ ঝাঁকিয়ে বসে পড়েছে। ‘আমি ছাড়া অন্য কারো অনুসরণ করার ব্যাপারটা কী?’

প্রিচার বাধা দিল, ‘আপনার আদেশে আমাদের যানে হাইপারট্রেসার বসানো হয়েছিল, স্যার?’

মিউল ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকাল, অবশ্যই। ইউনিয়ন অব ওয়ার্ল্ডস ছাড়া গ্যালাক্সির অন্য কোনো পক্ষ কী সেখানে ঢুকতে পারত? যাই হোক, তুমি কিছু বলছিলে চ্যানিশ?

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার ভুল হয়েছিল, স্যার। আমার ধারণা ছিল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কেউ ট্রেসার বসিয়েছে এবং তাদের কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাদের এখানে পথ দেখিয়ে আনা হয়েছে। আমি সেটা প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এ ছাড়াও আমার ধারণা ছিল জেনারেল বোধহয় তাদের হাতে চলে গেছেন।

‘এখন আর তোমার সেরকম মনে হচ্ছে না।’

‘এখন আর মনে হচ্ছে না।‘

‘ঠিক আছে, এই বিষয়টা বাদ দাও।’ মিউল প্যাড লাগানো এবং ইলেকট্রিক্যালি উত্তপ্ত পোশাকের উপরের স্তর খুলে ফেলল। আমি বসতে পারি? এখন–এখানে আমরা নিরাপদ এবং অনাহুত প্রবেশের বিপদমুক্ত। এই বরফের ডিপোর স্থানীয় লোকদের এখানে প্রবেশের কোনো আগ্রহ নেই। নিশ্চিন্ত থাকতে পার। নিজের ক্ষমতার উপর পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস ফুঠে উঠল।

চ্যানিশ তার বিরূপভাব গোপন করল না। গোপনীয়তার প্রয়োজন কেন? কেউ কি পানীয় সার্ভ করবে আর নর্তকীরা নাচ দেখাবে?

‘হতে পারে, তোমার থিওরি কী বলে? কোনো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার তোমাকে এমন একটি ডিভাইস দিয়ে অনুসরণ করেছে যা আমি ছাড়া আর কারো কাছে নেই এবং এই জায়গা তুমি কীভাবে খুঁজে পেলে?’

‘জানা সমস্ত ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে নির্দিষ্ট ধারণা আমার মাথায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল–’

‘সেই একই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার দ্বারা?’

‘আমার তাই ধারণা।‘

‘তা হলে তোমার কী একবারও মনে হয়নি যে যদি একজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনে যেতে তোমাকে বাধ্য বা প্ররোচিত করতে পারে–এবং তুমি জান যে সে আমার মতো একই পদ্ধতিতে কাজ করে। যদিও খেয়াল করো, আমি শুধু ইমোশন প্রতিস্থাপন করতে পারি, আইডিয়া না–তোমার কী মনে হয় না, সে যখন এভাবেই কাজ সারতে পারছে, তখন হাইপারট্রেসার বসানোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না।’

হঠাৎ কেঁপে উঠল চ্যানিশ। তীব্র চোখে মিউলের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। স্বস্তি তে প্রিচারের কাধ ঝুঁকে গেল।

না,’ বলল চ্যানিশ, আমার সেরকম মনে হয়নি।‘

‘অথবা তারা যদি তোমাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়, তা হলে তোমাকে কীভাবে পথনির্দেশনা দেবে। আর পথনির্দেশ না পেলে এই জায়গা তুমি খুঁজে পেতে না। বিষয়টা ভেবেছিলে?

‘সেটাও আমি চিন্তা করিনি।’

‘কেন করনি? তোমার বুদ্ধিমত্তা কী সাধারণ মাত্রার চেয়েও নিচু স্তরের?’

‘এর উত্তরে আমি শুধু একটা প্রশ্ন করব স্যার। আপনিও কী জেনারেলের সাথে মিলে আমাকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে অভিযুক্ত করছেন?’

‘যদি করেই থাকি তবে অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য তুমি কী বলবে?’

‘জেনারেলকে যা বলেছি তাই বলব। যদি আমি বিশ্বাসঘাতক হই এবং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অবস্থান আমার জানা থাকে, তাহলে আমাকে কনভার্ট করে সহজেই তথ্যগুলো জেনে নিতে পারতেন। যদি আমাকে অনুসরণ করার প্রয়োজন হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে আমি আগে থেকে কোনো তথ্য জানি না এবং বিশ্বাসঘাতক নই। অর্থাৎ আপনার ধাঁধার উত্তরে আমি আরেকটি ধাঁধা তৈরি করলাম।’

‘তো, শেষপর্যন্ত উপসংহার কী হলো?’

‘আমি বিশ্বাসঘাতক নই।‘

‘আমাকে বিশ্বাস করতেই হচ্ছে, যেহেতু যুক্তি আছে তোমার কথায়।‘

‘তা হলে আপনি আমাদের গোপনে অনুসরণ করে এসেছেন কেন?’

‘কারণ পুরো ঘটনার একটা আলাদা ব্যাখ্যা আছে। তুমি এবং প্রিচার নিজেদের মতো করে কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছো, সবগুলোর দিতে পারোনি। আমি–যদি তোমরা আমাকে সময় দাও–অল্প সময়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রিচার, তোমার ব্লাস্টার আমার হাতে দাও। আমাদের উপর আঘাত আসার কোনো ভয় নেই। ভিতর থেকে না, বাইরে থেকেও না, এমনকি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন থেকেও কোনো ভয় নেই।‘

রোসেমিয়ান পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক তার দ্বারা কামরাটি গরম রাখা হয়েছে। হালকা হলুদ আলো দিচ্ছে সিলিং থেকে ঝুলন্ত একটা বাল্ব, বড় হয়ে তিনজনের ছায়া পড়েছে দেওয়ালে।

মিউল বলল, ‘চ্যানিশকে যেহেতু আমি অনুসরণ করে এসেছি বুঝতে হবে যে আমি কিছু একটা পেতে চেয়েছিলাম। তারপর সে যেরকম দ্রুত ও সরাসরি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনে চলে গেল, আমরা ধরে নিতে পারি যে এরকম একটা কিছুই আমি চেয়েছিলাম। কোনো একটা বাধার কারণে আমি চ্যানিশের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। এই হচ্ছে ঘটনা। চ্যানিশের কাছে সমস্ত জবাব রয়েছে। আমি জানি। প্রিচার, তুমি বুঝতে পেরেছ?’

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘না, স্যার।‘

‘আমি বুঝিয়ে বলছি। শুধুমাত্র এক ধরনের লোকেরাই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব জানে এবং আমাকে বাধা দিতে পারে। চ্যানিশ, আমি নিশ্চিত তুমি একজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার।‘

হাঁটুর উপর কনুই-এর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে এল চ্যানিশ। রাগের সাথে বলল ‘কোনো সরাসরি প্রমাণ আছে। এই অভিযোগ আজকে দিনে দুইবার ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।‘

‘সরাসরি প্রমাণও রয়েছে, চ্যানিশ। আমি তোমাকে বলেছি আমার লোকদের টেম্পার করা হচ্ছে, যে করছে সে অবশ্যই আনকনভার্টেড এবং সব বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। খুব সহজ ব্যাপার। তুমি অত্যন্ত সফল চ্যানিশ। মানুষ তোমাকে পছন্দ করে। সবকিছুই ভালোমতো চলছিল।

‘তারপর আমি তোমাকে এই অভিযানের দায়িত্ব নিতে বললাম তুমিও পিছপা হলে না। তোমার ইমোশন পরীক্ষা করে বুঝলাম তোমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। যে কোনো সাধারণ লোক এই অভিযানে যেতে সামান্য হলেও অনিশ্চয়তায় পড়ে যেত। কিন্তু তোমার কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না। হয় তুমি প্রচণ্ড বোকা অথবা কন্ট্রোলড।

‘তাই তোমাকে আরেকভাবে পরীক্ষা করলাম। এক মুহূর্তের জন্য আমি তোমার মাই পূর্ণ করে দিলাম প্রচণ্ড কষ্টে এবং পরমুহূর্তেই সরিয়ে নিলাম। তুমি রেগে উঠলে, আমার কাছে স্বাভাবিক আচরণ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তার আগে, মাত্র এক পলকের জন্য, খুব সামান্য এক পলকের জন্য নিজেকে সামলে নেওয়ার আগে তোমার মাইও রেজিস্ট করল। এটাই জানার প্রয়োজন ছিল আমার।’

‘আমার মতো ক্ষমতা ছাড়া কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না, এমনকি কয়েক পলকের জন্যও না।‘

চ্যানিশের কণ্ঠস্বর নিচু এবং তিক্ত, ‘তো এখন কী ঘটবে?’

‘এখন তুমি মারা যাবে–একজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার হিসাবে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো তোমাকে মেরে ফেলা দরকার।’

আরেকবার ব্লাস্টার এর মাজল-এর মুখোমুখি হল চ্যানিশ। এইবার মাজল এর পিছনে যে রয়েছে সে প্রিচারের মতো দুর্বল কেউ নয়, বরং তার নিজের মতোই পরিণত এবং শক্তিশালী।

আর তার হাতে সময়ও খুব কম।

.

পরবর্তী পরিস্থিতি ইমোশনাল কন্ট্রোলে অক্ষম সাধারণ কারো পক্ষে বর্ণনা করা কঠিন।

বস্তুত ব্লাস্টারের ট্রিগারে মিউল বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতে শুরু করার পর অতি স্বল্প সময়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারল চ্যানিশ।

মিউলের এই মুহূর্তের ইমোশনাল মেকআপ দৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী। কোনো দ্বিধাগ্রস্ততা নেই। পরে চ্যানিশের যদি কৌতূহল জাগে সে হিসাব করে দেখতে পাবে যে তার মৃত্যু ছিল আর মাত্র এক সেকেণ্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ দূরত্বে।

সেই একই সময়ের ভেতর মিউল যা বুঝতে পারল তা হচ্ছে, চ্যানিশের মস্তিষ্কের ইমোশনাল পটেনশিয়াল তার কোনো প্রভাব ছাড়াই হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল, একই সাথে অপ্রত্যাশিত দিক হতে সীমাহীন ভয়ঙ্কর ঘৃনার এক প্রবাহ আছড়ে পড়ছে তার উপর।

নতুন এই ইমোশনাল এলিম্যান্ট ঝাঁকি দিয়ে ট্রিগার থেকে মিউলের আঙুল সরিয়ে দিল। আর কিছু করার ছিল না, পরিস্থিতির পরিবর্তন সে পুরোপুরি বুঝে ফেলেছে।

তিনজন ব্যাক্তি এমন অবস্থানে আছে যে কতগুলো রেখা দিয়ে তাদের সংযুক্ত করলে একটা ত্রিভুজ তৈরি হবে।

দাঁড়িয়ে আছে মিউল, হাতে ব্লাস্টার, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চ্যানিশের দিকে। চ্যানিশ নিঃশ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছে। আর প্রিচার, তাকে দেখে মনে হয় যেন কেউ তাকে চেয়ারের সাথে ঠেসে ধরে রেখেছে। তার শরীর কাঁপছে প্রচণ্ড বেগে, মাংশপেশীগুলো এতো বেশি শক্ত হয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে মিউলের দিকে, দৃষ্টিতে সুতীব্র এবং ভয়ঙ্কর ঘৃণা।

চ্যানিশ এবং মিউলের মধ্যে একটা বা দুটো শব্দ বলা হয়েছে। একটা বা দুটো শব্দই ইমোশনাল কনশাসনেস-এর প্রবাহকে চালু করে দেয়, যে প্রবাহ শুধু তাদের মতো দুজনই বুঝতে পারবে। আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য তাদের অনুভূতিকে শব্দে অনুবাদ করাই ভালো।

চ্যানিশ চাপা গলায় বলল, ‘আপনি দুটো আগুনের মাঝখানে রয়েছেন, ফার্স্ট সিটিজেন। একই সাথে আপনি দুটো মাইণ্ড কন্ট্রোল করতে পারবেন না, যেখানে একটি হচ্ছে আমার। প্রিচার এই মুহূর্তে আপনার কনভার্সন থেকে মুক্ত। আমি তার বাধাগুলো সরিয়ে দিয়েছি। ও হচ্ছে সেই আগের প্রিচার যে এক সময় আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, সে আপনাকে সমস্ত মুক্ত ও পবিত্র জিনিসের শত্রু বলে মনে করে এবং এও জানে যে আপনি তাকে পাঁচবছর ধরে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তার ইচ্ছাশক্তি দমিয়ে আমি তাকে সামলে রাখছি কিন্তু যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন, সে মুক্ত হয়ে যাবে এবং আমার দিক থেকে ব্লাস্টার বা আপনার ইচ্ছা শক্তি সরিয়ে নেওয়ার আগেই সে আপনাকে খুন করবে।‘

বুঝতে পারল মিউল। একটুও নড়ল না।

চ্যানিশ বলে যেতে লাগল, ‘যদি আপনি তাকে কন্ট্রোল বা হত্যা বা অন্য কিছু করার জন্য মাইণ্ড ঘুরিয়ে নেন, আমাকে থামানোর জন্য আবার আপনি আমার দিকে এত দ্রুত ঘুরতে পারবেন না।‘

মিউল এবারও স্থির। শুধু হালকা সম্মতির চিহ্ন রয়েছে।

‘তাই,’ চ্যানিশ বলল, ‘ব্লাস্টার নিচে ফেলে দিন এবং আগের আলোচনায় ফিরে যাই।‘

‘আমি একটা ভুল করেছি’ অবশেষে বলল মিউল, যখন তোমাকে জেরা করছিলাম তখন এখানে তৃতীয় কারো উপস্থিত থাকাটা বোকামি হয়েছে। এখন ভুলের খেসারত দিতেই হবে।

সে ব্লাস্টার নিচে ফেলে দিল এবং লাথি দিয়ে পাঠিয়ে দিল কামরার অন্যদিকে। একই সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল প্রিচার।

‘জেগে উঠে আবার সে স্বাভাবিক হয়ে যাবে,’ মিউল আগের গলাতেই বলল।

মিউল ট্রিগারে চাপ দিতে শুরু করার পর ব্লাস্টার ফেলে দেওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে মাত্র দেড় সেকেণ্ড।

কিন্তু সচেতনতার ঠিক বাইরে থেকে হঠাৎ করেই চ্যানিশ এক পলকের জন্য মিউলের মাইণ্ডের ভেতর কিছু একটা ডিটেক্ট করতে পারল। সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস এবং বিজয়উল্লাস।

.

১.৬ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন

লোক দুজন সম্পূর্ণ শিথিল ও সহজভাবে বসে রয়েছে; দুজন দুই দিকে। কিন্তু আবেগিক স্নায়ুগুলো কাঁপছে উত্তেজনায়।

দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এই প্রথম মিউল অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চ্যানিশ জানে এই মুহূর্তে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও বেশিক্ষণ পারবে না।

এ ধরনের চিন্তাও মৃত্যুর সামিল। কোনো ধরনের আবেগিক দুর্বলতার প্রকাশ মানেই মিউলের হাতে একটা অস্ত্র তুলে দেওয়া। মিউল এরই মধ্যে কোনো পরিকল্পনা করে ফেলেছে।

সময় পেতে হবে–

এখনও আসছে না কেন? সেটাই কী মিউলের আত্মবিশ্বাসের কারণ? তার প্রতিপক্ষ এমন কী জানে যা সে জানে না? তার মাইণ্ড কিছুই বলছে না, যদি সে আইডিয়াগুলো বুঝতে পারত। এবং এখনও–

‘যেহেতু আপনার ধারণা আমি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার,’ চ্যানিশ বলল, এবং আমিও অস্বীকার করিনি, তাহলে বলুন কেন আমি জেনডায় এসেছি?

‘ওহ না,’ মিউল আত্মবিশ্বাসের সাথে হাসল, ‘আমি প্রিচার নই। তোমার কাছে আমার কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। তুমি যে যুক্তিই দেখাও, তোমার আচরণেই আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি।’

‘তারপরও আপনার গল্পের কোথাও ফাঁক থাকতে পারে। জেনডাই কী আপনি যা খুঁজছেন সেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন? প্রিচার প্রায়ই আপনার আরেকটি প্রচেষ্টার কথা বলত এবং আপনার সাইকোলজিস্ট এবলিং মিস-এর কথা। আমার স্বল্প উৎসাহে সে অনেক কিছুই বলত। এবলিং মিস এর কথা চিন্তা করুন, ফার্স্ট সিটিজেন।’

‘কেন করব?’ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল মিউল।

চ্যানিশ বুঝতে পারছে মিউল ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে, যেন সময়ের সাথে সাথে তার সমস্ত উদ্বেগ কেটে যাচ্ছে।

নিজের মরিয়া ভাব দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করল চ্যানিশ। আপনার কৌতূহল কম তাহলে। প্রিচার বলেছিল মিস কিছু একটার প্রতি প্রবলভাবে বিস্মিত হয়েছিল। সে বারবার দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে সতর্ক করে দেওয়ার কথা বলছিল। কেন? এবলিং মিস মারা গেল। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কেন সতর্ক হয়নি। এবং তারা টিকে আছে।

নিষ্ঠুর তৃপ্তির সাথে হাসল মিউল, অবশই তারা সতর্ক হয়েছিল। তা নইলে কেন আমার লোকদের সামলানোর জন্য বেইল চ্যানিশ নামের একজন কালগানে উপস্থিত হল এবং সম্ভবত আমাকে উৎখাতের উদ্দেশ্যও তার ছিল। একটু দেরি করে এসেছিল এই যা।‘

‘তাহলে,’ চ্যানিশ কিচ্ছু করুণা বোধ করুল তার প্রতি, ‘আপনি জানেনই না দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কী, অথবা যা সব ঘটছে তার মূল অর্থ কী?’

মিউল অন্যজনের করুণা বুঝতে পেরে বিরূপ হয়ে উঠল। তার সেই পরিচিত ভঙ্গিতে নাক ঘষল চার আঙুল দিয়ে। ‘বল তাহলে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ব্যাপারটা কী?’

চ্যানিশ মরিয়াভাবে বলা শুরু করল, আবেগিক প্রতীকের বদলে এখন সে শব্দ ব্যবহার করছে। ‘আমি যতুটুকু জানি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে ঘিরে থাকা রহস্যই মিসকে বেশি বিভ্রান্ত করে তু্লেছিল। হ্যারি সেলডন তার দুটো ইউনিট অত্যন্ত ভিন্নভাবে স্থাপন করেছিলেন। প্রথম ফাউণ্ডেশন ছিল প্রকাশ্য। কিন্তু দ্বিতীয়টি অন্ধকারে থাকা রহস্যময় কালো গহ্বর।

‘কেন এরকম করেছিলেন, সেটা বুঝতে হলে আবার আপনাকে ধ্বংসোন্মুগ এম্পায়ারের তৎকালীন পরিবেশ অনুধাবন করতে হবে। সেটা ছিল এক চরম সময়, চুড়ান্ত উৎকর্ষতার পর সমস্ত অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল। এক মুমূর্ষ সভ্যতার নিদর্শন। যেখানে নতুন ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে বাধা তৈরি করা হয়েছিল। সেলঙ্গন এই বাধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন যা তাকে বিখ্যাত করে তোলে। এটাই ছিল তার সর্বশেষ তারুণ্যদীপ্ত সৃষ্টি যা এম্পায়ারের অস্তমিত সূর্যকে উজ্জ্বল করে তোলে এবং দ্বিতীয় এম্পায়ারের সূর্যোদয়ের পথ তৈরি করে।”

‘বেশ নটিকীয় তো?’

তাই তিনি সাইকোহিস্টোরির নীতি অনুসরণ করে দুটো ফাউণ্ডেশন তৈরি করেন। কিন্তু তার চেয়ে আর কে ভালোভাবে জানে যে এই নীতিগুলো সব আপেক্ষিক। তিনি কোনো ফিনিশ প্রোডাক্ট তৈরি করেননি। ফিনিশ প্রোডাক্ট ক্ষয়িষ্ণু মনের জন্য। কিন্তু তার একটা গতিশীল মেকানিজম ছিল এবং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন হচ্ছে সেই গতিশীলতার মূল হাতিয়ার। আমরা, ক্ষণস্থায়ী ইউনিয়ন অব ওয়ার্ল্ডের ফার্স্ট সিটিজেন, আমরাই হচ্ছি সেলডনস প্ল্যানের আসল অভিভাবক, রক্ষক, শুধু আমরা।’

‘তুমি কী নিজেকে সাহস যোগাচ্ছ,’ মিউল অবজ্ঞার সাথে বলল, ‘অথবা আমাকে প্রভাবিত করতে চাও? দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন, সেলডনস প্ল্যান, দ্বিতীয় এম্পায়ার আমাকে একেবারেই প্রভাবিত করতে পারেনি। আবেগিক যে উপাদানগুলো তুমি আমার ভেতর ঢুকানোর চেষ্টা করছ, তাতেও লাভ হয়নি। তাছাড়া বোকা, দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন এখন অতীত। কারণ তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।‘

মিউল চেয়ার ছেড়ে সামনে এগুলো। চ্যানিশ তার মাইণ্ডে ইমোশনাল পটেনশিয়ালিটি চেপে বসছে বুঝতে পারছে। সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল প্রাণপণে। কিন্তু একটা বিরুদ্ধ শক্তি তার ভেতরে নির্মমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, আঘাত করছে, তার মাইণ্ড দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে।

দেওয়ালের সাথে পিঠ লেগে গেল, মিউল দাঁড়িয়ে আছে একেবারে মুখোমুখি। কোমরে হাত, বিশাল নাকের নিচে ঠোঁট ভয়ঙ্করভাবে ফাঁক হয়ে আছে।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

তোমার খেলা শেষ, চ্যানিশ। তোমাদের সবার খেলা–সরার, যাদের দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন বলা হত।

এখানে বসে তুমি কিসের অপেক্ষা করছিলে। যখন তুমি প্রিচারে সাথে তর্ক করছিলে, যখন শারীরিক শক্তি ছাড়াই প্রিচারকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিলে। তুমি আসলে অপেক্ষা করছিলো, তাই না? অপেক্ষা করছিলে প্রতিকূল একটা পরিস্থিতিতে আমাকে স্বাগত জানাতে। তোমার জন্য দুঃসংবাদ যে আমার জন্য প্রতিকূল বলে কোনো কথা নেই।

‘আর এখন তুমি কিসের অপেক্ষা কবুছ? এখনও আমার দিকে এমনভাবে শব্দবান ছুঁড়ছ, যেন তোমার কণ্ঠস্বর আমাকে চেয়ারের সাথে গেঁথে রাখবে। আর যখনই তুমি কথা বলছ তোমার মাইণ্ড কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে–তো করছেই। কিন্তু কেউ আসবে না। যাদের তুলি আশা করছ, তোমার বন্ধুরা তাদের কেউ না। তুমি এখানে একা চ্যানিশ এবং একই থাকবে। কেন জান?

কারণ প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আমাকে ভুলভাবে বিচার করেছে। আমি তাদের পরিকল্পনা আগে থেকেই জানি। তারা ভেবেছিল তোমাকে অনুসরণ করে আমি এখানে আসব এবং সিদ্ধ হওয়ার জন্য তাদের উত্তপ্ত কড়াইতে চড়ে বসব। তুমি আসলে একটা টোপ, দুর্বল, বোকা এক মিউট্যান্টের জন্য একটি টোপ।

‘তারা কীভাবে চিন্তা করল যে আমি আমার ফ্লিট ছাড়া এখানে আসব? যে কোনো আর্টিলারির বিরুদ্ধে তারা অসহায়। আমার শিপ প্রায় বার ঘণ্টা আগে জেনভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এতক্ষণে জেনডা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। জনবসতির কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এবং দুর্বল কুৎসিত এই আমি এখন গ্যালাক্সির সব ক্ষমতার অধিকারী।’

চ্যানিশ অসহায়ভাবে মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কিছু করতে পারল না। আর্তস্বরে বলল-–’না, না।’

‘হ্যাঁ–হ্যাঁ—’ মিউল ভেঙচি কেটে বলল। এবং তুমি সম্ভবত সর্বশেষ জীবিত। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না।’

বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর চ্যানিশের মাইণ্ডের সবচেয়ে ভিতরের টিস্যুতে অনুপ্রবেশের ফলে হঠাৎ তীব্র ব্যথায় সে প্রায় গড়াগড়ি দিতে লাগল।

মিউল পিছিয়ে গেল, ‘যথেষ্ট নয়,। তুমি পরীক্ষায় পাস করতে পারোনি। তুমি ভণ্ড। বড় একটা আদর্শ ধ্বংস হয়ে যাবে। তার জন্য তোমার কোনো আক্ষেপ নেই, বরং নিজের মৃত্যুভয়ে কাতর।

মিউল তার দুর্বল হাতের ছোট্ট মুঠি দিয়ে চ্যানিশের গলা চেপে ধরল। অনেক কষ্টেও সে ছুটতে পারল না।

‘তুমি আমার বীমা, চ্যানিশ। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তুমি তার বিরুদ্ধে আমার পরিচালক ও সেফগার্ড।‘ মিউলের চোখ তার ভিতরে গেঁথে যাচ্ছে–জোরালোভাবে–তীব্রভাবে–

‘আমার হিসাব ঠিক আছে, চ্যানিশ? আমি তোমার দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছি? জেনডা ধ্বংস হয়ে গেছে চ্যানিশ, পুরোপুরি ধ্বংস; বাস্ত বতাটা কী? আমি অবশ্যই বাস্তবতা এবং সত্য জানতে চাই। কথা বল চ্যানিশ কথা বল। আমি কী তবে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করতে পারিনি? এখনও বিপদ রয়ে গেছে? কথা বল, চ্যানিশ। আমি কোথায় ভুল করেছি?’

চ্যানিশ অনুভব করল শব্দগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। অনিচ্ছাকৃতভাবে। দাঁত চেপে ধরে সেগুলোকে বাধা দিতে চাইল। জিহ্বা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল। গলার সমস্ত পেশী শক্ত করে রাখল।

কিন্তু শব্দগুলো বেরিয়ে এল ফিসফিস করে প্রচণ্ড শক্তিতে বেরিয়ে আসার পথে তার গলা, জিভ, দাঁত ছিন্নভিন্ন করে দিল।

‘সত্য,’ সে অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলল, ‘সত্য-–’

‘হ্যাঁ, সত্য। আর কী করার আছে?’

‘সেলডন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন স্থাপন করেছিলেন এখানে। এখানে, আমি মিথ্যা বলছি না। সাইকোলজিস্টরা এখানে এসে স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ নেয়।‘

‘আর জেনডা?’ মিউল তার আবেগকে অত্যাচারের বন্যায় ডুবিয়ে দিল– নিষ্ঠুরভাবে সেগুলোকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগল। জেনডা আমি ধ্বংস করেছি। তুমি জান আমি কী চাই। আমাকে বল।’

‘জেনডা নয়। আমি বলেছি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সম্ভবত সরাসরি ক্ষমতায় থাকবে না। জেনডা হচ্ছে সবার মাথা–’ শব্দগুলো বোঝাই যায় না। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারের ইচ্ছার প্রতিটি অণুর বিরুদ্ধে সেগুলো তৈরি হচ্ছে, ‘রোসেম–রোসেম? রোসেমই হচ্ছে সেই পৃথিবী–’

মিউল তার মুঠো ঢিলে করল এবং চ্যানিশ যন্ত্রণা ও পীড়নের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকল।

‘তুমি আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছ?’ খুব নরমভাবে বলল মিউল।

‘তোমাকে বোকা বানানো হয়েছে।‘ এটাই ছিল চ্যানিশের সর্বশেষ প্রতিরোধ।

‘কিন্তু খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। আমি আমার ফ্লিটের সাথে যোগাযোগ করেছি। জেনডার পর তারা রোসেমেও আসতে পারবে। কিন্তু প্রথমে–’

চ্যানিশ টের পাচ্ছে তার চারপাশে যন্ত্রণাদায়ক অন্ধকার তৈরি হচ্ছে, কিছুতেই দূর হচ্ছে না। অন্ধকার তার শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে, বুঝতে পারছে তার অত্যাচারিত, আহত মাইণ্ড চির অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আবছাভাবে দেখতে পেল মিউল বিজয় গর্বে হাসছে। হাসির তালে কাঁপছে লম্বা, মাংসল নাক।

শব্দটা হালকা হয়ে গেল। অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিল।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চেতনা ফিরে আসতে লাগল চ্যানিশের। ব্যাপারটা অনেকটা ছোট ফুটো দিয়ে একঝলক আলো এসে পড়ার মতো। আলোটা একবার ফুটোর সামনে আসছে আবার চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসছে। চ্যানিশ।

সে বেঁচে আছে অবশ্যই। নরমভাবে প্রায় পালকের মতো হালকা করে শ্বাস নিল। তার চিন্তাভাবনা স্থির হচ্ছে। আরামবোধের একটা প্রবাহ তার ভিতরে প্রবেশ করছে সে বুঝতে পারল। বাইরে থেকে। নাক ঘষল সে।

দরজা খোলা এবং ফার্স্ট স্পিকার ঠিক চৌকাঠের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে। সে কথা বলার চেষ্টা করল, চিৎকার করার চেষ্টা করল, সতর্ক করার চেষ্টা করল–কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। সে জানে মিউলের পরাক্রমশালী মাইণ্ডের একটা অংশ এখনও তাকে ধরে রেখেছে এবং শব্দগুলো তার ভিতরেই আটকে রাখছে।

সে আরেকবার নাক ঘষল। মিউল এখনও কামরায় রয়েছে। অত্যন্ত ক্ষিপ্ত এবং চোখ লাল হয়ে আছে। এখন আর সে হাসছে না। কিন্তু হিংস্রভাবে দাঁত বেরিয়ে রয়েছে।

তার মাইণ্ডে ফার্স্ট স্পিকারের কোমল মেন্টাল ইনফ্লুয়েন্স অনুভব করছে চ্যানিশ। আস্তে আস্তে তার যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে। হঠাৎ করেই সব অনুভূতি হারিয়ে গেল। কারণ ফার্স্ট স্পিকারের মেন্টাল ইনফ্লুয়েন্স মিউলের প্রতিরক্ষার সাথে এক মুহূর্তের জন্য ধাক্কা খেল। তারপর আবার সব ঠিক।

মিউল তার কৃশকায় শরীরের সাথে বেমানান ক্রোধের সাথে বলল, আরেকজন আমাকে স্বাগত জানাতে এসেছে। তার ক্ষিপ্র মাইণ্ড কামরা ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেল–

‘তুমি একা,’ সে বলল।

‘আমি পুরোপুরি একা।’ বললেন ফার্স্ট স্পিকার, একা আসাই দরকার, যেহেতু পাঁচবছর আগে আমিই তোমাকে চিনতে ভুল করেছিলাম। সেই ভুলের সংশোধন আমাকে একাই করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত যে মেন্টাল ওয়েভ দিয়ে তুমি জায়গাটা ঘিরে রেখেছো, সেটা আমার হিসাবে ছিল না। এখানে আসতে সে কারণেই আমার সময় বেশি লেগেছে। তোমার দক্ষতার জন্য অভিনন্দন।‘

‘অভিনন্দনের প্রয়োজন নেই।‘ বৈরী জবাব আসল। ‘তুমি কী ওইখানে পড়ে থাকা তোমার ভাঙা পিলারের সাথে তোমার ব্রেইনের ছিটেফোঁটা যোগ দিতে এখানে এসেছো?’

ফার্স্ট স্পিকার হাসলেন, ‘কেন, যাকে তুমি বেইল চ্যানিশ হিসাবে চেন সে তার মিশন পুরোপুরি সম্পন্ন করেছে, যদিও মেন্টালি সে তোমার সমকক্ষ নয়। আমি দেখতে পারছি তুমি তার কতটুকু ক্ষতি করেছ, হয়তো আমরা তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে পারব। সে অত্যন্ত সাহসী, এই মিশনে স্বেচ্ছায় এসেছে।‘

চ্যানিশের মাইণ্ড তরঙ্গ কিছু বলার চেষ্টা করছে, সতর্ক করে দিতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। সে শুধু ভয়ের একষ্টা স্রোত নিক্ষেপ করতে পারল।

মিউল একেবারেই শান্ত। ‘তুমি নিশ্চয়ই জেনডার ধ্বংসের কথা জান?’

‘আমি জানি। তোমার কামলার কথা আমরা আগেই অমনুমান করেছিলাম।‘

‘হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি। কিন্তু প্রতিরোধের ব্যবস্থা করনি?’

‘না, প্রতিরোধ করা হয়নি। ফার্স্ট স্পিকারের ইমোশনাল সিম্বোলজী একেবারেই সরল। যেন তিনি নিজের প্রতিই বিরক্ত। এবং ভুলটা তোমার চেয়ে আমারই বেশি। পাঁচবছর আগে কে ভাবতে পেরেছিল তোমার এত ক্ষমতা। প্রথম থেকেই আমরা অনুমান করেছিলাম–যখন কালগান দখল কর–যে তোমার ইমোশনাল কন্ট্রোলের ক্ষমতা আছে। খুব একটা অবাক হওয়ার মতো কিছু না, ফার্স্ট সিটিজেন, আমি ব্যাখ্যা করতে পারি।’

তুমি আর আমি যেভাবে ইমোশনাল কন্টাক্ট করি সেটা নতুন কিছু নয়। এটা মানুষের ব্রেইনের মধ্যেই রয়েছে। অধিকাংশ মানুষই প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতিতে ইমোশন প্রকাশ করতে পারে যেমন মুখের ভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ইত্যাদি। কিছু পশু গন্ধশোঁকার অনুভূতিকে ব্যবহার করে। এই ক্ষেত্রে আবেগ কম জটিল।

‘বস্তুত মানুষের ক্ষমতা আরও বেশি। কিন্তু মিলিয়ন বছর আগে কথা বলতে শেখার পর সরাসরি ইমোশনাল কন্টাক্ট বিষয়টি বন্ধ হয়ে যায়। একমাত্র দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনই এই ভুলে যাওয়া বিষয়টি কিছু পরিমাণে ধরে রাখতে পেরেছে।

‘কিন্তু আমরা এই ক্ষমতা নিয়ে জন্মাই না। মিলিয়ন বছরের ক্ষয় একটা ভয়ানক বাধা এবং আমাদের এই অনুভূতিকে শিখতে হয়, চর্চা করতে হয়। পেশীর জন্য যেমন ব্যায়াম করি এর জন্যও সেভাবে ব্যায়াম করতে হয়। তোমার সাথে এখানেই আমাদের পার্থক্য। তুমি এই ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছ।

‘অনেক কিছুই আমরা বুঝতে পারি। যে মানবগোষ্ঠীর এই ধরনের ক্ষমতা নেই তাদের উপর এর প্রভাব আমরা বুঝতে পারি। আমাদের হিসাবে তুমি ছিলে ম্যাগালোম্যানিয়াক এবং আমাদের ধারণা ছিল যে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু দুটো কারণে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

‘প্রথমত তোমার অনুভূতির ক্ষমতা। আমরা কেবলমাত্র মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে ইমোশনাল কন্টাক্ট আরোপ করতে পারি। আর তাই যে কোনো অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা অসহায়। কিন্তু তুমি দৃষ্টি এবং শ্রবণ সীমার বাইরে থাকলেও তোমার লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পার। ব্যাপারটা অনেক পরে ধরতে পারি।’

‘দ্বিতীয়ত তোমার শারীরিক অক্ষমতার কথা আমাদের জানা ছিলনা। বিশেষ করে যে কারণে তুমি মিউল নাম গ্রহণ করেছ। ধারণাও ছিল না যে তুমি শুধু একজন মিউট্যান্টই নও বরং শারীরিক অক্ষমতার কারণে একটা বিকৃত মিউট্যান্ট। আমরা শুধু একজন ম্যাগালোম্যানিয়াককে ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম–একজন সাইকোপ্যাথকে ঠেকানোর প্রস্তুতি আমাদের ছিল না।

‘এই ভুলের সমস্ত দায়দায়িত্ব আমার, যেহেতু তুমি যখন কলগান দখল করা আমি ছিলাম দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নেতা। যখন তুমি ফার্স্ট ফাউণ্ডেশন ধ্বংস কর, আমরা তোমার ব্যাপারে সব বুঝতে পারি–কিন্তু অনেক দেরিতে–সেই ভুলের জন্য জেনডাতে কয়েক মিলিয়ন লোক মারা গেল।

‘এখন তুমি সব কিছু ঠিক করে দেকে? মিউলের পাতলা ঠোঁট বেঁকে গেল, তার ভিতর থেকে নির্জলা ঘৃণার তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কী করবে তুমি? আমাকে শক্তিশালী বলিষ্ঠ লোকে পরিণত করবে? শৈশব থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি তুমি সেটা বুঝতে পারবে? নিজের প্রয়োজনে যা করেছি তার জন্য আমার কোনো অনুতাপ নেই। গ্যালাক্সি নিজেই নিজেকে রক্ষা করুক। যখন আমার প্রয়োজন ছিল তখন সে একটা পালকও নড়ায়নি।’

‘যে সব শিশুদের তোমার মতো ইমোশন রয়েছে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।’ ফার্স্ট স্পিকার বললেন, তবে তোমার ইমোশনের পরিবর্তন হবে না। জেনডার ধ্বংস ছিল অনিবার্য। অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হয়তোবা পুরো গ্যালাক্সিতে শতাব্দী জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যেত। আমাদের যতটুকু সম্ভব আমরা করেছি। জেনডা থেকে যতজন লোককে সম্ভব সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য গ্রহগুলোকে ডিসেন্ট্রালাইজড করে রাখা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হিসাব প্রকৃত হিসাবের অনেক বাইরে ছিল। বহু মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে তার জন্য তোমার কোনো অনুতাপ নেই?

‘একেবারেই নেই–এমনকী আগামী ছয়ঘণ্টা পর রোসেমে যে বহু লোক মারা যাবে তার জন্যও নেই।

‘রোসেমে!’ ফার্স্ট স্পিকার দ্রুত বললেন।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

তিনি চ্যানিশের দিকে ঘুরলেন। চ্যানিশ অনেক কষ্টে অর্ধেক উঠে বসেছে। তিনি তার, মাইও ফোর্স বৃদ্ধি করলেন। চ্যানিশ তার ভিতরে দুটো মাইণ্ড-এর যুদ্ধ টের পেল, হঠাৎ করেই খুলে গেল সমস্ত বন্ধন এবং শব্দগুলো অর মুখ দিয়ে ছিটকে বের হলো, ‘স্যার, আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। আপনি আসার দশ মিনিট আগে সে জোর করে আমার কাছ থেকে সব কথা বের করে নিয়েছে। আমি বাধা দিতে পারিনি এবং এর জন্য আমি ক্ষমাও চাই না। সে জানে জেনডা নয় রোসেমই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন।‘

আবার তার মাইণ্ড আবদ্ধ হয়ে গেল।

ফার্স্ট স্পিকারের ভুরু কুঁচকে গেল, ‘আচ্ছা! তুমি এখন কী করতে চাও?’

‘তুমি কী আসলেই অবাক হচ্ছ? যখন তুমি আমাকে ইমোশনাল কন্টাক্ট সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছিলে, আমাকে ম্যাগালোম্যানিয়াক, সাইকোপ্যাথ বলে আখ্যায়িত করছিলে, আমি তখন কাজ করছিলাম। আমি আমার ফ্লিটের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং তারা তাদের আদেশ পেয়ে গেছে। ছয় ঘণ্টার মধ্যে যদি না আমি কোনো কারণে আদেশ প্রত্যাহার করি, পুরো রোসেম তারা ধ্বংস করে ফেলবে। শুধু এই গ্রাম এবং এর আশেপাশের এক হাজার স্কয়ার মাইল এলাকা বাদে। তারপর তারা এখানে ল্যাণ্ড করবে।

‘তোমার হাতে ছয় ঘণ্টা সময় আছে। এই ছয় ঘণ্টায় তুমি আমার মাইণ্ড ফোর্স পরাজিত করতে পারবে না বা রোসেম রক্ষা করতে পারবে না।’

মিউল দুহাত ছড়িয়ে হাসতে লাগল আর ফাস্ট স্পিকারকে দেখে মনে হচ্ছে। পরিস্থিতির এই নতুন মোড় হজম করার চেষ্টা করছেন।

তিনি বললেন, ‘বিকল্প উপায়?’

‘কেন, বিকল্প থাকবে কেন? বেশি কিছু কী পাব আমি? যদি তুমি রোসেমাইটদের জীবন বাঁচাতে চাও তবে তোমাদের সবাইকে–দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সবাইকে আমার মেন্টাল কন্ট্রোলের অধীনে চলে আসতে হবে। তাহলে আমি আমার ফ্লিটকে ফিরে যেতে বলব। এতগুলো তীক্ষ্ণ মেধার লোককে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা মূল্যবান সম্পত্তির মতো। আবার কষ্টকরও। তাই তুমি রাজি না হলেই আমি খুশি হব। তোমার কী মত? আমার মাইণ্ডের বিরুদ্ধে তোমার কী অস্ত্র আছে, অথবা আমার যুদ্ধ জাহাজের বিরুদ্ধে, যেগুলো তুমি স্বপ্নেও পাওয়ার কথা চিন্তা করনি।’

‘কী আছে আমার কাছে?’ ফার্স্ট স্পিকার বললেন, ধীরে ধীরে। কিছুই নেই–একদানা শস্য ছাড়া– জ্ঞানের ছোট এককণা শস্য যা এমনকী তুমিও জান না।’

‘তাড়াতাড়ি বল,’ মিউল হাসল, ‘বিশ্বাসযোগ্য কিছু বল। অস্বাভাবিক কিছু বলে। লাভ নেই।’

‘বোকা মিউট্যান্ট। আমি অস্বাভাবিক কিছু বলছি না। নিজেকেই জিজ্ঞেস কর–বেইল চ্যানিশকে কেন টোপ হিসাবে পাঠানো হল, বেইল চ্যানিশ তরুণ, সাহসী, কিন্তু মেন্টালি তোমার এই ঘুমন্ত অফিসার হ্যান প্রিচারের মতোই দুর্বল। আমি কেন যাইনি, আমাদের অন্যান্য নেতৃস্থানীয়দের কেউ, যারা তোমার সমকক্ষ।‘

‘সম্ভবত,’ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী উত্তর, ‘তুমি যথেষ্ট বোকা নও, অথবা তোমাদের কেউই আমার সমকক্ষ নয়।’

‘আসল কারণটা আরও যুক্তিযুক্ত। তুমি চ্যানিশকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার হিসাবে জান। ব্যাপারটা তোমার কাছ থেকে গোপন করার ক্ষমতা তার ছিল না। এটাও জানত তুমি তার চেয়ে ক্ষমতাশালী, তাই তাকে তোমার কোনো ভয় ছিল না এবং তার ইচ্ছামতো অনুসরণ করে আসলে। যদি আমি কালগানে যেতাম, তখন আমাকে প্রকৃত বিপদ মনে করে হত্যা করতে অথবা আমি পরিচয় গোপন করে মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারতাম। এখন পেসে আমাকে অনুসরণ করতে আমি তোমাকে বাধা দিতে পারি। কিন্তু তুমি কালগানে থাকলে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সমস্ত শক্তি দিয়েও তোমার কোনো ক্ষতি করা যেত না, কারণ সেখানে তোমার লোকজন, মেসিন এবং মেন্টাল পাওয়ার তোমাকে নিরাপদে ঘিরে রেখেছে।’

‘আমার মেন্টাল পাওয়ার এখনও আমার সাথে আছে, মিউল বলল, এবং আমার লোকজন ও মেসিন খুব বেশি দূরে নেই।’

.

‘সত্যিই তাই, কিন্তু তুমি এখন কালগানে নও। তুমি এখানে, কিংডম অব জেনডায়, লজিক্যালি যা তোমার কাছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ, ফার্স্ট সিটিজেন এবং যুক্তি মেনে চল। তাই তোমার কাছে। সতর্ক যুক্তির সাথে ঘটনাটা উপস্থাপন করা হয়েছে।’

‘ঠিক, কিন্তু এটা তোমার একটা ক্ষণস্থায়ী বিজয় মাত্র, চ্যানিশের কাছ থেকে প্রকৃত সত্য বের করার জন্য প্রচুর সময় আমার হাতে আছে এবং সেটা সত্য না মিথ্যা বুঝার ক্ষমতাও আমার আছে।’

‘আমাদের দিক থেকে, বলতে পারি আমরা খুব ভালভাবেই জানতাম তুমি সবসময়ই একধাপ এগিয়ে থাকবে। তাই বেইল চ্যানিশকে তোমার জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়।

‘অর্থাৎ, আমি তার ব্রেইন মুরগির পালক ছাড়ানোর মতো করে পরিষ্কার করে দিয়েছি। সে রোসেমকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন বলছে কারণ এই মিথ্যা কথাটাই এমন শক্তভাবে তার ভিতর গেঁথে দিয়েছি যে অতি সূক্ষ্ম পরীক্ষাতেও ধরা পড়বে না।

‘আমি তোমাকে বলেছি বেইল চ্যানিশ একজন স্বেচ্ছাকর্মী। তুমি জান সে কী ধরনের স্বেচ্ছাকর্মী? কালগানের উদ্দেশ্যে আমাদের ফাউণ্ডেশন ত্যাগ করার আগে তার উপর জটিল ধরনের ইমোশনাল চিকিৎসা চালানো হয়। তুমি কী মনে কর শুধু এতটুকুই তোমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট! নাকি বেইল চ্যানিশ তোমাকে বিভ্রান্ত করতে পারত? না, বেইল চ্যানিশ নিজে প্রয়োজন বোধে এবং স্বেচ্ছায় বিভ্রান্ত হয়েছে। তার মাইণ্ডের গভীরতম প্রদেশে সে প্রকৃতই বিশ্বাস করে যে রোসেমই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন।‘

ঝট করে দাঁড়িয়ে গেল মিউল। রোসেম দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন নয়?

চ্যানিশ অনুভব করল ফার্স্ট স্পিকারের মেন্টাল ফোর্সের প্রবাহের কারণে তার রুদ্ধ অবস্থা দূর হয়ে যাচ্ছে চিরতরে। একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, ‘দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন রোসেমে নয়?’

তার স্মৃতি, সমস্ত জ্ঞান, সবকিছু তার ভিতরে বিভ্রান্তভাবে ঘুরপাক খেতে লাগল।

ফাস্ট স্পিকার হাসলেন, ‘দেখ ফার্স্ট সিটিজেন, চ্যানিশও তোমার মতো হতবাক। অবশ্যই রোসেম দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন না। আমরা কী পাগল নাকি যে আমাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী শত্রুকে নিজেদের পৃথিবীতে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসব।’

‘তোমার ফ্লিট যতটুকু পারে রোসেম ধ্বংস করে দিক। তারা শুধুমাত্র আমাকে এবং চ্যানিশকে হত্যা করতে পারবে–এর ফলে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটবে না।

 

১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘রোসেমে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের তিন বছরের প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা এখন কাজ করছে। এই গ্রামের অস্থায়ী এন্ডারস্রা কালগানের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। তারা তোমার ফ্লিটকে ফাঁকি দিয়ে কমপক্ষে তোমার একদিন আগে কালগানে পৌঁছবে। তাই তোমাকে সব কথা বলছি। আমি আদেশ প্রত্যাহার না করলে, তুমি ফিরে গিয়ে বিদ্রোহপূর্ণ সাম্রাজ্য পাবে। তোমার হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। শুধুমাত্র এখানে তোমার ফ্লিটের লোকজন তোমার প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু তারা সংখ্যায় একৈবারেই কম। তাছাড়া তোমার হোম ফ্লিটের সাথে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের লোক থাকবে। তারা লক্ষ্য রাখবে তুমি যেন আর কাউকে কনভার্ট করতে না পার। তোমার রাজত্ব শেষ, মিউট্যান্ট।

আস্তে আস্তে মিউল মাথা ঝাঁকাল, রাগ এবং অসন্তোষ তার মাইণ্ডকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, ‘হ্যাঁ, অনেক দেরি হয়ে গেছে–অনেক দেরি হয়ে গেছে–এখন আমি বুঝতে পারছি।’

‘তুমি এখন বুঝতে পারছ,’ ফার্স্ট স্পিকার সম্মত হলেন। কিন্তু আর বুঝতে পারবে না।’

ঠিক সেই মুহূর্তের হতাশার কারণে মিউলের মাইণ্ড ফার্স্ট স্পিকারের সামনে একেবারেই অরক্ষিত হয়ে পড়ল–এই মুহূর্তটির জন্য তিনি তৈরি ছিলেন এবং মিউলের মাইণ্ডের প্রকৃতিও জানতেন–দ্রুত মিউলের মাইণ্ডে অনুপ্রবেশ করলেন। তাকে সম্পূর্ণভাবে কনভার্ট করতে এক সেকেণ্ডেরও কম সময় লাগল।

চোখ তুলে তাকাল মিউল এবং বলল, তাহলে আমি কালগানে ফিরে যাব?’

‘অবশ্যই। কেমন বোধ করছ?’

‘দারুণ,’ তার ভুরু কোঁচকানো, তুমি কে?’

‘জানার দরকার আছে।’

‘অবশ্যই না।’ ব্যাপারটা সে এখানেই শেষ করে দিল এবং প্রিচারের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘উঠো প্রিচার আমরা বাড়ি ফিরছি।

.

দুই ঘণ্টা পর নিজের পায়ে হাঁটার মতো শক্তি অর্জন করল চ্যানিশ। ‘তার আর কিছুই মনে পড়বে না?’ চ্যানিশ জিজ্ঞাসা করল।

‘কখনও না। তার মেন্টাল পাওয়ার এবং সাম্রাজ্য আগের মতোই আছে কিন্তু তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের কথা তার মন থেকে পুরোপুরি মুছে গেছে এবং সে এখন একজন শান্তিকামী লোক। শারীরিক অসামঞ্জস্যতার কারণে আর যে কয়েক বছর সে বাঁচবে আগের চেয়ে শান্তিতে বাঁচবে। তারপর তার মৃত্যুর পর, সেলডন প্ল্যান আগের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে–যেভাবেই হোক।’

‘সত্যি নাকি,’ চ্যানিশের স্বরে ব্যাকুলতা, ‘সত্যিই রোসেম দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন না। আমি কসম খেয়ে বলতে পারি–আমি জানি এখানেই। আমি পাগল হয়ে যাইনি।’

‘তুমি পাগল হওনি, চ্যানিশ, শুধু পরিবর্তন হয়েছ। রোসেম দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন না। এস, আমরাও বাড়ি ফিরছি।’

.

পঞ্চম সম্মেলন

বেইল চ্যানিশ সাদা টাইলস বসানো রুমে বসে আছে। তার মাইণ্ড এখন শিথিল। সে শুধু বর্তমানে বেঁচে আছে। দেওয়াল, জানালা, বাইরে ঘাস রয়েছে। তার কাছে। সেগুলোর কোনো নাম নেই। শুধুই বস্তু। একটা বিছানা, একটা চেয়ার এবং বই পড়ার জন্য বিছানার পায়ের কাছে একটা স্ক্রিন রয়েছে। একজন নার্স তার খাবার এনে দেয়।

প্রথম প্রথম টুকরো টুকরো যা সে শুনত সেগুলো জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করত। যেমন দুজন লোক কথা বলছিল–

একজন বলছিল, বাকশক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। সব পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে এবং আমার মনে হয় কোনো ক্ষতি হয়নি। তার মূল ব্রেইন ওয়েভের প্রকৃত গঠন ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি ছিল।’ কথাগুলো তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়।

তারপর কামরায় কেউ একজন এসে তাকে কিছু প্রয়োগ করল। ফলে সে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে থাকল।

এবং যখন সেই সময় পেরিয়ে গেল, বিছানাটা হঠাৎ করেই বিছানা হয়ে গেল এবং বুঝতে পারল যে সে হাসপাতালে রয়েছে। শোনা কথাগুলোর অর্থও তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

সে উঠে বসল ‘কী ঘটছে? ফার্স্ট স্পিকার তার পাশে ছিলেন, ‘তুমি এখন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনে এবং তুমি তোমার মাইণ্ড ফিরে পেয়েছ–তোমার আসল মাইও।’

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ’ চ্যানিশ হঠাৎ করেই বুঝতে পারল সে সেই এবং এর আনন্দ বর্ণনা করা কঠিন।

‘এখন বল, ফার্স্ট স্পিকার বললেন, তুমি জানো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কোথায়?’

এবং সত্যটা বিশাল স্রোতের মতো আছড়ে পড়ল, চ্যানিশ কোনো উত্তর দিল না। এবলিং মিস-এর মতোই সেও বিপুল বিস্ময়ে অনুভূতিহীন হয়ে গেল।

অবশেষে সে মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘স্টারস অব দ্য গ্যালাক্সি, এখন আমি জানি! আমি জানি!’

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

cropped Bangla Gurukul Logo ১ম পর্ব: মিউলের অন্বেষণ -সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment