সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি
১৫.

পরদিন সকালবেলায় সিটাফোর্ড হাউসের সামনে পায়চারী করছিল এমি’লি, সেখানেই মিঃ রাইক্রফটের সঙ্গে তার আলাপ হল। কথাপ্রসঙ্গে মিঃ রাইক্রফট জানালেন যে পক্ষীতত্ব আর অপরাধতত্ত্ব এই দুটি বিষয়ে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বড় ভাগ্নে জিম পিয়ার্সনকে পুলিশ ওঁর খুনী সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছে, মিঃ রাইক্রফট বলেন, আমার ধারণা ও পুরোপুরি নির্দোষ।

কিন্তু পিয়ার্সনের গতিবিধি বা কার্যকলাপ সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? এমি’লি প্রশ্ন করল।

এককথায় বলতে গেলে কিছুই জানি না, মিঃ রাইক্রফট উত্তর দিলেন, তবে আপনার মতো সুন্দরী যুবতীর যিনি প্রণয়ী তিনি কি আর সত্যিই হত্যাকারী মানসিকতাসম্পন্ন লোক হবেন? সেদিন ঘটনা যা ঘটেছিল আমার মতে তা এরকম : জিমের হয়তো হঠাৎ কিছু বেশি টাকার দরকার পড়েছিল আর মামার কাছে এসে সে ওই টাকাটা চেয়েছিল। কিন্তু জিমের মামা অর্থাৎ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওই টাকা তাকে দিতে রাজী হননি। টাকাটা না পেয়ে জিম নিশ্চয়ই খুব রেগে যায় আর তখনই হাতের কাছে পড়ে থাকা ধাতুর হাতলটা তুলে নিয়ে সে তার মামার মাথায় আঘাত করে সাজোরে। এক আঘাতেই নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান মারা গিয়েছিলেন। সেদিন থেকে এটাই বলা যায় যে মামাকে খুন করার কোনও পরিকল্পনা সেদিন জিমের ছিল না। আবার এমনও হতে পারে যে জিম আদৌ রাগের মাথায় সেদিন তার মামাকে খুন করেনি, টাকা না পেয়ে শুধু ঝগড়াঝাটি করে সে ওইদিন বেরিয়ে এসেছিল তাঁর বাড়ি থেকে। তারপর অন্য কোনও পেশাদার খুনী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ভেতরে কোনও গতিকে ঢুকে পড়েছিল যার হাতে তিনি খুন হন। এই দ্বিতীয় ধারণাটির ওপরেই আমি জোর দিচ্ছি। তাহলে এটাও ধরে নিতে হয় যে মামা ভাগ্নের মধ্যে টাকাকড়ি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে তা আড়ালে দাঁড়িয়ে আসল অপরাধী শুনে ফেলেছিল। এও হতে পারে যে সেই অপরাধী বহুদিন ধরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার সুযোগ খুঁজছিল, ওইদিন মামা ভাগ্নের ওই ঝগড়া, সে সুযোগ এনে তুলে দিয়েছিল তার হাতে।

আপনার এই ধারণা যদি সত্যি হয়, বলে কথা শেষ না করে মাঝপথে থেমে গেল এমি’লি।

-হ্যাঁ, আমার এই ধারণা সত্যি হলে এটাই প্রতিপন্ন হবে যে আসল অপরাধী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুবই ঘনিষ্ট ছিল এবং এটাও ধরে নিতে হবে যে সে এই এক্সহ্যাম্পটনের বাসিন্দা। এই প্রসঙ্গে যার নাম আমার মনে আসছে সে হল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনি ইভানস। হয়তো ঘটনার সময় ইভানস বাড়ির ভেতরেই ছিল আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে তার বড় ভাগ্নে জিমের ঝগড়াও সে শুনতে পেয়েছিল। এখন দেখতে হবে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান মারা গেলে ইভানসের কোনওভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা আছে কিনা?

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ইভানসের নামে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল, এমি’লি মন্তব্য করল।

পর্যাপ্ত মোটিভ খাড়া করার পরে এই যুক্তি যথেষ্ট নয়, মিঃ রাইক্রফট বললেন, আমাদের জানতে হবে মাঝখানে ইভানসের হঠাৎ বেশি টাকার দরকার পড়েছিল কিনা। এছাড়া মিসেস ইভানসকেও বাদ দিলে চলবে না। এমনও হতে পারে যে তার নিজেরই হঠাৎ টাকার দরকার পড়েছিল আর স্ত্রীকে খুশি করতে গিয়েই ইভানস এই কান্ডটি ঘটিয়েছে। এটা গ্রাম দেশ মিস ট্রেফুসিস, এখানে বিচিত্ররূপিনী নারী অনেক দেখতে পাবেন আপনি। কিন্তু জানবেন, মিসেস ইভানসকে কিছুতেই সন্দেহের আওতার বাইরে রাখা যাবে না।

আচ্ছা মিঃ রাইক্রফট, এমি’লি প্রশ্ন করল, প্রেতচর্চার নামে আপনারা সেদিন যে টেবলটার্নিং-এর খেলায় মেতেছিলেন সে সম্পর্কে আপনার নিজের কি অভিমত?

মিস ট্রেফুসিস, মিঃ রাইক্রফট জবাব দিলেন, আমি অলৌকিকে বিশ্বাসী তা জেনে রাখবেন। সেদিনের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ আমি পরামনোবিদ্যা গবেষণা সমিতিতে লিখে পাঠিয়েছি। সত্যিই কি অদ্ভুত ঘটনা, পাঁচজন লোক বসে প্রেতচর্চা করছে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুন হবার ঘটনা যারা কেউ জানে না, কিন্তু সে খবর অলৌকিক ভাবে তাদের কাছে পৌঁছে গেল এক প্ৰেতলোক-এর এক অজানা বাসিন্দার মাধ্যমে।

মিঃ গারফিল্ড লোকটি কেমন? এমি’লি প্রশ্ন করল।

ভাল ছেলে, মিঃ রাইক্রফট বললেন, কিন্তু তার মধ্যে কোনরকম কৈফিয়ৎ আমার চোখে পড়েনি।

মিসেস উইলেট আর তার মেয়েকে আপনার কিরকম মনে হয়?

ওঁরা দুজনেই খুব মিশুকে, মিঃ রাইক্রফট বললেন, যদিও কিছুটা সেকেলের ধাঁচে। ওঁদের হাতে পয়সাকড়ি আছে বিস্তর তেমনি ওঁরা খুবই অতিথিপরায়ণ।

এতো জায়গা থাকতে শীতকালে ওঁরা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এখানে এসে হাজির। হলেন কেন?

আপনার প্রশ্নটা অসঙ্গত নয়, মিস ট্রেফুসিস, মিঃ রাইক্রফট বললেন, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রচণ্ড গরম ওঁদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল তাই শীতের সময় তুষারপাতের মধ্যে কাটানোর লোভে ওঁরা মা মেয়ে এসে হাজির হয়েছেন এখানে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে চালুপথ বেয়ে নেমে এল। সামনে একসারি সুদৃশ্য ছোট কটেজ, তার একটির দিকে ইশারা করে এমি’লি প্রশ্ন করল, এখানে কে থাকেন?

ক্যাপ্টেন উইয়াট, মিঃ রাইক্রফট বললেন, ভদ্রলোক গত যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছেন। হাঁটাচলা করতে পারেন না।

উনি কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বন্ধু ছিলেন? এমি’লি জানতে চাইল।

বন্ধু নয়, মিঃ রাইক্রফট বললেন, পরিচিত ছিলেন বলা যায়, দুজনের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না, উইয়াট মোটেই মিশুকে নন তবু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান এদিকে এলে ওঁর সঙ্গে দেখা করতেন।

আরও কিছুক্ষণ যাবার পর মিঃ রাইক্রফট এমি’লিকে তার নিজের কটেজে নিয়ে এলেন। বসার ঘরের সবকটি আলমারী বইয়ে ঠাসা, তাদের মধ্যে পক্ষীতত্ত্বের চাইতে আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের বই-ই সংখ্যায় বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিচার ও তদন্ত কাহিনীর কয়েকটি সংকলন তার চোখে পড়ল।

বাঃ বেশ সুন্দর তো আপনার কটেজটা, এমি’লি মন্তব্য করল, কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে তাই এবার আমায় ফিরতে হবে।

.

১৬.

ব্রেকফাস্ট খাবার অল্প কিছুক্ষণ বাদেই রণি গারফিল্ড এসে হাজির হল মিসেস কার্টিসের বাড়িতে, এমি’লির সঙ্গে একরকম যেতেই আলাপ করল সে। রণি গারফিল্ড এমি’লিকে নিয়ে এল তার মাসী মিস পার্সিহাউসের কাছে যার নাম এমি’লি এর আগেই শুনেছিল মিসেস কার্টিসের কাছে।

তাহলে তুমিই সেই মেয়ে যার সঙ্গে কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর বড় ভাগ্নে জিমের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে? কোনও ভূমিকা না করেই মিস পার্সিহাউস এমি’লির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তোমার কথা মিসেস কার্টিস আগেই আমায় বলে রেখেছেন। জিম যে পুরো নির্দোষ তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই জেনো। আর এটাও জেনো যে পুলিশ ওকে ঠিকই ছেড়ে দেবে। যা তুমি নিজে এই খুনের তদন্ত করবে শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি, আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করব তোমায়। বল, কি করতে পারি তোমার জন্য?

রণি গারফিল্ড কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে মিস পার্সিহাউস বলে উঠলেন, উঁহু, গুরুজনদের কথার মাঝখানে একদম কথা বলবে না বাছা, আর কোনদিন যেন এটা তোমায় করতে না দেখি। তাছাড়া তুমি পুরুষ মানুষ, আমাদের মেয়েদের কথার মধ্যে থাকা তো তোমার কোনও দরকার নেই। বাগানের শেষে দুটো চেয়ার আর একটা বেঞ্চ পড়ে আছ, তুমি বরং ওগুলো রং করে ফ্যালো, রংয়ের টিন আর বুরুশ ওখানেই পাবে।

তাই যাচ্ছি মাসী, বলে বাধ্য ছেলের মতো রণি গারফিল্ড দ্রুতপায়ে এগোলো বাগানের দিকে। তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল এমি’লি তারপর মুখ তুলে বলল, ম্যাডাম আমি পরপর কয়েকজন স্থানীয় লোকের নাম বলে যাচ্ছি, আপনি দয়া করে আমায় বলুন এরা কে কেমন লোক। প্রথম লোকটি হলেন মেজর বারনাবি।

গোড়াতেই এই হতচ্ছাড়ার নাম করলে? মিস পার্সিহাউস জবাব দিলেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের লোক, স্কুলের গন্ডী পেরোনোর পরেই রোজগারের দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঢুকে গিয়েছিল মিলিটারীতে। গত মহাযুদ্ধে বিদেশে গিয়েছিল, লড়াই করে অনেক মেডেলও পেয়েছিল, কিন্তু হলে কি হবে, অবসর নেবার পরে স্বভাবটা ভয়ানক হিংসুটে আর কুচুটে হয়ে পড়েছে। সবসময় শুধু নিজের কথাই ভাবছে, কারও ভাল দুচোখে সইতে পারে না। যেমন খিটখিটে ওঁর স্বভাব তেমনি নিচু ওঁর মন, যেখানে স্বার্থের গন্ধ নেই সেখানে ওঁকে কখনও দেখতে পাবে না।

মিঃ রাইক্রফট?

উনি হলেন সেই ধাঁচের লোক যাঁরা চান লোকে সবসময় তাদের মাথায় তুলে নাচানাচি করুক। দুনিয়ার এমন কোনও গোয়েন্দা গল্পের বই নেই যা তুমি ওঁর কাছে পাবে না, আর সেগুলো দিনরাত পড়ে ওঁর ধারণা হয়েছে গোয়েন্দাগিরির সবটুকু ওঁর জানা হয়ে গেছে। ওঁকে খুব বেশি পাত্তা দিয়ো না।

মিঃ ডিউক?

উনি খুব সাধারণ আর সাদাসিধে ধাঁচের লোক যার মধ্যে কোনরকম বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু তাহলেও আমার অনেক সময় মনে হয় ওঁর মধ্যে অদ্ভুত কোনও সত্ত্বা লুকিয়ে আছে। অথচ সেটা কি তা আজ পর্যন্ত আমার জানা হয়ে ওঠেনি।

মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেট?

ভাল লোকের নাম করেছ, মিস পার্সিহাউস পাশের টেবলে রাখা একটা খাম তুলে নিলেন, তার ভেতর থেকে একটা লেবেল টেনে বের করে বললেন, এ হল এমনই একটা লেবেল যা ট্রেনে, জাহাজে বা প্লেনে চড়ে বেড়ানোর সময় যাত্রীরা তাদের মালপত্রে এঁটে রাখে, এতে তাদের নামধাম, গন্তব্যস্থল, সবকিছু লেখা থাকে। মিসেস উইলেট আর ওঁর মেয়ে এখানে এসে পৌঁছোনোর পরে গাড়িতে চেপে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই গিয়েছিলেন আর ঠিক তখনই ওঁর কোনও বাক্সের গায়ে সেঁটে থাকা এই লেবেলটা খসে বাতাসে উড়ে এসে পড়েছিল আমার বাড়ির সামনে। রণি ওটা কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। রণির মুখ থেকে শুনেছিলাম ওঁরা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন যে ওঁরা দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেন। সে সময়কার গরম সইতে না পেরে শীতকালটা ইংল্যান্ডের অজ পাড়াগাঁয়ে তুষারপাতের মধ্যে কাটাবেন বলে এসেছেন। অথচ মজার ব্যাপার হল এই লেবেলের গায়ে যে হোটেলের নাম ঠিকানা লেখা আছে সেটা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অবস্থিত। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে একটাই, তা হল–দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, ওঁরা আসলে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। প্রশ্ন হল, অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন অথচ তা চেপে গিয়ে বারবার ওঁরা কেন বলছেন যে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছেন?

 

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময় তাতে সন্দেহ নেই, এমি’লি বলল, তাছাড়া শুধু গরমের হাত থেকে বাঁচতে শীতকালটা ইংল্যান্ডের এক অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বাড়ি ভাড়া নেয়, এটাও আমার চোখে ঠিক স্বাভাবিক ঠেকছে না।

আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত,মিস পার্সিহাউস বললেন, তুমি কি ওঁদের সঙ্গে দেখা করেছো?

না, এমি’লি বলল, তবে ভাবছি আজ একবার যাব, মুশকিল হচ্ছে কেন এসেছি তা কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না।

আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ এটা কোনও সমস্যাই হবে না। বলেই মিস পার্সিহাউস গল্প চড়িয়ে তার বোনপো রণিকে ডাকলেন।

কি ব্যাপার মাসী, সবুজ রং মাখা বুরুশ হাতে নিয়ই রণি বাগান থেকে দৌড়ে এল, এত হাঁকডাক করছ কেন, কি হয়েছে?

শোন বাছা, মিস পার্সিহাউস রণির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, গতকাল বিকেলে উইলেটদের বাড়িতে চা খেতে গিয়েছিলে মনে পড়ছে?

পড়ছে মাসী, রণি ঘাড় নেড়ে জবাব দিল। কিন্তু কেন বলতো?

চায়ের সঙ্গে কি খাবার ওখানে খেয়েছিলে তা মনে আছে?

আছে মাসী, রণি বলল, একটা নতুন ধরনের কেক মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট আমায় খাইয়েছিল, নাম বলেছিল কফি কেক। বলেছিল ও নিজের হাতে ওই কেক বাড়িতে তৈরি করেছে।

বাঃ, মিসেস পার্সিহাউস এমি’লির দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন, এই তো খুব ভালো অজুহাত পাওয়া গেছে, আর তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই। একটুকরো কাগজে তিনি মিসেস উইলেটের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখলেন যা তার দূর সম্পর্কের বোনঝি এমি’লিকে পাঠাচ্ছেন, মিসেস উইলেট যেন কফি কেক তৈরী করার পদ্ধতি লিখে তার হাতে দেন। চিঠির নিচে নিজের নাম সই করলেন তিনি ক্যারোলিন পার্সিহাউস হিসাবে। চিঠিখানা খামে পুরে এমি’লির হাতে দিলেন তিনি তারপর বললেন, কই, আমার বোনগো রণির সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তো করলে না বাছা। অথচ এই ঘটনার দিন কিন্তু উইলেট ওখানে উপস্থিত ছিল। শোনো এমি’লি, আমার রণি এমনিতে ছেলে হিসাবে খুবই ভাল কিন্তু মানসিক দিক থেকে ও ভয়ানক দুর্বল। দুঃখের সঙ্গে বলছি টাকার জন্য এমন কোনও কাজ নেই যা করতে ওর বাধে। এতোবড় হয়েছে অথচ বুদ্ধি শুদ্ধি এখনও হয়নি।

এমি’লি কোনও মন্তব্য না করে চুপ করে রইল। মিস পার্সিহাউস বলতে লাগলেন, আরও একজন বাকি আছেন তিনি হলেন ক্যাপ্টেন উইলেট। বেচারা যুদ্ধে গিয়ে পঙ্গু হয়েছেন, এখন ও দিনরাত বাড়িতে বসে থাকেন আর আফিমের নেশা করেন। ওইরকম একটি মস্তিষ্ক আর বদমেজাজী হাড়হাভাতে লোক তুমি ইংল্যান্ডে আর দুটি পাবে না। বলো, আর কি জানতে চাও?

আর কিছু আপাততঃ আমার জানা নেই, ম্যাডাম, এমি’লি বলল, যেটুকু বলেছেন তা এখনকার মতো যথেষ্ট।

.

১৭.

মিস পার্সিহাউসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিটাফোর্ড হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এমি’লি, এমন সময় পেছন থেকে হেঁড়েগলায় কে যেন বলে উঠল দাঁড়ান তো। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল এমি’লি, পেছন ফিরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল মাঝবয়সী একটি লোক কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটির গায়ের রং গাড় তামাটে। মাথার চুল ধপধপে সাদা। লোকটির একটি পা নেই আর দৈহিক ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি কাঠের ক্রাচে ভর দিয়ে আছেন তিনি।

এই লোকটিই যে ক্যাপ্টেন উইয়াট সে সম্পকের এমি’লির মনে কোনো সন্দেহই রইল না।

মাপ করবেন, মাঝবয়সী সেই অচেনা লোকটি বললেন, এপথে কিছুক্ষণ আগে একটা মাদী বুল টেরিয়ারকে যেতে দেখেছেন?

না এমি’লি বলল, পথের মাঝখানে কোনও কুকুর, বেড়াল আমার চোখে পড়েনি, একটু থেকে এমি’লি জানতে চাইল, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই বহুদিনের পরিচয় ছিল? এমি’লি বেশ বুঝতে পারল যে এই মুহূর্তে গোটা সিটাফোর্ড গ্রামে এক দর্শনীয় মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এই ক্যাপ্টেন উইয়াট নিজেও যেচে তার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিলেন, কুকুরের প্রসঙ্গটা একটা ছুতো মাত্র।

তেমন ঘনিষ্ঠতা আমাদের মধ্যে ছিল না, ক্যাপ্টেন উইয়াট বললেন, এই কটেজটা উনি আমায় বিক্রী করেছিলেন। আমি নিজে ভীষণ খিটখিটে মেজাজের লোক, ওঁকে কখনোই বরদাস্ত করেতে পারতাম না। এসব গ্রাম্য জায়গায় একা সময় কাটানো অভ্যেস করতে হয়, কিন্তু কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তা জেনেও যখন তখন এসে হাজির হতেন, আমি পছন্দ করছি না বুঝেও বসে থাকতেন আর নিজের মনে এন্তার বকবক করতেন। কথা শেষ করে কটেজের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় হাক দিলেন ক্যাপ্টেন উইয়াট, আবদুল!

সঙ্গে সঙ্গে কটেজের ভেতর থেকে একজন কালো চামড়ার লোক বেরিয়ে এল, তার গায়ের রং আর মাথার পাগড়ী দেখে এমি’লি বুঝতে পারল যে লোকটি জাতে ভারতীয়।

আমি মিলিটারীতে থাকার সময় শেষ লড়াই লড়েছিলাম ইন্ডিয়ায়। কাপ্টেন উইয়াট আবদুলকে দেখিয়ে বললেন, ওই খানেই বর্মার যুদ্ধে আমার বাঁ পা বাদ যায়। আবদুল সেখানে আমার আদালী ছিল। খুব বিশ্বস্ত লোক, যুদ্ধ শেষ হবার পরেও ও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি। এসব জায়গায় এইরকম চাকরবাকরই আমার পছন্দ। ছিঃ ছিঃ আপনাকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। দয়া করে আমার কটেজে একবার আসুন, আমার সঙ্গে এককাপ চা অন্ততঃ খান।

ধন্যবাদ, এমি’লি মুচকি হাসল, আজ আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না, আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

এখনকার দিনের হালচালই অন্যরকম।ক্যাপ্টেন উইয়াট নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বললেন, এই ট্রেন ধরা, এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখা, সব যেন অত্যন্ত যাচ্ছেতাই।

এমি’লি কোনও মন্তব্য করল না, হাত নেড়ে সংক্ষেপে বিদায় জানিয়ে সে আবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

একসময় হাঁটতে হাঁটতে সিটাফোর্ড হাউসের সামনে এসে পৌঁছল এমি’লি। কলিংবেলের দড়ি ধরে টানার মিনিটখানেকের ভেতর একজন যুবতী পরিচারিকা দরজা খুলে দাঁড়াল তার সামনে। এমি’লি কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সেই পরিচারিকা চটপটে ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলে উঠল, মাফ করবেন, মিসেস উইলেট মানসিক দিক থেকে ভয়ানক ক্লান্ত, আজ ওঁর পক্ষে কোনও খবরের কাগজের রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হবে না।

এমি’লি বুঝতে পারল মেয়েটি তাকে রিপোর্টার ঠাউরেছে। অন্যদিকে খবরের কাগজের রিপোর্টারেরা যে ইতিমধ্যেই এ বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেছে সে বিষয়েও নিঃসন্দেহ হল সে।

তুমি ভুল করছ, গলা সামান্য চড়িয়ে এমি’লি বলল। আমি রিপোর্টার নই, মিস ক্যারোলিন পার্সিহাউস আমায় পাঠিয়েছেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে।

ওঃ তাই নাকি! রণির মাসীর নাম শুনে পরিচারিকার হাবভাব পাল্টে গেল, সম্ভ্রম মেশানো গলায় সে বলল, তা কি দরকার আপনি বলুন তো।

আবার ভুল করলে! এমি’লি কাষ্ট হেসে বলল, যার সঙ্গে আমি দেখা করতে এসেছি দরকারটা তাকেই বলব। তুমি ভেতরে গিয়ে ওঁকে শুধু খবরটা দাও, তাহলেই হবে।

এমি’লির আচরণে পরিচারিকাটি বেশ দমে গেল, আর কথা না বাড়িয়ে সে তাকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। মিস উইলেটের ড্রইংরুমটি আকারে বেশ বড়, তাকে হলঘর অনায়াসে বলা চলে। চারপাশে বিলাসের প্রচুর উপকরণ ছড়ানো, ঘরের এককোণে ফায়ার প্লেসে কাঠের বড় বড় টুকরো জ্বলছে। একটা অস্বাভাবিক জিনিস এমি’লির চোখে পড়ল তাহল ঘরের চারটে দেয়ালের কোনটিতে একটিও ফোটো ঝুলছে না।

গুড মর্নিং, এক সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী যুবতী এগিয়ে এসে এমি’লির সঙ্গে করমর্দন করল, আমি মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট। মার শরীরটা খুব ভাল নেই তাই এখনও বিছানা থেকে ওঠেন নি। আমি কি আপনাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি?

এমি’লি এবার মিস পার্সিহাউসের লেখা চিঠিখানা তুলে দিল ভায়োলেটের হাতে। চিঠি পড়ে ভায়োলেট বলল, মিস পার্সিহাউস কফি কেক তৈরি করার পদ্ধতি জানতে চেয়েছেন, এতো খুব ভাল কথা, আপনি দয়া করে একটু বসুন, আমি রাঁধুনীর কাছ থেকে ওটা এখুনি লিখে নিয়ে আসছি। ইয়ে, আপনি কি মিস পার্সিহাউসের বাড়িতেই উঠেছেন?

না, এমি’লি গম্ভীরগলায় জবাব দিল, আমি মিসেস কার্টিসের বাড়িতে উঠেছি।

তাই বলুন, ভায়োলেট মুখ টিপে হাসল, তাছাড়া মিস পার্সিহাউসের বাড়িটাও খুব ছোট, বাড়িতে যে একখানা ঘর ছিল সেটা দখল করে বসে আছে ওঁর বোনপো রণি। তবে মিস পার্সিহাউস খুব চমৎকার মহিলা, ওঁর তুলনা হয় না।

 

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

সায় দিয়ে এমি’লি বলল, এ সম্পর্কে আমি আপনার সঙ্গে একমত। আচ্ছা এ বাড়ির মালিক তো ছিলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তাই না, যিনি সেদিন খুন হলেন?

ঠিক ধরেছেন,বলতে গিয়ে ভায়োলেটের গলা হঠাৎ ধরে এল, কি ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো। কোথা থেকে কি যে ঘটে গেল এখনও বুঝতেই পারছি না।

শুনলাম আপনারা নাকি প্রেতচর্চার আসর বসিয়েছিলেন, এমি’লি বলল, আর তখনই নাকি অলৌকিকভাবে জানতে পারেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন। ব্যাপারটা কি সত্যি?

ওফ! সেই সন্ধ্যের কথা জীবনের শেষ দিনটুকু পর্যন্ত আমার স্মৃতিতে বয়ে বেড়াতে হবে। ভায়োলেট আক্ষেপের সুরে বলল, আমরা খেলাচ্ছলে যা করছিলাম তা যে এমন ভয়ঙ্কর আর ভয়ানক রূপ নেবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি।

সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যে কজন পুরুষ মানুষ উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে মেজর বারনাবি ছিলেন পয়লা নম্বরের নাস্তিক। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাম অলৌকিকভাবে প্রকাশ পাবার পরে উনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে, ফিরে আসার পরে ওঁর মুখ থেকেই সেই ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংবাদ জানতে পারি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন শুনে মিঃ রাইক্রফটের তো প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা, অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সামলে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। আর রণি? মনে হচ্ছিল যেন ভূত দেখেছে। আমার মা নিজেও এ ব্যাপারটায় খুব বিচলিত হয়েছিল, এমন ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি, এখনও পারেন না, আর সত্যি বলতে কি আমি নিজেও এখনও পারছি না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছি, হে ঈশ্বর, একি হল? এও কি সম্ভব?

এমি’লি কিছু বলতে যাবার আগেই যুবতী পরিচারিকাটি রূপোর ট্রেতে একটি ভাজ করা কাগজ এনে রাখল তার সামনে। কাগজটা তুলে নিল এমি’লি, ভাঁজ খুলে দেখল কফি কেক তৈরি করার পদ্ধতি তাতে সবিস্তারে লেখা হয়েছে। কাগজখানা ভাঁজ করে হাতব্যাগের। ভেতরে রেখে দিল সে। ভায়োলেটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এমি’লি সদর দরজার দিকে সবে পা বাড়িয়েছে এমন সময় ভেতরের একটি ঘর থেকে নারী কণ্ঠে অসহ্য কাতরানির আওয়াজ ভেসে এল তার কানে।

হা ইশ্বর! নারী কণ্ঠে সেই কাতরানি স্পষ্ট শুনতে পেল এমি’লি, আমি যে আর সইতে পারছি না। এই দুর্ভাগ্যের অবসান কি আর ঘটবে না? কেন তুমি তবে আমায় বাঁচিয়ে রেখেছো প্রভু?

এ যন্ত্রণার আওয়াজ যে মিসেস উইলেটের গলা থেকে ভেসে আসছে, সে বিষয়ে এমি’লির কোনও সন্দেহ রইল না।

.

১৮.

দুপুর আড়াইটে নাগাদ এমিলি দেখা করল ডঃ ওয়ারেনের সঙ্গে।

দেখুন মিস ট্রেফুসিস, ডঃ ওয়ারেন বললেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ যখন আমি প্রথম দেখি তখন ঠিক আটটা। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে তারও দু ঘন্টা আগে ওঁর মৃত্যু ঘটেছিল। আমার ধারণা উনি যখন খুন হন তখন ঠিক বিকেল চারটে বেজেছিল

ডঃ ওয়ারেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে এমিলি এরপর বিকেল তিনটে দশের ট্রেন ধরে এক্সেটারে এল। স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে উঠেছিলেন মিঃ ডেকার্স, মিঃ ডেকার্স জিমের পক্ষের উকিল। তার সঙ্গে দেখা করল এমিলি।

মিঃ ডেকার্স এমিলিকে ছোটবেলা থেকে চিনতেন, তাকে পাশে বসিয়ে তিনি বললেন, এমিলি তোমার কাছে গোপন করে কোনও লাভ নেই, কিন্তু পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে এমন কিছু তথ্য হাতে পেয়েছে যেগুলো জিম পিয়ার্সনের বিপক্ষে যাবে।

সেগুলো আপনি অনায়াসে আমায় জানাতে পারেন,কথাগুলো বলতে গিয়ে এমিলির গলা একটুকু কাপল না, আমি এখন সবকিছুর জন্য তৈরি আছি।

তাহলে শোনো, মিঃ ডেকার্স বলতে লাগলেন, জিমের যে হঠাৎ প্রচুর টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল তা প্রমাণিত হয়েছে। বিবিন্ন কোম্পানীর শেয়ার কেনার নেশা ছিল ওর, যে কারণে প্রায়ই ওকে নিজের অফিস থেকে টাকা ধার করতে হত। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার কিছুদিন আগে একটা নামী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার জলের দরে বিক্রী হবার খবর পায় জিম, আর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার কিছু শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেই সময় শেয়ার কেনার মত টাকা তার হাতে ছিল না। এদিকে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে টাকা ব্যাপারটাই বানচাল হয়ে যাবে। তাই উপায় না দেখে জিম পিয়ার্সন শেষকালে গিয়ে হাত পেতেছিল তার মামা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর কাছে শেয়ার কেনার টাকা ধার চেয়ে। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, ট্রেভিলিয়ান সেদিন ওকে অতগুলো টাকা ধার দিতে রাজী হন নি।

এমিলি কোনও মন্তব্য না করে চুপ করে শুনে যেতে লাগল, মিঃ ডেকার্স বলতে লাগলেন, এখন ব্যাপার হল পুলিশ গোটা ব্যাপারটাকে খুনের একটা বড় মোটিভ হিসাবে দাঁড় করাতে চাইছে। কোর্টে মামলা উঠলে সরকারী উকিল এটাই প্রমাণ করতে চাইবেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান টাকা ধার দেবেন না জেনে জিম তখনই ওকে খুন করে। ওঁর অ্যাটর্নি মিঃ বার্কউডের অফিসে গিয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের উইলে ওঁর নামে যে টাকা গচ্ছিত ছিল সেটা যোগাড় করে নেয়। পুলিশ যাতে খুনী হিসাবে তাকে সন্দেহ করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই জিম এটা করেছিল।

কিন্তু মিঃ ডেকার্স, এমিলি বাধা দিয়ে বলে উঠল, সেক্ষেত্রে এটা কি প্রমাণ করা যায় যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান উইলে তার নামে কত টাকা গচ্ছিত রেখেছেন তা জিম আগে থাকতে জানতে পারে নি?

না বাছা, মিঃ ডেকার্সের মুখে করুণ হাসি ফুটে উঠল, তা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। সিলভিয়া, জিম আর ব্রায়ান ওরা তিনজনেই তাদের মামার উইলের কথা জানত আর তা নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে নানারকম আলোচনা আর ঠাট্টা রসিকতা করত। জিম নিজে অস্বীকার করলেও ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত চাপা থাকবে না।

আচ্ছা মিঃ ডেকার্স, এমিলি প্রশ্ন করল, আপনি নিজে কি সত্যিই জিমকে অপরাধী বলে মনে করেন। দয়া করে আমার কাছে কিছু লুকোবেন না।

না বাছা, মিঃ ডেকার্স কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, আমার মতে জিম খুবই সাদাসিধে ধাঁচের ছেলে। তবে একই সঙ্গে এও বলব যে ওর মধ্যে সতোর খুব অভাব। তা হলেও মানুষ খুন করার মত ক্ষমতা যে ওর নেই সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তবে জিমের বিরুদ্ধে সব প্রমাণই অত্যন্ত জোরালো যা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি তাই চাইছ মিঃ লরিমার ওর হয়ে এই মামলা লড়ুন, সবাই বলে উনি অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারেন।

মিঃ ডেকার্সের সামনেই একটুকরো কাগজে জিমের উদ্দেশ্যেই চিঠি লিখল এমিলি। তাতে উল্লেখ করল,

প্রিয়তম জিম,
……..বিশ্বাস কর, সবকিছু ঠিক সময় মিটে যাবে, কাজেই মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করে মন খারাপ কোর না। আরেকটা অনুরোধ, ভুলেও যেন কখনও সত্য গোপন কোর না, প্রকৃত পক্ষে যা ঘটেছে তাই বলবে। মিঃ ডেকার্স এ ব্যাপারে তোমায় সবদিক থেকে সাহায্য করবেন। বুঝলে? ইডিয়ট কোথাকার।
–তোমার এমিলি।

চিঠিখানা মিঃ ডেকার্সের হাতে তুলে দিল এমিলি, বলল যাতে তিনি সেটা জেল হাজতে জিমের হাতে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। মিঃ ডেকার্স কথা দিলেন চিঠিটা জিমের হাতে পৌঁছে দেবেন বলে।

মিঃ ডেকার্সের কাছে বিদায় নিয়ে থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে এল এমিলি। জানতে পারল যে মিসেস গার্ডনার বাইরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে।

আপনি কি নার্স ডেভিসের সঙ্গে দেখা করবেন? একজন পরিচারিকা এমিলিকে প্রশ্ন করল।

নিশ্চয়ই, এমিলি জবাব দিল, তার কিছুক্ষণ বাদেই নার্স ডেভিস এসে হাজির হলেন সেখানে। সংক্ষেপে নিজের পরিচয় ওকে দিল এমিলি, সেই সঙ্গে শোনাল তার দুর্ভাগ্যের বিবরণ।

হ্যাঁ, আজকের সকালের কাগজেই আমরা খবরটা পড়েছি। নার্স ডেভিস বললেন, কি ভয়ংকর ব্যাপার দেখুন তো! সত্যি, আপনার সহ্যশক্তির তারিফ করেত হয় মিস ট্রেফুসিস।

কোথায়, এমিলি কোথায়? বলতে বলতে দশাসই বপু অথচ সুশ্রী দেখতে এক মহিলা এসে হাজির হলেন সেখানে।

এই যে মাসী, তুমি এসে গেছে, এমিলি হাসিমুখে এগিয়ে এসে মহিলাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, আমি কতক্ষণ ধরে তোমার আশায় বসে আছি।

বস এমিলি, শ্রীমতী গার্ডনার হেসে বললেন, চা খাও, আমি এক্ষুনি একবার ওপর থেকে ঘুরে আসছি।

এমিলিকে পরিচারিকা এক কাপ চা এনে দিল। ওপরে কাজ সেরে শ্রীমতী গার্ডনার ফিরে এলেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। এমিলিকে বললেন, এত ঘাবড়াবার কিছু নেই বাছা, পুলিশ যথাসময় আসল খুনীকে গ্রেপ্তার করবে তা জেনে রেখো। তুমি শুধু দুশ্চিন্তা করে নিজের চেহারা নষ্ট করো না। তাছাড়া ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান লোকটি ছিলেন ভয়ানক নিষ্ঠুর ধাঁচের, আমরা কি সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি তা ওঁর অজানা ছিল না। সময়মত কিছু টাকা যদি উনি ধার দিতেন তাহলে তোমার রবার্ট মেশোর চিকিৎসা আর একটু ভালভাবে করতে পারতাম। কাজেই সত্যি বলতে কি, উনি খুন হওয়ায় আমি নিজে অন্ততঃ তেমন দুঃখ পাইনি।

এমিলির শরীর ও মন দুদিক থেকেই খুব ক্লান্তি বোধ করছিল, কখন যে তার দুচোখের কোল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করছে তা সে নিজে টেরই পায় নি।

কেঁদো না বাছা, এমিলির মাসী গার্ডনার রুমাল দিয়ে তার দুচোখ আর গাল মুছিয়ে দিয়ে স্নেহভরা গলায় বললেন, বুঝতে পারছি এতো ধকল তুমি সইতে পারছে না, তবু উপায় কি বলো। জিম পিয়ার্সন যতদিন না বেকসুর খালাস পাচ্ছে ততদিন এই চাপ তোমায় সইতেই হবে।

 

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

১৯.

কিন্তু মিস ট্রেফুসিস অ্যাটর্নি মিঃ বার্কউড প্রশ্ন করলেন, আপনি হ্যাজেলমুরে গিয়ে নিজে ব্যক্তিগতভাবে খানাতল্লাসী চালিয়ে কি খুঁজে পাবেন বলে আশা করছেন? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নিজের ব্যবহার্য যা কিছু জিনিস পত্র ওখানে ছিল পুলিশ তদন্তের গোড়াতেই সরিয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারছি আপনি যেকোন ভাবে মিঃ পিয়ার্সনের নির্দোষিতা প্রতিপন্ন করতে ব্যর্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু এইভাবে কতদূর এগোতে পারবেন?

আমি পুলিশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি না, মিঃ বার্কউড, এমিলি বলল, তাদের তদন্তের কাজে বাধাও দিচ্ছি না। আমি নিজে একবার হ্যাজেলমুরে গিয়ে সেখানকার পরিবেশটা নিজে চোখে দেখতে চাইছি। দয়া করে হ্যাজেলমুরে ঢোকার চাবিটা আমায় দিন আপনি।

চাইছেন যখন তখন নিন, মিঃ বার্কউড তার টেবলের ড্রয়ার খুলে একটা মাঝারী আকারের চাবি বের করে তুলে দিলেন এমিলির হাতে, আপনার হাতে চাবিটা দিলে কোনও ক্ষতি হবে না বলে মনে করি।

চাবিটা নিয়ে মিঃ বার্কউডকে ধন্যবাদ দিল এমিলি, তারপর ফিরে এল বাড়িতে। সেদিন সকালবেলাতেই মিসেস বেলিংয়ের লেখা একটা চিটি এসে পৌঁছেছিল এমিলির হাতে যার বয়ান এরকম?

প্রিয় মিস ট্রেফুসিস,
সাধারণভাবে ধরে নিয়েছিলাম যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যুর পরে তার বাড়ি থেকে কিছুই সরানো হয়নি এবং পুলিশও তাই অনুমান করেছিল। কিন্তু ইভানসের মুখ থেকে জানতে পারলাম সে তার প্রভুর অর্থাৎ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের একজোড়া বুট খুঁজে পাচ্ছে না। প্রসঙ্গতঃ জানাচ্ছি যে এটা সাধারণ বুট জুতো নয়, এ হল সেই ধাঁচের একজোড়া বুট, যা লোকে প্রচণ্ড তুষারপাতের সময় পায়ে গলিয়ে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোয়। বেঁচে থাকতে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওই বুট জোড়ায় নিয়মিত তেল মাখাতেন সেকথা ইভানস নিজে আমাকে জানিয়েছে। হয়তো এটা আদৌ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়, তবু যেহেতু আপনি নিজে ও খুনের তদন্ত নিয়ে মাথা ঘামচ্ছেন তাই এ খবর আপনাকে জানান আমার কর্তব্য বলে মনে করছি। ঈশ্বরের কাছে আপনার সাফল্য কামনা করছি।
ইতি–মিসেস বেলিং।

এমিলির হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে চার্লস নিজেও তাতে চোখ বোলালো, পুরোটা পড়ে নিয়ে সে বলল, ধ্যাৎ, এটা আদৌ কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

অত শীগগির মন্তব্য করো না চার্লস, এমিলি বলল, এত জিনিস থাকতে ওই একজোড়া বুটই বা হারিয়ে গেল কেন সেটা ভেবে দেখছো না?

হয়তো ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ঘটনার দিন নিজেই ওই বুটজোড়া কোনও ভিখিরি বা ভবঘুরেকে দয়া পরবশ হয়ে দান করেছিলেন, চার্লস বলল, আর সেই ফাঁকে সে ব্যাটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে তাকে খুন করেছিল।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছিলেন এক পয়লা নম্বরের কৃপণ লোক। এমিলি বলল, জীবনে ওঁর হাত দিয়ে কখনও একটা শিলিং কেউ গলতে দেখেনি। কাজেই এহেন লোক দয়াপরবশ হয়ে কোনও ভিখিরি বা ভবঘুরেকে একজোড়া বুট দান করেছেন এই সিদ্ধান্ত আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, চার্লস, তুমি কিছু মনে করো না।

চার্লস এমিলির মন্তব্যের কোনও প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইল। এমিলি কথা না বাড়িয়ে তখনই এসে হাজির হল এক্সহাম্পটনে। থ্রি ক্রাউনস সরাইখানায় পৌঁছে মিসেস বেলিংয়ের সঙ্গে দেখা করল সে। মিসেস বেলিং তার লেখা চিঠিখানা এমিলির হাতে পৌঁছেছে জেনে খুশি হলেন, তাকে তখনই নিয়ে এলেন তিনি ইভানসের বাড়িতে। ইভানস কাজে বেরিয়েছিল। কিন্তু এমিলি এতটুকু নিরাশ হল না, ইভানসের স্ত্রীর মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করল সে।

তোমার স্বামী মিসেস বেলিংকে বলেছে যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার পরে ওঁর একজোড়া বুট সে খুঁজে পাচ্ছে না, এমিলি বলল, অথচ পুলিশ ওই বাড়ি থেকে জিনিসপত্র কিছুই সরায় নি।

হ্যাঁ, ইভানসের বৌ সায় দিয়ে বলল, খবরটা আমিও জেনেছি, সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। খুব লো দেখতে একজোড়া বুট, শীতের সময় ক্যাপ্টেন ও-দুটো পায়ে গলিয়ে বেরোতেন। তার আগে দু জোড়া গরম পশমী মোজা পায়ে গলাতেন তিনি।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার আগে যে নিজে ওই বুটজোড়া মেরামত করতে দেননি সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত? এমিলি গলা সামান্য চড়িয়ে প্রশ্ন করল।

নিশ্চয়ই, ইভানসের বৌ জবাব দিল, মেরামত করতে দিলে আর কেউ না থোক তা ইভানসের অজানা থাকতো না। আমার মনে হচ্ছে এটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার, ক্যাপ্টেনের খুনের সঙ্গে এই বুট জোড়া খোয়া যাবার কোনও সম্পর্ক নেই।

আমারও তাই ধারণা, এমিলি তার মনোভাব ইচ্ছে করেই ফাঁস করল না ইভানসের বৌয়ের কাছে।

জানেন মিস ট্রেফুসিস,ইভানসের বৌ মুচকি হেসে বলল, ক্যাপ্টেনের খুনের তদন্ত যে পুলিশ অফিসার করছেন তিনি আজ সকালে আবার এসেছিলেন।

তা উনি গেলেন কোন দিকে?

শুনলাম উনি মিঃ ডিউকের বাড়িতে গেছেন।

মিঃ ডিউক। নামটা শুনে ভেতরে ভেতরে খুব অস্বস্তি আর বিরক্তি বোধ করল এমিলি। এখনও পর্যন্ত এই লোকটি সম্পর্কে কোনও ধারণা গড়ে তুলতে পারেনি সে।

ধন্যবাদ, এমিলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখনি একবার সিটাফোর্ডে যাব, ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে আমার একবার দেখা করতে হবে। কিন্তু তার আগে একবার হ্যাজেলমুরটা ঘুরে যাব ভাবছি।

একা আর পুরোপুরি নিরস্ত্র অবস্থায় এমিলি এসে হাজির হল হ্যাজেলমুরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরে। ঢুকে দেখতে পেল মিঃ বার্কউড ঠিকই বলেছিলেন, ভেতরে বেশির ভাগ জিনিসই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কম্বলগুলো ভাজ করে থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা, সবকটা টেবলের ড্রয়ার ফাঁকা, আলমারীর ভেতরে টাঙ্গানো হ্যাঁঙ্গারগুলোতে জামা-প্যান্ট দূরে থাক একটা গেঞ্জীও ঝুলতে দেখল না এমিলি! জুতো রাখার শেলফটাও একদম ফাঁকা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একতলায় বসার ঘরে নেমে এল এমিলি। এখানেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ পড়েছিল, খোলা জানালা দিয়ে তুষার মেশানো ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক হু হু করে ঢুকছিল ঘরের ভেতরে।

সেদিনের ঘটনাটা দেখবার চেষ্টা করল এমিলি। কে খুন করেছিল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে, এবং কেন, এই প্রশ্ন আবার উঁকি দিল তার মনের কোণে। সবারই অনুমান বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিটের সময় তিনি খুন হয়েছিলেন, সেকি সত্যি, নাকি তার প্রণয়ী জিমই খুন করেছিল তার মামাকে উত্তেজনার বশে, যে কথা বারবার সে চেপে গেছে পুলিশের কাছে? মামাকে খুন করে জিম কি সত্যিই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছিল, তারপর জানালার ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল ঘরের ভেতরে মেঝের ওপর পড়ে থাকা তার মামার মৃতদেহের দিকে তারপর প্রচণ্ড ভয় পেয়ে একসময় ছুটে পালিয়েছিল সেখান থেকে। এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে এমিলিকে?

অন্যদিকে মিঃ রাইক্রফটের ধারণা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ভেতরে খুনী আগেই ঢুকে বসেছিল, মামার সঙ্গে জিমের ঝগড়া আড়াল থেকে শুনতে পেয়েছিল সে, আর জিমের অজান্তেই সে-ই খুন করেছিল। যদি এ সিদ্ধান্ত সত্যি হয় তাহলে কে সে লোক? যদি এই সিদ্ধান্ত আদৌ সত্যি হয় তাহলে তার সঙ্গে কি বুটজোড়া খোয়া যাবার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে? বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এমিলি একবার খাবার ঘরে উঁকি দিল একজোড়া ট্রাঙ্ক দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এককোণে। তখনই এমিলির চোখে পড়ল একটা কৌচের ওপরে পড়ে আছে তিনটে আনকোরা ইংরেজী উপন্যাস।

এই বইগুলো ট্রেভিলিয়ান খবরের কাগজের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার উত্তর নির্ভুলভাবে পাঠিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন কিন্তু বেঁচে থাকতে একদিনের জন্যও বইগুলো খুলে দেখেন নি তিনি।

কোথায় গেল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সেই বুটজোড়া, কোথায় যেতে পারে? মাথার ভেতর তোলপাড় করা এই তিনটি প্রশ্ন নিয়ে এমিলি আবার এসে হাজির হল ওপরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরে। শোবার ঘরের ভেতরটা একরকম ফাঁকাই বলা চলে তবু যদি কোথাও কোনও সূত্র পাওয়া যায় সেই আশায়। মেঝের কার্পেট টেবলের ফাঁকা ড্রয়ার কিছুই ঘাঁটতে বাদ রাখল না সে। সবশেষে আস্তিন গুটিয়ে দুটো হাত গুঁজে দিল সেই ঘরের কোণে ফায়ারপ্লেসের চিমনির ভেতরে। হঠাৎই বাইরে থেকে সেখানে কি যেন তার চোখে পড়েছিল।

হাতড়াতে হাতড়াতে কি যেন একটা শক্ত জিনিস এমিলির হাতে ঠেকল, সঙ্গে সঙ্গে একটানে সেটা টেনে বের করে আনল সে।–এই তো, পুরোনো খবরের কাগজের একটা মোড়ক। মোড়টা খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজোড়া পুরু চামড়ার। বুটজুতো।

একি! ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর সেই পুরনো বুটজোড়া? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করল এমিলি, কিন্তু কেন? এই বুটজোড়া পুরোনো খবরের কাগজে মুড়ে এই ফায়ারপ্লেসের চিমনির ভেতরে রাখল কে? কি তার উদ্দেশ্য?

অনেকক্ষণ সেই জুতোজাড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল এমিলি, তারপর জুতোজাড়া হাতে নিয়ে আবার চলে এল নীচে। খাবার ঘরের পাশেই এককোণায় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের যাবতীয় খেলাধুলো, শিকার আর মাছ ধরার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা, সেগুলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল এমিলি, তারপর হঠাৎ নিজের মনে বলে উঠল, ওঃ, তাহলে এই হল ব্যাপার। কথাটা বলেই এমিলি সামনের একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়ল।

হা, নিজের মনে বলে উঠল এমিলি।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে কে খুন করেছে তা এবার আমি বের করে ফেলেছি, কিন্তু কেন সে এই কাজ করেছে তা জানি না। তবু আমার সময় নষ্ট করলে চলবে না।

একলাফে দৌড়েই হ্যাজেলমুর থেকে বেরিয়ে এল এমিলি, ট্যাক্সি ভাড়া করে তখনই এসে হাজির হল মিঃ ডিউকের বাড়িতে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সদর দরজার কড়া খুব জোরে জোরে নাড়ল এমিলি। সদর দরজার পাল্লা খুলে গেল মিনিট খানেক বাদে। একটি অপরিচিত পুরুষের মুখ দেখে এমিলি ধরে নিল ইনি মিঃ ডিউক ছাড়া অন্য কেউ নন।

 

সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

আপনি মিঃ ডিউক? এমিলি প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ।

আমি এমিলি ট্রেফুসিস, একবার ভেতরে আসতে পারি? আমার বিশেষ দরকার।

কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে মিঃ ডিউক একপাশে সরে দাঁড়ালেন।

আমি ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে দেখা করতে চাই, এমিলি বলল, উনি ভেতরে আছেন?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট? মিঃ ডিউক বিস্ময় মেশানো গলায় বললেন, হ্যাঁ, উনি আছেন, কিন্তু আপনি কেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান জানতে পারি?

এই কারণে, সেই বুটজোড়া সামনে নামিয়ে রেখে এমিলি জবাব দিল।

এই বুটজোড়া সম্পর্কে ওঁর সঙ্গে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

cropped Bangla Gurukul Logo সিটাফোর্ড হাউসের সামনে -মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর ( আগাথা ক্রিস্টির অন্যান্য উপন্যাস ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment