শরৎকাল রচনাঃ ভাদ্র ও আশ্বিন এই দু’মাস শরৎকাল। এই সময় বর্ষা আস্তে আস্তে বিদায় নেয়, আকশের বুকে সাদা সাদা পেঁজা তুলাের মত মেঘ ভেসে বেড়ায়, আকাশের রং হয় গাঢ় নীল। মাটিতে ও সবুজ ধান গাছের ডগায় রােদ আর ছায়ার লুকোচুরি খেলা দেখা যায়।

Table of Contents
শরৎকাল রচনা
ভূমিকা:
বাংলার ঋতু চক্রের তৃতীয় ঋতু হলো শরৎ। প্রভাতের শিউলি ঝরা সকাল, ফসল বিলাসী হাওয়া, মেঘমুক্ত আকাশের মতন প্রকৃতির নানা মনভোলানো দানে সমৃদ্ধ এই ঋতু। নীল আকাশ জুড়ে পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা শরতের আবির্ভাবের ঘোষণা করে যায়। এই ঋতু এমন এক অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ যা আর অন্য কোনো ঋতুর মধ্যে নেই।
শরতের সোনালী রৌদ্র, কাশ ফুল, শিউলি ফুলের সুগন্ধ সমগ্র পরিবেশকে মাতোয়ারা করে তোলে। অন্যদিকে চলতে থাকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আয়োজন। সব মিলিয়ে এই ঋতুতে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের আরাধনায় সকল মানুষ মেতে ওঠে। হয়তো সেজন্যেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন,
‘শরৎ, তোমার অরুন আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেলো ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।”
শরতের আগমন:
ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস জুড়ে শরৎ ঋতুর ব্যপ্তিকাল। বর্ষবরণের পর গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষের জীবন বড়ই কষ্টকর হয়ে পড়ে। আবার বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণ ফসলের পক্ষে যতই মঙ্গলজনক হোক না কেন, সাধারণ মানুষের জন্য সেটি বড়োই ক্লান্তিকর।
বাংলার বুকে বিপরীতধর্মী এই দুই ঋতুর উত্থান-পতনের পরই আগমন ঘটে শরতের। বর্ষার মেঘকে বিদায় দিয়ে সারা আকাশ হয়ে ওঠে নীল ও মেঘমুক্ত। বিপরীতধর্মী গ্রীষ্ম ও বর্ষার উত্থান-পতনের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠে মানুষ সাদরে বরণ করে নেয় শরৎকে।
শরৎ কালের বৈশিষ্ট্য:
প্রকৃতির রঙ্গশালায় অন্যতম চিত্তরঞ্জনকারী ঋতু হলো শরৎ। এই সময়ে আরও মনোরম ও সুন্দর পরিবেশ নব রূপে সেজে ওঠে প্রকৃতি। চারিদিকে তৈরী হয় উৎসবের আমেজ। বর্ষার পরে শরতের আগমনে যেন বাংলার প্রকৃতির বুকে নতুন রঙের ছোঁয়া লাগে।
নীল অম্বর জুড়ে শুভ্র মেঘমালা এক খুশির আমেজ গড়ে তোলে। চারিদিকে শিউলি ফুলের অপরূপ সুবাস মা দুর্গার আগমনকে প্রতিদিন ইঙ্গিত দিতে থাকে। প্রত্যেক দিন ভোরের নরম মিষ্টি হাওয়া উৎসবের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসে।
শরত ফসলের ঋতু না হলেও, ফসল সম্ভাবনার ঋতু বটে। প্রাপ্তির আনন্দ যেমন, ঠিক তেমনি প্রাপ্তির আগে প্রস্তুতির আনন্দও মধুর এবং নাটকীয়। তাই হেমন্ত যদি ফসল তোলার ঋতু হয়ে থাকে, তবে শরৎ হল ফসল সম্ভাবনার ঋতু। সম্ভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যৎ স্বরূপ, তাই তাতেই আনন্দ। আর এই সম্ভাবনাকেই সামনে রেখে সৃষ্টি হয় আনন্দের সমারোহ। তাই কৃষি নির্ভর বাংলার বুকে এই ঋতু প্রাপ্তির আশা জাগিয়ে তোলে।
অন্যদিকে শরতকালের আশ্বিন মাস থেকেই একটু একটু করে শীতের পদশব্দ শোনা যায়। ভোরবেলা ঘাসের আগায় শিশির পড়তে শুরু করে।

শরৎ কালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:
বর্ষার অবসানে শরৎ বাংলার বুকে এনে দেয় সৌন্দর্যের মাধুরী। প্রকৃতি এ সময় আগের থেকে আরো স্নিগ্ধ ও মনোরম হয়ে ওঠে। বর্ষার ধারায় সিক্ত পৃথিবী এ সময় থাকে তাপমুক্ত। এই ঋতুতে সবুজ প্রাণে হিল্লোলিত হয়ে ওঠে বন ও প্রকৃতি। শ্বেতশুভ্র কাশ ফুলের নৃত্যভঙ্গিমা, দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার খেলা সকলের মনে সৃষ্টি করে আনন্দের হিল্লোল।
সকল মানুষের কণ্ঠে জেগে ওঠে গান, মেতে ওঠে মন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে প্রাণভরে উপভোগ করার জন্য। নদীর বুকে পাল তোলা নৌকোর মিছিল, শিশির সিক্ত দূর্বা ঘাস, মাঝিদের মন মাতানো ভাটিয়ালি গান এক অপরূপ মোহময় পরিবেশ রচনা করে। সকল সৌন্দর্যের সমাহার শরৎ ঋতুকে প্রকৃতই প্রকৃতির রানী করে তোলে।
শরৎকালের উৎসব:
শরৎ কালের এই অনিন্দ্য সুন্দর রূপের মাঝে বেজে ওঠে ছুটির মন কেমন করা বাঁশি । এই ঋতুটি জীবনে এনে দেয় অবকাশ এবং ছুটির অঢেল আনন্দ। কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ সর্বত্রই তখন উৎসবের সমারোহ। প্রাঙ্গনে প্রাঙ্গনে আম্র পল্লব সজ্জিত মঙ্গল ঘট স্থাপিত হয়। অঙ্কন করা হয় বিচিত্র আলপনা। ঢাকের আওয়াজ বয়ে আনে অনাবিল আনন্দের জোয়ার। ধনী থেকে দরিদ্র সকলের মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের হাসি।
শরৎ কাল আমাদের সকলের সারা বছরের দুঃখ, বেদনা তথা ক্লান্তির গ্লানি ভুলিয়ে দেয়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গা পুজোয় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ একসাথে আনন্দে মেতে ওঠে। দীর্ঘ চারদিন ব্যাপী আরাধনা চলে দেবী দুর্গার। এরপর দশমীতে দেবীর বিসর্জন। কিন্তু এখানেই উৎসবের শেষ নয়। দেবী দুর্গার পর আগমন ঘটে তার কন্যা গৃহস্থরা ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর। বাংলার ঘরে ঘরে মানুষ তার পূজা করেন।

জীবন সত্যের উপলব্ধি:
জীবনে যেমন আনন্দ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বেদনাও। যেমন রয়েছে সুখ, তেমনি আছে দুঃখও। ঠিক তেমনি শরৎ ঋতুর মধ্যেও রয়েছে যেমন আনন্দের সমাহার, তেমনি রয়েছে বেদনা। জীবনের সুখ-দুঃখের দোলাচলের এই গভীর সত্যটা শরতের মধ্যে সহজেই আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। আগমনীর আনন্দ আর বিজয়ার বিষাদ জীবনের এই স্বরূপকে উপলব্ধি করতে শেখায়।
সারা বছর ধরে প্রত্যেকটা দিন মা মেনকা তাঁর সাধের উমার আসার অপেক্ষা করতে থাকেন। আর বছরের শেষে সেই দীর্ঘ মেয়াদি প্রতীক্ষার পরে যখন মা মেনকা তাঁর সাধের উমাকে পান, তখন তিনি অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠেন। কিন্তু দশমীর বিচ্ছেদের বেদনা এই আনন্দকে নির্ঝর করে দেয় এক নিমিষে। এর জন্যই তো নবমী নিশিকে উদ্দেশ্য করে মা মেনকা বলে ওঠেন,
“যেও না রজনী, আজি লয়ে তারা দলে।
গেলে তুমি, দয়াময়ী, এ পরান যাবে। “
এটা শুধু মা মেনকার বিলাপ নয়, প্রত্যেক পিতৃ গৃহগতা কন্যাকে তার শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর সময় বাঙালি মায়েদের এক করুন আর্তনাদ। এই ঋতু যেন আমাদের বুঝিয়ে দেয় সুখ-দুঃখের দোলাচালে উত্থান-পতনের নামই হলো জীবন। দুঃখ ছাড়া আনন্দ পূর্ণতা পায় না; আনন্দের স্বরূপ আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা। বুদ্ধের অমোঘ বাণী আকাঙ্খাই দুঃখের কারণ এই পরম সত্য আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। আর আকাঙ্খার পূর্ণতাতেই হয় আনন্দের প্রাপ্তি।

উপসংহার:
শরৎ বাংলার হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের এক ঋতু। এক কথায়, আনন্দের পুরোধা। এই ঋতুর নিজস্ব একটা আনন্দময় গন্ধ রয়েছে। তাই শরতের প্রতিষ্ঠা উৎসব প্রিয় বাঙালির হৃদয়ের তথা অন্তরের মণিকোঠায়। শিউলি ঝরার আনন্দ, কাশ ফুলের দুলুনি, মেঘ মুক্ত আকাশে নীলের সমারোহ হেমন্তের শুরুতে বিদায় নেয়। আর তখন সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আনন্দের সমারোহ শুধুই স্মৃতিতে পরিণত হয়। আর থাকে শুধু নতুন এক বছরের প্রতীক্ষা।
আরও পড়ুনঃ