[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিসেস আরিয়াদে অলিভার

Table of Contents

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

মিসেস আরিয়াদে অলিভার তার এক বান্ধবীর কাছেই থাকে। আজ সে এক সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে শিশুদের পার্টিতে গেছে বান্ধবীর সাথে সাজানো-গোছানোতে সাহায্য করার জন্য। এই পার্টির নাম হলো হ্যালুইন পার্টি। এখানে নিমন্ত্রিতরা হলো দশ থেকে সতের বছরের ছেলেমেয়েরা।

এসে দেখলো চারিদিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা। সাজাবার বড় আকৃতির রংবেরং-এর কুমড়ো এক জায়গায় এনে রাখা হচ্ছে। মিসেস অলিভার কপালের ওপর থেকে পাকা চুলের গুচ্ছ সরিয়ে দিয়ে বললো, গত বছর আমেরিকায় এই রকম কুমড়ো এক সঙ্গে অনেকগুলো দেখেছিলাম। সারা বাড়িতে সাজানো হয়েছিলো। ভেতরে হয় মোমবাতি নয়তো অনুজ্জ্বল আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছিলো। তবে হ্যালুইন পার্টির জন্য সাজানো হয়নি, সাজানো হয়েছিল ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের দিনে। এখন আমি প্রত্যেক বছর হ্যালুইন পার্টিতে যোগ দিই। বান্ধবী মিসেস বাটলার মিসেস অলিভারের কথাগুলি শুনতে লাগলো।

মাঝে মাঝে ব্যস্ত মহিলারা মিসেস অলিভারের কাছে এসে পড়লেও কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করছে না। সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। এইসব মহিলাদের মধ্যে মায়েদের সংখ্যাই বেশি। দু-একজন বয়স্কা অবিবাহিতা স্ত্রীলোক আছে আর আছে কয়েকটি অল্পবয়স্কা মেয়ে, তাদের বয়স হবে তেরো থেকে উনিশ বছর। এছাড়া এগারো থেকে পনেরো বছরের কিছু ছেলেমেয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প করছে হাসাহাসি করছে।

এই পার্টির উদ্যোক্তা সুন্দরী মিসেস ড্রেক ঘোষণা করলো, আমি এই পার্টিকে হ্যালুইন পার্টি বলতে চাই না, আমি বলবো ইলেভেন প্লাস পার্টি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে আজকের এই উৎসব। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এই দি এলমস ছেড়ে অন্য স্কুলে চলে যাচ্ছে।

কিন্তু রোয়েনা তুমি ঠিক বলতে পারলে না ঝুলি পড়া চশমা নাকের উপর দিকে ঠেলে দিয়ে অনুমোদনের ভঙ্গিতে মিস ইউটেকার বললো, কারণ ইলেভেন প্লাস ক্লাস আমরা আগেই তুলে দিয়েছি।

মিসেস উইটেকার এই স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। কাউকে ভুল করতে দেখলে বা ভুলতে দেখলে চটে যাওয়া তার স্বভাব।

মিসেস অলিভার হঠাৎ সোফার ওপরে বসে মানুষের ভিড়ে ঠাসা ঘরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। লেখিকার মন নিয়ে সে ভাবলো এখন যদি আমি এইসব মানুষদের নিয়ে কোনো বই লিখি তাহলে কি ভাবে লিখবো? এরা প্রত্যেকেই চমৎকার মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার মনে হলো এই মানুষগুলো সম্পর্কে বেশি না জানাই ঠিক হবে। এরা প্রত্যেকেই উডলিফ কমন্স এ বাসা করে। জুডিথের কাছে যা শোনা গেছে তাতে বোঝা যায় এদের প্রত্যেকের মধ্যে বেশ বোঝাঁপড়া আছে।

এই মানুষগুলো মিসেস অলিভারের কাছে কেবল মাত্র নাম ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মধ্যে আছে একজন নান, বেট্রিসা, ক্যাথি, জম্বলা আর জয়েসা। জয়েসা মেয়েটা দেখতে সুন্দরী, একটু ছটফটে আর প্রশ্ন করে প্রচুর। এ্যানা নামে মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গী এবং বয়স জয়েসার চেয়ে একটু বেশি। সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছে, এমন দুটি ছেলে আছে বিভিন্ন কায়দায় চুল আঁচড়ানো, কিন্তু যে জন্য এতো কায়দা করে চুল আঁচড়ায় তার কোনো সুফল ফলে না।

একটা ছোট ছেলে লাজুক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে বললো, মা এই আয়নাগুলো পাঠিয়ে দিলেন এতে কাজ চলবে কি না দেখুন, মিসেস ড্রেক তার হাত থেকে আয়নাগুলো নিয়ে বললো, অনেক ধন্যবাদ, এডি।

এতো দেখছি সাধারণ হাত আয়না,

–এ্যানা বললো, এগুলোর ভেতরে কি সত্যিই আমাদের ভাবী স্বামীদের মুখ দেখতে পাব? জুডিথ বাটলার উত্তর দিলো– কেউ পাবে, কেউ পাবে না।

বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় বেট্রিসা বললো, প্রত্যক্ষ করবার শক্তি থাকলেই দেখতে পাওয়া যায়।

লী একটি গামলা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেলো, আপেলের বোকা বানানোর খেলার জন্য গামলা উপযুক্ত হবে, না বালতি উপযুক্ত হবে এই আলোচনায় সবাই মেতে উঠলো, বেশিরভাগ কর্মী লাইব্রেরীতে গেল জায়গাটা ভালো করে দেখার উদ্দেশ্যে। কয়েকজন অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে আপেলের বোকা বানানোর খেলা হাতেকলমে করে দেখলো ঠিক হচ্ছে কি না। কারো মাথার চুল ভিজে গেলো আর গামলা থেকে জল উপছে পড়ল কার্পেটের ওপর। টাওয়েল দেওয়া হলো তাদের জল মোছার জন্য। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো প্লাস্টিক বালতির চেয়ে গ্যালভানাইজড গামলাই ব্যবহার করা হবে।

ভেতরে বয়ে আনা গামলা ভরা আপেল একপাশে রাখলো মিসেস অলিভার। তারপর একটু একা থাকার উদ্দেশ্যে একটা নির্জন ঘরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে ওপর দিকে উঠতে লাগলো। ল্যাণ্ডিংয়ের সামনে তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। এখানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে জড়াজড়ি করে একটা বদ্ধ ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মিসেস অলিভার এই ঘরেই ঢুকতে চান। তাকে দেখে যুগলমূর্তি একটুও বিচলিত হলো না, বরং আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেটির বয়স হবে পনেরো আর মেয়েটির বয়স হবে বারো।

অ্যাপেল ট্রি বাড়িটা বেশ বড়ো। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে কারো নজর পৌঁছায় না। মিসেস অলিভার ভাবলো, মানুষ কত স্বার্থপর আজকালকার ছেলেমেয়েরা অন্যের তোয়াক্কা করে না।

মিসেস অলিভারের অনুরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলে আর মেয়েটি ছাড়াছাড়ি হলো, বিরক্তি মেশানো দৃষ্টিতে তারা মিসেস অলিভারের দিকে তাকালো। মিসেস অলিভার ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

.

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

০২.

কিশোর কিশোরীদের পার্টি সম্বন্ধে কোনো ধারণা আছে কি না জানতে চাইলো জুডিথ মিস অলিভারের কাছে।

মিসেস অলিভার জানালো বিশেষ কিছুই জানা নেই।

জুডিথ বললো, খুব ঝামেলা হয় বড়দের এড়িয়ে নিজেরাই সব করতে চায়। কাঁচের গ্লাস বা ওই ধরনের জিনিস ভেঙে একাকার করে। অবাঞ্ছিত মানুষজন ভেতরে ঢুকে পড়ে, কেউ হয়তো অনাহূত কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। সেই সঙ্গে আনে অদ্ভুত সব ওষুধপত্র–এল এস-ডি না কি যেন নাম, দেখতে ঠিক টাকার মতো কিন্তু আসলে টাকা নয়, তাই নাকি?

দামী হলেও ওগুলো খুব বাজে। খুব বাজেও-জুডিথ বললো, তবে এই পার্টি নির্বিঘ্নে শেষ হবে। রোয়েনা ড্রেকের ওপর আস্থা রাখতে পার। ব্যবস্থাপনার কাজে খুব দক্ষ। হাতে নাতে পারে। জান, মিরান্দা পার্টিতে আসতে পারলো না বলে খুব খারাপ লাগছে।

মিসেস অলিভার বললো, জ্বর যখন নেই তখন তো আনতে পারতে।

ভরসা হল না…ভাগ্য খারাপ আর কি।

রাত সাড়ে সাতটার সময় পার্টি শুরু হলো। প্রত্যেকেই যথাসময়ে এসে হাজির হলো। ঘড়ি ধরে সব কিছু চলতে লাগলোলা। সিঁড়িতে লাল নীল আলো দেওয়া হয়েছে, আর প্রচুর সংখ্যক হলুদ কুমড়ো ঝুলিয়ে চারিদিক সাজানো হয়েছে। রোয়েনা ড্রেক রাতের কর্মসূচী ঘোষণা করলো, প্রথমে হাতল ওয়ালা ঝাড়ুর প্রতিযোগিতা হবে। পুরস্কার আছে তিনটে–প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয়। তারপর কাটা হবে ময়দার কেক। অনুষ্ঠানটা হবে ছোট আকারের। তারপর হবে আপেলের বোকা বানানোর খেলা। দেওয়ালে সহযোগী প্রতিযোগীদের নাম টাঙ্গিয়ে দেওয়া হবে। তারপর হবে না। একবার করে আলো নিভে যাবে আর তোমরা সঙ্গী বদল করবে। এরপর স্টাডিরুমে মেয়েদের আয়না দেওয়া হবে–আয়নার খেলা। এই অনুষ্ঠানের পরে হবে ভোজ, ভোজের পর হবে স্ন্যাপড্রাগনের খেলা। আর অবশেষে পুরস্কার বিতরনী।

আরিয়াদে অলিভার জিজ্ঞাসা করলো-আচ্ছা ময়দার খেলাটা কি রকম?

প্রথমে ময়দা ঠেসে একটা গামলায় ভরতে হবে, তারপর একটা ট্রের উপর চাপ বাঁধা ময়দা উপুড় করে ঢালতে হবে। সেই চাপ-বাঁধা ময়দার ওপর একটা ছ পেন্সের মুদ্রা রাখতে হবে। প্রতিযোগীরা ছুরি দিয়ে চাপ বাঁধা ময়দা কাটতে থাকবে এমনভাবে যেমন মুদ্রাটা উপর থেকে নিচে না পড়ে যায়। যদি কেউ নিচে ফেলে দেয় তাহলে সেই খেলায় সে আর অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এইভাবে একজন করে খেলা থেকে সরে যেতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত যে টিকে থাকতে পারবে সে পাবে ছ পেন্সের সেই মুদ্রাটা।

খেলা শুরু হয়ে গেছে। হাতলওয়ালা ঝাড়ুর খেলা দেখে সবাই খুব প্রশংসা করলো।

লাইব্রেরীর ঘর থেকে উত্তেজিত চীৎকার ভেসে আসছে। এই ঘরে আপেলের খেলা চলছে। জলে ভেজা প্রতিযোগীরা পরস্পরকে জড়াজড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসছে।

মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো হ্যালুইন ডাইনীর আবির্ভাব। এই ডাইনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মিসেস গুডবডি। বাসন মাজার কাজ করে। তার নাক সূচাল আর বাঁকান এবং থুতনি সরু। তার কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় যেন শয়তানের কণ্ঠস্বর বেশ খনখনে।

ডাইনি খনখনে গলায় কথা বলে চলেছে: তুমি বেট্রিসা না কি যেন তোমার নাম? বেশ মজার নাম, আকর্ষণীয় নাম। তুমি জানতে চাও তোমার ভাবী স্বামী কেমন দেখতে হবে? তাহলে এখানে বসো। হ্যাঁ আলোর ঠিক নিচে। এই আয়নাতে হাত দাও, এটা হাতে নিয়ে আলোর নিচে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়নার দিকে তাকাও দেখতে পাবে ভাবী স্বামীর মুখ, ঠিক যেন তোমার পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। আয়নাটা শক্ত হাতে চেপে ধর। অর্থহীন যাদুমন্ত্র পড়তে থাকো… যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, তাকেই তুমি দেখতে পাবে।

পর্দার আড়ালে রাখা একটা মই থেকে হঠাৎ এক ঝলক আলো এসে পড়লো ঘরের মধ্যে, সেই আলো প্রতিফলিত হলো উত্তেজিত বেট্রিসার হাতে ধরা আয়নার উপর ওহো। সবিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল বেট্রিসা ওকে দেখেছি–আয়নায় দেখেছি ওকে।

নীল আলোর ঝলক নিভে গিয়ে সাধারণ আলো জ্বলে উঠলো। সারা ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। ছাদের নিচে ঝুলন্ত একটা কার্ডের উপর আঠা দিয়ে আটকানো একটা রঙীন ফটোগ্রাফ বাতাসে আন্দোলিত হতে দেখা গেলো। বেট্রিসা উত্তেজিতভাবে সারা ঘরে এলোমেলো ভাবে নাচতে লাগলো।

মিসেস অলিভারকে বেট্রিসা বললো, ওকে দেখতে গায়ক এডি প্রেসাওয়েটের মতো, ওকে দেখেছি আমি।

খবরের কাগজে পপ গায়ক এডি প্রেসাওয়েটের ছবি মিসেস অলিভার অনেকবার দেখেছেন কিন্তু তার একবারও মনে হলো না মুখখানা তার মতো দেখতে। সে জিজ্ঞাসা করলো এসব কিভাবে করা হয়?

এসব রোয়েনাই ব্যবস্থা করে নিকিকে বলে। নিকির বন্ধু ডেসমণ্ড ওকে সাহায্য করে।

অলিভার বললো, আমি ভাবতেই পারছি না আজকালকার মেয়েরা অসভ্য হয়ে যাচ্ছে।

যাই হোক ভোজ পর্ব বেশ ভালো ভাবেই মিটে গেলো। সবাই বেশ পেট ভরে খেল।

এবার রোয়েনা বললো, আজ রাতের খেলা স্ন্যাপড্রাগন। তার আগে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ শেষ হলো। তারপর ভেসে আসতে লাগলো বাস্তু পরীর আর্তবিলাপের সুর। ছেলেমেয়েরা ডাইনিং হলের পিছন দিকে ছুটে গেলো।

টেবিলের ওপর থেকে খাবার সরিয়ে ফেলে সবুজ মোটা কাপড় পেতে দেওয়া হয়েছে। একটা বড়ো ডিসের ওপর রাখা হয়েছে স্তূপীকৃত আঙ্গুর, মনাক্কা, কিসমিস, বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি। প্রত্যেকে সেইদিক ছুটে গিয়ে প্লেটে রাখা ফলগুলি ধরে টানাটানি করতে লাগলো, অবশ্য আগুন বাঁচিয়ে।

সবাই চীৎকার করছে : ওঃ পুড়ে গেলো। কি সুন্দর তাই না? ধীরে ধীরে স্ন্যাপড্রাগন ফুল পুড়তে পুড়তে একেবারে নেতিয়ে পড়লো। সব আলোগুলো একসাথে জ্বলে উঠলো। উৎসবের সমাপ্তি হলো– হ্যালুইন পার্টি শেষ।

প্রত্যেকেই বললো, পার্টি খুবই সফল হয়েছে, চমৎকার হয়েছে।

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

০৩.

লণ্ডনের একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে টেলিফোন বেজে উঠলো। চেয়ারে বসে আছে এরকুল পোয়ারো। সে নড়ে চড়ে বসলো, সে হতাশায় ভুগতে লাগলো। সে ভালো করেই জানে কে ফোন করেছে, নিশ্চয়ই আজ সন্ধ্যায় যার সঙ্গে ক্যানিং রোডের মিউনিসিপ্যাল বাথরুমে খুন হওয়া লোকটির প্রকৃত আততায়ী কে সে ব্যাপারে আলোচনা করার কথা ছিলো এখন ফোনে সে সেইগুলি জানাবে, সে এখানে আসতে পারবে না।

হতাশ হলো পোয়ারো কারণ খুনের সপক্ষে কিছু প্রমাণ সে সংগ্রহ করে রেখেছে। ভদ্রলোকের না আসতে পারবার সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে, কারণ আজ রাস্তায় দেখা হতে লক্ষ্য করা গেছে বেশ অসুস্থ।

পোয়ারোর চাকর জর্জ ঘরে ঢুকে জানালো যে, মিঃ লোগলির ফোন ছিল উনি জানিয়েছেন যে আজ সন্ধ্যায় তার পক্ষে আসা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ তিনি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নিয়েছেন।

টেলিফোনটা আবার বেজে উঠলো। পোয়ারো হাত বাড়িয়ে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে বলললো, এরকুল পোয়ারো বলছি।

আমার সৌভাগ্য বলতে হবে–

একটা ঝাঁঝালো মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ভেবেছিলাম বেরিয়ে গেছ। শোন, এই মুহূর্তে তোমাকে আমার খুব দরকার। এক্ষুনি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?

মেয়েটি হলো পোয়ারোর বান্ধবী– আরিয়াদে।

উত্তর দেওয়ার আগে পোয়ারো কিছু সময় চুপ করে রইলো। বোধহয় তার বান্ধবীকে দুঃখ, হতাশা বা এই ধরনের কিছু বিচলিত করে তুলেছে। কোনো কারণে উতলা হয়ে পড়েছ নাকি?

– পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।

হা। ভেবে পাচ্ছি না এখন কি করব। একমাত্র তুমিই আমাকে সঠিক পথ বলতে পারবে। তাহলে কি আমি যাব? — অলিভার জিজ্ঞাসা করল।

নিশ্চয়ই! এলে খুশী হব। অপর প্রান্তে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো।

জর্জকে ডেকে পোয়ারো বললো, মিনিট দশেকের মধ্যে মিসেস অলিভার এসে পড়বেন।

জর্জ চলে গেলো।

একটা ঘন্টা বাজলো ফ্ল্যাটের বাইরের দরজায়। জর্জের দরজা খোলার শব্দ ভেসে এলো। কোনো সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হওয়ার আগেই বসবার ঘরের দরজা খুলে গেলো। আরিয়াদে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো তার ঠিক পিছনেই জর্জ। তার মাথায় জেলেদের টুপি আর গায়ে পিচ্ছিল চামড়ার তৈরি জামা।

এসব কি পরেছ?–পোয়ারো বললো, জর্জের হাতে ওগুলো খুলে দাও। বেশ ভিজে বলেই মনে হচ্ছে।

হা বেশ ভিজে–মিসেস অলিভার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো, জলে ডুবিয়ে ভেজানো হয়েছে। জান, জল নিয়ে আগে কখনও এতো মাথা ঘামাইনি, সাংঘাতিক জিনিস।

পোয়ারো বললো, আচ্ছা সব শুনছি আগে বসো।

অলিভার বসে বলতে শুরু করলো, একটা হ্যালুইন পার্টিতে গিয়েছিলাম। এটা ছিল ছোটদের পার্টি। বুক ভরে হাওয়া গ্রহণ করে মিসেস অলিভার বললো, শুরু হয় আপেল দিয়ে। আপেল দিয়ে বোকা বানানোর খেলা। যে কোনো হ্যালুইন পার্টিতে এই খেলাটা হয়ে থাকে।

আরো নানারকম খেলার শেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয় স্ন্যাপড্রাগন খেলা দিয়ে। আমার ধারণা সেই সময় ঘটনাটা ঘটে। স্ন্যাপড্রাগন খেলার পর নিমন্ত্রিতরা একে একে বাড়ি চলে যায়। ওর খোঁজ কেউ করেনি।

কার খোঁজ করেনি?

একটা মেয়ের নাম জয়েসা। প্রত্যেকে তার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছে, এদিক ওদিক খোঁজ করেছে এবং জিজ্ঞাসা করেছে কারো সঙ্গে বাড়ি চলে গেছে কি না। ওর মা বিরক্ত হয়ে ভেবেছিল জয়েসা ক্লান্ত বা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে একাই বাড়ি চলে গেছে। যাই হোক অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একা একাই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল?

না বাড়ি ফেরেনি– মিসেস অলিভারের কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল। শেষ পর্যন্ত ওকে পাওয়া গেলো লাইব্রেরীতে। ওখানে কেউ ওকে খুন করে রেখে গেছে। আপেলের খেলায় খেলার ভঙ্গিমায় ওকে পাওয়া যায়। মাথাটা গামলার জলের মধ্যে ডোবানো।

পোয়ারোর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণশোনালো, ঠিক কি ঘটেছিল?

মেয়েটাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করা হলো। কেউ যেন তার মাথাটা গামলার জলের মধ্যে চেপে ধরেছিল। মেরে ফেলার উদ্দেশেই কাজটা করা হয়। জয়েসা হাঁটু ভেঙে বসে আছে তার মাথাটা জলের ভেতর ডোবান।… আমি আপেলকে ঘৃণা করি, আপেলকে সহ্য করতে পারছি না, কোনোদিন পারবও না…

পোয়ারো চুপচাপ তাকিয়ে রইল উত্তেজিত মিসেস অলিভারের দিকে। হাত বাড়িয়ে কোনিয়াক মদ ঢাললো গ্লাসে তারপর মৃদুকণ্ঠে বললো, এইটুকু খেয়ে নাও অলিভার, খারাপ লাগবে না।

.

০৪.

মিসেস অলিভার গ্লাস নামিয়ে রেখে বললো, এখন বেশ ভালোই লাগছে, কেমন যেন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

পোয়ারো বললো, বুঝতে পারছি তুমি অত্যন্ত মানসিক আঘাত পেয়েছ। ঘটনাটা কবে ঘটেছে।

গত রাতেই ঘটেছে ঘটনাটা।

কিন্তু বুঝতে পারছি না আমার কাছে এসেছো কেন তুমি? মনে হলো একমাত্র তুমিই আমায় সাহায্য করতে পারো। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে ব্যাপারটা সাধারণ নয়।

তুমি আমায় সব খুলে বলতে পারো। বুঝতে পারছি কেসটা এখন পুলিসের হাতে। ডাক্তারের মতামত কি?

অনুসন্ধান চলবে–মিসেস অলিভার বলল।

চলাটাই স্বাভাবিক। ওই মেয়েটা মানে জয়েসার বয়স কত হবে?

সঠিক বলতে পারবো না। তবে তেরো কি চোদ্দ হরে।

শোন, আমার মনে হচ্ছে সব কথা তুমি আমায় খুলে বলোনি, জয়েসা তোমার পরিচিত?

না ওকে একেবারেই চিনতাম না। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে খুলে বলা দরকার ওখানে কেন গিয়েছিলাম।

ওখানে মানে– কোথায়?

উডলিফ কমন্সে।

উডলিফ কমন্স।–চিন্তিত মনে পোয়ারো বললো, এখন সেখানে

এখানে এক বান্ধবীর সঙ্গে আমি থাকি। জুডিথ বাটলার ওর নাম। বিধবা। একবার হেলেনিতে জাহাজে করে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই জাহাজে জুডিথও ছিলো। সেখানেই আমাদের পরিচয় আর বন্ধুত্ব। ওর এক মেয়ে আছে নাম মিরান্দা। বয়স বার কি তেরো। জুডিথের আমন্ত্রণেই এই হ্যালুইন পার্টিতে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি পার্টিটা সম্পর্কে আমার মনে যথেষ্ট আগ্রহ জেগেছিল। তাই বুঝি! পোয়ারো বললো, আচ্ছা, মনে করে দেখোত উনি বলেছিলেন কিনা পার্টিতে খুন হয়েছে, এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে।

তাছাড়া পার্টিতে কি এমন কোনো লোক ছিল যে তোমার পরিচয় জানতো?

হ্যাঁ, ছিল। ছোটদের মধ্যে কে একজন আমার লেখা বই সম্পর্কে মন্তব্য করছিল আর বলছিল খুন জখম ওদের ভালো লাগে।

আমাকে কিন্তু এসব কথা এখনও বলোনি।

দেখ, প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে আমি মাথা খামাইনি, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা তো মাঝে মাঝে কত প্রশ্নই করে, সে সব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না।

আচ্ছা কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পড়েছে এমন কোনো ছেলে ওখানে ছিল? দুজন। বয়স হবে ষোল থেকে আঠার।

আমার ধারণা ওদের দুজনের মধ্যে কেউ করতে পারে। পোয়ারো বলল পুলিসের ধারণা কি তাই?

কিছু প্রকাশ না করলেও ওদের কথাবার্তা আর আচরণ দেখে তাই মনে হয়েছে।

জয়েসা দেখতে কি খুব আকর্ষণীয় ছিল?

না, তেমন কিছু নয়। তবে মেয়েটাকে আমার খুব ভালো বলে মনে হয়নি। আসলে বয়সটা খারাপ বুঝলে না? শুনতে খারাপ লাগলেও কথাগুলো সত্যি।

আচ্ছা সেই সময় পার্টিতে কতো লোক উপস্থিত ছিল?

পাঁচ ছজন মহিলা, কয়েকজন মা, একজন স্কুল শিক্ষয়িত্রী, একজন ডাক্তারের স্ত্রী কিম্বা বোন ষোল থেকে আঠারো বছর বয়সী দুটি ছেলে, পনের বছরের একটা মেয়ে আর দু-তিনটে এগারো বছরের মেয়ে এই পার্টিতে উপস্থিত ছিল। সব মিলিয়ে কুড়ি পঁচিশ কিম্বা ত্রিশজন।

একে অপরকে চিনতো। কাজের লোকের জন্য কাজ ফেলে রাখা হবে না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরাই ঘরগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছিলাম, সেই সময়ে আমরা লাইব্রেরীর ঘরে মৃত জয়েসাকে আবিষ্কার করি। সঙ্গে তার বলা কথাগুলো আমার মনে পড়ে যায়।

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

কি কথা– কি কথা বলেছিলো?

বলেছিল, আমি একটা খুন হতে দেখেছি মিসেস অলিভার সমস্ত ঘটনা খুলে বললো, কিন্তু কেউ ওর কথা বিশ্বাস না করে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছিল বলে খুব রেগে গিয়েছিল।

মেয়েটি বিস্তারিত ভাবে কিছু বলেনি! যেমন কোনো নাম?

না। জয়েসাকে যখন বিস্তারিতভাবে বলবার জন্য সবাই পীড়াপীড়ি করতে লাগলো ও বলেছিল, অনেকদিন আগের ঘটনা তো আমার কিছু মনে নেই। তবে বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।

একটা ব্যাপার ভাববার আছে-পোয়ারো বললো, এখন নিশ্চয় ওর বোঝার মতো বয়স হয়েছিল।

মিসেস অলিভার বললো, একজন ওকে প্রশ্ন করেছিলো, কেন তুমি পুলিসে খবর দিলে না?

উত্তরে মেয়েটা কি বলল?

বলল, তখন আমার মনেই হয়নি যে ওটা খুন।

পোয়ারো নড়েচড়ে বসলো তারপর বললো, চমৎকার উত্তর দিয়েছে তো!

মেয়েটাকে সবাই মিলে ঠাট্টা করছিল বলেই বোধহয় বিরক্ত হয়ে এ ধরনের উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কেউ ওর কথা বিশ্বাস করেনি। তবে মৃতদেহ আবিষ্কার করবার পর আমার মনে হলো, ও সত্যি কথা বললেও বলতে পারে। তারপর তোমার কথা মনে পড়লো।

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। তারপর নড়েচড়ে বসে প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করলো পোয়ারো, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করবো। ভেবে চিন্তে উত্তর দেবে। আচ্ছা মেয়েটা কি সত্যি কোনো খুন হতে দেখেছিল বলে তোমার মনে হয়?

সত্যি করে বলা কঠিন, তবে আমার মন বলছে মেয়েটা হয়তো সত্যিই খুন হতে দেখেছিলো। এর থেকে কয়েকটা সিদ্ধান্তে আসা যায়। পার্টিতে উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন একজন ছিল যে এই খুনটা করেছে আর এই খুনী জয়েসাকে আগেই বলতে শুনেছে অতীতের খুনের কথা।

জয়েসাকে যে খুন করেছে, মাথাটা জলের মধ্যে চেপে ধরে রাখার মতো শক্তি তার ছিল। খুনটা করা হয়েছে চোখের নিমেষে। খুন হতে দেখার কথা শুনে খুনী ভয় পেয়েছিল তাই সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজটা সেরে ফেলেছে।

তার মানে জয়েসা জানবার সুযোগ পায়নি যে, ওকে যে খুন করেছে সে আগের খুনটা করেছে কিনা।–মিসেস অলিভার বললো তাছাড়া ও জানতোই না যে খুনী ঘরের মধ্যেই ওৎ পেতে বসে আছে।

না জানতো না। সম্ভবতঃ জয়েসা খুন হতে দেখেছিল, কিন্তু খুনীর চেহারা দেখতে পায়নি। আমাদের আরও আগে চলে যেতে হবে।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না। এমনও হতে পারে এমন একজন লোক পার্টিতে উপস্থিত ছিল যে জানতো খুনটা কে করেছে। হয়তো খুনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমনও কেউ হতে পারে। সে নিশ্চয়ই ভেবেছিল সে ছাড়া আর কেউ কিছু জানে না। সহসা জয়েসা মুখে খুন হতে দেখার কথা শুনে…

পোয়ারো বললো, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কেন উডলিফ কমন্স নামটা আমার কাছে এতো পরিচিত।

.

 ০৫.

আধুনিক প্যাটার্নের চমৎকার রংয়ের আর সুন্দরভাবে তৈরি বাড়িটা হলো পাইন ক্রেষ্ট। এরকুল পোয়ারো বাড়ির গেটের দিকে তাকালো। বাড়িটা একটা পাহাড়ী টিলার ওপর তৈরি। বাড়িটা ঘিরে লাগানো হয়েছে পাইন গাছ। সামনে একটা ছোটো ফুল বাগান, একজন বয়স্ক লোক ফুলগাছে জল দিচ্ছে।

সুপারিন্টেন্টে স্পেনস আগুন্তুকের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারলো, এরকুল পোয়ারো না?

চমৎকার! পোয়ারো বললো, তুমি যে চিনতে পেরেছো এতেই আমি সন্তুষ্ট।

হেমন্তের রোদ ঝলমল করছে সামনের বারান্দায়। একটা গোল টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে। ওরা মুখোমুখি বসলো। স্পেনস বললো সে তার বোন এলস্পেথকে নিয়ে এখানে থাকে।

বাড়ির ভেতরে চলে গেলো স্পেনস তারপর কিছু সময় পরে বিয়ার হাতে ফিরে এলো। গ্লাস দুটো টেবিলের উপর রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। তারপর বললল, এবার বল আমাকে স্মরণ করেছ কেন? কোনো খুনের ব্যাপারে কি?.মনে হচ্ছে জলে মাথা গুঁজে ধরা মেয়েটাকে খুন করার কেসের ব্যাপারে এসেছ?

ঠিক ধরেছ।

দেখ খুনের ব্যাপারে কোনো সাহায্য আর করতে পারবো না। আজকাল পুলিসের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই।

দেখ যে একবার পুলিসে নাম লেখায় সে চিরকাল পুলিসেই থাকে।

তা আমাকে কি করতে হবে?

তুমি মুখে মুখে সব শুনেছ… পোয়ারো বলল, এই কাজ করে এমন বন্ধু তোমার আছে। এই খুনের ব্যাপারে পুলিস কি ভাবছে বা কাকে সন্দেহ করছে তোমার পক্ষে জানা সম্ভব।

স্পেনস জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা এর মধ্যে তুমি নিজেকে জড়ালে কি করে? এখানে তো তুমি থাক না?

নিজেকে জড়িয়েছি এক বান্ধবীর অনুরোধে। মিসেস অলিভার।

আরিয়াদে এখানে থাকে?

না এখানে থাকে না। কদিনের জন্য ওর বান্ধবী মিসেস বাটলারের কাছে উঠেছে। মিসেস অলিভার লণ্ডনে আমার কাছে গিয়েছিল। ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চেয়েছে।

সামান্য এক চিলতে হাসি সুপারিন্টেন্টে স্পেনসের দুঠোঁটের ফাঁকে জেগে উঠে মিলিয়ে গেল। সে বললো, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, তোমার কাছেও আমি একই আর্জি নিয়ে কতবার গেছি। পোয়ারো বললো, এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে, আমি এসেছি তোমার কাছে। আচ্ছা এখানকার আজেবাজে লোক কারা নিশ্চয়ই জানা?

জানি বৈকি। আমি এখানে মাত্র কয়েক বছর হলো আছি। বসবাস করতে এসে মানুষ এইসবই তো আগে দেখে।

এই খুনের ব্যাপারে সন্দেহ করা যেতে পারে এমন লোককে তোমার জানা আছে?

দুটো ছেলে তো পার্টিতেই ছিল, নিকোলাস র‍্যামসাম, সুদর্শন, বয়স হবে সতের আঠার। আর একজন ডেসম বয়স হবে ষোল। এই বয়সে এধরনের অপরাধ করা এমন কিছু অসম্ভব নয়। তাছাড়া বাইরে থেকে কোনো লোক পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে খুন করে যেতে পারে। শোন, মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে জয়েসা একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলেছিল–পোয়ারো বলল কি কথা?

মিসেস অলিভার তাকে যে গল্প শুনিয়েছিল পোয়ারো হুবহু তাই শোনালো স্পেনসকে। সে আরো বললো, মেয়েটা খুন হতে দেখার কথা বললো আর তার কয়েকঘন্টা পরে সে নিজেই খুন হয়ে গেল। এর থেকে একটা ধারণাই হয় যে মেয়েটার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে বুঝতে হবে খুনী সুসময়ের অপচয় করেনি।

ঠিক তাই। স্পেনস বলল, মেয়েটা যখন খুন হতে দেখার কথা বলেছে তখন ঠিক কতজন সেখানে উপস্থিত ছিল?

চোদ্দ কি পনের জন। পাঁচ ছজন শিশু, পাঁচ ছজন কিশোর কিশোরী তবে ঠিক তথ্যের জন্য তোমার ওপর নির্ভর করতে হবে আমায়।

এটা তেমন কঠিন কাজ হবে না। স্পেনস বলল, তবে এক্ষুনি বলা সম্ভব হবে না।

পার্টিতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের একটা নামের লিস্ট আমার কাছে আছে।

ওদের মধ্যে যারা এ কাজ করতে পারে তাদের একটা লিস্ট দিতে পারবে?

সে কাজটা এক্ষুনি করা সম্ভব হবে না।

পোয়ারো বললো, তুমি আমায় এখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে কিছু খবর দাও। এখানকার লোকজন তোমার পরিচিত।

স্পেনস বললো,–যথাসম্ভব চেষ্টা করবো। এ ব্যাপারে আমার বোন এলস্পেথের সাহায্য নিতে হবে। এখানে এমন কোনো লোক নেই যার সম্পর্কে ও জানে না।

.

০৬.

পোয়ারোর কোনো সন্দেহ রইলো না যে, প্রয়োজনীয় খবর সে নিশ্চয়ই পাবে। কেসটাতে স্পেনসকে উৎসাহিত করা গেছে। উচ্চপদস্থ রিটায়ার্ড সি-আই-ডি অফিসার হিসাবে তার খ্যাতি স্থানীয় পুলিস অফিসে খুব কম নয়। এই ডিপার্টমেন্টে তার কয়েকজন বন্ধু আছে।

এখন দশ মিনিটের মধ্যে দি অ্যাপেল ট্রিজ নামে বাড়ির সামনে মিসেস অলিভারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সত্যি খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ নাম। এখানে আপেলের সঙ্গে যাদুদণ্ড আর ডাইনী এবং পুরাতন গ্রাম্য গাথা এবং শিশুহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।

নির্দেশ মতো পোয়ারো একটা পুরোনো টাইপের লাল ইটের তৈরি বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। বাড়িটাকে ঘিরে আছে ঝোঁপ জঙ্গল। পিছনের দিকে একটা সুন্দর বাগান আছে।

গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মিসেস অলিভার। বললো তোমার অপেক্ষায় জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যাক্‌ কার কার সঙ্গে দেখা করলে আজ পর্যন্ত?

আমার বন্ধু সুপারিন্টেন্টে স্পেনস এর সঙ্গে।

এই কেস সম্পর্কে ওর মতামত কি? তোমরা দুজনে মিলে কি করবে ঠিক করেছ?

তুমি এতো ব্যস্ত হয়ো না। আমার প্রোগ্রাম তৈরি করে ফেলেছি। প্রথমে আমার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে ফেলেছি। তাকে বলেছি কিছু খবর যোগাড় করে দিতে। ম্যাডাম এরপর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থল পরিদর্শন করতে যাব।

মিসেস অলিভার ঘাড় ফিরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকাল, তারপর সে বললো, আচ্ছা এই বাড়িটা দেখে কি মনে হচ্ছে এখানে কোনো খুন হতে পারে?

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

না।–পোয়ারো বললো বাড়িটা দেখে তেমন মনে হয় না। অকুস্থল দেখার পর আমি মৃত মেয়েটির মায়ের সঙ্গে দেখা করবো। আজ বিকেলে একসময় স্পেনসের সঙ্গে যাব স্থানীয় ইনসপেক্টরের সাথে কথা বলতে। স্থানীয় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারপর কথা বলবো স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে, সন্ধ্যা ছটার সময় বন্ধু স্পেনস আর তার বোনের সঙ্গে একটু বসবো কিছু আলোচনা করার জন্যে।

তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি একটি কম্পিউটার।

হ্যাঁ আমি কম্পিউটারের মত কাজই করে থাকি–পোয়ারো বললো, অন্য লোক খবর ভরে দেয়। কম্পিউটারে কোনো ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

মিসেস অলিভার বললো, ভেতরে চল মিসেস ড্রেকের সঙ্গে দেখা কর।

মিসেস ড্রেকের দেখবার মতো চেহারা বটে। পোয়ারো ভাবল। বেশ দীর্ঘাঙ্গী এবং সুন্দরী। বয়স হবে চল্লিশের মতো। একমাথা সোনালী চুল ধূসরতার সামান্য ছাপ চোখে পড়ে নীল চোখ দুটি উজ্জ্বল। মহিলাটি যখন কোনো পার্টির দায়িত্ব নেয় তখন তা সফল হবেই।

অ্যাপেল ট্রিজ বাড়ির ভেতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। মূল্যবান মেহগনি কাঠের তৈরি আসবাব পত্র। জানালা দরজার পর্দার কাপড় এবং বিছানা বা অন্যান্য জিনিসের ঢাকা দেখতে চমৎকার কিন্তু খুব যে মূল্যবান তা নয়।

মিসেস অলিভার আর পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানালো মিসেস ড্রেক। ঘুমের চেহারায় তার মনের কথা বোঝা যায় না। একটা দুঃখবোধ তাকে সবসময় ঘিরে আছে।

মঁসিয়ে পোয়ারো চমৎকার সুরেলা গলায় মিসেস ড্রেক বললো, আপনি কষ্ট করে আমার কাছেই এসেছেন বলে আমি খুশি হয়েছি। মিসেস অলিভারের কাছে শুনেছি, আপনি আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন খুনের ব্যাপারে।

নিশ্চিন্ত থাকুন মাদাম, আমার ক্ষমতা মতো আমি সাহায্য করবো তবে কেসটা সহজ বলে মনে হয় না।

মিসেস ড্রেক বললো, আমার ধারণা মানসিক রোগগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি সকলের অলক্ষ্যে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, সেই লোকই মেয়েটাকে প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আপনি যা কল্পনাও করতে পারবেন না তেমন ঘটনা ঘটে গেছে।

অকুস্থলটা আমায় দেখাবেন?

নিশ্চয়ই। মিসেস ড্রেক উঠে দাঁড়ালো। সে বললো, পুলিসের ধারণা যখন স্ন্যাপড্রাগন অনুষ্ঠান চলছিল তখনই কাজটা চুকিয়ে ফেলা হয়েছে। অনুষ্ঠানটা চলছিল ডাইনিংরুমে।

হলঘর পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজা খুলে ফেললো। প্রথমেই নজর পড়লো বড় ডাইনিং টেবিল আর ভেলভেটের মোটা পর্দা। অনুষ্ঠান চলার সময় ঘর অন্ধকার ছিল।

এবার হলের ওপাশে একটা বন্ধ দরজা খোলা হলো। একটা ছোট ঘর নজরে পড়লো। ভেতরে রয়েছে কয়েকটা আর্মচেয়ার, খেলাধুলার সরঞ্জাম আর বইয়ের তাক। একটা লাইব্রেরী। মিসেস ড্রেক যেন সামান্য কেঁপে উঠে বললো, গামলাটা ছিল এখানে অবশ্য একটা প্লাসটিক শিটের উপর– আমি যেতে পারবো না, দৃশ্যটা যেন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন অবশ্য ভেতরে দেখার মত কিছুই নেই। গামলায় জল ছিল-মিসেস ড্রেক বললো, প্লাস্টিক শিটের উপর জল থাকার কথা। মেয়েটার মাথা যদি জলে চেপে ধরা হয়ে থাকে তাহলে প্রচুর জল উপচে নিচে পড়ার কথা।

তা ঠিক আপেলের খেলা তখন চলছিল। একবার না দুবার গামলায় ঢেলে ভর্তি করতে হয়েছিল।

তাহলে যে ব্যক্তি খুন করেছে তারও পোশাক ভিজে যাওয়ার কথা।

পোয়ারো বললো, মেয়েটাই একমাত্র সূত্র। আশা করছি মেয়েটা সম্পর্কে যা জানেন আমায় বলবেন। তারা আবার ড্রয়িংরুমে ফিরে এলো।

মিসেস ড্রেক বললো, আমি বুঝতে পারছি না আমার কাছে কি শুনতে চাইছেন, সব কিছু পুলিসের কাছে কিম্বা জয়েসার মায়ের কাছে জানতে পারেন।

কিন্তু আমি জানতে চাই এমন জিনিস যা সন্তান খুন হওয়া কোনো মায়ের কাছ থেকে জানা যাবে না। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে যার ধ্যান ধারণা আছে এমন একজন লোকের কাছে আমি স্পষ্ট এবং পক্ষপাতহীন মতামত জানতে চাই।

শুনেছি জয়েসা বলেছিল সে একটা খুন হতে দেখেছে। কথাটার কোনো গুরুত্ব দেননি?

না দিইনি। একটা বাজে ব্যাপার। এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। জয়েসার মা বলেছেন তা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

আচ্ছা উপস্থিত অন্যান্য ছেলেমেয়েরা কি ওর কথা বিশ্বাস করেছিল?

উপহাস করেছিল এই জন্যই তো রেগে গিয়েছিল।

আচ্ছা চলি মাদাম, আমার প্রশ্নের যেটুকু উত্তর দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।

জয়েসা কি যে একটা বাজে কথা বলে গোটা ব্যাপারটা ঘোরালো করে রেখে গেলো। মিসেস ড্রেক বিড় বিড় করলো। আচ্ছা উডলিফ কমন্সে আগে কখনও কেউ খুন হয়েছে?

মনে করতে পারছি না।

এমন কোনো খুন হয়েছে যা একটা তেরো বছরের মেয়ের পক্ষেদেখা সম্ভব?

না হয়নি। আমি আবার বলছি মঁসিয়ে পোয়ারো, নিজেকে একজন বিখ্যাত মানুষের কাছে জাহির করবার জন্য কথাগুলো বলেছিলো। মিসেস অলিভারের দিকে মিসেস ড্রেক তাকালো।

আসলে সব দোষ আমারই–মিসেস অলিভার বললো পার্টিতে যাওয়া আমার উচিত হয়নি। না, ভাই না আমি সেই অর্থে বলিনি। মিসেস অলিভারের সঙ্গে বাড়ির বাইরে এসে পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, খুন হওয়ার পক্ষে জয়েসা মোটেই উপযুক্ত নয়। কেউ মিসেস ড্রেককে খুন করে যেতে পারে এমন পরিবেশ এখানে নেই।

যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, জয়েসার মায়ের কথা বলছি উনি মানুষ হিসাবে কেমন?

চমৎকার মহিলা, তবে একটু বোকা ধরনের ওর জন্য দুঃখ হয়। সবচেয়ে দুঃখের কথা হলো ওর মেয়ের খুন হওয়াকে সবাই মনে করছে যৌন অপরাধ।

ধর্ষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া না গেলেও স্থানীয় লোকজন তাই ভাবছে। মিসেস অলিভার বললো, আচ্ছা আমার বান্ধবী জুডিথ বাটলার যদি তোমায় মিসেস রেনল্ড এর কাছে নিয়ে যায় কেমন হবে? মিসেস রেনল্ড এক ও খুব ভালো করে জানে আমি তো নতুন এসেছি।

পরিকল্পনা মতো কাজ করবো আমরা।

.

০৭.

মিসেস ড্রেকের ঠিক বিপরীত হলো মিসেস রেনল্ড এর চরিত্র। দেখে মনে হয় না মনে কোনো ছল চাতুরী আছে। পরনে কালো পোশাক। চোখে জল।

মিসেস রেনল্ডস মিসেস অলিভারকে বললো, আপনার অসীম করুণা আমাদের সাহায্য করার জন্য আপনার বন্ধুকে ডেকে এনেছেন, উনি যদি সাহায্য করতে পারেন তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। কি করে যে এই বয়সের একটা মেয়েকে খুন করতে পারলো। যদি মেয়েটা চীৎকার করতে পারতো–কিন্তু তাকে তো জলের মধ্যে চেপে ধরা হয়েছিল।

পোয়ারো বললো, আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি কেবল আপনার কাছে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি। যাতে আপনার মেয়ের খুনীকে ধরতে অসুবিধা না হয়। আচ্ছা কে খুন করতে পারে বলে আপনার সন্দেহ হয়?

কি করে বলব বলুন? ভাবতেই পারছি না, এ ধরনের নোক এখানে বাস করে। এই জায়গাটা খুব ভালো, আরও ভালো এখানকার লোকজন। আমার ধারণা উত্তেজক ওষুধ খেয়ে কোনো লোক জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল।

আপনার কি স্থির বিশ্বাস যে খুনী একজন পুরুষ?

কোনো মেয়েলোকের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব?

মেয়েলোকেরও গায়ে যথেষ্ট শক্তি থাকতে পারে।

আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝেছি কিন্তু একজন মেয়েলোকের পক্ষে এধরনের কাজ… জয়েসা যে একেবারেই শিশু–মাত্র তের বছরের মেয়ে ছিল মঁসিয়ে পোয়ারো।

আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো, আপনার মেয়ে পার্টিতে একটা মন্তব্য করেছিলো, ও একটা খুন হতে দেখেছে। আমার ধারণা আপনি তখন ওখানে উপস্থিত ছিলেন না।

আমার তিন ছেলেমেয়েকে গাড়ী করে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই, তারপর তাদের নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম। একথা কেউ বিশ্বাস করেছে বলে আমার মনে হয়নি। মিসেস রেনল্ড বললো, মিথ্যে কথা বলা জয়েসার স্বভাব।

পোয়ারো বললো মনে করবার চেষ্টা করুন, তিন সপ্তাহ আগে কিম্বা তিনবছর আগে হয়ত বলেছিল, জয়েসা বলেছিলো, সেই সময় সে বেশ বড়। উত্তেজনামূলক কোনো ঘটনা কি ঘটেছিলো এখানে।

না মনে পড়ছে না।

আচ্ছা আপনার আর দুজন ছেলেমেয়ে তো পার্টিতে উপস্থিত ছিল ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

নিশ্চয়ই।

পোয়ারো লিওপোল্ড এর সঙ্গে কথা বলে তেমন কিছু কিনারা পেলো না।

এবারে তারা এলো উপর তলার এ্যানার কাছে। এ্যানাকে বয়সের তুলনায় একটু বড়ো দেখায়।

এ্যান এর সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো নিজেকে জাহির করা জয়েসার একটা স্বভাব ছিল। কেউ জয়েসাকে খুন করতে পারে একথা ভাবাই যায় না। সুযোগ সন্ধানী ছাড়া এ কাজ আর কেউ করেনি।

এ্যানা আরো একটি কথা জানালো যে জয়েসা ছিল ভীষণ ভাবে মিথ্যেবাদী।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মিসেস অলিভার বললো, আমরা কি কিছুটা এগোতে পেরেছি?

একটুও নয়–এরকুল পোয়ারো চিন্তিত মনে বললো, কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং।

মিসেস অলিভার এমন ভাবে চোখ তুলে তাকালো যেন সে তার মতের সঙ্গে একবারেই একমত হতে পারছে না।

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

০৮.

ঘড়িতে এখন ছটা বাজে। পাইন ক্রেস্টে বসে এরকুল পোয়ারো এক টুকরো সসেজ মুখে পুরে এক ঢোক চা পান করলো। তারপর সামনে বসা মিসেস এলস্পেথ ম্যাকের দিকে তাকালো। মিসেস ম্যাকের মুখ মেদহীন এবং লম্বাটে কিন্তু চোখ তীক্ষ্ণ বদমেজাজী স্ত্রীলোক বলেই মনে হয়। রোগাটে চেহারা।

জয়েসা রেনল্ড কি প্রকৃতির মেয়ে ছিল তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে–দু চোখে প্রশ্ন নিয়ে স্পেনসার দিকে তাকালো পোয়ারো, এদিকটা আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে। পোয়ারো ম্যাকের দিকে তাকালো। মহিলার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।

এলস্পেথ বললো, আমার মতে মেয়েটা ছিল প্রকৃত মিথ্যেবাদী, চমৎকারভাবে গুছিয়ে বানিয়ে গল্প বলতো। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও ছিল ওস্তাদ। আমি কোনোদিন মেয়েটাকে বিশ্বাস করিনি।

আচ্ছা জয়েসা কাকে খুন হতে দেখতে পারে?– পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলো।

কাউকে না– এলস্পেথ তাড়াতাড়ি জবাব দিল।

এখানে নিশ্চয়ই গত তিনবছরে কারো মৃত্যু হয়েছে? অস্বাভাবিক আর অনভিপ্রেত মৃত্যু কারো হয়ে থাকলে তাদের একটা তালিকা পেলে সুবিধা হতো।

হা মানে–এলস্পেথ ইতস্ততঃ করলো।

স্পেনস একটা কাগজ পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিলো, এদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে তোমার সুবিধা হবে।

এদের সন্দেহজনক ভাবে মৃত্যু হয়েছে?

ওই রকমই বলতে পারো।

লেখা নামগুলো পোয়ারো চেঁচিয়ে পড়তে লাগলো–মিসেস লেওয়েলিন স্মিথ কার্লোট বেনফিল্ড, জেনেট হোয়াইট, লেসলি ফেরিয়ার হঠাৎ থেমে গিয়ে মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের নাম পুনরাবৃত্তি করলো।

সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে–মিসেস ম্যাককে বলল কি যেন ঘটেছিল শুনেছি। তার কথার শেষে যাত্রা কথাটা উচ্চারণ করতে শোনা গেলো।

যাত্রা? –পোয়ারোকে বিস্মিত দেখালো।

একরাতে পালিয়ে গেলো। এলস্পেথ বললো আর ফিরেছে বলে শুনিনি। মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের কথা বলছ? না, না। যাত্রাদলের মেয়েটার কথা বলছি। তার পক্ষে ওষুধের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ যথেষ্ট ছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক টাকার মালিক হয়েছিল, কিম্বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তারপর আর তার কথা শোনা যায়নি। যাত্রা কথাটা পোয়ারোর মাথায় ঘুরছে। কেউ মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের মৃত্যু সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল?- পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলো।

না, ভদ্রমহিলা হার্টের অসুখে ভুগছিলেন, নিয়মিত চিকিৎসাধীন ছিলেন।

কিন্তু সন্দেহজনক ভাবে যারা মারা গেছে তাদের নামের তালিকার প্রথমেই ওর নাম কেন রেখেছ বন্ধু?– স্পেনসকে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।

বুঝিয়ে বললো স্পেনস, ভদ্রমহিলা ছিলেন ধনী। তার মৃত্যু যে অপ্রত্যাশিত তা নয়, তবে হঠাৎ হয়েছে। চিকিৎসা করছিলেন যে ডাক্তার সেই ডাঃ ফার্গুসন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমার ধারণা তিনি ভেবেছিলেন আরো কিছুদিন ভদ্রমহিলা বাঁচবেন। তবে তাকে ডাক্তার যা নিষেধ করতেন তিনি সেইগুলোই করতেন। এসব তার হার্টের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল। ভদ্রমহিলা ছিলেন জাহাজ কোম্পানীর মালিকের বিধ্বা স্ত্রী। প্রচুর টাকা ছিলো।

আচ্ছা এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধান করার প্রশ্ন ওঠেনি?

না, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিক ভাবে।

এলস্পেথ বললো, যাত্রাদলের মেয়েটা ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী।

কেন?

কারণ মেয়েটা উইল জাল করেছিলো।

পোয়ারো বললো, আমাকে এই উইল জালের ব্যাপারটা খুলে বলো।

আগে অনেকগুলো উইল করেন। প্রত্যেকটা প্রায় একই ধরনের। তার শেষ ইচ্ছাপত্রে সবকিছু যাত্রাদলের মেয়েটাকে দিয়ে গেছেন, এলস্পেথ বলল, তার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে। মেয়েটা মধ্য ইউরোপের কোনো দেশ থেকে এসেছিল, এক বছরের কিছু বেশি সময় বৃদ্ধার কাছে ছিল। আইনবিদ্রা সরাসরি উইল জালের অভিযোগ আনলো।

সবাই ধরে নিলো যে যাত্রাদলের মেয়েটাই এই উইল জাল করেছে।

মিসেস লিওয়েলিনের নিজের উকিলরা এই জালিয়াতি ধরেছিল?

হ্যাঁ, ফুলার্টন হ্যারিমান আর লিডবেটার। মেনচেস্টারের একটা নামী ফার্ম। ভদ্রমহিলার আইন সংক্রান্ত কাজ তারাই করত। যাত্রা দলের মেয়েটার বিরুদ্ধে আদালতে যাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই সে গা ঢাকা দিল। সম্ভবত নিজের দেশেই পালিয়ে যায় কিম্বা নিজের পরিচয় পরিবর্তন করে নিজেকে গোপন করে আছে।

কিন্তু প্রত্যেকের ধারণা মিসেস লেওয়েলিন স্মিথের মৃত্যু স্বাভাবিক।

পোয়ারো জানতে চাইলো, ভদ্রমহিলা কিরকম সময়ে মারা গেছে কোথায়?

নিজের বাড়িতেই মারা গেছেন।

কি একটা কাজে একদিন বাগানে গেলেন। তাকে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে দেখা গেল, জানালেন শরীরটা খুব ক্লান্ত। বাংলোয় ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আর উঠলেন না। ডাক্তারী মতে সবই স্বাভাবিক। পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করল পোয়ারো। একটা পাতার ওপর দিকে লেখা আছে যারা স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে। তলায় লিখলোএক নম্বর। মিসেস লেওয়েলিন সম্পর্কে আলোচনা হলো। পরের পাতায় স্পেনসর নামগুলো একে একে লিখলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, কার্লোট বেনফিল্ড?

স্পেনস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ষোল বছর বয়স। একটা দোকানে সহকারীর কাজ করতো। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হয়েছিল। কোম্বারী উডের কাছে রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুজন যুবককে সন্দেহ করা হয়। তারা মাঝে মাঝে মেয়েটার সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

পিটার গার্ডনের বয়স হবে একুশ। অল্পবয়সী অপরাধীদের সঙ্গে মিশতো, কিন্তু নিজেকে কোনোদিন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলেনি।

আর একজন যুবক টমাস হুড এর বয়স একুশ। একটু লাজুক প্রকৃতির। একটু খেপাটে। মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থায় কোনো অপরাধ করে ফেলা অসম্ভব কিছু ছিল না। মেয়েটা তাকে নাচাত, হিংসার বশবর্তী হয়ে খুন করা অসম্ভব ছিল না। তবে সে ধরনের কোনো প্রমাণ পুলিস পায়নি।

পোয়ারো আর একটা নাম পড়ল, লেসলি কেরিয়ার। স্পেনস বলল, উকিলের কেরানী, বয়স আঠাশ। কে বা কারা ছুরি মেরে খুন করে। ঘটনাটা ঘটে গ্রীন সোয়ান পাবের কাছাকাছি।

এই বাড়ির মালিক হ্যারী গ্রিফিনের স্ত্রীর সঙ্গে লেসলির একটা হৃদয় ঘটিত ব্যাপার ছিল। মহিলাটির দেখবার মতো রূপ ছিল। বয়সে লেসলির চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ই ছিল। স্ত্রীর পক্ষেই কাজটা করা সম্ভব। চলনে বলনে সে ছিল জিপসিদের মত আর মেজাজ ছিল খুব উগ্র। তবে দোষ লেসলিরও অনেক ছিল। কুড়ি বছর বয়সে জালিয়াতি করার অপরাধে অল্পদিনের জেল খাটে। জেল থেকে বের হওয়ার পর ফুলার্টন হ্যারিসন আর নিউরেটার কোম্পানী তাকে চাকরীতে বহাল করে।

চাকরীর পর একটা বাজে দলের সঙ্গে মেলামেশা করতো। অনেকের ধারণা এই দলের কেউ তাকে খুন করেছে। তার নামে ব্যাঙ্কের এ্যাকাউন্টে মোটা অংকের টাকা ছিল। নগদে জমা দেওয়া হয়েছিল। কোথা থেকে সেই টাকা পেয়েছিল তার কোনো হদিশ মেলেনি। ব্যাপারটা সন্দেহজনক।

পুলিস ধারণা করতে পারেনি কোথা থেকে এই টাকা পেয়েছিল?

না।

তাহলে এই খুন হতে দেখা জয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। পোয়ারো।

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

শ্বাসরোধ হয়ে খুন হওয়া অবস্থায় পায়ে হাঁটা পথ স্কুল থেকে তার বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওখানে নোরা এমব্রোজ নামে একজন মহিলার সঙ্গে থাকতো। নোরার বিবৃতি অনুসারে জানা যায়, বছরখানেক আগে একটি পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবার পর থেকে তাকে ভয় পেতে থাকে। কারণ মাঝে মাঝে সে জেনেটকে ভয় দেখিয়ে চিঠিপত্র লিখতো। নোরা লোকটার নাম না জানলেও কোথায় থাকতো সেটা জানতো।

আহ!– পোয়ারো বললো বেশ ভালোই লাগছে শুনতে। সে জেনেট বোয়াইটের নামের পাশে একটা দাগ দিল। কারণ এই ধরনের খুন জয়েসার মত কোনো মেয়ের পক্ষে দেখা সম্ভব। নিহত স্কুল শিক্ষককে সে চিনতে পেরেছিল।

কিন্তু আততায়ী তার অপরিচিত ছিল। দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি করতে দেখেছিল। কিন্তু তখন তার মনে কোনো দাগ কাটেনি। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়েসা বুঝতে পারলো লোকটার গলা চেপে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছিল।

পোয়ারো বললো, আমরা আড়াই বছর আগে থেকে তিন দিন আগের ঘটনায় এসেছি। এখন দেখতে হবে উডলিফ কমন্সে কে আছে এমন ব্যক্তি যে একজন পুরোন অপরাধী।

পার্টিতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে কেউ সুযোগ বুঝে খুন পর্ব শেষ করেছে বলে মনে হয়।

কাজের সুবিধার জন্য স্পেনস একটা নামের তালিকা পোয়ারার দিকে এগিয়ে দিলো যাতে আঠারোটা নাম লেখা আছে।

তুমি নিশ্চিত এই সব নাম? না। স্পেনস বলল, অনেকে বিভিন্ন কাজে এসেছে আবার চলে গেছে। পোয়ারো জানালো, ডাঃ ফাগুসনের কাছে যাওয়ার কথা আছে। এখন ওখানে যাব।

নাম লেখা কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখলো পোয়ারো।

.

০৯.

ডাঃ ফার্গুসন স্কটিশ। বয়স প্রায় ষাট। কথাবার্তা অমার্জিত। পোয়ারোর আপাদমস্তক বারকয়েক দেখে নিলেন ভদ্রলোক। তারপর জানতে চাইলেন পোয়ারোর আগমনের হেতু।

পোয়ারো কোনো ভনিতা না করে খুনের ব্যাপারটা জানালো। তারপর বললল, স্পেনস। আর ইনসপেক্টর রাগলাস-এর প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, আশা করছি আপনার দয়াও পাবো।

দয়ার কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না।-ফার্গুসন বললেন, ঠিক কি ঘটেছে তা জানি না, তবে শুনেছি পাটির্তে একটা ছোট মেয়ে এক গামলা জলে মাথা গোঁজা অবস্থায় মারা গেছে। নিশ্চয়ই কোনো পাগলের কাণ্ড। জানেন মানসিক রোগগ্রস্ত অনেক নারী পুরুষ আমাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। তাদের কথাবার্তা আর চালচলন দেখে ধরতেই পারবেন না। কিন্তু সুযোগ পেলে তারাই খুন করে নিতান্ত প্রবৃত্তির তাড়নায়। তিনি আরও বললেন, মেয়েটা আমার চিকিৎসাধীন ছিল। মেয়েটি অতিরিক্ত কথা বলতো কিছু জনশ্রুতিও আমার কানে এসেছে। ডাঃ ফার্গুসন বললেন, ওই খুন হতে দেখা–তাই তো? এরজন্যে কারো মনে খুন করবার মোটিভ তৈরি করতে পারে।

অন্য কারণও হতে পারে, যেমন মানসিক অস্থিরতা। খুনীর মানসিক অস্থিতি এর কারণ হতে পারে। একজন মনোবিজ্ঞানীই ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবেন।

তাহলে আপনি মনোবিজ্ঞানীর মতামত নেওয়ার সপক্ষে?

নিশ্চয়ই ধরুন যে ছেলেটা জয়েসাকে খুন করেছে তার বাবা-মা সুন্দর মানুষ, স্বাভাবিক মনের মানুষ। কিন্তু কেউ কোনোদিন কল্পনাও করেনি ছেলেটা অপ্রকৃতিস্থ।

তেমন কেউ আপনার চোখে পড়েছে?

উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া শুধু লক্ষ্মণ দেখে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

তাহলে আপনার বিশ্বাস পার্টিতে এধরনের কোনো লোক ছিল?

পোয়ারো বললো, থাকবে নাই বা কেন, খুনী উপস্থিত না থাকলে খুন হবে কেন?

হ্যাঁ, খুনী পার্টিতে ছিল একজন অতিথি রূপে।

ডাঃ ফার্গুসন বললেন, আমি নিজেও পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম, অবশ্য একটু দেরী হয়েছিল পৌঁছুতে। শুধু দেখতে গিয়েছিলাম কি ঘটছে সেখানে।

খবরের কাগজে সামাজিক বিজ্ঞপ্তি ছাপা হওয়ার মতো ছাপা হলো : উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ছিল–একজন খুনী।

.

১০.

পোয়ারো দি এলমস বাড়িটার দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করল। সম্ভবতঃ প্রধান শিক্ষিকার সেক্রেটারী তার স্টাডিতে তাকে নিয়ে এল।

মিস এমলিন বলল, বসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। শুনলাম আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, জয়েসার মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আপনি কি ওকে ওর পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন?

না-পোয়ারো বলল, আমার বান্ধবী মিসেস আরিয়াদের অনুরোধে এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, ভদ্রমহিলা এখানেই থাকেন আর এই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।

পোয়ারো বললো, আমার ধারণা আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের মতো এটাও একটা। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো মোটিভ আছে। মোটিভটা হল প্রবৃত্তি সম্পন্ন হতে পারে।

কারণ? জয়েসার উক্তি সেই খুন হতে দেখা–শুনেছি ওর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি।

সেটাই স্বাভাবিক। আপনাকে খোলাখুলি বলতে চাই মঁসিয়ে পোয়ারো, জয়েসা ছিল মাঝামাঝি ধরনের মেয়ে, বুদ্ধিমতী তো ছিল না, আবার বোকাও ছিল না। কোনো দোষ ত্রুটির মধ্যে নিজেকে জড়াত না। তবে দাম্ভিক প্রকৃতির ছিল। যেসব ঘটনা ঘটেনি তাই নিয়ে দম্ভোক্তি করতে ছাড়ত না। শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল এই যে তার কথা কেউ বিশ্বাস করত না।

তার মানে জয়েসা মোটেই খুন হতে দেখেনি?

আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়।

এমলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল তারপর সে বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার মতে মিস এলিজাবেথ উইটেকার-এর সঙ্গে কথা বললে আপনি লাভবান হবেন।

মিস এমলিন ঘর থেকে চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পরে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো একজন চল্লিশ বছরের মহিলা। মাথার চুলের রঙ পিঙ্গল, ছোট করে ছাঁটা।

আপনি মঁসিয়ে পোয়ারো –মিস উইটেকার জিজ্ঞাসা করল। আপনি নাকি আমার সাহায্য চান? মিস এমলিন এই ধরনের কথাই বললেন।

মিস এমলিন যখন বলেছেন আপনি নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবেন। বসুন, মিস ইউটেকার।

এলিজাবেথের বুক তোলপাড় করা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে বলল, আমার অনুমান আপনি জয়েসা রেনল্ড এর ব্যাপারে এসেছেন।

পোয়ারো বলল, ঠিক ধরেছেন।

বলুন কি জানতে চান?

দেখুন, সেদিন সন্ধ্যায় পার্টিতে যা ঘটেছিল আমার জানা দরকার। আপনি পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।

ছিলাম। চমৎকার পার্টি হয়েছিল। নানা বয়সের প্রায় ত্রিশজন উপস্থিত ছিল। আপনি বোধ হয় জানতে চান আমার চোখে বিশেষ কিছু পড়েছে কিনা বা কোনো ঘটনার উপর গুরুত্ব দিয়েছি কিনা?

হ্যাঁ, পোয়ারো বললো, যা বলবার নিঃসংকোচে বলুন।

যেমন আশা করা গিয়েছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ভালোভাবেই শেষ হয়। শেষ অনুষ্ঠান ছিল স্ন্যাপড্রাগন ফুল পোড়ান। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করছিল আর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল সারা ডাইনিং হলে। ঘরের মধ্যে তখন ভীষণ গরম। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরে এলাম। হল ঘরে এসেই আমার নজরে পড়ল দোতলায় যে সিঁড়ি উঠে গেছে তার ল্যাণ্ডিংয়ে এসে দাঁড়ালেন মিসেস ড্রেক। হাতে ফুল আর পাতা ভর্তি একটা বড় ফুলদানী। ঘুরে যাওয়া সিঁড়ির কোণে দাঁড়ালেন কি যেন চিন্তা করলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর লাইব্রেরীর ঘরের দিকে তাকালেন।

 

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

তারপর–পোয়ারো নড়ে চড়ে বসল।

নেমে আসার আগে নিশ্চল অবস্থায় লাইব্রেরীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাতে ধরা ফুলদানী হাত থেকে মেঝেয় পড়ে গুঁড়িয়ে গেলো।

আপনি নিশ্চিত যে মিসেস ড্রেক কিছু দেখে চমকে উঠেছিলেন।

হ্যাঁ। সম্ভবত আশা করেননি এমন কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেখে চমকে উঠেছিলেন। হাত থেকে ফুলদানী পড়ে যায়।

মিসেস ড্রেক তারপর কি করলেন?

বিচলিত হয়ে কিছু যেন বলতে চাইলেন।

আপনি নিশ্চিত যে উনি চমকে উঠেছিলেন?–পোয়ারো জানতে চাইলো।

আমার তো তাই মনে হয়েছে, মঁসিয়ে পোয়ারো।

তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, একটু আগে ওই লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পেরে আবার ভিতরে ঢুকে যে দরজা বন্ধ করে দিল, সে কে? তারপর ধরা যাক অতিথিরা যখন খুব ব্যস্ত, সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে অবশ্য মৃতদেহ আবিষ্কারের আগেই। আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করতে চাই। নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন পার্টিতে কোনো খেলার পর কোনো খেলা হয়?

মনে হচ্ছে পারব–এলিজাবেথ সামান্য সময় চিন্তা করে বলল, প্রথমে হয় বঁটার প্রতিযোগিতা, তারপর হয় বেলুনের খেলা, এরপর হয় আয়নার খেলা। সব খেলার শেষে হয় স্ন্যাপড্রাগনের খেলা। জয়েসাকে শেষ দেখা যায় ময়দার খেলায়।

আচ্ছা আপনি তো স্কুলে পড়ান। বছর দুই আগে এই স্কুলে জেনেট হোয়াইট নামে একটি মেয়ে পড়তো তাকে আপনি চেনেন?

এলিজাবেথ সহসা আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। একটু বিব্রত বোধ করে বললো, এই সব ঘটনার সঙ্গে জেনেটের সম্পর্ক কোথায়?

পোয়ারো বললো, থাকতেও তো পারে। আচ্ছা জয়েসা জোর দিয়ে বলছে যে কয়েক বছর আগে সে একটা খুন হতে দেখেছো, এটা কি জেনেটের খুন হওয়ার ব্যাপার বলে আপনার মনে হয়? জেনেট হোয়াইট কিভাবে মারা যায়?

তাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়। একরাতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল– সম্ভবত একা নয়।

আচ্ছা, জয়েসা কিভাবে এই ঘটনা দেখতে পারে বা জানতে পারে?

কোয়ারী উডের কাছে একটা সরু গলিতে ঘটনাটা ঘটেছে। তখন তার বয়স নিশ্চয়ই দশ এগারো হবে।

পুলিস এই কেসটার কোনো কিনারা করতে পারেনি?

এলিজাবেথ মাথা নাড়ল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে বাঁধা ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর সে বলল, এখন আমায় যেতে হবে।

পোয়ারো বললো, কষ্ট করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Bangla Gurukul Logo মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

কোয়ারী হাউসের দিকে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ভ্রুকুটি করলো পোয়ারো -হিকরি ডিকরি ডক (১৯৫৫) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিস লেমনকে নোট দিতে -হিকরি ডিকরি ডক (১৯৫৫) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment