ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ভাষা ও শিক্ষা সিরিজের ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থ:
যে-গ্রন্থ কোনও ভাষাকে সম্যক বিশ্লেষণ করে তার গঠন-প্রকৃতি ও স্বরূপকে চিনিয়ে দেয়, তাকে শুদ্ধভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহার করতে শেখায়, তাকে সে ভাষার ব্যাকরণ বলে। অর্থাৎ ব্যাকরণ হল, ভাষার বিশ্লেষণ, প্রকৃতি ও প্রয়োগরীতি ও স্বরূপ আলোচনা ও ব্যাখ্যা করে এমন শাস্ত্র।”
ব্যাকরণ ও বাংলা ভাষার ব্যাকরণের সঠিক সংজ্ঞার্থ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে ব্যাকরণের যথার্থ পরিচয় প্রকাশের জনো ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭), মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সংজ্ঞার্থগুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা যায়।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে , ‘যে বিদ্যার দ্বারা কোনও ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপটি আলোচিত হয়, এবং সেই ভাষার পঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শুদ্ধ রূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ (Grammar) বলে। ‘
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘যে ব্যাকরণের সাহায্যে এই ভাষার স্বরূপটি সব দিক দিয়া আলোচনা করিয়া বুঝিতে পারা যায়, এবং শুদ্ধ রূপে (অর্থাৎ ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে যে রূপ প্রচলিত সেই রূপে) ইহা পড়িতে ও লিখিতে ও ইহাতে বাক্যালাপ করিতে পারা যায়, সেইরূপ ব্যাকরণ বুঝায়।
মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর মতে, ‘যে শাস্ত্রে কোনো ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও সরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়, তাকে ব্যাকরণ বলে।
বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠনপ্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয় এবং এদের সম্পর্ক ও সুষ্ঠ প্রয়োগবিধি আলোচিত হয়, তাই বাংলা ব্যাকরণ।
উল্লিখিত সংজ্ঞার্থগুলোর পাশাপাশি দু-একটি পুরোনো সংজ্ঞার্থও উল্লেখ করা যায়। যেমন,
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫-১৯৬৯) মতে, ‘যে শাস্ত্র জানিলে বাঙ্গালা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায় তাহার নাম বাঙ্গালা ব্যাকরণ।
ড. সুকুমার সেন-এর (১৯০০-১৯৯২) মতে, ‘কোন ভাষার উপাদান সমগ্রভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ যে বিদ্যার বিষয় তাহাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।” বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতির রিচার ও বিশ্লেষণ এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারা যায় তাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সংক্ষেপে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
ড. মুহম্মদ এনামুল হকের (১৯০২-১২) মতে, যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া ইহার বিবিধ অংশের পারস্পরিক সম্মন্ধ নির্ণয় করা যায় এবং ভাষা রচনাকালে আবশ্যকমত সেই নির্ণীত তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়োগ সম্ভবপর হইয়া উঠে, তাহার নাম ব্যাকরণ। ‘
উল্লিখিত সংজ্ঞার্থগুলোর আলোকে ড. হুমায়ুন আজাদ মন্তব্য করেছেন, “এখন ‘ব্যাকরণ’ বা ‘গ্রামার’ বলতে বোঝায় এক শ্রেণির ভাষাবিশ্লেষণাত্মক পুস্তক, যাতে সন্নিবিষ্ট হয় বিশেষ বিশেষ ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের সূত্রাবলি।”
উৎস নির্দেশ:
* অশোক মুখোপাধ্যায়; সংসদ ব্যাকরণ অভিধান, শিশু সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৫
৬. ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ভাষা প্রকাশ বা বাঙ্গালা ব্যাকরণ; কলকাতা।
৭. মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত)।
৮. ড. সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত।
৯. ড. সুকুমার সেন, বাঙ্গলা বা ভাষার ব্যাকরণ।
১০. রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বাঙ্গলা ব্যাকরণ।
সুতরাং, উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা স্পষ্ট যে ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলার আলোচনাই ব্যাকরণ। ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করে ভাষায় কখন কী হওয়া উচিত তা বলে না বা নির্দেশ করে না বা বিধানপ্রণয়ন করে না, বর্ণনা করে মাত্র। ব্যাকরণের সাহায্যে ভাষার সংগোপন অভ্যন্তর-সূত্র উদ্ঘাটন করে ভাষার বিশুদ্ধ রূপ বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। প্রসঙ্গত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন, ‘আমি ব্যাকরণ নামে যে বিজ্ঞান শাস্ত্রের উল্লেখ করিতেছি, তাহার উদ্দেশ্য ভাষা শেখান নহে। উহার উদ্দেশ্য নিজে শেখা, ভাষার ভিতরে কোথায় কী নিয়ম প্রচ্ছন্নভাবে রহিয়াছে, তাহাই আলোচনা দ্বারা আবিস্কার করা।’
ভাষা যেন বহতা নদী। উৎসবার থেকে নদীর বিপুলকায় জলধারা বেরিয়ে সর্পিল গতিতে কত বাঁকে কত মোড় নিয়ে এগিয়ে চলে মোহনার দিকে। অনুরূপভাবে বিবর্তন, রূপান্তর ও ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে ভাষারও অগ্রগতি ঘটে। এ ক্ষেত্রে ব্যাকরণের ভূমিকা ভাষাকে নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা নয়, বরং পরিবর্তনের ধারায় ভাষাকে সুশৃঙ্খল, গতিশীল ও জীবন্ত করে রাখা। তাই বলা হয়— ‘ব্যাকরণ ভাষাকে শাসন করে না, বরং ভাষাই ব্যাকরণকে শাসন করে’ অর্থাৎ, ব্যাকরণ ভাষাকে চলতে নির্দেশ দেয় না কিংবা শাসন করে না, বরং ভাষাই ব্যাকরণকে শাসন করে বা চলতে নির্দেশ দেয়, কিংবা ব্যাকরণ ভাষার বিষয়কে বর্ণনা করে মাত্র।
আরও দেখুন:
- গণমাধ্যম রচনা । Essay on Mass media । প্রতিবেদন রচনা
- সৈয়দ শামসুল হক | বাঙালি সাহিত্যিক, কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, অনুবাদক
- দীপাবলি রচনা । Essay on Diwali । প্রতিবেদন রচনা
- তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ রচনা । Essay on Information and Bangladesh । প্রতিবেদন রচনা
- যদি আসে তবে , প্রেম ৩৪২ | Jodi ashe tobe