বাচ্যার্থ লক্ষ্যার্থ ব্যঙ্গ্যার্থ | অর্থ পরিবর্তনের নানা ধারা | ভাষা ও শিক্ষা , বাচ্যার্থ লক্ষ্যার্থ ব্যঙ্গ্যার্থ : কোন শব্দ উচ্চারণ করা মাত্রই যে ছবিটি আমাদের মনের মধ্যে ফুটে ওঠে তাই হল এর মূল অর্থ। একে মুখ্যার্থ বা বাচ্যার্থও বলা হয়। আমরা একে আক্ষরিক অর্থও বলি। ইংরেজিতে একে আমরা বলি literal meaning অর্থাৎ the meaning which directly comes from the combination of particular letters. মাথা বদলে শরীরের ঊর্ধ্বাংশে স্থিত যে অবয়বটির ছবি আমাদের মনে ফুটে ওঠে তা-ই হল এর বাচ্যার্থ।
কিন্তু যদি বলি ‘লোকটা গ্রামের মাথা’ তখুনি আমরা লক্ষ্যার্থে পৌঁছব। লক্ষ্যার্থ হল রূপকার্থ। “যা উঁচুতে থাকে” এই অর্থ নিয়ে ‘গ্রামের মাথার “গ্রামের প্রধান’ অর্থে উপনীত হয়। আবার যখন বলব এর মাথা নেই অঙ্গে তখন লক্ষ্যার্থকে ছাপিয়ে তা হয়ে উঠবে ব্যঙ্গ্যার্থ বা সাংকেতিক অর্থ (suggested sense) ।
বাচ্যার্থ লক্ষ্যার্থ ব্যঙ্গ্যার্থ | অর্থ পরিবর্তনের নানা ধারা | ভাষা ও শিক্ষা
সে গোলমালের মধ্যে মাথা ঠিক রাখতে পারে নি’ বললেও আমরা বাঙ্গার্থের গন্ডির মধ্যে পড়ব। লক্ষ্যার্থ ও ব্যঙ্গ্যার্থ অনেক সময় সমীকৃত হয়ে যেতে পারে। লক্ষ্যার্থ ধরব না ব্যঙ্গ্যার্থ ধরব সেটা নির্ভর করবে অন্য পদের সঙ্গে শব্দটির মিলিত সম্পর্কের ওপরে। মাথা ঘামানো লক্ষ্যার্থ- ব্যঙ্গ্যার্থ হয়ে উঠতে পারে। আসলে লক্ষ্যার্থের মধ্য দিয়েই আমরা ব্যঙ্গার্থে পৌঁছই।
অর্থ পরিবর্তনের নানা ধারা
শব্দকে বিশ্লেষণ করলে শব্দের মূল অর্থটি ধরা পড়ে। শব্দের এই মুখ্যার্থের পারিভাষিক নাম অভিধা। শব্দের গৌণার্থের বোধ যার দ্বারা জন্মায় তার পরিভাষা লক্ষণা। শব্দের অর্থ-তাৎপর্য এই দুই পরিভাষা-বহির্ভূত হলে, সেই ব্যঙ্গ্যার্থবোধক অর্থ-তাৎপর্যের নাম ব্যঞ্জনা। প্রকৃতপক্ষে অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা শব্দের এক-একটি শক্তি। এই শক্তিগুলোর দ্বারা শব্দের অর্থান্তর ঘটে।
বস্তুত শব্দার্থ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, পারিবেশিক, মনোবিষয়ক ও আলংকারিক কারণে এবং সেই সঙ্গে বহু ব্যবহারের জীর্ণ খোলস ছেড়ে নতুন নতুন অর্থকৌলীন্যে সমৃদ্ধ হওয়ার অভীপ্সায় এগিয়ে চলে। তাতে পরিবর্তনের নানা ধারাপথ ও বৈচিত্র্য গড়ে ওঠে। শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যেমন-
১. অর্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি (Elevation of meaning)
২. অর্থের অপকর্ষ বা অবনতি (Deterioration of meaning)
৩. অর্থের প্রসার বা বিস্তার (Expansion of meaning)
৪. অর্থের সংকোচ (Narrowing of meaning),
৫. অর্থের সংশ্লেষ বা নতুন অর্থের আগমন বা শব্দার্থের রূপান্তর (Transfer of meaning)।
১. অর্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি : শব্দ যখন তার বাচ্যার্থ বা মূল অর্থ বর্জন করে উচ্চতর ভাব বা বিষয় প্রকাশক অর্থে প্রযুক্ত হয়, তখন সে শব্দার্থের হয় উৎকর্ষ বা উন্নতি। যেমন- ‘মন্দির’ (মন্দ+ইর)। মূল বা আদি অর্থ ছিল ‘গৃহ’। এখনকার পরিবর্তিত বা প্রচলিত অর্থ ‘দেবালয়’- মনুষ্যবাসের পরিবর্তে দেবতার আবাসস্থল। এখানে অর্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি হয়েছে। শশধর’ (শশ+বৃ+অ)। মূল বা আদি অর্থ ‘যে শশক ধারণ করে”। পরিবর্তিত বা আধুনিক প্রচলিত অর্থ ‘চন্দ্র’। শব্দার্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি হয়েছে।
অনুরূপ দৃষ্টান্ত
২. অর্থের অপকর্ষ বা অবনতি : শব্দ যখন তার বাচ্যার্থ বা মূল অর্থের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত হীন বা নিম্নতর অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন সে-শব্দার্থের অপকর্ষ বা অবনতি ঘটে। যেমন- ‘মহাজন’। বাচ্যার্থ বা মূল অর্থ ‘মহৎ’ যে জন বা “মহৎ ব্যক্তি’। এখন পরিবর্তিত বা প্রচলিত অর্থ ‘উত্তমর্ণ’ বা ‘সুদখোর।’ এখানে অর্থের অপকর্ষ বা অবনতি হয়েছে। ‘ঝি’ শব্দের আদি বা মূল অর্থ ‘মেয়ে’। আধুনিক প্রচলিত অর্থ ‘দাসী’। অর্থের অবনমন বা অপকর্ষ হয়েছে।

অনুরূপ দৃষ্টান্ত
৩. অর্থের প্রসার বা বিস্তার : শব্দের মূল বা আদি অর্থ যখন বস্তু বা ব্যক্তির গুণ-ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে বস্তুনিরপেক্ষ গুণ-ধর্মের পরিচায়ক হয়, তখন তাকে বলা হয় শব্দার্থের প্রসার বা বিস্তার। যেমন—’গৌক্রন্তিকা’ (গৌরচন্দ্র+ইক+আ)। মূল বা আদি অর্থ ‘কীর্তন গানের সূচনায় গৌরাঙ্গ গীতি’। আধুনিক পরিবর্তিত বা প্রচলিত অর্থ ‘যে কোনো আলোচনার ভূমিকা। ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হওয়ায় অর্থের প্রসার বা বিস্তার ঘটেছে।
অনুরূপ দৃষ্টান্ত
৪. অর্থের সংকোচন : শব্দের অর্থসমষ্টির মধ্যে কোনো একটি প্রধান হলে কিংবা কার্যকারণের মধ্যে কারণবাচক থেকে কার্যবাচক বোঝালে, অথবা সমগ্রের মধ্যে অংশকে বোঝালে তা না হয়ে সমষ্টিবাচক শব্দ ব্যষ্টি অর্থে প্রযুক্ত হলে, তাকে বলা হয় শব্দার্থের সংকোচন। যেমন- ‘কৃপণ’ (কৃপ+অন)। আদি বা মূল অর্থ ছিল ‘কৃপার পাত্র’। আধুনিক প্রচলিত অর্থ ব্যয়কুণ্ঠ। শব্দার্থের সংকোচ হয়েছে। ‘মৃগ’ (মৃগ+ক)। আদি বা মূল অর্থ ‘পশু’, আধুনিক প্রচলিত অর্থ ‘হরিণ’। শব্দার্থের সংকোচন হয়েছে।
অনুরূপ দৃষ্টান্ত
৫. অর্থের সংশ্লেষ বা নতুন অর্থের আগমন বা শব্দার্থের রূপান্তর: আমরা দেখেছি শব্দার্থের যেমন বিস্তার বা প্রসার ঘটে, তেমনি সংকোচও হয়। এরকম সংকোচন ও প্রসারণের টানাপড়েনে শব্দের মূল অর্থের ও প্রচলিত অর্থের মধ্যবর্তী অর্থ-পরিবর্তনের স্তরগুলো লুপ্ত হয়ে মূল অর্থ থেকে প্রচলিত অর্থের দূরত্ব এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে, মূল অর্থের সঙ্গে প্রচলিত অর্থের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়।
শব্দের অর্থ তখন তখন সম্পূর্ণ নতুন বলে মনে হয়। সুতরাং, শব্দার্থ মূল বা আদি অর্থ থেকে রূপান্তরিত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ পরিগ্রহ করলে তাকে বলা হয় শব্দার্থের সংশ্লেষ বা রূপান্তর। ‘লৌহ’ (লোহ+অণ্) আদি বা মূল অর্থ ‘লাল রঙের ধাতু। আধুনিক প্রচলিত অর্থ ‘ধাতু বিশেষ’। ‘পাষণ্ড’ (পা-য-ণিচ্ +অচ্)। আদি বা মূল অর্থ ‘ধর্ম-সম্প্রদায় বিশেষ। আধুনিক প্রচলিত অর্থ “নিষ্ঠুর’।
অনুরূপ দৃষ্টান্ত
আরও দেখুন: