বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই | Fakir Lalon Shai

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ] ১১৯৬ বঙ্গাব্দের (১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ, মতান্তরে ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে) ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম ও বংশ পরিচয় নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। এক পক্ষ বলেন তিনি তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার (বর্তমানে জেলা) কুমারখালী থানার চাপড়া ভাঁড়ারা নামক একটি গ্রামে হিন্দু কায়স্থকুলে জন্মগ্রহণ করেন। বংশপরম্পরায় তাঁর পদবি হচ্ছে কর এবং গোত্র ঘৃত কৌশিকী। পিতামাতার নাম যথাক্রমে মাধব চন্দ্র কর ও পদ্মাবতী।

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ]
বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ]

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ] এর পূর্বপূরুষদের আবাসস্থল ছিল ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার পানিহাটিতে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দি খাঁর (১৬৭৬-১৭৫৬) শাসনামলে বর্গি হাঙ্গামা হলে পানিহাটি অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে বিপন্ন। সে সময় এলাকার অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নানা স্থানে চলে যায়।

ফকির লালন সাঁইয়ের পিতামহ বাউল কর তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও সঙ্গী-পরিজনদের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া কুমারখালীর চাপড়া গ্রামে এসে বসতি গাড়েন। কোনো কোনো লালন-গবেষকের মতে, বাউল করের একমাত্র পুত্র মাধব চন্দ্র কর এবং তাঁর একমাত্র পুত্র লালন চন্দ্র করই হচ্ছে ফকির লালন সাঁই।

আবার কোনো কোনো গবেষক বলেন, মাধব চন্দ্র করের দুই পুত্র হলেন ললিতনারায়ণ কর ও রামকৃষ্ণ কর। ললিতনারায়ণই পরবর্তী সময়ে পরিচিত হন সাধক সংগীতজ্ঞ ফকির লালন সাঁই নামে। এমনকি লালন নামটিও তাঁর পারিবারিক নাম নয়। ঠিক একইভাবে লালনের ঘরবাড়ি নিয়েও মতভেদ আছে। কারো মতে, ভাঁড়ারা ও চাপড়া গ্রামের মধ্যবর্তী রাস্তার পশ্চিমদিকে লালনের বাড়ি ছিল। কেউ কেউ বলেন – ওই রাস্তার পূর্বদিকে লালন বাস করতেন।

আবার অন্যমতে, যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) হরিশপুর গ্রামে (দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের আবাসস্থল) মহান সুরসাধক লালন ফকির জন্মগ্রহণ করেন। লালন যে সময় জন্মগ্রহণ করেন সে সময় ‘ভাঁড়ারা’ ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘ধর্মপাড়া’ এবং ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত গ্রাম ‘চাপড়া’ কবিগান ও হরিসংকীর্তনে ছিল মুখরিত। এই পরিবেশেই তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়।

ফকির লালন শাহের জন্মস্থানের মতোই তাঁর জাতি বা সম্প্রদায় নিয়েও অনেক মতভেদ রয়েছে। এই প্রশ্ন তাঁর জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর পরেও দীর্ঘকাল বিদ্যমান ছিল। পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদি ও গবেষণার তথ্য-উপাত্ত থেকে অনুমান করা হয় যে, তিনি হিন্দু কায়স্থ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল লালন কর এবং কুষ্টিয়ার চাপড়া গ্রামের ভৌমিক বংশীয়রা ছিলেন তাঁর আত্মীয়। শৈশবে লালন পিতৃহীন হন। অল্প বয়সে বিয়ে হলে বিধবা মা পদ্মাবতী এবং সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ভৌমিক মহাশয়ের বাড়ির কাছাকাছি দাসপাড়ায় বসবাস করতেন তিনি। তাঁর মাতামহের নাম ছিল। ভন্মদাস।

প্রথম যৌবনে সঙ্গীদের সঙ্গে নৌকায় তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার পথে তাঁর শরীরে প্রকাশ পায় বসন্তরোগের লক্ষণ। সেই সময় তীর্থযাত্রী সঙ্গীদের পরামর্শে গঙ্গাস্নানের প্রচণ্ড ইচ্ছেকে ত্যাগ করে বাধ্য হয়েই বাড়ির পথে রওনা দেন তিনি। কিন্তু অসুখের মারাত্মক আক্রমণ তাঁকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছার কোনো সুযোগই দেয় না। জলবসন্তে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী লালনকে পথের ধারে পড়ে থাকতে দেখে যেন কলাগাছের ভেলায় তাঁকে ভাসিয়ে দেয়।

Lalon complex at kushtia, Source - Ferdous, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.
Lalon complex at kushtia, Source – Ferdous, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.

তৎকালীন বৃহত্তর নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া শহরসংলগ্ন পূর্বদিকে ছেঁউড়িয়া গ্রাম। সেখানকার অধিবাসী তন্তুবায় (তাঁতি) মুমিন সম্প্রদায়ভুক্ত মুন্সী খায়রুল্লাহর চার পুত্র যথাক্রমে – মলম, আলম, কলম ও তিলম (তিলাম)। এঁদের মধ্যে মলম, কলম ও তিলম ছিলেন নিঃসন্তান। মলম ছিলেন একজন হাফেজ ও মওলানা। চারিত্রিক গুণাবলি এবং শিক্ষাদীক্ষার কারণে গ্রামের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করত ভক্তিসহকারে।

একদিন ভোরে মওলানা মলম ফজরের নামাজ আদায় করে নিজ বাড়ির পশ্চিমপাশে কালী নদীর ধারে প্রাতভ্রমণ করছিলেন। হঠাৎ দেখলেন একজন মানুষ অর্ধজলমগ্ন অবস্থায় কালী নদীর ঘাটের কিনারায় পড়ে আছে। কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে তিনি দেখতে পান জলবসন্তে ক্ষতবিক্ষত মৃতপ্রায় সতেরো-আঠারো বছর বয়সী এক মৃত্যুপথযাত্রীর শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে অতি ধীরগতিতে। এই অবস্থা দেখে নিঃসন্তান মওলানার পিতৃস্নেহ জেগে ওঠে এবং তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ভাইদের সহযোগিতায় মৃত্যুপথযাত্রীকে নিজগৃহে নিয়ে আসেন।

মওলানা মলম ও তাঁর স্ত্রী মতিজান বিবির অক্লান্ত সেবা-শুশ্রূষা ও চিকিৎসায় রোগীর বসন্তরোগ নিরাময় হতে থাকে। তিন সপ্তাহ ধরে আন্তরিক সেবা-শুশ্রুষার ফলে তাঁর বসন্তজনিত ঘা শুকাতে থাকে এবং শরীরের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। আরো সপ্তাহখানেক পর তাঁর শরীর এতটাই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যে বসন্তরোগে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কোনো চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিঃসন্তান মওলানা মলম ও তাঁর স্ত্রী পুত্রস্নেহে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ভাবেন মহান আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতের খেলা মানুষের বোঝার কোনো সাধ্য নেই।

যশোর জেলার ঝিনাইদহের ফুলবাড়ি-হরিশপুর গ্রামে সিরাজ সাঁই নামে একজন দরবেশ ছিলেন লালনের গুরু। রোগশয্যায় থাকাকালে লালন এই সিদ্ধফকিরের কৃপালাভ করেন এবং পরে তাঁর মাধ্যমে ফকির সম্প্রদায়ের গূঢ় যোগতত্ত্বের অধিকারী হন। অসুস্থ অবস্থায় মুসলিম পরিবারের সেবা গ্রহণ এবং ইসলাম ধর্মানুসারী অধ্যাত্মসাধক সিরাজ সাঁইয়ের কবিরাজি ওষুধপত্রে আরোগ্য লাভ করায় হিন্দুসমাজ লালনকে সমাজচ্যুত করে। সমাজ-পরিত্যক্ত লালন স্ত্রী ও জননীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হন বৈরাগী ।

লালন ঘর ছাড়ার কিছুকাল পরেই তাঁর দুঃখিনী স্ত্রী ইহলোক ত্যাগ করেন । মা পদ্মাবতী একাকিনী সংসারে নিদারুণ কষ্ট ও গভীর বেদনার মধ্যে দিন কাটাতে থাকেন। অবশেষে তিনিও ঘর ছেড়ে ভাঁড়ারা গ্রামে বৈরাগী শম্ভুমিত্রের আখড়ায় আশ্রয় নেন। অবশিষ্ট জীবন সেখানেই কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই স্থানেই মৃত্যুবরণ করেন। জননীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে লালন ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়ে জননীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন।

Lalon sketch by Jyotirindranath Tagore
Lalon sketch by Jyotirindranath Tagore

গুরু সিরাজ সাঁইয়ের মরমি উপদেশে লালনের হৃদয়ে সঞ্চালিত হয়। এক নতুন চেতনার আবেশ। তাই তো গুরুজির নিবাস ঝিনাইদহের হরিশপুরে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে শুরু করেন সাধকজীবন। সিদ্ধপুরুষ সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে থেকে জাগতিক বিষয়ের ঊর্ধ্বলোকের সন্ধান লাভ করেন তিনি। সৃষ্টিকর্তা, তাঁর সৃষ্টির রহস্য ও মাহাত্ম্য নিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হন লালন। কঠোর সাধনা আর গুরুর কৃপায় সিদ্ধপুরুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। লালন কর হয়ে ওঠেন লালন সাঁই ফকির।

গুরুজির মৃত্যুর পর তিনি ধর্ম বাবা-মার কাছে ফিরে আসেন। মলম দম্পতি দত্তক পুত্র লালনকে জমি দান করলে ছেঁউড়িয়াতেই বসতি স্থাপন করেন তিনি। এরপর লালন বিশাখা নামের এক রমণীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সে সময় শত শত মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে কৃতার্থ হয়। ইসলাম ও সনাতন উভয় ধর্মের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হন তিনি। ফকির লালনের শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জ্ঞানীগুণী শ্রেণির মানুষ।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অনেক গণ্যমান্য মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাঁকে নিজ বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং ধর্মালাপ করতেন। কেউ তাঁর জ্ঞান-গুণ-গরিমায় আকৃষ্ট হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ তর্কযুদ্ধ করতে এসে কথা ও গান শুনে মুগ্ধ হয়ে শিষ্যত্ব বরণ করেন। উচ্চশিক্ষিত ধর্মীয় মওলানা এবং উচ্চশিক্ষিত ধর্মীয় গোঁসাই তাঁর সঙ্গে জ্ঞানালাপ ও ধর্মীয় আলোচনা করে বিমোহিত হতেন। লালনের এই গানটি তখন জনমানসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথায় একঘর পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না
দেখিলাম তারে ॥

তৎকালীন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁকে নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আধ্যাত্মিক আলোচনা করে ধন্য হতেন। ফকির লালন সাঁই রচিত :

বেঁধেছে এমনও ঘর
শূন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে

এই গানটি শুনে সেই সময়ের জ্ঞানী, গুণী ও বিদগ্ধজনেরা বিমোহিত হয়ে পড়তেন।

Tomb of Lalon Shai, Source - Own work, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 4.0 International license.
Tomb of Lalon Shai, Source – Own work, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 4.0 International license.

প্রচলিত রয়েছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরকে শিলাইদহে তাঁদের কাছারিবাড়িতে, আবার কখনো নৌকায় আমন্ত্রণ করে তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবসমৃদ্ধ সংগীতে অবগাহন করে তৃপ্ত হতেন। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ না থাকায় এই ঋদ্ধ গুণীজনদের সাক্ষাৎকার নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু মতামত রয়েছে। কিন্তু ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে (১২৯৬ বঙ্গাব্দের ২৩ বৈশাখ) শিলাইদহে বোটের ওপর লালন ফকিরকে চেয়ারে বসিয়ে শিল্পগুরু জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা প্রতিকৃতি থেকে বোঝা যায় তাঁদের মধ্যে অবশ্যই সাক্ষাৎ ঘটেছিল।

আবার বোনঝি সরলা দেবী সংগৃহীত লালনগীতি এবং ভাইঝি ইন্দিরা দেবীর স্বরলিপিকৃত লালনের গান ১৮৯৫ (১৩০২ বঙ্গাব্দ) ও ১৮৯৮ (১৩০৫ বঙ্গাব্দ) খ্রিষ্টাব্দে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন সাঁইয়ের গানের ভাব ও গভীরতায় চমৎকৃত হয়ে লিখেছেন শিলাইদহে যখন, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদায় দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হ’ত।

আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। (মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, হারামণি, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় প্রকাশ, জুলাই ১৯৭৬, পৃষ্ঠা : ‘আশীর্বাদ’)

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাউলাঙ্গ সংগীত রচনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। লালন ফকিরকে মুসলমান কিংবা হিন্দু বলে চিহ্নিত করা না গেলেও তিনি নিজে ছিলেন সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তাঁর সম্পর্কে বিশ্বকবি মন্তব্য করেছেন, ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কি যেন একটা বলতে চেয়েছেন। আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিত।’

কেননা ফকির লালন সাঁই বলেন:

দিন থাকিতে তিনের সাধন
কেন করলে না ॥
সময় গেলে সাধন হবে না।

Tomb Lalon, Source - Md. Saiful Aziz Shamseer, his file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 license.
Tomb Lalon, Source – Md. Saiful Aziz Shamseer, his file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 license.


বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি গেলে মুর্শিদি গানের আসর বসত। অনুষ্ঠান শেষে কেউ লালনগীতি জানে কি না জানতে চাইলে পল্লীকবি মাহিন শাহকে দেখিয়ে নজরুলকে বলেন, ‘এই ছেলে জানে। বিদ্রোহী কবির অনুরোধে মাহিন ‘রাসুল রাসুল বলে ডাকি’ এই লালনগীতিটি শোনালে তিনি আরো গান শুনতে চান। তখন মাহিন শাহ আবারো গাইলেন:

আকার কি নিরাকার সাঁই রাব্বানা।
আহাদ আর আহম্মদের বিচার
হলেই যায় জানা

‘’বাও’ অর্থ বাতাস এবং ‘উল’ অর্থ সন্ধান। যারা হাওয়া বা বাতাসের সন্ধান করে তারা হচ্ছে বাউল। এই বাউলেরা সকাল ও সন্ধ্যায় গুরুর বার্জোখ নিরিখ রেখে মহাপ্রভুর সন্ধানে আত্মনিবেশ করে। ‘আউল’, ‘বাউল’, ‘দরবেশ’, ‘সাঁই’ ও ‘ফকির’ এই হলো তাদের সাধনা স্তরের পাঁচটি পর্যায়ের নাম। তাদের মতে, আউল হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বাউল হচ্ছে দীক্ষাপ্রাপ্ত সাধক, দরবেশ হচ্ছে আত্মসংযমী আদর্শ মানুষ, সাঁই হচ্ছে অধ্যাত্মজ্ঞানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি আর যিনি অধ্যাত্মতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছান তিনি হলেন ফকির।

তাই তো লালন ফকিরের হৃদয় চিরে বেরিয়ে আসে –

পাবে সামান্যে কি তাঁর দেখা
বেদে নাই তাঁর রূপ রেখা ।

জনশ্রুতি আছে চাতক-চাতকী মেঘের বর্ষণ হওয়া পানি ছাড়া অন্য পানি পান করে না। মধ্যযুগের কাব্যে বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত এই লৌকিক বিশ্বাসকে উপমা করে লালনের কণ্ঠে সুরধ্বনিত হয়

চাতকের প্রাণ যদি যায় তবু কি অন্য জল খায়
ঊর্ধ্বমুখে থাকে সদায়
নব ঘন জল চেয়ে

Lalon's Shrine Bangladesh, Source - Shahnoor Habib Munmun, This file is licensed under the Creative Commons Attribution 3.0 Unported license.
Lalon’s Shrine Bangladesh, Source – Shahnoor Habib Munmun, This file is licensed under the Creative Commons Attribution 3.0 Unported license.

ছেঁউড়িয়ায় আখড়া স্থাপন করে বহু শিষ্য-পরিবৃত হয়ে বাস করলেও ফকির লালন সাঁইয়ের বিষয়াসক্তি একেবারেই ছিল না। পার্থিব সুখ-দুঃখের প্রতি তিনি ছিলেন চরমভাবে উদাসীন। তাঁর মনমধুকর সর্বদাই সংগীতরসে বিভোর হয়ে থাকত। তিনি আপন মনে গাইতেন :

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়

আপনভোলা ঈশ্বর নিবেদিতপ্রাণ সাধক ফকির গূঢ় তাৎপর্যপূর্ণ অজস্র আধ্যাত্মিক সংগীত রচনা করে একদিকে যেমন অধ্যাত্ম জগৎকে সমৃদ্ধ। করেছেন, অপরদিকে নিজের উচ্চ আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে জনমানসে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি রচনা করেছেন

আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়
পারে লয়ে যাও আমায়।

লালনের বেশকিছু রচনা থেকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তিনি কোনো ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে আদৌ আগ্রহী বা প্রভাবিত কিংবা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বিভেদ ও সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তাঁর গানে জাতপাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা বাংলা গীতিকবিতার জগতে মৌলিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তাই তো তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন –

তাইতে জাত ভিন্ন বলায়
কেউ মালায় কেউ তছবি গলায়
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কায় রে ॥

মানুষে মানুষে কোনোরকম ভেদাভেদে তিনি বিশ্বাস করতেন না। আর সেজন্যই তাঁর কণ্ঠে বলিষ্ঠ উচ্চারণে ধ্বনিত হয়েছে –

ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই। হিন্দু কি যবন বলে জাতের বিচার নাই ॥
তাঁর কাছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ এসবের কোনো মূল্য ছিল না। ছুৎমার্গের প্রতি

Lalon's ORS, Source - Iqbal Hossain, Wikimedia Commons, CC BY-SA 4.0
Lalon’s ORS, Source – Iqbal Hossain, Wikimedia Commons, CC BY-SA 4.0

কটাক্ষ করে তিনি রচনা করেন –

একই পাটনী দিচ্ছে কেওয়া কেউ খায় না কারও ছোঁয়া বিভিন্ন জল কে কোথায় পান
একই ঘাটে আসা যাওয়া

তিনি ছিলেন মানবতাবাদী, অধ্যাত্মবাদী এক মহান সংগীতসাধক। নিজের জাত সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে অবলীলায় তাঁর বিখ্যাত একটি গানে তিনি বলেছেন

সব লোকে কয়
লালন বলে জাতের কি রূপ
লালন কি জাত সংসারে দেখলাম না তা নজরে

লালন ফকিরের গান কখনো ‘লালনগীতি’ কখনো বা ‘লালনসংগীত’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। শিষ্য বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন তা কালে কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, মানুষের মুখে মুখে সেগুলো সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশিষ্ট লালন-গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন একাই তিন শতাধিক লালনগীতি সংগ্রহ করেছেন, যা তাঁর হারামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এই বিদগ্ধ গবেষকের লালন ফকিরের গান এবং লালন গীতিকা নামের অন্য দুটি গ্রন্থেও বহু লালনগীতি সংকলিত হয়েছে।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন সংগৃহীত লালনগীতি মাসিক প্রবাসী পত্রিকার হারামণি অংশে প্রকাশিত হতো। ফকির আনোয়ার হোসেন (মন্টু শাহ্) সম্পাদিত লালন সংগীত (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে লালন ফকিরের তিনশো গান সংকলিত হয়েছে। এছাড়া ওয়াকিল আহমেদের লালনগীতি সমগ্র, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বাংলার বাউল ও বাউল গান, মুহাম্মদ আবু তালিবের লালন শাহ্ ও লালন গীতিকা, শক্তিনাথ ঝাঁয়ের লালন সাঁই-এর গান, ম. মনিরউজ্জামানের লালন ফকিরের গান, মতিলাল দাস ও পীযূষকান্তি মহাপাত্রের লালন গীতিকা ইত্যাদি গ্রন্থে শত শত লালনগীতি রয়েছে।

উপরন্তু আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপকবৃন্দ বাউলসাধক লালন ও তাঁর গান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে যাচ্ছেন। কেননা তাঁর গানগুলো যেমন প্রেমরসসিক্ত তেমনি আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণ। শাশ্বত সত্য এবং চির সুন্দর তাঁর গানের বাণী ও সুর, মাটি আর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে যেন হয়ে যায় একাকার।

Lalon Tomb1, Source - Md. Saiful Aziz Shamseer, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.
Lalon Tomb1, Source – Md. Saiful Aziz Shamseer, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.

মিলন হবে কতো দিনে
আমার মনের মানুষেরও সনে ।

চাতক প্রায় অহর্নিশি
হবো বলে চরণ দাসী
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
কালারে হারায়ে তেমন
চেয়ে আছে কালো শশী লুকালে না পায় অন্বেষণ

ও তা হয় না কপাল গুণে ॥
ঐ রূপ হেরি এ দর্শনে।

সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অন্তিমলগ্নে রাতশেষে প্রিয় শিষ্য মতিজান, স্ত্রী বিশাখা, পালিতা কন্যা পেয়ারিনেসা, ভোলাই শাহ্ ও মনিরুদ্দিন শাহ্‌কে আহ্বান করে সাঁইজি মৃদুস্বরে আরম্ভ করেন তাঁর জীবনের শেষ সংগীত

“পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে। ক্ষম হে অপরাধ আমার এ ভব কারাগারে!

নিজ বাড়িতে রুগণ শয্যায় অধ্যাত্মবাদী সংগীতজ্ঞ সাধক ফকির লালন সাঁই তন্ময় হয়ে গেয়েই চলেছেন –

‘পাপী অধম জীব হে তোমার
তুমি যদি না করো পার দয়া প্রকাশ করে; পতিত পাবন পতিত নাশ
কে বলবে আর তোমারে।

ভোরের আলো মহান সুরসাধককে শেষবারের মতো দর্শনের জন্য কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়ার খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরে উঁকি দিলে, বাউলসম্রাটের সংগীত অতি ধীরে সমাপ্ত হয়। তারপর চাদর মুড়ি দিয়ে নীরবে নিস্তব্ধ হয়ে যান তিনি।

আধ্যাত্মিক সংগীতের মূর্ছনায় মুখরিত পরিবেশ যেন হঠাৎ করেই থমকে যায় ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক শুক্রবার (১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর) সবার অজান্তে। অতি কাছে থেকেও প্রিয় শিষ্যরা বুঝতে পারেনি তাদের প্রাণপ্রতিম ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ির গানের পাখি গানে গানে শেষবিদায় নিয়ে ১০০ বছর বয়স পেরিয়ে (মতান্তরে হিতকরী পত্রিকা অনুযায়ী ১১৬ বছর বয়সে) মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন।

Lalon Tomb, Source - Md. Saiful Aziz Shamseer, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.
Lalon Tomb, Source – Md. Saiful Aziz Shamseer, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.

আজো সারাদেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেঁউড়িয়ায় মিলিত হয়ে ফকির লালন সাঁইয়ের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর মৃত্যুর বারো দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী নামের একটি পাক্ষিক পত্রিকায় তৎকালীন প্রসিদ্ধ লেখক রাইচরণ তাঁর একটি রচনায় সর্বপ্রথম ফকির লালন সাঁইকে ‘মহাত্মা’ বলে আখ্যায়িত করেন।

জন্মসূত্রে লালন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং পরে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও হিন্দু বা মুসলিম পরিচয়ে তিনি জীবন ধারণ করেননি। তিনি ছিলেন মূলত সাধক কবি, নিজের মধ্যে পরম সত্যকে জানার সাধনা করেছেন একাগ্রচিত্তে। সাধনার মাধ্যমে হয়েছিলেন সে সময়ের একজন প্রধান সিদ্ধপুরুষ। সাধন তত্ত্বের কথা গানে গানে বলতে গিয়ে শৈল্পিক আঙ্গিকে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-গোত্র-সামাজিক অবস্থান ইত্যাদিকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে তাঁর রচনায় ও সুরে মানুষের জয়গানকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন নিঃসন্দেহে তা তুলনাহীন। তাই তো বাংলাদেশের তথা বাঙালি গীতিকবিদের মধ্যে সংগীতজ্ঞ ফকির লালন সাঁই এখনো অদ্বিতীয় এবং কালোত্তীর্ণ।

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ]

 

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ]
বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই [ Fakir Lalon Shai ]

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment