পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা

Table of Contents

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

কার্টেন (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি

০১.

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতায় কে না উদ্বেল হয়ে উঠবে। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে যাবে পূর্বে যা ঘটেছিল…অথবা কি করেছিলাম…।

অতীতের এই মন চঞ্চল করার কারণ কি জানে?

এসেকসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম। আর আমার সেই উদাস চোখের সামনে দিয়ে সবুজের সমারোহ একের পর এক সরে যাচ্ছে। ট্রেন তার আপন ছন্দে-তালে ছুটে চলেছে।

বহুযুগ পূর্বে একদিন এমনই এক ট্রেনে চেপে এই একই পথে আমি গিয়েছিলাম এক পথিকের ন্যায়। তার হিসেবে এখন আর নেই। সেই স্মৃতি শুধু বুকের ব্যথা বাড়ায়। তখন বেশি চঞ্চল হয়ে উঠি। জীবনের সেই সুমধুর, মহান অভিজ্ঞতা–চাওয়া, পাওয়ার সেইসব দিন ঝোড়ো বাতাসের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়।

মনে পড়ে ১৯১৫ সালের সেই দিনগুলি। যুবা আর্থার হেস্টিংস নিজেকে তখনই জ্ঞানবৃদ্ধ ভাবতে শিখে গিয়েছিল। যুদ্ধ প্রত্যাগত আর্থার হেস্টিংস কী এখন তেমনই আছে? কিন্তু যখন নিজের বর্তমান চেহারা ভেসে ওঠে তখনই সব ভুল ভেঙে যায়। এখন সূর্যাস্তের মত আমার সেই সৌন্দর্য অস্তমিত, মহাসিন্ধুর ওপারের ডাকে যে কখন সাড়া দিয়েছি খেয়ালই থাকে না। কিন্তু এই চিরন্তন নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। তবুও সেই সুখস্মৃতি আমাকে পিছনে টানে–কেন? যেতে নাহি দিব” বলে যেন টেনে ধরে রাখতে চায় আমাকে। আর এরই টানে ভেসে ওঠে ক্যাভেণ্ডিস-আমার প্রিয় বন্ধু। ওর হাতেই আমার জীবনের শুরু–সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি। যে মাটিতে সে শুয়ে আছে চিরকালের মত সেই টান কী অত সহজে মুছে যাবার। শুনেছি ক্যাভেণ্ডিসের মা-র পুনরায় বিবাহ হয়েছে– বাড়ি কিনেছেন স্টাইলস-এ।

স্টাইলস! আহ! ভাবতেই যেন শিরা-উপশিরার রক্ত কণিকা হাওয়ায় দুলে ওঠে। রোমাঞ্চিত, পুলকিত…. আরো কী সব আছে এই স্টাইলসে। তাকে ভোলা যায় না। তার স্মৃতি আজও মনের মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছে। সে কে? কার স্মৃতি? কার আবার? এরকুল পোয়ারো। –আহা! দেহে মনে রোমাঞ্চ জেগে ওঠে। এখন এরকুলই আমার নিকটতম বন্ধু। বেলজিয়ামে ওকে প্রথম চিনেছিলুম, স্টাইলসে তার প্রকৃত স্বরূপটি দেখে এক নতুন পৃথিবীর দ্বারা আমার মনের মলিনতা আলোকের ঝরণা ধারায় এখানেই তো ধুইয়ে দিল। তাই স্টাইলস শুধু একটি নামমাত্র আমার কাছে নয়, এ যেন বহু পথ পরিক্রমার পর এক তীর্থক্ষেত্র।

পূর্বের স্মৃতিগুলো সেলুলয়েডে যখন ভেসে যাচ্ছিল একের পর এক তখন বুঝতেও পারিনি এখানে একটা হত্যা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ব। অথচ এই রকম এক রহস্যময় হত্যার মধ্য দিয়েই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু এরকুল পোয়ারোকে পেয়েছিলুম। আর সেই সঙ্গে পেয়েছিলুম তার জীবন সঙ্গিনীকে। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে–হ্যায়। সেই দিন কী আর ফিরে আসবে কোনোদিন?

চতুর্দিকে শুধু পরিবর্তন আর পরিবর্তন আমার প্রিয়তমাশ্রী আর্জেনটিনার নরম মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত। জন ক্যাভেণ্ডিস মারা গেলেও তার জীবিত স্ত্রী মেরী আছে এখন ডেভনশায়ারে। লরেন্স ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সত্যি! সবকিছুর কী পরিবর্তন! যদি ফিরে আসত সেই উনিশশ ষোল সাল। কিন্তু সে কী আর ফিরবে? পুরানো কথার মধ্যে মনে হয় আর সে সব জেগে উঠবে না।

কিন্তু একটা কথা ভাবলে রোমাঞ্চিত হই যে পুরানো দিন থাক বা না থাক, আমি, স্টাইলস, এরকুল পোয়ারো–আমারা তো আছি। যেদিন পোয়ারোর চিঠি পেলাম সেদিন যেন পাগলের ন্যায় আনন্দে উন্মাদ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সব প্রভাতের সূর্যোদয়ের মত ঝলমল করছিল। সত্যি বলতে কী, সেই ঠিকানা, স্টাইলস কোর্ট, স্টাইলস এসেক্স প্রেরকের নামের পাশের দেখেই উদ্দাম উত্তাল হয়ে উঠে এক বিরল আচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলুম। আমার শিরা-উপশিরায় যে নাম মিশে আছে, সেই নাম আমায় দোলা দেবে এটাই তো স্বাভাবিক।

বিগত একবছর আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। শেষবারের মতন যখন তাকে দেখেছিলুম তখন মনটা শুধু যন্ত্রণায় টন্ করেই ওঠেনি। আঘাতও পেয়েছিলাম। আসলে আমি ওকে অন্য চোখে দেখতাম, ভাবতাম। কিন্তু সেদিন জরাজীর্ণ কুজ বৃদ্ধ পোয়ারোকে দেখে আমার সব কল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। পুরানো যাইটিস রোগে ও এখন পঙ্গু ও অথর্ব। শুনেছিলাম ঈজিপ্টে গিয়েছিল হৃত স্বাস্থ্য উদ্ধারে, কিন্তু তার বিন্দুমাত্রও দেখতে পেলাম না। এবার চিঠিতেও সেই কথা। যদিও প্রগতা ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তবুও স্বাস্থ্যের উন্নতি তেমন কিছু নেই।

এবং যে ঠিকানা থেকে চিঠিখানা পাচ্ছ তা দেখে নিশ্চয়ই তোমার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। ঠিক নয়? সেই স্টাইলস। হাঃ হাঃ। ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ছুটে এসে তোমায় নিশ্চয়ই চাবকে দিচ্ছে। আর ঘুরে ফিরে আমিও এসে উঠেছি সেই স্টাইলসে। তবে বন্ধু স্টাইলসের সেই বাড়ি আর নেই। এখন একে বলতে পারো এক পান্থশালা। ভারতবর্ষ আর মুনার কথা তোমার মনে পড়ছে নিশ্চয়ই। সেই সময়কার তোমার এক বন্ধু এখন এর মালিক। খুব ভালো… খুব ভালো তবে কী জানো তোমার এই কর্নেল বন্ধুটির অবস্থা দেখে আমার হৃদয় মথিত হয়। আসলে তার স্ত্রীই প্রকৃত মালিক। হায় কর্নেল! অনেক ভাগ্যে এমন একটি স্ত্রীরত্ন জুটেছে তার কপালে। জিভ তো নয় শানানো ছুরি। কেঁচো হয়ে থাকেন তোমার কর্নেল বন্ধু। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই কর্নেলের জায়গায় যদি আমি হতাম তবে কোনোদিন না জানি কাস্তের এক কোপ বসিয়ে দিতাম তার গলায়।

যাক সে কথা

কাগজে একদিন বিজ্ঞাপন দেখলাম। মনটা কেমন করে উঠল। হাজার হোক পুরনো স্মৃতি তো। কেবল পিছু টানে। এলাম বলে, মারো লাগাম চালাও ঘোড়া। ঠিক তাই না? এখানে এসেই দেখি রাজ্যের সব চেনা মানুষের ভীড়। তোমার মেয়ে আছে। আছে ওর মনিবের বন্ধু। যদিও খুব মাধার শুরের ব্যারন। তার পর ফ্রঙ্কলিন দম্পতি আসছে গরমের ছুটি কাটাতে। দেখে শুনে মনটা তোমার জন্য আনচান করে উঠল। তুমিই বা বাদ থাকবে কেন? একা একা কোথায় ঘুরে মরবে। তাই এই আমন্ত্রণ! সবাই মিলেমিশে খুব হৈ হৈ করে কটা দিন কাটানো যাবে।

কাজেই, চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবে। কোনো বাধা না মেনে। পিছু সব টান ফেলে। হ্যাঁ ভয় পেও না। তোমার উপযুক্ত একটা ঘরও ঠিক করে ফেলেছি। বাথরুম টাথরুম সহ চমৎকার একঘর। (মনে করো দেখি সেই পুরনো স্টাইলসকে। এতসব আড়ম্বর কী তখন ছিল।) মিসেস কর্নেল লাটরেল অবশ্য এত কম ভাড়ায় ঘর দিতে চায়নি। কিন্তু আমি যে নাছোড়বান্দা। শুনছে কে। সব প্রস্তুত, অতএব হে রথী, চলে এসো মহারণে।

তোমার চিরকালের
এরকুল পোয়ারো

এই দুরন্ত আহ্বান অতিক্রম করা অসাধ্য। রাঁধাবাড়ার জন্য কেউ নেই। মেয়ে-ছেলেদের মধ্যে একছেলে নৌবাহিনীতে, একছেলে আর্জেনটিনায় গরুমোষের খাটাল করে আছে, একমেয়ে গ্রেস সৈন্যবাহিনীর একজনকে বিয়ে করে ভারতবর্ষে ঘর বেঁধেছে। অবশ্য ছোট মেয়ে জুডিথকে নিয়ে মনে একটা অশান্তি আছে। বড় জেদী ও একগুঁয়ে মেয়ে। সব সন্তানদের থেকে ওকে একটু বেশি ভালোবাসারই ফল এটি। সব ছেলে মেয়েদের মধ্যে বেশি সুন্দর হওয়ায় হয় তো বেশিই আদর করে ফেলেছি ওকে। কিন্তু ফলটা হয়েছে এইরূপ কারো কথা শোনে না, কারো যুক্তি নেয় না। নিজের খেয়ালে চলে। অস্বস্তি বোধ হয়েছে; ভেবেছি এই জেদী স্বভাব কোথা থেকে পেল ও। আমি ও জুডিথের মা দুজনেই ছিলাম সরল প্রকৃতির, কিন্তু ও ঠিক উল্টোটা। হয়তো ওর প্রখর বুদ্ধি ও সব কিছু জানার স্পৃহা থেকে এই রকম হয়েছে। ওর পড়াশোনায় আমি বাধা দিইনি, ফলে বিজ্ঞানে ডিগ্রী পেয়েছে অবলীলায়, কিন্তু, তারপর যে কাজ সে নির্বাচন করল তার জন্য একজন আমার মতন বিপত্নীক ভদ্রলোকের দুশ্চিন্তার কারণ। ওর সহজাত জেদী স্বভাবই এর জন্য দায়ী। শুনেছি এক গ্রীষ্মপ্রধান দেশের এক দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কারের নেশায় পাগল হয়ে রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছেন এক ডাক্তার ভদ্রলোক। জুডিথ তারই সেক্রেটারী। এটা মাথাব্যথার কারণ না হলেও ব্যাপারটা হল ওঁর পঙ্গু শয্যাশায়ী স্ত্রীকে নিয়ে। পিতা হিসাবে কর্তব্যের খাতিরে, ওঁর সঙ্গে জুডিথের কোনো বাজে সম্পর্ক আছে কিনা খোঁজ নিয়েছিলুম। কিন্তু তেমন কোনো সংবাদও পাইনি, অথবা তাদের মধ্যে মালিক কর্মচারী ভিন্ন কোনো সম্পর্কও লক্ষ্য করিনি।

জুডিথ আমায় শ্রদ্ধাভক্তি করলেও মাঝে মাঝে ওর ব্যবহারে আমি নার্ভাস হয়ে পড়ি যখন ও আমার কোনো পরামর্শ, স্থিতধী চিন্তাকে সেকেলে বলে উড়িয়ে দেয়।

স্টাইলস সেন্ট মেরী স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই আমি তটস্থ হয়ে উঠি। পুরানো স্মৃতি অন্য খাতে বয়ে চলে। স্টেশনের দিকে মনসংযোগ করতেই বুঝতে পারি সময় চলে গেলেও পুরানো পরিবেশ, সেই ঘর বাড়ি, সে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, গাছের সমারোহ সবই এখনও আছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম, অনেক কিছু বদলে গেছে। একটা পেট্রল পাম্প, একটা সিনেমা হল, গুটিকয় সুদৃশ্য সরাইখানা, কয়েকটি বৃহৎ অট্টালিকা চোখে পড়ল, যা আগে ছিল না।

কিন্তু স্টাইলস-এ এসে মনে হল, এখানে আধুনিকতা প্রবেশ করেনি। সবই এক আছে। বৃদ্ধ বটগাছের মত আমার লীলাভূমি দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে লন ধরে হেঁটে অদুরে চোখে পড়ল এক মহিলা জীর্ণ ফুলচারায় জল দিচ্ছেন। ট্যাক্সির গেট খোলার শব্দেই হয়তো ঘুরে আমার দিকে দাঁড়ালেন।

তাকে দেখে মনে হয়েছিল এভিলিন হাওয়ার্ড। কিন্তু জরাজীর্ণ চেহারা, গালবসা, বাদামী ছোপ হনুর উপর সাদা চুল, গর্তে বসা দুটো নীল চোখ দেখে মনে হল এ এভিলিন নয়। আমাকে দেখে উনি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।

আহ! যদি ভুল না হয়ে থাকে নিশ্চয়ই মিঃ হেস্টিংস। কী সৌভাগ্য। এতক্ষণ আপনার আলোচনাই হচ্ছিল। ইস! দেখুন আমার দুটো হাতেই কী জঞ্জাল। একটু অভ্যর্থনা করব, উপায় নেই। কিছু মনে করলেন না তো? আমি, আমি মিসেস লাটরেল। আপনি জিজ্ঞেস না করতেই পরিচয় দিলাম। জানেন মিঃ হেস্টিংস, আমি আর আমার স্বামীর কী যে ভুত চাপল কিনে ফেললাম এই নোংরা বাড়িটা। কিন্তু মশাই, আমি একটু গাঁট কাটা বলতে পারেন। পয়সার খোঁজ পেলে ছাড়ি না। কিছু একটা করতে হবে তো। করে দিলাম সারইখানা। দু পয়সা আসবে। বৃদ্ধ বয়সের সংস্থান চাই তো। হিঃ হিঃ

নিজেকে জাহির করছে বুঝতে পারলেও হাসতে হল ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু বুঝতে পারলুম আক্ষরিক অর্থে তিনি ব্যবসায়ী, বাইরে চপলতা প্রকাশ করলেও ভিতরে ভিতরে তিনি ঘাঘু মাল।

জানতে চাইলাম, আমার বন্ধু পোয়ারোর খবর কী? দারুণ দুশ্চিন্তার সঙ্গে উত্তর দিলেন, কী মানুষ হয়ে গেছেন, কেবল আপনার কথাই বলছেন। রোগটাও যন্ত্রণা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে বুঝি আপনার সঙ্গে দেখা হলেই পৃথিবীর মায়া কাটাবেন। ততক্ষণে আমরা এগোতে শুরু করেছি। তারপর মিঃ হেস্টিংস, কিসেস লাটরেল শোনাচ্ছিলেন, আপনার মেয়ে জুডিথের কথা কী বলব। এমন সুন্দরী সুশ্রী মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। ওর ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ। তবে কি জানেন, আমরা পুরনো দিনের মানুষ। আজকালকার মেয়েদের ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এই তো কচি বয়স। কোথায় হৈ হুল্লোড় করে বেড়াবে তা নয় আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ীর মত চোখে মাইক্রোসকোপ এঁটে বসে আছে।

কোথায় ও জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে তিনি বললেন, হয় ল্যাবরেটরি বা স্টুডিও ঘরে মুখ থুবড়ে বসে আছে। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ঘর ভাড়া নিয়ে এসব করছেন আমি বাধা দেবার কে? ঐ নিরীহ অবলা গিনিপিগ, ইঁদুরগুলোকে নিয়ে কাটাছেঁড়া নৃশংস কাণ্ডকারখানা দেখলে গা জ্বলে ওঠে। তারপর বললেন আসুন মিঃ হেস্টিংস, আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

দাঁড়কাকের মত, ছিপছিপে লম্বা, মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, কোটরাগত নীলচোখ, গোঁফে অনবরত তা দিচ্ছে, চলাফেরায় অসংবৃত এক বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়ালেন।

ওহ-জর্জ, মুখিয়ে উঠলেন লাটরেল, তুমি যেন দিনকে দিন হাঁদাভোঁদা হয়ে যাচ্ছো। বললাম তো ইনিই ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। পাগলের ন্যায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে করমর্দন করে বললেন –মানে–পাঁচটা চল্লিশের গাড়িতেই এলেন বুঝি? একটু চড়া গলায়, শাসনের সুরে বললেন, ওই ছাড়া আর কী গাড়ি আছে? আর গাড়ি নিয়ে কী হবে ওঁকে উপরে নিয়ে যাও। পারলে তোমার মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘরটাও বুঝিয়ে দিও। তারপর সুর পাল্টে আমি চা খাব কিনা জিজ্ঞেস করলেন।

করুণ হেসে ঘাড় নাড়লুম। না এখনই আমার চা খাবার প্রয়োজন নেই।

গেটের কাছে আমার নামানো জিনিসপত্রগুলো দেখে মিনমিনে গলায় কর্নেল লাটরেল স্ত্রীকে বললেন- ডেই লি ক্যাপ্টেনের জিনিসপত্রগুলো–সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ওটা কী মেয়েদের কাজ। তাছাড়া চোখের মাথা কী খেয়ে বসে আছো? দেখছো না–কথা শেষ না করে তিনি জোড়া হাত দেখালেন। থতমত খেয়ে মিঃ কর্নেল বললেন, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

ওঁকে দেখে মায়া হল, তাই তাড়াতাড়ি ওঁনাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। ভিতরে ঢুকতে গিয়েই একজন হন্তদন্ত হয়ে আগত–ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিলাম। লোকটির কুঁজো, তোতলা, রোগ, সাদা চুল, হাতে একজোড়া কিন্তু গ্লাভস–তাতেই চলছিল বলে হয়তো দেখতে পায়নি। কর্নেলকে বললেন–ওই যে ডুমুর গা-গাছ, ওটাতে একজোড়া শ্যামা বাসা বাঁধছে, কী সু-সুন্দর। বলেই কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল পরিচয় দিলে-মিঃ নরটন। পাখি দেখলেই পাগল হয়ে যায়। এমনিতে সাধাসিধে।

মস্ত এক হলঘরের ভিতরে মোটাসোটা এক চেহারার ভদ্রলোক টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হল এই মাত্র কোনো কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঘুরেই তাকালেন। যতদোষ যেন মিঃ লাটরেলের এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, সব ব্যাটা শয়তান। বুঝেছেন মিঃ লাটরেল। ওই হাড়হাভাতে কনট্রাক্টর আর আর্কিটেক্টরদের টিকির দেখা নেই, ব্যাটারা সব ভেবেছ কী। তাদের ছাড়াব ভেবেছেন––শূন্যে-ওঁনার হাত চালানো দেখে আমরা হেসে উঠলাম। ভদ্রলোকের ঋজু, সুপুরুষ, চেহারা যেমন সমীহ জাগায় তেমনি আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

কর্নেল বিনীত ভঙ্গিতেই বললেন–ইনি বিরাট ব্যক্তি। স্যার উইলিয়াম বয়েড ক্যারিংটন। যিনি এক প্রদেশের গভর্ণর একসময়ে ছিলেন, ভারতবর্ষে এক কিংবদন্তী ব্যক্তি, নামকরা প্রশাসক ও দক্ষ শিকারী বলে খ্যাত, তিনি আমার সামনে, এ রীতিমত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাকে দেখে বাক্যরোধ হল, আজ এঁদের আমরা ভুলতে বসলেও একসময় এঁরা দেশের জন্য অনেক করেছেন।

বলিষ্ঠ হাতে করমর্দন করে বললেন, কী সাংঘাতিক, রক্ত মাংসের সেই মিঃ হেস্টিংস! মঁসিয়ে পোয়ারো তো আপনার নামে পাগল, আর তাকেই আমি দেখতে পেলাম। আর হেসে বললেন, উপরি পাওনা হিসেবে পেয়ে গেছি আপনার মেয়ে জুডিথকে। চমৎকার মেয়ে। অপূর্ব।

লজ্জিত হয়ে বললুম, এতটা বোধহয় আমার পাওনা নয়, মিঃ ক্যারিংটন। তাছাড়া আমার মেয়ে নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে এত প্রগলভ নয়। ক্যারিংটন বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সম্পর্কে উদাসীন। ওদের চোখে বাবা-মা এখন অবাঞ্ছিত বোঝার মতন। তিনি আরো বললেন, আমার দুর্ভাগ্য বলতে পারেন আমার কোনো সন্তান নেই। জুডিথ সুন্দরী, লাবণ্যময়ী। চলাফেরায় একটু অহমিকা জড়িয়ে থাকে। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে মিঃ লাটরেলকে তেতো তেতো মুখ করে বললেন–কিছু মনে করবেন না, মিঃ লাটরেল। আপনার ফোন যথেচ্ছ ব্যবহার করছি বলে। ঘেন্না ধরে গেছে এখানকার এক্সচেঞ্জের উপর। ব্যাটাদের যদি সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকে। আমার অত ধৈর্য নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনের জন্য বসে থাকব

লাটরেল বললেন, চেষ্টা করে দেখুন। তারপর লাটরেলের সঙ্গে দোতলায় বা-হাতি একটা ঘরের সামনে থামলাম। বহুবছর পূর্বে এখানে উঠেছিলুম। আসার পথে দেখলাম ঘরগুলোর মধ্যে পার্টিশান করে ঘর বানানো হয়েছে, পরিবর্তন সর্বত্র।

ঘরটা সেই পুরনো দিনের মত বলে একটু ঘিন্ন হলুম। পুরনো একটা চেয়ার টেবিল, সামান্য জায়গা নিয়ে বাথরুম। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে লাগেজ এসে গেছে। মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘর আমার ঘরের উল্টোদিকে। মাঝখানে শুধু করিডোরের বাবধান। আমি মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘরে যেতে প্রস্তুত কিনা একতলা থেকে নারীকণ্ট ভেসে এল জর্জ। ভয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, মিসেস লাটরেল, মি-মিস্টার হেস্টিংস, যদি কিছু প্রয়োজন হয় জানাবেন– নিচ থেকে সেই ভীষণ কণ্ঠ ভেসে এল জর্জ। যাচ্ছি এই যে, আ–আমি আসছি, মিঃ হেস্টিংসকথা শেষ না করেই দ্রুত তিনি নেমে গেলেন ওকে দেখে খুব কষ্ট হল। মিসেস লাটরেল সম্পর্কে এতটুকু অত্যুক্তি করেননি। ধীরে ধীরে পোয়ারোর ঘরের দিকে গেলুম ও দরজায় আলতো করে ঘা দিলুম…

 

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

০২.

ঘরে ঢুকে আমার মনে হল দিন-মাস বছরের সঙ্গে মানুষের চেহারার কী আশ্চর্য বিবর্তনই না ঘটে যায়! আমার সেই হতভাগ্য বন্ধু যার কাহিনী আমি এতকাল বিমূর্ত করেছি, শুনিয়েছি তার কীর্তি গাঁথা। আজ এভাবে তাকে দেখব ভাবতে পারিনি। সেই অস্বাভাবিক প্রাণোচ্ছল মানুষটির ছায়ামাত্র। একটা চাকা লাগানো চেয়ারে জড় অথর্বের মত বসেছিল। রোগে চামড়া কুঁচকে গেছে। কিন্তু বিখ্যাত কালো গোঁফ জোড়া এখনও আছে। একসময় বিখ্যাত কোম্পানির কলপ ব্যবহার করত, যদি এখনও সেই কলপ ব্যবহার করে তবে সেই নাটকের কুশীলব সেজে থাকার ইচ্ছেটা মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু আশ্চর্য চর্চকে সেই উজ্জ্বল তীক্ষ্ণচোখ দুটো এখনও আছে। কতক্ষণ নিঃস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, জ্ঞান ফিরল যখন পোয়ারো পুরানো দিনের মতন আহ! প্রিয় বন্ধু আমার। এসো, কাছে এসো-বলে আহ্বান করল।

আমার বুকের মধ্যে তখন এক ঝড় বইছিল। তবুও তাকে অভ্যাসবশতঃ সম্ভাষণ জানালুম। কাছে যেতেই আগের মতন পরম আশ্বাসে বলতে লাগল, আহ। আমার প্রিয় হেস্টিংস। আমার বন্ধু। ঠিক, ঠিক সেইরকম। সেই ঋজু দেহ। সেই চওড়া কাঁধ। সেই উজ্জ্বল প্রশস্ত ললাট। বন্ধু হেস্টিংস যা শুধু তোমাকেই মানায়। তোমারই বিশেষ গুণবলী। হ্যাঁ পরিবর্তন তো হয়েছেই, তবু বলব মেয়েরা এখনও তোমায় দেখে আকৃষ্ট হবে। উত্তরে বললাম এই বয়সেও? শুধু সে বলল, বন্ধুবর সেটা তোমার পা ফেলার উপর নির্ভর করছে। হাসতে হাসতে ওর কথা জানতে চাইলাম। একটা শ্বাসকে দীর্ঘায়িত করে পোয়ারো বলল, আর আমার কথা দেখতেই পাচ্ছ, একটি ভঙ্গুর, একটি অতীত স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সূর্যাস্ত নেমেছে জীবনে। এখন আমি চলচ্ছক্তিহীন পঙ্গু অথর্ব জীবমাত্র। মনের জোরে যা হোক একটু নড়াচড়া করি। একেবারে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তবে কি জানো বন্ধু, এখনও মনের গহনে সেই অন্তঃসলিলা নদীটি তিরতির করে বইছে।

মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, তোমার হার্ট এখনও বেশ মজবুত। মাথানেড়ে বলল, হার্টের কথা বলিনি, আমার এই মস্তিষ্কটি এখনও আগের মত কাজ করে চলেছে। তার এই শারীরিক কষ্ট অথচ বিনষ, অমায়িক ব্যবহার দেখে বললাম, কেমন আছো?

সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মন্দ নয়। তুমি যদি রিৎজ হোটেলের স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে তুলনা করো তবে নিশ্চয়ই হতাশ হবে। খাবার দাবারের কোনো জৌলুষ নেই। রান্না একেবারে যাচ্ছেতাই। আলু সেদ্ধ দেয়, বটে তবে তাতে যে নুন দিতে হবে তা খেয়াল থাকে না। সবকিছুই পানসে। ইংরেজ খানাপিনার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না।

সহানুভূতির সঙ্গে বললাম, তাহলে ভালো কোথায় আছো? থাক, খাওয়ার কষ্ট। কিন্তু আমায় থামিয়ে বললেন, এ কষ্ট আমি ইচ্ছে করেই বয়ে চলেছি। কেউ আমার এখানে এসে দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে বলেনি–ওর কথার মর্মার্থ না বুঝেই বললাম, বুঝেছি। যুদ্ধের পর যে হারে জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে এবং তোমার আয়ের পথ

কিন্তু আমায় থামিয়ে বলল, একদিকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে আছি। আমার আর্থিক কোনো কষ্ট নেই বা আর্থিক অনটনের জন্য আমি এখানে থাকছি না। খুশী হয়েই তখন বললাম ভালো লাগল সে সব কিছুই তোমার দুঃখকষ্টের কারণ নয়। ওর পাশে বসে বলতে লাগলাম, পুরনো স্টাইলের একটা মোহ আমার মধ্যে আছে। কতকাল পরে আমরা আবার মিলেছি। সেই পুরনো স্থান, স্মৃতি মনকে ভারাক্রান্ত করবে জেনেও এখানে ফিরে এসে আনন্দ পাচ্ছি, তোমারও নিশ্চয়ই হচ্ছে?

কিন্তু উদাসীনতার সঙ্গে সে বলল, তার তেমন কিছু হচ্ছে না। পুরনো স্মৃতি আমায় তাড়া করে না। ভুলে যেও না আমি বেলজিয়াম ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে এসেছিলাম অর্থকষ্টের তাড়নায়, বাঁচার তাগিদে, উদ্বাস্তু হয়ে, ভাবিনি ইংল্যাণ্ড কোনোদিন আমার বাসভূমি হবে। তোমার সুখ আর আমার সুখ হল নদীর এপার ওপার। তোমার সুখ তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাও-অপ্রতিভ হয়ে বললুম–মোটেই তা নয়। কিন্তু পোয়ারো মুচকি হেসে বলল যে সেই যে আমি একসঙ্গে দুটো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম, সেই স্মৃতিও আমি ওর উপর বহাল করব কিনা? ও ভোলেনি। আরো বলল, তখন তোমার দুটি মেয়েকে ভালোবেসে কী বিড়ম্বনায় পড়েছিলে তা তোমার চেখে মুখে ফুটে উঠেছিল। বিগলিত হয়ে পোয়রোর হাতদুটো ধরে বলি, সেদিন তুমি আমায় না বাঁচালে কে উদ্ধার করত। তোমার ভালোবাসা, তোমায় পেয়ে আমার এ জীবন ধন্য হয়ে গেছে।

পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলল, পিছনে তাকাবে না। সামনে তাকাও পিছনে যেমন দুঃখ আছে, তেমন সুখও আছে। এখনও হয়তো কিছু আছে।

কিন্তু আমি সেইসব সুখস্মৃতি শেষ করে দিতে চাই না বলে বিরক্তির সঙ্গেই বললাম, কী আছে সামনে? এই তো জীবন শেষ করে আনলুম। পোয়ারো হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, এখনও আমাদের সব কাজ শেষ হয়ে যায়নি, পোয়ারোকে দমিয়ে দেবার জন্য বললুম, দুজনেই বুড়ো হয়েছি। নতুন করে আর কী চাওয়ার বা পাওয়ার থাকতে পারে?

রহস্যময় এক হাসি হেসে বলল, আছে, আছে। বিভ্রান্ত হয়ে যাই, বলি কোথায়? পোয়ারো তখন এই বাড়ির দিকেই আঙুল দেখিয়ে বলল, এখানে।

অবাক হয়ে ভাবি, সত্যিই এখানে কোনো রহস্যময় ঘটনা তো চোখে পড়েনি, তবে কি থাকতে পারে এখানে?

একটু মদ নিয়ে পোয়ারো বলল, কেন আমি আবার সেই পুরনো স্টাইলস সেন্ট মেরীতে এসে উঠলাম জানো– এখানে একটি হত্যাকারীকে ফাঁদে ফেলব বলে ফাঁদ পেতে বসে আছি।

বৃদ্ধ, অথর্ব পঙ্গু হলেও এখনও রসিকতা আছে ওর মধ্যে। রহস্য জাল গুটিয়ে গুটিয়ে খুনীকে ফাঁদে ফেলার সময় তো অনেককাল আগে চলে গেছে। এ নিশ্চয়ই এর ছলনা মনে হল। আমার উৎসাহে ভাটা পড়তে দিতে চায় না বলে।

মরিয়া হয়ে আসল কথাটা জানতে চাইলুম। গলায় জোর এনে বলল, কাঠ খড় পুড়িয়ে এ বয়সে ছেলেমানুষী করে তোমাকে এখানে ডেকে আনার কোনো সাধ নেই। আমার দেহ পঙ্গু, অথর্ব হলেও মস্তিষ্ক সূর্যের ন্যায় দীপ্যমান। এখনও মস্তিষ্ক আমার আগ্নেয়গিরির মত অগ্ন্যুৎপাতে অভ্যস্ত, প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে আমার দেহ। এখন তুমি, আমার প্রিয় বন্ধু। আমার হাত-পায়ের কাজটা সারবে।

মনে হল ঠাট্টা করছে। কিন্তু ও বলল ঠাট্টা নয়, আমরা একবার শিকারে নেমে পড়তে চাই

মনশ্চক্ষে পোয়ারোকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলুম। তার মধ্যে কোনো ছলনা বা চপলতা নেই। তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল–শেষ পর্যন্ত তুমি আশ্বস্ত হয়েছে। আমাকে ভেবেছিলে হয়তো মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। বললাম-কী এমন গভীর রহস্য আছে এখানে, যেখানে তুমি সেই আগের পোয়ারো হয়ে উঠতে পারো? আমার এখনও এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ পরিচিত হয়ে ওঠেনি।

একটু গম্ভীর হয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল, কজনকে এ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছো? উত্তরে বললাম–লাস্টরেল দম্পতি, নরটন এবং বয়েড ক্যারিংটন।

হুম একটা গম্ভীর শব্দ করে, ভেবে পোয়ারো বলল, কিছু কিছু দেখেছো, সবটা নয়, সব দেখলে তখন তোমার মনে হবে চিন্তাভাবনাগুলো সোজা রেল লাইনের মতন। একটু অনুসন্ধিৎসু হয়ে বললাম, আর কে কে আছেন এখানে?

পোয়ারো বলল–ফ্রাঙ্কলিন দম্পতি, ফ্রাঙ্কলিন ডক্টর, তার রুগ্ন স্ত্রী, ডাক্তারের রুগ্ন স্ত্রীকে দেখাশোনার জন্য হাসপাতালের নার্স, তেমার মেয়ে জুডিথ, এক অ্যামারটন নামে ভদ্রলোক। সুন্দর, সুপুরুষ, মেয়েরা সহজেই মজে যাবে তার চেহারা দেখে। আর আছে মিস কেলি।

এবং এদের মধ্যেই একজন হত্যাকারী? –আলতো করে ছুঁড়ে দিলাম আমি।

পোয়ারো মন্তব্য করল, হা, এদের মধ্যে একজন হত্যাকারী।

পোয়ারো বললেন, একটু বিভ্রান্ত হয়েই, তোমার এমন মনে হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। ও শুধু বলল, এককথায় সব শেষ করে দেওয়া যাবে না। তবে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। একটা ছোট্ট বাক্স ও নিয়ে এল, চাবিটা আমাকে দিল- মনে হল পোয়ারো সেই পুরনো দিনে ফিরে এল। রহস্যের ঝাপি খুলবে। কোনো প্রতিবাদ না করে ঘরের কোণে রাখা বাক্সটার চাবি খুলে পোয়ারোর কোলের কাছে রেখে বসে উদগ্র আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম।

ডালা তুলে বাক্স থেকে ও সংবাদপত্র থেকে বেছে কেটে রাখা একগুচ্ছ কাটিং বার করল। টুকরোগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল- ওগুলো তোমার কাছে রাখো। এখন দেখার প্রয়োজন নেই। ওগুলো সময় মত দেখো। ওখানে কখন কখন ঘটে যাওয়া কিছু দুঃখজনক ঘটনার সংবাদ আছে, সব সত্য না হলে, তোমার চিন্তার খোরাক পাওয়া যাবে ওখানে। এবার অন্য কিছু দেখা যাক বলে, একপ্রস্থ কাগজ বাক্স থেকে বার করল যেখানে ওর হাতের লেখা দেখা গেল। বলল, চটপট পড়ে ফেলো। কতকগুলো ঘটনা আমি পর পর সাজিয়েছি। তোমার পড়া হয়ে গেলে আলোচনায় বসব। গভীর উৎসাহের সঙ্গে পড়তে শুরু করলাম। যেভাবে ও সাজিয়েছে ঠিক সেভাবে। ঘটনা ক–এথারিটন।

পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত, মনমরা, বদঅভ্যাসী, মদ ও হাশিসাসক্ত, স্ত্রী-যুবতীর প্রতি আসক্ত। স্বামীকে নিয়ে বড় ঝামেলা। এই মুহূর্তে এথারিটন মারা গেলেন। খাদ্যে বিষক্রিয়া, ডাক্তারেরা খুশী নন, পেটে সেঁকো বিষে মারা গেছে, তদন্তে জানা গেছে। মিসেস এথারিটনকে অ্যারেস্ট করা হল। মামলা রুজু হল হত্যার। কিছুদিন পূর্বে ভারতবর্ষে সিভিলিয়ান ছিলেন। মিসেসের একবন্ধু। চাকরি ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছেন। মিসেস তার প্রতি আসক্ত এ খবর পাওয়া না গেলেও দুজনের গোপন ভালোবাসার হদিশ মিলল। এই সিভিলিয়ান নাকি ভারতবর্ষ থেকে জাহাজে ফেরার সময় এক মহিলার প্রেমে পড়েন। মিসেস তাতে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। যদিও এ ঘটনা এথারিটনের মৃত্যুর পূর্ব না পরবর্তী ঘটনা তা জানা যায়নি। স্বামীর উচ্চুঙ্খল জীবনযাপন ও স্ত্রীর প্রতি নজর না দেওয়ার অভিযোগে মিসেস এথারিটন ছাড়া পেলেন। এবং খাদ্যে যে মিসেস এথারিটন বিষ মিশিয়েছেন তার প্রমাণও পুলিশ দেখাতে পারেনি। এর ঠিক দু বছর পরে মিসেস তো একদিন ঘুমের মধ্যে মারা যান। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন মৃত্যুর কারণ। ঘটনা খ মিস শার্পলস।

পঙ্গু, বর্ষীয়ান কুমারী। ভাইঝি ফ্রেডা ক্লে দেখাশোনা করে। মিস শার্পলস একদিন মারা গেলেন পেটের যন্ত্রণায়। ময়নাতদন্তে মরফিয়া পাওয়া যায়। তিনি পেটের যন্ত্রণায় প্রায়ই কষ্ট পেতেন। ফ্রেডা ক্লে স্বীকার করে যে অস্বাভাবিক পেটের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পিসি সেদিন বেশিমাত্রায় মরফিয়া নিয়েছিল। পুলিশ বলে এটি ইচ্ছাকৃত ঘটনা নিঃসন্দেহে কিন্তু পিসিকে মেরে ফ্রেডার কি লাভ তা জানতে না পারায় পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।

ঘটনা গ-এডওয়ার্ড রিগস।

কৃষি শ্রমিক। তার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে জমির মালিকের গোপন প্রণয় ছিল। একদিন হঠাৎ জমির মালিক ক্রেগ ও এডওয়ার্ডের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেল। রিগসের বন্দুক ছিল। পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে সেই বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। রিগসকে অ্যারেস্ট করা হল। প্রথমে মৃত্যুদণ্ড হলেও, মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল।

ঘটনা ঘ–ম্যাথু লিচফিল্ড।

নিষ্ঠুর বয়স্ক প্রকৃতির। চার মেয়ে। লিচফিল্ডের দাপটে সবাই তটস্থ। এক কানাকড়িও খরচ করে কাউকে দেয় না। এক সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরেন কে যেন হাতুড়ির ঘা বসিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়। হাসপাতালে মৃত্যু হয়। পুলিশি তদন্ত শুরু হলে, তার বড় মেয়ে মার্গারেট থানায় কবুল করে সেই বাবাকে মেরেছে। কারণ কী? না, বাবা বড় অত্যাচারী ও কৃপণ। পরের বোনেরা যাতে সুখে থাকে, সেই ভেবে একাজ সে করেছে। মিঃ লিচফিল্ড প্রভূত ধনসম্পত্তি রেখে গেছেন। বিচার কালে মার্গারেটের মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা গেল, হাসপাতালে ভর্তি করা হল এবং কিছুদিন পরে মারা গেল।

পর পর সাজানো ঘটনা, সুন্দর হলেও এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না। পোয়ারো চোখ বুজে বসেছিল, আমি থামতেই বলল–কেমন বুঝলে?

বললাম হুঁ যদিও তোমার এই পর্যায় ক্রমিক ঘটনায় কোনো খুঁত নেই, তবে বহুদিন পূর্বের ব্রাডলির মামলার কথা মনে আসছে। কাগজে পড়েছিলাম, ভদ্রমহিলা সুন্দরী ছিলেন।

কোনো কথা না বলে পোয়ারো মাথা ঝাঁকালো।

আমি নাছোড়বান্দা ভাবে বললাম, চুপ করে থাকলে হবে না এর রহস্য আমায় বুঝিয়ে বল।

কিন্তু উল্টে পোয়ারো বলল, ঘটনাগুলো তোমার কেমন লাগল?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বুঝিয়ে না দিলে বুঝতে পারব না। এখানে শুধু বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া পাঁচটি মৃত্যুর ঘটনাছাড়া কিছু নেই, সূক্ষ্মভাবেও কোনো মিল নেই এদের মধ্যে। একটি হিংসা থেকে, একটি অর্থের লোভে, একটি নির্দয় স্বামীর হাত থেকে মুক্তির জন্য, বাকি দুটোর কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে না পেলেও অতিরিক্ত সুরাপান এর কারণ হলেও হতে পারে। দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, এসব হত্যার মধ্যে কী কোনো যোগসূত্র আছে যা আমার নজর এড়িয়ে গেছে?

পোয়ারো বলল, সুন্দর বিশ্লেষণ। একটা ব্যাপার যা তুমি উল্লেখ করনি তা হল, এসব হত্যার মধ্যে সন্দেহের কোনোকিছুই নেই।

বিমূঢ় হয়ে বললুম, তোমার কথা বুঝতে পারলুম না।

মিসেস এথারিটনের মামলাটিই ধরো। তিনি খালাস পেয়েছেন ঠিকই, যদিও সবার মনেই স্থির বিশ্বাস ছিল তিনিই হত্যাকারী। তার পর ফ্রেডা ক্লে। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে বলল, কেউ কি ওর দিকে কুটি করে বলতে পেরেছে, হা তুমিই খুনী। তুমিই খুন করেছ। না, পারেনি। কারণ জুরীদের হাতে তেমন কোনো অকাট্য সাক্ষ্য ছিল না। রিগস বলছে সে মনেই করতে পারছে না যে সে-ই তার স্ত্রীর হত্যাকারী। অথবা, তার প্রণয়ীর যদিও এক্ষেত্রে সে ছাড়া আর কেউই খুনী হতে পারে না। একমাত্র মার্গারেট লিচফিল্ড বলেছিল সে তার বাবাকে আঘাত করেছে। অথচ সে মানসিক হাসপাতালে মারা গেল। আসলে প্রত্যেকটি ঘটনায় একজন না একজন অপরাধী থেকেই যাচ্ছে। এটা কি তোমার মনেই হচ্ছে না বন্ধু? বললাম, হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ঠিক বুঝতে পারছি না। পোয়ারো বলল, আমি ঠিক তোমাকে সত্যের সন্ধানে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ। ধর কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। প্রত্যেকটি ঘটনায় একটা যোগসূত্র আছে।

কিভাবে? ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না।

পোয়ারো আরো রহস্যময় হল। খুব গোপন কথা উচ্চারণ করার ভঙ্গিতে বলল, সেকথা উচ্চারণ করতে আমায় সাবধানী হতে হবে। কারণ অদৃশ্য সূত্রটি ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। এটাকে আরও স্পষ্ট করতে হবে। সমস্ত ঘটনাকে আমি যেভাবে ভেবেছি, তোমায় বলছি। ধর সমস্ত ঘটনার পিছনে এক্স-এর হাত আছে। কিন্তু সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে শুধু কল্পনামাত্র। আপাত দৃষ্টিতে হত্যার পিছনে তার কোনো উদ্দেশ্য নেই। শুধু একটি ঘটনায় তার ছায়া খুব কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। তবুও অস্পষ্ট যে সেই ঘটনার সময় এক্স এর খুব কাছে হলেও দু-শো মাইল দূরে থাকার কথা হিসেব মত। এখন এই ভদ্রলোকের পশ্চাৎপদ শুনে যাও। মিঃ এথারিটনের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা ছিল। একসময় রিগসের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকত। মিসেস ব্রাডলি তার খুব কাছাকাছি এসে ছিলেন। একটি ফটো পেয়েছি যেখানে এই ভদ্রলোক ফ্রেডা ক্লের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ লিচফিল্ড যেদিন মারা যান সেদিন এক্স খুব ধারে কাছেই ছিলেন। হঠাৎ পোয়ারো বলল, কেমন বুঝছো বন্ধু?

 

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

ওর দিকে তাকিয়ে বললাম যদিও বাড়াবাড়ি হচ্ছে তবুও বলতে পারি দুই কি তিনটি ক্ষেত্রে এক্স এর আনাগোনা সম্ভব। পাঁচটি ঘটনার ক্ষেত্রে…. না অতটা উদার হতে পারছি না।

পোয়ারো মুচকি হেসে বলল, একেবারে বিশ্বাস না হলেও উড়িয়ে দিতে পারছি না। তারপর বলল, এবার তোমায় একটু চমকে দেব। যদি বলি এক্স ভদ্রলোক এই বাড়িতেই আস্তানা গেড়েছে; তাহলে কেমন হয়?

যেন মহাশূন্যে তুলে, আমায় কেউ আছড়ে দিল। এ-এই বাড়িতে?

পোয়ারো আমার হৃদপিণ্ড মুচড়ে দেওয়ার জন্য যেন থমথমে গলায় বলল, যদি এতদিনের অভিজ্ঞতা মিথ্যে না হয়ে থাকে তবে এখানে আর একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে….

বহুক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। কে যেন আবার আমায় স্টাইলসের সেই ঘরে পোয়ারোর কাছে টেনে নিয়ে এল। বললাম এ হতে পারে না, যেমন করে থোক এ রুখতেই হবে।

অপার্থিব এক জ্যোতিতে পোয়ারোর মুখ উদ্ভাসিত হল। প্রথমে সস্নেহে পরে গভীর মমতায় বলল, হে আমার প্রিয় সুহৃদ। কী বলে তোমায় শ্রদ্ধা জানাব। এত নির্ভরতা তোমার আমার উপর। যদি তার সামান্যতমও দেখাতে পারতাম। হায় বন্ধু

পোয়ারোকে আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না। বললাম, তুমি পারো না এমন কোনো কাজ নেই। ও বলল, তোমার এই নির্ভরতার মর্যাদা যদি দিতে পারতাম তাহলে আমার চেয়ে কে বেশি সুখী হত? একটু ভেবে দেখ, একজন হত্যাকারীকে ফাঁদে ফেলা যায় কিন্তু হত্যাকে থামানো যায় কী ভাবে? এ কী কখনও সম্ভব?

পোয়ারোর হাত ধরে বললুম, তুমি পারো যদি তুমি আগে থেকে জেনে থাক কে সেই এক্স।

গভীর খেদের সঙ্গে বলল, যতটা ভাবছ, বাস্তবে ততটা স্বচ্ছ নয়। হয়তো তিনরকমভাবে আমরা কিছু একটা করলেও করতে পারতাম। প্রথমতঃ যার উপর আঘাত আসবে তাকে আগে থেকে সাবধান করে। তাকে বলতে পারি হত্যাকারীর অদৃশ্য খাড়া নেমে আসছে তোমার উপর। ভেবে দেখ বন্ধু এভাবে কোনো মানুষকে তুমি বুঝিয়ে উঠতে পারবে না, তোমার জীবন বিপন্ন। যদি বলা যায় হত্যাকারী আপনার খুব পরিচিত তবে সে হেসে উঠবে। ভাববে হয় রসিকতা, নয় তার উপর ঈর্ষান্বিত হয়েছে। তুমিই বল এ কাজ কি সম্ভব?

দ্বিতীয় পথ হল হত্যাকারীকে সতর্ক করে দেওয়া, সাবধান। যদি অমুক সময়ে খুন হয় তবে তুমিই খুনী এবং তখন তোমার জন্য ফাঁসির দড়ি অপেক্ষা করবে। এ তো খুব ছেলেমানুষী ব্যাপার। খুনীরা খুব চালাকচতুর, তখন সে অন্য পথ বেছে নেবে যা শত চেষ্টায় ধরতে পারবে না।

ও সামান্য থামতেই জিজ্ঞেস করলাম, তৃতীয় পথটি কি?

হা। বলল, এই পথটি মোটেই কুসুমাকীর্ণ নয়। তা হবে যেমন বুদ্ধিতে ক্ষুরধার তেমন চিন্তায় থাকবে নব নব উন্মেষণা। দৃষ্টি থাকবে জাগ্রত প্রহরীর মত, মন থাকবে বাতাসের মত গতিময়। প্রতিটি মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যুক্তি তর্ক দ্বারা আততায়ীর গতি প্রকৃতি বুঝতে হবে। তার মানসিক স্থিতিশীলতা বুঝতে হবে। যখনই চরম মুহূর্ত উদিত হবে ঝাঁপিয়ে পড়বে আততায়ীর উপর। যদি সবার প্রত্যক্ষ উপলব্ধির সামনে তার মনের বাসনাকে উন্মুক্ত করে দেখা যায় তবে যে দুটি প্রথমোক্ত কাজ আমরা করতে পারিনি, তা এবার করলেও করতে পারি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এসব ঘটনা ঘটানো মুস্কিল। খুনী তার ইচ্ছেটাকে সবার থেকে গোপন রাখবে, ফলে বাস্তবে কোনো প্রস্তুতি নিতে পারব না। যেহেতু তুমি ভদ্রলোক সেহেতু যিনি ঘটনা ঘটাতে পারেন তার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে পারবে না। তাই তৃতীয় পথ সম্বন্ধে আলোচনা করব কিনা ভাবছিলাম। নিজের সম্পর্কে গর্ববোধ করলেও আমি গর্দভ বনতে রাজী নই।

তাহলে আশু কর্তব্য কী?

হয়তো তিনটি চেষ্টাই চালিয়ে যেতে হবে যদিও প্রথমটা দুঃসাধ্য।

কেন, আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ওটাই সহজতর।

পোয়ারো বলল, হয়তো ঠিক। কিন্তু বন্ধু আসলে আমি এখনও ঠিক সেই লোকটিকে চিনে উঠতে পারিনি।

তুমিও জানো না! এবার রাজ্যের সব বিস্ময় আমার চোখ উপচে পড়ে।

পোয়ারো বলল, শতকরা একশভাগ সত্যি কিন্তু যে খুন হতে চলেছে তার পরিচয়টা জানা নেই। তাহলে বুঝতে পারছ কাজটা খুব সহজ নয়।

কিন্তু পোয়ারো খুনীর উদ্দেশ্য কী? সে কী চায়? কেন চায়?

হঠাৎ খুশী হয়ে উঠে বলল, শেষ পর্যন্ত তুমি ভাবতে শিখেছো দেখে আনন্দ হল।

আমি বুঝতে পারছি যে খুন হতে চলেছে তাকে না চিনলেও, এক্স কে চেনো।

মাথা নাচাতে নাচাতে পোয়ারো বলল, প্রাণসখা হে আমার, সেকথাটি এখনই বলছি না।

গোপন কথাটি গোপনেও শুনিয়ে যাও, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি।

কিন্তু কাজটি তো মোটেই করতে পারছি না প্রিয়। আমি চাই না দিনরাত তুমি খুনীর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকো, এই সেই খুনী যাকে ইচ্ছে করলে যে কোনো সময়ে ধরিয়ে দিতে পারি। তুমি কি ভেবেছো আমায়? এটুকু চেপে রাখতে পারব না? তুমি হাবে ভাবে দেখাবে আমি কিছুই জানি না–এরকম অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। তাতে খুব সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। তার থেকে এখন অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে থাকা যাক, যখন সময় হবে দুজনে আঁপিয়ে পড়ব।

বললাম, তুমি সেই আগের মতন ঘুঘুই আছো এবং হঠাৎ আমার কথার মাঝে দরজায় ঘা পড়ল। থেমে গেলুম।

পোয়ারো ডাকল–এস। দরজা ঠেলে আমার দুহিতা জুডিথ এল।

যদিও বর্ণনায় আমি চিরকাল কাঁচা তবুও আর সাধারণ পাঁচটা মেয়ের মতন বেশ লম্বা। ও প্রকৃত অর্থে সুন্দরী হলেও ওর সৌন্দর্যে উপচে পড়া যে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে সবসময়, তা বাবা হয়ে আমার ব্যথিত করে।

জুডিথের সেই জেদী স্বভাব এখনও বদলায়নি। আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না বা আদর করল না, শুধু হেসে জিজ্ঞেস করল, কখন এলে?

ওদের আধুনিকতার সঙ্গে কথা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, এই তো কিছুক্ষণ।

মিষ্টি অনুযোগের সঙ্গে বলল, বেশ চালাক হয়েছে তো, একটুও খবর দাওনি?

পোয়ারো হঠাৎ জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এখানকার খাওয়া দাওয়া, রান্নাবান্নার কথা সবই শুনিয়ে দিয়েছি পাছে তোমার পিতাঠাকুরের কষ্ট হয়।

জুডিথের এখানকার রান্না কী যাচ্ছেতাই? প্রশ্নের উত্তরে পোয়ারো বলল, কেন বোকা সাজার চেষ্টা করছ? দিনরাত ঐ খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে। নিজের ফুলের মতন আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ, নীলছোপ ধরেছে। তোমার বয়সের মেয়েরা শেখে সুন্দর সুন্দর রান্না করে স্বামীর হজমশক্তি কিভাবে বাড়াতে হয়। সে বয়সে তুমি টেস্ট টিউব নাড়াচাড়া ও মাইক্রোস্কোপে পোকামাকড় খুঁজে বেড়াচ্ছ।

জুডিথ গম্ভীরভাবে বলল, কোনোদিন আমার স্বামীটামী হবে না। বিয়েটা কী? সংসারে মেয়েদের কী আর কিছু করার নেই?

পোয়ারো কড়া অভিভাবকের মত বলল, বিয়েটা সবার আগে। সংসারে তাই হয়ে আসছে

জুডিথ পোয়ারোর সব কথা মেনে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।

পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন নয় বুড়ো বয়সে বুঝবে। এর মধ্যে ডঃ ফ্রাঙ্কলিন এলেন এবং তার সঙ্গে পরিচয় হল। বলিষ্ঠ, বছর পঁয়ত্রিশের যুবক। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল অন্যমনস্ক ধরনের।

ঘরে ঢুকেই পোয়ারোর চেয়ার একপাক ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, আমায় ক্ষমা করবেন।

ওর ছেলেমানুষী দেখে অবাক হবেন।

জুডিথ বলল, আমার বাবাকে নিশ্চয়ই চেনেন?

ফ্রাঙ্কলিন প্রথমে একটু লজ্জা পেয়ে তার পর আমার সঙ্গে করমর্দন করে বলে উঠল, শুনেছিলাম আপনি আসবেন। উত্তরের প্রত্যাশা না করেই জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল, জুডিথ তাহলে

জুডিথ বলল, এখন সময় দিতে পারছি না, বাবার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

ফ্রাঙ্কলিন সলজ্জ দৃষ্টিতে বলল, সত্যি মাঝে মাঝে আমি ভীষণ স্বার্থপর হয়ে পড়ি। ক্ষমা করবেন। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ হতেই বলে উঠল, বারবারাকে কথা দিয়ে দিলুম ডিনারের আগে উঠে কিছু পড়ে শোনাব, এখন চলি, বলে বেরিয়ে গেল।

জুডিথকে বললাম, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন এখন কেমন আছেন? আগের মত নেই। স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে।

বললাম, এ বয়সে অথর্ব হয়ে পড়া যে কি বেদনাদায়ক।

হঠাৎ জুডিথ ডাক্তারের পক্ষ হয়ে বলল, এ যে কী ভীষণ অবস্থা একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে। যারা রিসার্চ করেন তারা সবসময়ই চান একজন স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীকে পাশে।

আমি উম্মা প্রকাশ করে বললাম তোমরা, এই আজকালের ছেলেমেয়েরা বড় বেশি স্বার্থপর। কোনো দ্বিরুক্তি না করে জুডিথ বলল, আমি শুধু ওঁর প্রকৃত অবস্থার কথা বলেছি।

শুধু পোয়ারো বলল, এই সদাশিব ডাক্তারটির কর্তব্য বোধ আছে বলতে হয়, কেমন তাড়াতাড়ি চলে গেলেন স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু জুডিথ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ডাক্তার যেমন বোকা তেমন তার স্ত্রী। নার্স রাখা হয়েছে, দরকার হলে সে-ই পড়ে শোনাবে। আমি হলে এইসব ছেলেমানুষী বরদাস্ত করতাম না।

যার যেমন ইচ্ছে, বললুম আমি। পোয়ারোও বলল, খুকুমণি, তোমার সঙ্গে আমিও একমত হতে পারছি না। ফ্রাঙ্কলিনের স্ত্রী হয়তো সব সময় স্বামীকে চোখের সামনে রাখতে চান। জুডিথ নিজের মনে বলে গেল…. ভদ্রমহিলাটি কাণ্ডজ্ঞানহীন। না হলে ঐ সব বস্তাপচা উপন্যাস পড়ে শুনবে, ভালো জিনিস শুনবে না। আর দেখা হলেই নিজের স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য। উহঃ। অসহ্য, বড় একগুঁয়ে মহিলাটি। কেবল বেড়ালের মতন মিউমিউ করবে। আমি এইসব ঘ্যান ঘ্যানানি পছন্দ করি না, আর যে করে করুক না কেন।

আমি বলে উঠলুম, জুডিথ তোমার এই খুড়ো মশায় কিন্তু জাঁদরেল মেয়েদের বেশি পছন্দ করেন।

অমনি পোয়ারো ফেঁড়ন কেটে বলল, তোমার বাবা আবার সোনালী নরম চুলের টুসটুসে মেয়েদের বেশি পছন্দ করে। এর জন্য কম বিপাকে পড়তে হয়নি ওকে। জুডিথ হেসে বলল, তোমরা দুজনে কেউই কম যাও না।

জুডিথ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে পড়লুম, চানটানও সারা হয়নি।

পোয়ারো হুইলচেয়ারে আঁটা বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গেই এক নতুন ভৃত্য এল। ভর্জে কোথায়? বললাম, সে তো বহুকাল তোমার সঙ্গী ছিল।

ও দেশে গেছে, শরীর অসুস্থ। সবদিক দেখে শুনে শীঘ্রই ফিরবে। নতুন গৃহভৃত্যের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল, কারটিস এরপর আমারও ব্যবস্থা করো।

কারটিস হাসল। ওর চেহারাটা গোবেচারা ধরনের হলেও জবরদস্ত। ও চলে যাওয়ার পর পোয়ারো সেই কাগজগুলো বাক্সে তালা দিয়ে রাখল এবং আমিও ঘর ছাড়লাম।

.

০৪.

পোয়ারো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই খাবার টেবিলে একটু উন্মনা ছিলাম। চিন্তা ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সারাজীবন রহস্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে শারীরিক অপটুতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বৈকল্য ঘটাটাও ওর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই রহস্যের ভৌতিক কল্পনা করাটা স্বাভাবিক। হয়তো এথারটিনের স্বামীকে খুন, শ্রমিকের তার স্ত্রীকে খুন… ঐগুলো সবই ঘটেছে, কিন্তু এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায়? এসব তো আকছার ঘটে চলেছে। কিন্তু পোয়ারো সেই অদৃশ্য আততায়ীকে মনশ্চক্ষে দেখছে। কে সেই ভদ্রলোক?

পোয়ারোর চিন্তাধারাকে আমি ছোট করে দেখতে চাই না। হয়তো সত্যিই কোনো খুন হবে, আবার হয়তো নয়। ও আমার সাহায্য চাইছে অথছ খুনীর পরিচয় আমাকে জানাতে চায় না। অদ্ভুত! আমার উপর যদি ওর আস্থাই না থাকে তাহলে আমাকে কেন ওর চোখ-কান হতে বলবে? ওর ছেলেমানুষী দেখলে হাসি পায়। আমার মুখ দেখে নাকি সবাই বুঝে ফেলবে আমি কি ভাবছি। এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে।

ডিনারের ঘন্টা বাজল। হাসি মুখ নিয়েই ওখানে গেলাম। শুধু কে খুনী তো বোঝার চেষ্টা করব মনে মনে ভাবলাম। অনেক ভেবে মনে করলাম পোয়ারোর চিন্তা ভাবনাকে মর্যাদা দিতে হবে। মনে করে নিই এই একই ছাদের নিচে খুনীও আছে। কিন্তু। কে সে? এটা কি খুব সহজ কাজ?

মিস কেলি এবং মেজর এলারটনের সঙ্গে ডাইনিং রুমে যাওয়ার আগে পরিচয় হল। মিস কেলি দীর্ঘাঙ্গী, সুশ্রী, বয়স চৌত্রিশ হবে। এলারটনের দীর্ঘ দেহ এবং মেয়েদের আকৃষ্ট করার চেহারা দেখেই হয়তো একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। অথবা তার কথাবার্তার ধরন দেখে। যতই ওর পরিচয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততই আমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছি। হয়তো এর কারণ জুডিথের সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গতা। কেন যে মেয়েরা এই সব লোকগুলোকে এত পছন্দ করে ভেবে পাই না। লোকটির বয়স চল্লিশ হবে। মনে হয় মদ্যপান করেন বা রাত জেগে জুয়োটুয়ো খেলেন। কর্নেল লাটরেল, বয়েড ক্যারিংটন সবাই ওকে সমীহ করেন। শুধু এর প্রতিপত্তির জন্য?

খাবার টেবিলে বসে সবার দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। যদি পোয়ারোর মস্তিষ্ক বিকল না হয়ে থাকে তাহলে উপস্থিত এই সব মানুষগুলোর মধ্যেই খুনীও উপস্থিত। যদিও খুনী পুরুষ না মহিলা তা জানতে পারিনি। তবু অনুমান করতে পারি সে আমারই শ্রেণীভুক্ত।

খাবার ফাঁকে ভাবি নিশ্চয়ই বুড়ো লাটরেল নয় যেরকম দুর্বল আর সদাশিব মানুষ। নরটন, এরকম অস্থির মস্তিষ্কের যেরকম কিন্তু গ্লাস নিয়ে ছুটোছুটি করছিল। বয়েড ক্যারিংটন খ্যাতনামা ব্যক্তি, তার পক্ষে খুনীটুনী সাজা মানায় না। ফ্রাঙ্কলিন ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কারণ জুডিথ যেভাবে তার সঙ্গে মেলামেশা করে, তাহলে ও নিশ্চয়ই কোনো আঁচ পেত। মেজর এলারটনের চেহারার মধ্যে একটা মারকুটে ভাব আছে। দরকার পড়লে নিজের ঠাকুমার চামড়া ছাড়াতেও পিছপা হবে না। আর মেয়েদের সঙ্গে যেভাবে মেলামেশা করে, একটা সুন্দর অজুহাত তাতেই তৈরি করে নেয়া যায়।

পোয়ারোর কথানুযায়ী যদি এলারটনই এক্স হয়, তাহলে ওর নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। যারা মেয়েদের মধ্যে বেশি আনাগোনা করে, তাদের বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পোয়ারো তো জানায়নি এক্স পুরুষ না মহিলা? তাহলে কি মিস কেলি? বেশ চাপা স্বভাবের, একটা কাঠিন্য চেহারার মধ্যে আছে। এই টাইপের মহিলারা ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে, কিন্তু খাবার টেবিলে ওনার হাসিখুশী মেজাজ দেখে তা মনে হয় না। মিসেস লাটরেল, জুডিথ বা মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওদের কী খুনী ভাবা যায়?

উদ্ৰান্ত ভাবে ড্রয়িংরুমের জানলা দিয়ে বাইরের বাগানটা দেখতে দেখতে বহুযুগ আগের দিনগুলো মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল সিন্থিয়া মারকরকে, তার পাগলামী সোনালী চুল যেন ধানের শিসের মত হাওয়ায় দুলছিল। সেইসব স্মৃতি আজও আমায় বিচলিত, আনমনা করে…..।

জুডিথ পাশে এসে কী ভাবছ বাবা যখন বলল তখন ঘোর কাটল। বলল, খাবার টেবিলে অত চুপচাপ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিলে? সর্বনাশ, তাহলে কি ও টের পেয়ে গেল। বললাম, কই না তো। হয়তো পুরনো স্টাইলসের ছবি সবার মধ্যে দেখতে চাইছিলাম। ওঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম যুবা অবস্থায় তুমি এখানে ছিলে। আচ্ছা বাবা তখন এক বৃদ্ধা মহিলা এখানে খুন হয়েছিলেন না?

 

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

বললাম, হ্যাঁ, কেউ মারাত্মক বিষ তাকে দিয়েছিল।

ওকে দেখতে কেমন ছিল কুশ্রী না সুন্দরী?

ঠিক অতটা মনে নেই। তবে মহিলা বেশ দানশীলা ছিলেন, অন্তকরণও ভালো ছিল।

শ্লেষের সঙ্গে বলল, ও-দয়াবতী! আমি ভাবলাম না জানি কী। আন্তরিকভাবে তার পর বলল, আচ্ছা, তখনকার সব মানুষরা সুখী ছিলেন, না বাবা?

একটু আহত হলাম ওর প্রশ্নে। বললাম, মোটেই না।

বলল, কেন?

কারণ আছে। সবাই ভাবত, এখানে তারা বন্দী জীবনযাপন করছেন যেমন মিসেস ইঙ্গলথর্পপ, সেই দানশীলা মহিলা, অর্থের উপর কোনো ক্ষমতা ছিল না। তার যে সব সৎ ছেলেমেয়েরা ছিল তাদের নিজেদের ইচ্ছেমত অর্থকড়ি ব্যবহারের অধিকার ছিল না।

জুডিথ তিক্ত কণ্ঠে বলল, এইসব বুড়োবুড়িরা যে নিজে নিজেদের কী ভাবে? এইরকম একজন স্বার্থপর বদমেজাজী একজনকে আমি চিনি।

কার কথা বলছ?

উনি হলেন ফ্রাঙ্কলিনদের জানাশোনা এক ভদ্রলোক, লিচফিল্ড।

নামটা শুনেই চমকে উঠলাম।

ও আমার দিকে লক্ষ্য না করেই বলল, ভদ্রলোক ধনী হলেও নিজেদের মেয়েদের সঙ্গে কসাই-এর মতন ব্যবহার করত। কাউকে কানাকড়িও দিত না।

তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, তখন তার বড় মেয়ে তাকে খুন করল।

জুডিথ অবাক হয়ে বলল, খবরটা তাহলে তুমি পড়েছ। এর পেছনে ছিল না কোনো ঈর্ষা, শুধুই একটা ব্যক্তিগত পারিবারিক, ঘটনা। মার্গারেট লিচফিল্ড থানায় বলল সে তার বাবাকে খুন করেছে। সাহস ছিল, আমি হলে পারতাম না।

নিরাসক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কোনোটা পারতে না? খুন করা না, থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করা?

কোনোটাই নয়।

শুনে খুশী হলাম। ফ্রাঙ্কলিন কী বলে?

উনি বলেন-এ ঠিকই হয়েছে, পৃথিবীতে কেউ কারুর নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়।

শঙ্কিত ভাবে বললাম, জুডিথ এ মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। কে তোমার মাথায় এসব ঢোকাচ্ছে?

জুডিথ ভুরু নাচিয়ে বলল, কেউ না?

এসব আলোচনা মানসিক ও শারীরিক দুদিক থেকেই ক্ষতি করে। জুডিথ কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, যেটা বলতে এলাম; মিসেস ফ্রাঙ্কলিন তোমায় একবার দেখতে চান।

খাবার টেবিলে ওনাকে দেখতে না পেয়ে খারাপ লাগছিল, নিশ্চয়ই দেখা করব। ন্যাকামো, দুচোখে দেখতে পারি না, ঠোঁট বেঁকিয়ে জুডিথ কথাটা বলল।

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছোটরা এতও হৃদয়হীন হয়?

.

০৫.

যখন বয়স তিরিশ-ফিরিস তখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। ম্যাডোনার মত মুখশ্রী, উজ্জ্বল বাদামী চোখ, মাঝখানে সিৗথ কেটে চুল আঁচড়ানো, রোগা স্বচ্ছ মসৃণ কাঁচের মত চেহারা। বিছানায় বালিশ নিয়ে শুয়েছিলেন, ঈষৎ নীলাভ পাতলা গাউন পরে।

ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ও বয়েড ক্যারিংটন একপাশে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আমি ঢুকতেই উনি উঠে অভ্যর্থনা করলেন। আপনি এসেছেন শুনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। জুডিথও খুশি হবে। বড্ড বেশি খাটুনি যাচ্ছে ওর।

খাটের পাশে শূন্য চেয়ারে বসে বললাম, মনে হল এখানে ও বেশ ভালো আছে।

বারবারা ফ্রাঙ্কলিন একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, হয়তো আপনার কথা ঠিক। তবে ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে ওকে ভীষণ হিংসে হয়। ও সুস্থ সুখী বলেই হয়তো অসুখটা কী, বুঝতে পারে না। তবে আমাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য নার্স-ক্লাভেন আছে। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। আমাকে ও সারাক্ষণ বাচ্চা মেয়ের মত আগলে রাখে।

ক্লাভেনের সঙ্গে পরিচয় হল। আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভ্রমে মাথা নোয়ালো। দেখে মনে হল ঘরের সুন্দরী বৌ।

সত্যি বলতে কি জন নিষ্ঠুর জোতদারের মত ওর উপর ভীষণ কাজ চাপিয়ে দিয়েছে। কিছু ভুল বললাম জন। মিঃ ফ্রাঙ্কলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার ধারে গিয়েছিলেন। চমকে উঠে বললেন, কিছু বললে বারবারা?

হুঁ জুডিথকে ভীষণ খাটাচ্ছো। এখন মিঃ হেস্টিংস এসে পড়েছেন, আমি আর উনি দুজনে এখন জুডিথের সুখ সুবিধার দিকে নজর দিতে পারব।

জুডিথ হঠাৎ ঘরে ঢুকতে ওর দিকে তাকিয়ে ফ্রাঙ্কলিন বললেন, তোমাকে কি ভীষণ পরিশ্রম করাচ্ছি?

আমাদের দিকে এক পলক দেখে জুডিথ বলল, ওরা আপনার সঙ্গে মজা করছে। আমি জানতে এসেছিলাম কাঁচের টুকরোতে যে রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছে তার কী করবেন?

খুব ভালো করেছ মনে করিয়ে দিয়েছ। কিছু মনে করবে না, আমাকে এখনই একবার ল্যাবরেটরিতে যেতে হচ্ছে–আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। তারপর জুডিথ ও ফ্রাঙ্কলিন দুজনে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

সে সময় মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের চেহারা দেখে বড় কষ্ট হল। ক্লাভেন বলল, আসলে মিঃ ফ্রাঙ্কলিনের অত তাড়া থাকে না, মিস হেস্টিংস ওঁনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে।

লজ্জায় আমার মুখটা লাল হয়ে উঠল। বারবার নিজের মনেই বললেন, হা ঈশ্বর, আমি যদি এদের কোনো কাজে সাহায্য করতে পারতাম, ভীষণ খারাপ লাগে আমার।

ফায়ারপ্লেসের পাশে দাঁড়িয়ে বয়েড ক্যারিংটন বলল, ওসব বাজে কথা ভেবে নিজেকে ব্যস্ত কোরো না, তুমি বেশ সুস্থ আছো।

কান্নার গলায় বারবারা ফ্রাঙ্কলিন বলে উঠলেন, ও সব তুমি বুঝবে না, ঐ সব অবলা গিনিপিগ, ইঁদুর ধরে কেটে ফেলা…., উহঃ কি নিষ্ঠুর, প্রকৃতিতে এই সব প্রাণীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ আমি কি ভালোবাসি।

বয়েড ক্যারিংটন বারবারার বিছানার কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর প্রেমিকের মতন তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, তুমি একটুও বদলাওনি, সেই সতেরো বছরের কিশোরীর মত আছে। পুরোন স্মৃতিচারণা করতে করতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানেন আমরা দুজনে ছোটবেলার খেলার সঙ্গী ছিলাম।

বারবারা প্রতিবাদ করলেন, খেলার সঙ্গী

ওহঃ, আমি কি জানি না, তুমি আমার থেকে অন্ততঃ পনেরো বছরের ছোট হবে। বাচ্চা ছেলের মত তোমার সঙ্গে খেলা করেছি। যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে ফিরে এলাম, দেখলাম তুমি এক বিকশিত পূর্ণা যুবতী। তখনও তোমায় নিয়ে গলফ খেলেছি, খেলা শিখিয়েছি তোমার মনে নেই?

লজ্জায় বারবারার গাল লাল হয়ে উঠল, বেশ বুঝতে পারলাম।

সে ভুলবার কথা নয়। জানেন মিঃ হেস্টিংস, আমার পরিবারের লোকেরা একসময় এদিকটায় বাস করতেন। আর তখন বিল আসত ন্যাটনে ওর কাকা স্যার এভার্ডের কাছে বেড়াতে

ন্যাটন যাচ্ছেতাই। আমার মনে হত ওটা একটা কবরখানা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বারবারা আহত হলেন। বললেন, একটা কবরখানাকেও ইচ্ছে করলে মোহনীয় করে তোলা যায়

হয়তো যায়। আমার অত ধৈৰ্য্য বা কল্পনাশক্তি কোনোটাই নেই। ওসব সাজানো গোছানো মেয়েদের কাজ, পুরুষের নয়।

কেন আমিতো সব গুছিয়ে সুন্দর করে দেব বলেছি।

ক্লাভেনের দিকে তাকিয়ে ক্যারিংটন বললেন, যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে ওকে নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

সে তো, ভালো কথা। তাহলে ওঁরও একঘেয়েমী কাটবে। কিন্তু যেন বেশি পরিশ্রম না হয়–

আনন্দে লাফিয়ে উঠে ক্যারিংটন বললেন, তাহলে কাল আমি তোমায় নিয়ে যাব।

আমি এক নির্বাক শ্রোতা ও দর্শকের মত সব দেখতে শুনতে লাগলাম। তারপর আমি ও ক্যারিংটন বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। ক্যারিংটন আমার পাশে বসে বলল, জানেন সতেরো বছর বয়সে ও কত প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল। যখন বার্মা থেকে ফিরেছি দেশে, তখন স্ত্রী মারা গেছেন। কিছু মনে করবেন না, ওকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু সুখী হল না। ও একটু আবেগপ্রবণ। সামাণ্য আঘাতে নুইয়ে পড়ে। ওকে নিয়ে একটু বেড়াতে গেলে খুশীতে ভরে উঠে। কিন্তু স্বামীটা একটা হনুমান। দিনরাত টেস্টটিউব আর ল্যাবরেটরি নিয়ে পড়ে আছে…।

আড়চোখে একবার ক্যারিংটনকে দেখলাম। এই হাড় সর্বস্ব মহিলার মধ্যে তার মত দশাসই দেহের পুরুষ কি দেখতে পেয়েছে। ব্যবস বলতে অজ্ঞান।

নিচে নেমে আসার সময় লাটরেল পাকড়াও করল। বলল, একহাত ব্রিজ খেলা যাক।

সবিনয়ে জানালাম, ওটা আমার ধাতে সয় না। তাছাড়া অথর্ব পঙ্গু বন্ধুকে সঙ্গ দেওয়াটা জরুরী বলে মনে করি।

পোয়ারো বিছানায় বসে। কারটিস আমাকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। বললাম, কোথায় তুমি সাড়া বাড়ি তোলপাড় করে বেড়াবে, না বিছানায় বন্দী। আমি কিন্তু তোমার এক্স-এর পিছনে লেগে পড়েছি।

মুচকি হেসে বলল, ভালো, শুনে আশ্বস্ত হলাম। ইতিমধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে।

শুনে লজ্জা পেলাম, আন্দাজ করে ফেলেছো, জুডিথের কথা মনে হল কিন্তু কি করে সেকথা বলি?

কোনো সমাধানে পৌঁছতে পেরেছ কী?

না। তবে তোমার ওই নরটন মিঃ এক্স হতে পারে। তবে এটা অনুমান। অস্পষ্ট ভাবে একটা চিন্তা করেছি মাত্র। কিন্তু এই অস্পষ্ট বা ছায়া নিয়ে খেলারও রকমফের আছে।

 

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

কী রকম?

কোনো ঘটনা ঘটেনি এরকম একটা ঘটনার কথা ভাবা যাক। ধরো এক সাদাসিধে লোকের আবির্ভাব হল সেই খুনী। খুব মিশুকে, শোনা যাচ্ছে তার মাছ ধরার একটা নেশা আছে।

অথবা পাখি ধরার পোয়ারোর কথা মাঝে জুড়ে দিলাম।

পোয়ারো বলল, অন্য ভাবেও বলা যায়। মাংস বিক্রি করে। আর সেই ছুরিটি একদিন মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠবে ভাবা যায়নি

বাধা দিয়ে বললাম, বড্ড খাপছাড়া শোনাচ্ছে। যদি কোনোদিন ঐ মাংস বিক্রেতার সঙ্গে বিস্কুটওয়ালার তুমুল ঝগড়া হয়।

যদি না এই মাংস বিক্রেতা ঐ বিস্কুটওয়ালাকে খুনের পরিকল্পনা করে থাকে। তবে তা নয়। আমাদের ব্যাপারটা অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে।

পোয়ারোর কথা বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। কর্নেল লাটরেল কি তাহলে কাউকে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে অতিথিশালা খুলে বসেছেন? এমন ঘটনা তো আগেও ঘটেছে।

আমার বোকার মত মুখ দেখে পোয়ারো বলল, বন্ধু যদি আমার মুখ দেখে সব কথা বুঝে যাবে ভাবো, তাহলে ভুল করবে।

সত্যি পোয়ারো, আজও তোমায় বুঝতে পারলাম না। শুধু নরটনই নয়, এলারটনও আমার সন্দেহের উর্ধ্বে নয়

ও নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ নয়।

নিশ্চয়ই নয়–বললাম।

এদের আমরা ভালো চোখে দেখি না। ওরা মেয়েদের নিয়ে বড্ড বেশি মাতামাতি করে।

কেন যে মেয়েরা ঐ সব ফেরেববাজ লোকগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয় বুঝি না।

এটাই পৃথিবীর বিস্ময়কর নিদর্শন।

কেন এমন হয় বলতো?

সেটাই তো আমি তোমার কাছে জানতে চাই।

পোয়ারো বলল, এটাই পার্থিব জীবনের ভয়ঙ্কর খেলা। দেখো অনেকে ষাঁড়ের লড়াই দেখে মজা পায় আবার অনেকের কাছে তা দৃষ্টিকটু। মেয়েদের মধ্যে একটা বাঁধন ছেঁড়ার প্রবণতা আছে। তাই এই টাইপের পুরুষেরা ওদের বেশি টানে। অথচ কত ভালো ছেলে সুন্দরী মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয়ে ফিরে আসে।

এবার যেমন করে তোক আমি এক্সকে বার করবই। এলারটনই আমাকে জেদী করে তুলল।

বন্ধু তোমাকে ডেকেছি বিপাকে পা ফেলার জন্য নয়। একসময় আমরা একসাথে হেঁটেছি, এ পথটা যতটা সহজ ভাবছ ততটা নয়। এখানকার কেউ বরাহুত অথবা যে অর্থে আমরা হোটেল বুঝে থাকি, এখানকার স্টাইলকে সেভাবে দেখলে ভুল হবে। লাটরেল অর্থ সংকটে পড়েই এই অতিথিশালা খুলেছেন। এখানে যারা আছেন তারা ওদের বন্ধু বা বন্ধুদের পরিচিত। বয়েড ক্যারিংটন ফ্রাঙ্কলিনদের এখানে এনেছেন। আবার ফ্রাঙ্কলিনরা নরটনের জন্য সুপারিশ করেছেন। মনে হয় মিস কেলিও এই একই ভাবে এসেছেন। এখানে সবাই আত্মীয়ের মত আছে। তাহলে দেখ এক্স-এর এখানে কত সুবিধে। সে এল এবং অন্যকেও আসতে প্রলোভিত করল। এবার শ্রমিক রিগসের কথা মনে কর। যে গ্রামে সেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল তা বয়েড ক্যারিংটনের কাকার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ফ্রাঙ্কলিনরাও কাছাকাছি বাস করতেন। সেখানকার ঐ সরাইখানাটিতে অনেক মানুষের আনাগোনা ছিল। মিসেস ফ্রাঙ্কলিনদের পরিবারের লোকেরা এখানে বেড়াতে আসতেন। তিনি নিজেও কখনও কখনও এসেছেন। নরটন ও মিস কেলি ঐভাবেই ওদের কাছাকাছি এসেছে। না বন্ধু তোমাকে যে অগ্নিকুণ্ডের খোঁজ আমি দিইনি, তাতে তুমি অজান্তে হাত দিলে পুড়বে, তা হতে দিতে পারি না।

কী করব বল। ক্ষোভের সঙ্গে বললাম, তুমি আমায় এখন বিশ্বাস করে উঠতে পারছ না।

তুমি বুঝতে পারছ না বন্ধু। তোমার নিরাপত্তা আমার কাছে কতটা জরুরী যে পাঁচটা খুন করেছে সে যদি টের পায় কেউ তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে তাহলে সে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে।

পোয়ারোকে চেপে ধরে বললাম, তুমি কী এসবের উর্দ্ধে?

পোয়ারো গভীর দুঃখের সঙ্গে বলল, আমার চেয়ে তা আর কে বেশি জানে? সেইজন্যই তো তোমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে এনেছি।

পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Bangla Gurukul Logo পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা -কার্টেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

অদ্ভুত পার্টি চলছিল -প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মেজর ডেসপার্ডের ডিল ছিল -প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

একটা গোলমেলে ব্যাপার -প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

গম্ভীর স্বর ভেসে এল -প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

উপসংহার -ফাইভ লিটল পিগস্ ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

বনফুল (১৮৮০) | কাব্যগ্রন্থ | কবিতা সূচি | পর্যায় : সূচনা (১৮৭৮ – ১৮৮১) | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Leave a Comment