ছন্দোবিশ্লেষণ ছন্দ ও অলঙ্কার – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “ছন্দ ও অলঙ্কার” বিভাগের একটি পাঠ।
ছন্দোবিশ্লেষণ ছন্দ ও অলঙ্কার
ছন্দের বিশ্লেষণকালে নিম্নলিখিত দিকগুলো দেখতে হয় :
১. ছন্দের নাম।
২. ছন্দের লয় ও গতি।
৩. চরণে বা পঙ্ক্তিতে পর্ববিন্যাস।
৪. পর্বে মাত্রাবিন্যাস।
৫. স্তবকে চরণসংখ্যা।
কবিতার ছন্দ-নির্ণয়ের প্রাথমিক শর্ত, যথাযথভাবে যতি দিয়ে কবিতাটি পাঠ বা আবৃত্তি। কবিতায় যতিদানে যদি বিভ্রাট ঘটে, তাহলে ছন্দ মিলানো এক অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কবিতা যথাযথভাবে পাঠ করতে পারলে যেমন অর্থ- বোধে স্পষ্টতা আসে, তেমনি তা শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে।
কবিতা পাঠ করবার সময় লক্ষ রাখতে হবে, কবিতা পাঠের প্রথমেই একটা ধ্বনিতরঙ্গ বা ছন্দস্পন্দ সৃষ্টি হয় এবং সেই ধ্বনিতরঙ্গ সমস্ত কবিতাটা জুড়ে একইভাবে, সম ব্যবধানে আবর্তিত হতে থাকে। তরঙ্গটি যখনই নিচে নামে, তখনই যতিপাত হয়। এই যতি কিন্তু ‘ছেদ’ নয়, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এরপর ‘দল’ সম্বন্ধে ধারণাটা স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার। কারণ বাংলা শব্দ উচ্চারণে আমরা শব্দের দল-বিভাজনের ওপরই একান্তভাবে নির্ভরশীল। যে-কোনো শব্দকে বিশ্লেষণ করলে এক এক প্রচেষ্টায় তার যতটুকু করে উচ্চারণ করা যায়, ততটুকু এক একটা দল বা Syllable ।
একটা দলে একটাই স্বরবর্ণ থাকে। একটা স্বরবর্ণকে আশ্রয় করেই একটা দল গড়ে ওঠে। একটা দলে স্বরবর্ণ একটাই থাকে, কিন্তু ব্যঞ্জন থাকতে পারে একাধিক কিংবা একটাও নয়। – এ, কে, মা, টিক্, ধার্, হুম্, স্ত্রীর’- এদের প্রত্যেকটিই এক একটি দল।
একটি দলে যদি একের অধিক স্বরবর্ণ থাকে, তাও একই প্রচেষ্টায় উচ্চারিত হ’বে— ‘খৈ, দাও, দই, নাই’ প্রভৃতি। বানান দেখে দল ঠিক করা যাবে না, দল ঠিক করতে হবে উচ্চারণ ধরে। বাংলায় শব্দের শেষে অনেক সময় হসন্ত চিহ্ন থাকে না, কিন্তু উচ্চারণে থাকে : ‘জল, ফুল, ঘাস’— এগুলোতে হসন্ত চিহ্ন দেওয়া না হলেও উচ্চারণে আসে, তাই এদের প্রত্যেকটি এক একটি দল (জল্, ফুল্, ঘাস্)। ‘রবীন্দ্রনাথ’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাই— র, ‘বী, দ্ৰ নাথ- দল এখানে ৪টি, এদের মধ্যে ‘র’ ও ‘দ্র’ স্বরান্ত এবং ‘বীন্’ ও ‘নাথ্’, হসন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত।
স্বরান্ত দলের নাম মুক্তদল ও ব্যঞ্জনান্ত দলের নাম রুদ্ধদল। ‘দাও’-কে আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করি- এখানে ‘ও’ যেন অপূর্ণ বা অর্ধোচ্চারিত। ‘ও’– অতএব ‘দাও’ একটি মাত্র দল এবং রুদ্ধদল। পক্ষান্তরে ‘দিও’-কে উচ্চারণ করি ‘দি+ও’- এরকম বিচ্ছিন্নভাবে, তাই এখানে দুটি দল (দি, ও) এবং দুটিই মুক্তদল। অতএব দুটি বা তার চেয়ে বেশি স্বর যদি একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, তবে তা হয় যৌগিক স্বর এবং যৌগিকস্বর সর্বদাই রুদ্ধদল ৷ রুদ্ধদলের ব্যাপারটা খবর এবং যৌগি খুব পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া দরকার, কারণ এর ব্যবহারের ওপরই ছন্দের জাতিত্ব নির্ভর করছে।
যখন কোনো ছন্দে সব রুদ্ধদলের উচ্চারণ বিশ্লিষ্ট তথা সম্প্রসারিত অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক তখন ‘মাত্রাবৃত্ত ছন্দ’ : পদান্তের রুদ্ধদল বিশ্লিষ্ট, সম্প্রসারিত বা দ্বিমাত্রিক, কিন্তু পদের আদি ও মধ্যস্থিত রুদ্ধদল সম্প্রসারিত নয়; সংশ্লিষ্ট এবং উচ্চারণ -বিশিষ্ট তখন একমাত্রিক, তখন তা ‘অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’, এবং যখন সব রুদ্ধদলের উচ্চারণই সংশ্লিষ্ট এবং একমাত্রা-বি ‘স্বরবৃত্ত’ ছন্দ।
প্রত্নমাত্রাবৃত্ত ছাড়া অপর তিন জাতীয় ছন্দেই মুক্ত দল একমাত্রিক। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রতি পূর্ণ পর্বের মাত্রাসংখ্যা ৪, ৫, ৬ ও ৭ বা ক্বচিৎ ৮ হয়। অক্ষরবৃত্তের মাত্রা ৬, ৮ বা ১০, প্রবোধবাবুর অক্ষরবৃত্তে বিজোড় মাত্রাসংখ্যা কখনও স্থান পায় না। স্বরবৃত্ত ছন্দে পূর্ণ পর্বের মাত্রাসংখ্যা সর্বদাই ৪ দলও 8, সাধারণত এর কম-বেশি হয় না।
ক্বচিৎ দলের সংখ্যার হেরফের হলে মাত্রা সম্প্রসারণ বা সঙ্কোচন ঘটিয়ে ৪ মাত্রায় আনা হয়। দৃষ্টিগ্রাহ্য অক্ষরের হিসেবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যত অক্ষর তত মাত্রা, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অক্ষর অপেক্ষা মাত্রাসংখ্যা সাধারণত বেশি ও স্বরবৃত্ত ছন্দে অক্ষর অপেক্ষা মাত্রাসংখ্যা কম হয়ে থাকে। হয়ে থাকে। পর্বের ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই, তবে সাধারণত দুই থেকে পাঁচ পূর্ণ-পর্বের মধ্যেই চরণ সীমিত থাকে। প্রতি চরণের পর্ব সংখ্যা সমান নাও হতে পারে। সাধারণত চরণের শেষ পর্বটি থাকে অপূর্ণ বা খণ্ড। ক্বচিৎ কোনো চরণের আরম্ভে একটি খণ্ড পর্ব থাকতে পারে, যাকে বলা হয় ‘অতিপর্ব’।
স্বরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত প্রতি চরণের তিনটি পূর্ণ ও একটি অপূর্ণ পর্ব থাকে, তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। পর্বসমতা নিশ্ছিদ্র ছন্দ রচনার একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। যে কোনো একটি কবিতা এক জাতীয় ছন্দেই রচিত হয় এবং তার প্রত্যেকটি পূর্ণ পর্বের মাত্রাসংখ্যা সমান হতেই হবে (ব্যতিক্রম থাকতে পারে শুধু প্রবহমান ছন্দে)। অপূর্ণ পর্বের বা খণ্ড পর্বের মাত্রাসংখ্যা ব্যাপারে কোনো স্থিরতা নেই, কোনো বিধিনিষেধও নেই। বিভিন্ন চরণের অপূর্ণ পর্বের মাত্রাসংখ্যায় হেরফের ঘটতে পারে।
ছন্দোবিশ্লেষণের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয় সম্বন্ধে অবহিত থাকা প্রয়োজন : প্রথমেই কবিতাটা পড়তে হবে থেমে থেমে, একটানা গড়গড় করে নয়। এখন যথাস্থানে থামতে না পারলেই বিপদ। যে কোনো বাংলা কবিতা পাঠকালে দেখা যায়, নিয়মিত ব্যবধানে যতি পড়বেই-ব্যবধানটা মাত্রাগত অর্থাৎ সময়সীমা মেনে চলে।
যেখানে জিহ্বার স্বাভাবিক বিরাম ঘটবে, সেখানেই যতিচিহ্ন (লম্বা দাঁড়ি) দিতে হবে। এভাবে আরম্ভ থেকে অথবা এক যতিচিহ্ন থেকে আর এক যতিচিহ্ন পর্যন্ত হলো একটি একটা পর্ব। এক কবিতার প্রতিটি সমান, এই সমাজের মাপটা হবে কানের মানে, চোখের গো। এরা কিন্তুক টা তিনি যদি কবিতার প্রতি গড়ে, তবেই বিবে পড়তে গেলেই হোঁচট্ খেতে হবে।
ছন্দ চেনবার দুটি পদ্ধতি :
সমস্ত কবিতার যতিচিহ্ন দ্বারা পর্ব ভাগ হয়ে যাবার পর প্রতিটি অক্ষরের মাথায় দলচিহ্ন দিতে হবে। এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন, কারণ দলচিহ্নে ভুল হলে আর ছন্দ মেলানো যাবে না। এরপর দেখতে হবে কবিতার স্তবকটি কোন্ ছন্দে রচিত। এটি বোঝবার জন্য দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করা চলে।
যথাস্থানে রুদ্ধদল-মুক্তদল চিহ্ন দেবার পর এর প্রত্যেকটা পর্বের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখতে হবে— কোথাও কোনো পূর্ণ পর্বে সবগুলো মুক্তদল পাওয়া যাচ্ছে কিনা। সাধারণত অনেক কবিতাতেই এরূপ মুক্তদল পর্বের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। মুক্তদল পর্বে যতগুলো দল, সাধারণত ততগুলোই মাত্রা হবে, কারণ প্রত্নমাত্রাবৃত্ত ছন্দ ছাড়া অপর সব রকম ছন্দেই মুক্তদল একমাত্রিক।
এবার অন্য পর্বগুলোর অক্ষরসংখ্যার দিকে নজর দিতে হবে-যদি দেখা যায়, কোনো পর্বে মাত্রাসংখ্যার চেয়ে অক্ষরসংখ্যা কম আছে তখন ধরে নিতে হবে, এর ছন্দ হবে মাত্রাবৃত্ত; কারণ ওই পর্বে নিশ্চিত কোনো-না-কোনো রুদ্ধদল থাকবেই, আর ওই রুদ্ধদলে দু মাত্রা দিলেই পূর্বোক্ত দলের মাত্রাসংখ্যার সঙ্গে এটি সমান হবে। যদি দেখা যায়, সব পর্বেই অক্ষরসংখ্যা ওই মুক্তদল পর্বের মাত্রাসংখ্যার সঙ্গে সমান, তবে ধরে নিতে হবে ওই কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত, শুধু পদান্তস্থিত রুদ্ধদলগুলোতে দু মাত্রা দিলেই মাত্রাসংখ্যা সব সমান হয়ে যাবে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অপর বৈশিষ্ট্য- এর সব পূর্ণ পর্বেই অক্ষরসংখ্যা সমান এবং সেই সংখ্যা কখনো বিজোড় নয়। আবার যদি দেখা যায়, ওই মুক্তদল পর্বে যতগুলো মাত্রা, অপর কোনো পর্বের অক্ষরসংখ্যা এ মাত্রাসংখ্যার চেয়ে বেশি, ধরে নিতে হবে ওটি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। এর প্রতিটি পর্বেই সাধারণত দলের সংখ্যা ৪ এবং অধিকাংশ পর্বেই রুদ্ধদল মুক্তদল দুই-ই থাকে। রুদ্ধ-মুক্ত নির্বিশেষে একমাত্রা দিলেই সব পর্বের মাত্রাসংখ্যা সমান হবে। তবে স্বরবৃত্ত ছন্দে ক্বচিৎ কোনো পর্বের দলসংখ্যা দুই বা তিনও হতে পারে।

এখানে কেবল পূর্ণ পর্বের কথাই হলো, চরণের আদিতে অতি পর্ব বা চরণান্তিক প্রান্তিক অপূর্ণ বা খণ্ডপর্বে মাত্রাসংখ্যা পূর্ণ পর্বাপেক্ষা কম হয়, কাজেই ওগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি সর্ব অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য। যদি কোনো পর্বে সবগুলো মুক্তদল না পাওয়া যায় কিংবা পাওয়া যায়- উভয় ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা চলে। পর্বগুলো দল চিহ্নিত হলেই সর্বপ্রথম খেয়াল ক্রতে হবে, এটি স্বরবৃত্ত ছন্দ কি-না। স্বরবৃত্ত ছন্দ চেনার সহজ উপায়– এতে প্রতি পূর্ণ পর্বেই ৪টি দল থাকে।
ক্বচিৎ ব্যতিক্রম-রূপে ৩টি বা ২টি দল থাকতে পারে। তবে সাধারণত প্রতি পর্বে ৪টি দল থাকলে তা স্বরবৃত্ত হবেই। এইক্ষেত্রে প্রতি দলে (রুদ্ধ-মুক্ত নির্বিশেষে) একমাত্রা দিতে হবে। যদি প্রতিটি পর্বের দলসংখ্যা ৪ না হয়, তখন দেখতে হবে, এটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কিনা। এই ছন্দে প্রতি পূর্ণ পর্বের অক্ষরসংখ্যা সমান হবে এবং ৬, ৮– এরূপ জোড় সংখ্যক হবে। এক্ষেত্রে পদের অন্তে অর্থাৎ প্রান্তিক রুদ্ধদলে ২ মাত্রা, একদল শব্দ রুদ্ধদল হলে ২ মাত্রা, আর সব রুদ্ধদল এবং মুক্তদল ১ মাত্রা।
উপর্যুক্ত পদ্ধতিতে যদি কোনো কবিতা স্বরবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্তরূপে ধরা না পড়ে, তবে এটিকে মাত্রাবৃত্ত ধরে নিয়ে বীজী সেইভাবে মাত্রা দিতে হবে এক্ষেত্রে সব রুদ্ধদল ২ মাত্রা এবং সব মুক্তদল ১ মাত্রা। সর্বশেষ পর্বের মাত্রাসংখ্যা গুনে দেখতে হবে পর্বের মাত্রাসমতা বর্তমান আছে কি না। যদি মাত্রাসমতা বর্তমান না থাকে, তবে এর প্রত্নমাত্রাবৃত্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো Tags মাত্রা দিয়ে মাত্রাসমতা আনতে হবে।
যদি তাতেও না হয়, তবে পদে সাধারণভাবে ৪ দলের অধিক ও দু’-একটি ব্যতিক্রম থাকলে দেখতে হবে ওই- পর্বগুলোতে কোন দলের মাত্রা সম্প্রসারণ বা সঙ্কোচনে মোট ৪ মাত্রা হয় কি না। যদি হয়, তবে এটি স্বরবৃত্ত ছন্দ। নতুবা গোটা চরণটিতে ছন্দঃপতন ঘটাই সম্ভব। নিচের ছকটি অনুসরণ করলে ছন্দ সহজেই শনাক্ত করা যাবে :
আরও দেখুন: