পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাদিশাহ কামরান

পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাদিশাহ কামরান

মক্কার উদ্দেশ্যে দীর্ঘযাত্রায় আসকারি রওয়ানা দেয়ার পাঁচমাস পরে, বসন্তের সূচনালগ্নে একদিন খুব সকালে, হুমায়ুন তাঁর দূর্গ প্রাসাদে নিজের আবাসন কক্ষের পাথরের জানালা যেখান থেকে কাবুল দেখা যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের পাহাড়ী এলাকার দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। গত কয়েক সপ্তাহে যদি তুষারপাত হয়নি কিন্তু তাঁদের উঁচুনীচু চূড়াগুলো এখনও বরফাবৃত। বাতাসে এখনও হাড় কাঁপান শীতের আমজে এবং হুমায়ুন তার পশমের আস্তরণযুক্ত আলখাল্লাটা ভালোমতো শরীরের সাথে জড়িয়ে নেয়। বছরের এই সময়ে হিন্দুস্তান থেকে খুব অল্পসংখ্যক পথিকই গিরিপথ অতিক্রম করে কিন্তু হুমায়ুন যখন তাকিয়ে থাকে, দেখে একটা ক্ষুদ্র কাফেলা দক্ষিণে হিন্দুস্তানের দিকে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে সেটার বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসছে।

কাফেলাটা নিকটবর্তী হলে, হুমায়ুন দেখে সামান্য সংখ্যক অশ্বারোহী, তাঁদের সংখ্যা খুব বেশী হলে বিশজন হবে- সম্ভবত বণিক আর তাঁদের পরিচারক- এবং বিশ ত্রিশটা মালবাহী উট রয়েছে কাফেলায়। শীতের কবল থেকে বাঁচতে অশ্বারোহীদের সবারই পরণে ভেড়ার চামড়ার ভারী আলখাল্লা এবং প্রায় সবাই নিজেদের মুখ গলবস্ত্র দিয়ে মুড়ে রেখেছে। শীতের বাতাসে উটের উষ্ণ নিঃশ্বাস ভেসে থাকে যখন প্রাণীগুলো তাদের পিঠের দুপাশে ঝোলান পণ্যসামগ্রী দিয়ে ঠাসা ভারী ঝুড়ি নিয়ে শ্রান্তভঙ্গিতে মন্থর গতিতে উপরে উঠে আসে এবং শহরের প্রশস্ত প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ঠিক ভিতরে অবস্থিত সরাইখানাগুলোর একটার দিকে এগিয়ে যায়। কাফেলাটা দশ মিনিট পরে শহরের তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সরাইখানায় ঢুকে যেতে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়। হুমায়ুন কিছুক্ষণ পরেই অতিথিদের খাবার আর উষ্ণতা দিতে সরাইখানার চিমনি দিয়ে অতিরিক্ত ঘোয়ার কুণ্ডলী নির্গত হতে দেখে।

কাফেলার বিষয়ে আর কোনো চিন্তা না করে, হুমায়ুন নীচে দূর্গের আঙ্গিনার দিকে তাকায়- যেখানে বৈরাম খান দশ বছরের আকবরকে অসিযুদ্ধের কিছু সূক্ষ কৌশল দেখিয়ে দিচ্ছে এবং আকবরের দুধ-ভাই আধম খান দাঁড়িয়ে দেখছে। আকবর- তাঁর বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় শক্তিশালী, পেশীবহুল- বৈরাম খানের তরবারির আঘাত ঠেকানোর জন্য স্পষ্টতই একটা কৌশলে দক্ষ হয়ে উঠেছে। সে নীচু হয়ে তাঁর ওস্তাদের ঢাল এড়িয়ে গিয়ে নিজের ভোঁতা তরবারি দিয়ে প্রশিক্ষণের সময়ে পরিহিত পুরু প্রতিরক্ষা আবরণে আঘাত করে।

আকবর আর বৈরাম খান দম নেবার জন্য প্রশিক্ষণ বন্ধ করলে, হুমায়ুন দেখে ভেড়ার চামড়ার ভারী হাতাওয়ালা আলখাল্লা পরিহিত একটা লোক, তার মুখ একটা লাল পশমী কাপড়ের নীচে ঢাকা পড়ে রয়েছে, আঙ্গিনায় প্রবেশ করছে। লোকটা জরুরী ভঙ্গিতে প্রহরীদের একজনের সাথে কথা বলে, যে প্রথমে আধিকারিকদের বাসস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে এবং তারপরে হুমায়ুনের নিজস্ব আবাসন কক্ষ দেখিয়ে দেয়। দশ মিনিট পরে, হুমায়ুন দরজায় একটা করাঘাত শুনতে পায় এবং জওহর ভিতরে প্রবেশ করে। সুলতান, আহমেদ খানের গুপ্তচরদের একজন দক্ষিণের সংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছে। আহমেদ খান গুপ্তচরকে সশরীরে আপনার সামনে হাজির করে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে আপনার দর্শন প্রার্থনা করেছেন। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের ভেতরে নিয়ে এসো।

আহমেদ খানের অতি পরিচিত ছোপ ছোপ দাড়িঅলা চেহারা, কিছুক্ষণ পরে দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। হুমায়ুন ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট পরিহিত যে লোকটাকে আঙ্গিনায় দেখেছিল, সে আহমেদ খানের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটা তার মুখ থেকে লাল পশমের গলবস্ত্র আর মাথার টুপি খুলে রাখায় কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মাথার পাতলা হয়ে আসা কালো চুল দেখা যায়, দুটোর কারণেই সম্ভবত তার যা বয়স, তাকে তার চেয়ে বেশী বয়স্ক মনে হয়। আহমেদ খান আর নবাগত লোকটা মাথা নীচু করে অভিবাদন জানায়।

আহমেদ খান, কি ব্যাপার?

সুলতান, এর নাম হুসেন খলিল- আমাদের সবচেয়ে সেরা আর বিশ্বস্ত গুপ্তচর। সে কিছুক্ষণ আগে দক্ষিণে খোস্তের আশেপাশের এলাকার সংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছে।

আমি এইমাত্র যে কাফেলাটা শহরে প্রবেশ করতে দেখেছি, সেই কাফেলার সাথে সে এসেছে, তাই না? শহরে পৌঁছাবার পরে একপাত্র গরম স্যুপ কিংবা সরাইখানায় সদ্য প্রজ্জ্বলিত আগুনের সামনে বসে নিজেকে খানিকটা উষ্ণ না করে এত দ্রুত যদি সে আমাদের সাথে দেখা করতে আসে, তাহলে সে স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বয়ে এনেছে।

সংবাদটা একাধারে গুরুত্বপূর্ণ আর সেই সাথে ভয়ানক। খোস্তের দক্ষিণে সৈন্য সগ্রহ করে আপনার সৎ-ভাই কামরান আরো একটা বিদ্রোহের পায়তারা করছে।

হুমায়ুন চোখ মুখ কুঁচকে চুপ করে থাকে। সে এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য আপাতভাবে প্রস্তুতই ছিল কিন্তু আশা করেছিল যে হয়ত শুনতে হবে না। হিন্দালের মৃত্যু আর হজ্জের উদ্দেশ্যে আসকারি রওয়ানা দেবার পরে, হুমায়ুনের সৈন্যদের নিবিড় তল্লাশি সত্ত্বেও কামরান যেন পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে হারিয়ে গিয়েছিল। হুমায়ুন নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে কামরান হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে তার উচিত সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করা এবং কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় পশ্চাদপসরণ করা কিংবা নির্বাসনে গিয়ে, হিন্দুস্তানের সিংহাসন খোয়াবার পরে এই প্রথম হুমায়ুনকে তাঁর সমস্ত লোকবল আর প্রচেষ্টা স্বাধীনভাবে সেটা পুনরুদ্ধারে নিবদ্ধ করা।

হুমায়ুন অবশ্য মনে মনে ঠিকই জানতো যে তাঁর ভ্রাতৃসম শত্রুদের ভিতরে কামরান সবচেয়ে দৃঢ়সংকল্প আর উদ্যমী এবং এটা অসম্ভব সে তার বিদ্রোহের প্রয়াস পরিহার করে হুমায়ুনকে স্বাধীনভাবে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেবে। তাদের ভিতরে কোনো ধরনের শান্তি, কোনো ধরনের সন্ধি হওয়া অসম্ভব। কামরান কখনও তার মনের গভীরে গেঁথে যাওয়া বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ বর্জন করেনি, যে বয়সে পাঁচ মাসের বড় হবার কারণে বাবর মারা যাবার আগে তাকেই সবকিছু দিয়ে গিয়েছে। সে সম্ভবত এটাও মনে মনে বিশ্বাস করে যে, বাবর তাঁর চেয়ে অপদার্থ হুমায়ুনকে বেশী ভালোবাসতো- খুব সম্ভব তাঁর কুটিল চরিত্রে মা গুলরুখ এই ধারণাটা ছেলের ভেতরে ঢুকিয়েছে। হুমায়ুন এসব কিছুই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না কিন্তু সে জানে, তাঁকে আরো একবার তার সৎ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং এইবার চিরতরে তাঁর হুমকির সমাপ্তি ঘটাতে হবে। কামরান ঠিক কোনো জায়গায় রয়েছে?

বালুচ আর আমাদের আফগান ভূখণ্ডের সীমানার কাছে, আহমেদ খান উত্তর দেয়। উঁচু পাহাড়, নির্জন উপত্যকা আর দূরবর্তী গুহার কারণে এলাকাটা বিদ্রোহী আর ডাকাতদের আত্মগোপন করে থাকার জন্য দারুণ এবং স্থানীয়দের সমর্থণ ছাড়া কারো পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা অসম্ভব। কিন্তু হুসেন খলিল হয়ত তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বলতে আগ্রহী?

অবশ্যই।

হুসেন খলিল এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর স্থানান্তর করে এবং চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ রেখে খানিকটা সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলতে আরম্ভ করে, সে কথা বলার সাথে সাথে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে।

আহমেদ খানের আদেশে আমি অটমান ঔষধবিক্রেতার ছদ্মবেশে দক্ষিণে গমন করি- ঔষধপত্রের বিষয়ে আমার যৎসামান্য জ্ঞান আছে। আমি খোস্তের কাছাকাছি পৌঁছাবার পরে আমি একটা গুজব শুনতে পাই যে সেখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে একটা দুর্গম পাহাড়ী দূর্গে আপনার সৎ-ভাই আশ্রয় নিয়েছে। আমি সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নেই এবং খাড়া, পাথুরে রাস্তা, অগণিত গিরিপথ আর ছোট, আঁকাবাঁকা, কিন্তু খরস্রোতা নদী অতিক্রম করে একাকী রওয়ানা দেই। আমি যখন গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাই, লক্ষ্য করি যে পথের ধারে অবস্থিত বিশ্রামাগার আর চায়ের দোকানগুলোয় লোকের উপচে পড়া ভীড়। দোকানগুলোর প্রায় সব খরিদ্দারই আমার মতো একই দিকে ভ্রমণ করছে। তাদের প্রায় সবাই সশস্ত্র এবং শক্তসমর্থ। আপনার সৎ-ভাইয়ের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য তাঁরা রওয়ানা হয়েছে সেটা বোঝার জন্য খুব একটা মাথা খাটাবার প্রয়োজন হয় না এবং বস্তুত পক্ষে তাঁদের অনেকেই মনেপ্রাণে এতটাই প্রস্তুত যে কথাটা তারা লুকাবার দরকারও মনে করে না। আমি অবশ্য তারপরেও দূর্গটা নিজের চোখে দেখতে এবং ফিরে আসবার আগে সেখানে আপনার সৎ-ভাই কামরানের উপস্থিতি আর তাঁর অনুগত বাহিনীর সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানবার সিদ্ধান্ত নেই।

সেখানে পৌঁছাবার পরে তুমি কি জানতে পারলে?

আমি আরো কয়েকদিন পরে যখন কামরানের দুর্ভেদ্যঘাটিতে উপস্থিত হই, আমি আবিষ্কার করি যে সেটা আসলে উঁচু পাহাড়ে, একটা সংকীর্ণ উপত্যকার একপ্রান্তে অবস্থিত একটা সুরক্ষিত গ্রাম। পুরো গ্রামটা উঁচু আর প্রশস্ত মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং চারপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাপড়ের তাবু টাঙানো হয়েছে সেখানে আসবার পথে আমি যাদের দেখেছি সেইসব নবাগতদের বাসস্থান। ঔষধবিক্রেতা হিসাবে আমার নিজের ছদ্মবেশের উপর আস্থা রেখে আমি মাটির দেয়ালে অবস্থিত লোহার কীলক দেয়া পাল্লা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করি এবং ভেতরে অবস্থিত ছোট একটা বাজারে গিয়ে হাজির হই। পথের দুপাশে অবস্থিত দোকানগুলোতে কাঁচা শাকসজি এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু বাজারের কেন্দ্রস্থলে একটা শক্তসমর্থ লোক স্পষ্টতই একজন আধিকারিক- এক সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভাব্য নবাগত এবং তাঁদের বাহন পরীক্ষা করছে, লোকগুলোর পেটে খোঁচা দিয়ে তাঁদের মাংসপেশী পরীক্ষা করছে, তাঁদের অস্ত্রের ধার দেখছে এবং তাঁদের ঘোড়ার দাঁত এবং পায়ের পেশী খুটিয়ে দেখছে। সে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের এক তৃতীয়াংশ পরীক্ষা করার আগেই একটা হালকা লালচে হলুদ রঙের লম্বা ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে আপনার সৎ-ভাই তার কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে সেখানে হাজির হয় এবং তার চারপাশে নবাগতদের সমবেত হতে বলে। হঠাৎ এক পশলা। তুষারপাত হবার কারণে সেখানের প্রেক্ষাপট আর উপস্থিত সবাইকে সাদা রঙ রাঙিয়ে দেয়ার পরে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য আরম্ভ করেন।

সে ভাষণে কি বলেছে?

সুলতান, আমাকে মার্জনা করবেন। আমি ঠিক নিশ্চিত নই তার রূঢ় কথাগুলো আমার পুনরাবৃত্তি করা উচিত হবে কিনা, কারণ কথাগুলো আপনার সাথে সম্পর্কিত।

বলতে শুরু কর। শব্দগুলো তোমার না আমার সৎ-ভাইয়ের উচ্চারিত এবং আমি সেগুলো শুনতে আগ্রহী।

বক্তব্যটা ছিল অনেকটা এমন: আমার সৎ-ভাই, মহামান্য সম্রাট একজন দুর্বল, অস্থিরচিত্ত লোক, শাসনকার্য পরিচালনার যোগ্য নয়। তাঁর দৃঢ়োক্তি সত্ত্বেও সে এখনও আফিমে আসক্ত। নেকাটা তাঁকে চলচিত্ত আর নিষ্ক্রিয় করে তুলেছে। হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের অনেক সুযোগ সে পেয়েছে কিন্তু সুযোগগুলো সে কাজে লাগাতে পারেনি। সে নয়- আমি আমার রয়েছে সম্পদ আর জমির জন্য সত্যিকারের ক্ষুধা, যা আমার মরহুম আব্বাজান বাবরকে উৎসাহিত করেছিল। আমার প্রতি অনুগত থাকলে আমি তোমাদের জন্য বিশাল পুরষ্কার বয়ে আনব।

হুমায়ুন উত্তেজিত হয়ে নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখে। সত্যের একটা দানার সাথে নিজের মিথ্যের মিশেল দিয়ে এমন কথা বলা ধূর্ত কামরানের চরিত্রের সাথেই মানানসই। হিন্দুস্তানের পুনরুদ্ধারে কোনো ধরনের অগ্রগতি লাভে নিজের ব্যর্থতায় অস্বস্তিকর হতাশার হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য, হ্যাঁ, সে কালেভদ্রে কখনও কখনও আবারও আফিমের প্রবোধের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সেই ব্যর্থতার কারণ কামরান নিজে এবং তাঁর অবিরত বিদ্রোহ। হুমায়ুন নিজেকে সংযত করে। লোকগুলো কিভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে?

তারা তাকে উৎসাহিত করে এবং সে তাঁর সঙ্গীদের একজনকে ইশারা করলে, সে সবুজ চামড়া দিয়ে তৈরী বিশাল একটা বটুয়া বের করে। আপনার সৎ-ভাই সেখান থেকে কিছু রৌপ্যমুদ্রা নিয়ে প্রত্যেককে পাঁচটা করে দিয়ে, বলে, এগুলো তোমরা ভবিষ্যতে লাভ করবে এমন অসংখ্য পুরস্কারের একটা মামুলি স্মারক। লোভে চকচক করতে থাকা চোখে তারা গর্জে উঠে বলে কামরান পাদিশাহ! আমৃত্যু আমরা আপনাকে অনুসরণ করবো।

সেটা হবে খুবই সংক্ষিপ্ত একটা যাত্রা। কামরান আর তারা যদি তাঁদের বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে তাহলে নিশ্চিতভাবেই সবাই বেঘোরে মারা পড়বে। কিন্তু তুমি আপাতত বলতে থাকো।

আমি সেই বসতিতে চারদিন অবস্থান করে, নবাগতদের সাথে কথা বলি এবং তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির উপরে নজর রাখি। একজন পক্ককেশ আধিকারিক, অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে যিনি হাত পায়ের স্ফীতিতে ভুগছিলেন যার জন্য আমি তাঁকে সরিষার একটা পটি লাগাবার পরামর্শ দেই- আমি আল্লাহতালার প্রতি কৃতজ্ঞ- যা থেকে বোধহয় তিনি উপকার লাভ করেন, আমাকে জানান যে আর এক সপ্তাহরে ভিতরে তারা কাবুলের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা আরম্ভ করবেন। আমি এরপরে আর অপেক্ষা করাটা সমীচিন মনে করিনি এবং ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করি। দশদিন আগে, ডাকাত আর যথেচ্ছাচারী গোত্রগুলোর হাত থেকে বাঁচতে আমি একটা কাফেলার সাথে যোগ দেই- যারা আজকে শহরে প্রবেশ করেছে।

হুসেন খলিল, তুমি তোমার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। আহমেদ খান, গুপ্তদূতদের একটা দলকে এই মুহূর্তে পাঠান আমার ভাইয়ের অগ্রসর হবার চিহ্ন খুঁজে দেখতে।

সুলতান, আমি ইতিমধ্যেই আপনার কথামতো কাজ করেছি।

আধঘন্টার ভিতরেই দূর্গপ্রাসাদের অভ্যন্তরের বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড দ্বারা উষ্ণ একটা কামরায় হুমায়ুনের চারপাশে তার সামরিক উপদেষ্টারা সমবেত হয়। হুমায়ুন প্রথমে হুসেন খলিলের প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার সবাইকে জানায় এবং তারপরে চোখে ক্রোধ আর কণ্ঠে ইস্পাতশীতল প্রতিজ্ঞা জারিত করে বলে, আমি আমার সৎ-ভাইয়ের রাষ্ট্রদ্রোহীতা আর সহ্য করবো না। গুপ্তদূত তার আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হবার বিষয়টা নিশ্চিত করায় আমি সে কাবুলের কাছে পৌঁছাবার পূর্বে আমরা এগিয়ে গিয়ে তাকে মোকাবেলা করি, সম্ভব হলে গিরিপথে তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করা। সে কথা থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপরে জিজ্ঞেস করে, বৈরাম খান, আমরা খুব দ্রুত কত সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে পারবো?

সুলতান, প্রায় চার হাজার। একটা ব্যাপার আমাদের পক্ষে রয়েছে যে সিন্ধু নদ অভিমুখে আপনি অনুসন্ধানী অভিযান পরিচালনার বিষয়ে চিন্তা করায় আমরা ইতিমধ্যে কাবুলের আশেপাশে বসবাসরত গোত্রগুলো থেকে লোক নিযুক্ত করা শুরু করেছিলাম।

নতুন যাদের নেয়া হয়েছে তারা কি অনুগত থাকবে? এইসব গোত্রগুলোর মানুষ ভীষণ রগচটা আর গোত্রের ভিতরে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের কারণে নানা উপদলে বিভক্ত।

সুলতান, আমাদেরও সেই রকমই ধারণা। আপনি তো জানেন যে, আমরা তাদের নিয়োগ করার সময়েই থোক একটা অর্থ দিয়েছি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছি প্রতিটা বিজয়ের পরে আরো দেয়া হবে।

ভালো কথা। আমরা তাহলে পাঁচদিনের ভিতরে যাত্রা করবো।

চারদিন পরে- হুমায়ুন প্রথমে যেমনটা ভেবেছিল প্রস্তুতি নিতে তারচেয়ে কম সময় লাগে- সে তার বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের ঢালু পাথুরে পথ দিয়ে নীচের সমভূমিতে অবস্থিত কুচকাওয়াজ ময়দানের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে তাঁর চার হাজার সৈন্যের বাহিনী সমবেত হয়েছে, শীতল জোরাল বাতাসে অসংখ্য নিশান পতপত করে উড়ছে। সৈন্যসারির কেন্দ্রে হুমায়ুন তার নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করার পরে, সে মনে মনে ভাবে যে হিন্দুস্তানে একদা তাঁর অধীনে যে বিশাল বাহিনী থাকতো তারচেয়ে এখন যদিও তারা সংখ্যায় অনেক অল্প, কিন্তু কামরানকে পরাস্ত করার জন্য এই সৈন্য সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশীই হবার কথা। তার প্রায় সব লোকই অশ্বারূঢ় এবং সে যেহেতু দ্রুতগতিতে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই এইদফা তাঁর সাথে কোনো কামান নেই, তাঁর অনেক সৈন্যের সাথেই ছয় ফিট লম্বা গাদাবন্দুক তাদের ঘোড়ার পর্যানে বাধা রয়েছে। অন্যদের সাথে রয়েছে ধনুক আর পিঠে আড়াআড়িভাবে ঝুলছে তীরভর্তি তূনীর।

আহমেদ খানের গুপ্তচরেরা নিশ্চিত করেছে যে কামরান আসলেই অগ্রসর হতে শুরু করেছে এবং সাফেদ পাহাড়ী অঞ্চলের দীর্ঘ গিরিন্দর দিয়ে অগ্রসর হয়ে, এতদিনে কাবুল থেকে দশদিনেরও কম দূরত্বে তার অবস্থান করার কথা। অভিযানের স্থায়ীত্বকাল কম হবার কারণে তারা এক সপ্তাহের কম সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরের মুখোমুখি হবে বলে আশা করছে- হুমায়ুন রসদ আর তাদের বহনকারী অন্যান্য উপকরণের পরিমাণ যতটা সম্ভব সীমিত রাখতে আদেশ দিয়েছে। উপকরণের অধিকাংশই যেমন শেষরাতের কুয়াশার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাপড়ের তাবু, তামার ডেকচি আর বস্তাভর্তি চাল- উটের পিঠে বাঁধা বেতের ঝুড়িতে চাপান হয়েছে। অবশিষ্ট উপকরণ বহনের জন্য সৈন্যসারির পিছনে সারিবদ্ধ অবস্থায় মালবাহী ঘোড়া আর খচ্চরের দল দড়ি বাঁধা অবস্থায় অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছে।

হুমায়ুন তার আধিকারিকদের মাঝে অবস্থান গ্রহণ করা মাত্র, সে তার তূর্যবাদকদের ইঙ্গিত করে তাঁদের লম্বা পিতলের তূর্য সংঘোষণে এবং তাঁর দামামাবাদকদের ঘোড়ার দুপাশে ঝোলান দামামায় রণসংগীতের বোল তুলতে। এটা সৈন্যসারির অগ্রসর হবার সংকেত, যার সাথে যোগ হয় ঘোড়ার চিহি রব আর ঘোড়ার সাজসজ্জার টুংটাং শব্দ এবং উদ্ধত-দর্শন উটের দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।

*

 

পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

অভিযানের তৃতীয় দিন বিকেলের দিকে, দক্ষিণের দিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া উপত্যকা ঘিরে থাকা উঁচুনীচু পাহাড়ের কাছাকাছি খুব নীচু যখন সূর্য নেমে এসেছে, হুমায়ুন সেদিন রাতের মতো অস্থায়ী শিবির স্থাপনের বিষয় নিয়ে তাঁর আধিকারিকদের সাথে যখন আলোচনা করছে তখন আহমেদ খান ঘোড়া নিয়ে অর্ধবল্পিত বেগে সেখানে উপস্থিত হয়। তাঁর পাশে আরেকটা ঘোড়ায় রয়েছে। সাদা-চুলবিশিষ্ট রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে পোড় খাওয়া চেহারার এক লোক। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে লোকটা তার লম্বা চুলঅলা পাহাড়ী টাটু ঘোড়াটা কেবল একহাতে সামলাচ্ছে এবং তার পরণের খয়েরী পশমের হাতাওয়ালা জ্যাকেটের ডান হাতের কনুইয়ের নীচের অংশটা আলগাভাবে ঝুলে আছে। বৃদ্ধ লোকটা বিস্ময়কর দ্রুততায় ক্ষিপ্রতায় ঘোড়া থেকে নেমে এসে মাথা নত করে হুমায়ুনকে অভিবাদন জানায়।

সুলতান, আহমেদ খান শুরু করে, এর নাম ওয়াসিম পাঠান। আমাদের গুপ্তদূতদের একজন তার গ্রামে গেলে এখানে আসবার জন্য সে অনুরোধ করেছিল। সে দাবী করে সে, কনৌজের যুদ্ধের আগে পুরো সেনাবাহিনীর সামনে আপনার পুরস্কৃত করা তিনজন সৈন্যের, একজন। শেরশাহের আগুয়ান বাহিনীর সাথে এক খণ্ডযুদ্ধে তাঁর ডানহাত কনুইয়ের থেকে কাটা পড়ে এবং দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে দেশে ফিরে যাবার সময় আপনি তাঁকে এক ব্যাগ মোহর দান করেন। সে তার বক্তব্যে স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে এটা দেখিয়েছে। আহমেদ খান একটা ধুসর হয়ে যাওয়া লাল মখমলের ব্যাগ বের করে, যার উপরে মোগল সম্রাটের প্রতীক নক্সা করা রয়েছে।

ওয়াসিম পাঠান আপনাকে এবং সেই ঘটনার কথা দুটোই আমার ভালো করে মনে আছে। আপনার সাথে আবার দেখা হওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ এবং মাঝের। বছরগুলো আপনি ভালোই ছিলেন বোঝা যাচ্ছে।

সুলতান, আহমেদ খানকে আমি বলেছি আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণের একটা সামান্য অংশ আমি পরিশোধ করতে চাই। বিগত বছরগুলোতে, আমি এখান থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে চলাচলের মূল পথের পাশে একটা উপত্যকায় অবস্থিত আমার ছোট্ট গ্রামের মোড়লে পরিণত হয়েছি। আপনি আপনার চারপাশে যে পাহাড়ী এলাকা দেখছেন আমি এখানেই জন্ম নিয়েছি এবং বড় হয়েছি আর এখানের সব পথঘাট আমার নখদর্পণে। আমার গ্রামের পেছন থেকে নুড়ি পাথরে পূর্ণ একটা ঢাল উপরের দিকে উঠে গিয়েছে এবং তারপরে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা পাথরের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গিয়ে উপত্যকার এই প্রধান চলাচলের রাস্তা, যেখান দিয়ে আপনার বিশ্বাসঘাতক সৎ-ভাইকে অবশ্যই যেতে হবে, তাঁর উপরে একটা অবস্থানে গিয়ে শেষ হয়েছে। আপনি এই উচ্চতা থেকে তাঁকে অতর্কিত আক্রমণ করতে পারবেন, গুলিবর্ষণ করে তার লোকদের ধরাশায়ী করতে পারবেন এবং তাঁকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারবেন।

হুমায়ুনের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে ওয়াসিম পাঠান সত্যি কথাই বলছে। আজ রাতে তোমার গ্রামের কাছে আমরা যাত্রাবিরতি করবো এবং আগামীকাল খুব ভোরে তোমার প্রস্তাবিত পথের সম্ভাব্যতা যাচাই করবো। অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসার আগেই আমরা যদি শিবির স্থাপন করতে চাই তাহলে আমাদের এখন। অবশ্যই দ্রুত অগ্রসর হতে হবে।

*

ওয়াসিম পাঠান হুমায়ুনকে অনুরোধ করে তার ছোট জানালাবিহীন সমতল-ছাদযুক্ত মাটির বাসাটা, যাঁর ছাদে একটা ছিদ্রের সাহায্যে ধোঁয়া নির্গমনের ব্যবস্থা করে আগুন জ্বালাবার জন্য কেন্দ্রীয় উনানের বন্দোবস্ত রয়েছে, তাঁর অস্থায়ী সদর দপ্তর হিসাবে ব্যবহার করতে। নিজের বুড়ো যোদ্ধাকে সম্মান দেখাতে হুমায়ুন তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি দেয়, যদিও রাতটা সে জওহরের সতর্ক দৃষ্টির সামনে ওয়াসিম পাঠানের বাড়ির সীমানার নীচু দেয়ালের মধ্যে স্থাপিত নিজের চিরাচরিত তাবুতেই ঘুমায়। পরদিন ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার সামান্য আগে, আহমেদ খান তাঁর কিছু লোক নিয়ে তাদের মতো একটা সৈন্যবাহিনীর জন্য ওয়াসিম পাঠানের প্রস্ত বিত পথের প্রায়োগিক সম্ভাবনা যাচাই করতে রওয়ানা দেয়। এখন সূর্য সরাসরি মাথার উপরে পৌঁছাবার কিছুক্ষণের ভিতরেই, হুমায়ুন কাছের পাহাড়ের ধুসর নুড়িপাথরে পূর্ণ ঢাল বেয়ে তাঁদের ঘোড়াগুলোকে এঁকেবেঁকে পথ করে নিয়ে নীচের দিকে নেমে আসতে দেখে।

সুলতান, পৌনে একঘন্টা পরে আহমেদ খান যখন দিনের বিবরণী, ওয়াসিম পাঠানের আড়ম্বরহীন বাসায় আগুনের চারপাশে বসে থাকা হুমায়ুন আর তার সামরিক আধিকারিকদের সামনে পেশ করার সময়, ঝড়ো বাতাসের কারণে ছাদের ছিদ্র দিয়ে ধোঁয়া ফিরতি পথে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করায় মাঝে মাঝে কাশতে থাকে, ওয়াসিম পাঠান আমাদের যে রাস্তাটা দেখিয়েছে সেটা দিয়ে আসলেই অস্ত্রধারী লোকদের পক্ষে উপরে যাওয়া সম্ভব, যদিও এই পথ দিয়ে পুরো বাহিনীকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। রাস্তাটা এমন একটা অবস্থানে গিয়ে শেষ হয়েছে যেখান থেকে নীচের উপত্যকা দেখা যায়, ঠিক যেখানে সেটা সংকীর্ণ হয়ে এসে একটা গিরিকন্দরে পরিণত হয়েছে। আপনার সৎ-ভাইয়ের লোকদের অতর্কিত আক্রমণের জন্য স্থানটা একেবারে আর্দশ।

কামরানের বাহিনীকে আমাদের গুপ্তদূতরা যারা অনুসরণ করছিলো তারা তাঁর অগ্রসর হবার কি বিবরণ দিয়েছে?

আগামীকালের পরের দিন দুপুরবেলা অতর্কিত আক্রমণের জন্য নির্ধারিত স্থানের নীচে দিয়ে তাঁদের অতিক্রম করার কথা।

তাহলে, সবধরনের বিতর্কের সমাপ্তি টেনে দিয়ে হুমায়ুন বলে, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। আমরা আমাদের ছয়শ সেরা যোদ্ধাকে, যাদের ভিতরে আমাদের বেশীরভাগ গাদাবন্দুকধারী তবকিরা থাকবে, অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থানে পাঠাব। জাহিদ বেগ সৈন্য নির্বাচনের দায়িত্ব আপনার। তাদের বলে দেবেন নিজেদের অস্ত্র ছাড়াও কম্বল আর পশুর চামড়া সাথে নেয়, উপরে আমরা যে রাত অতিবাহিত করবো সেসময় নিজেদের উষ্ণ রাখতে আর সেই সাথে দুইদিনের জন্য পর্যাপ্ত পানি আর শুকনো খাবার। আমাদের অবস্থান যাতে কোনোমতে প্রকাশ না পায় সেজন্য আমরা উষ্ণতার জন্য কিংবা রান্নার জন্য আগুন জ্বালাবো না। বৈরাম খান আমাদের বাকি লোকেরা এখানে আপনার নেতৃত্বে অবস্থান করবে, কামরানের লোকদের ভিতরে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়ে মূল সড়ক দিয়ে কাবুলের পথে উত্তরে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করবে তাদের জন্য রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

পরের দিন সকালবেলা, পরিষ্কার নীল আকাশের নীচে এবং একপাশে নিজের কষ্টসহিষ্ণু টাটুঘোড়ায় উপবিষ্ট ওয়াসিম পাঠান আর অন্যপাশে নিজের চিরাচরিত খয়েরী রঙের ঘোটকীতে উপবিষ্ট আহমেদ খানকে নিয়ে হুমায়ুন ওয়াসিম পাঠানের ছোট গ্রাম ছেড়ে কাছের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া নুড়িপাথরেপূর্ণ ঢাল অনুসরণ করে। এক ঘন্টা পরে, সে আর সৈন্যসারির প্রথমাংশ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরে পূর্ণ এলাকায় এসে পৌঁছে এবং ধীরে ধীরে আর একসারিতে বিন্যস্ত হয়ে পাথরের ভিতর দিয়ে আর গিরিখাতে তুষারপাতের ফলে সংগৃহিত জমাট বরফের ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে আরো উপরে উঠতে থাকে। আরো দেড়ঘন্টা অতিবাহিত হবার পরে, ওয়াসিম পাঠান প্রায় আধ মাইল দূরে পর্বতশীর্ষের একটা সরু দীর্ঘ উচ্চভূমিরেখার দিকে ইঙ্গিত করে। সুলতান, ঐ উঁচু এলাকার অপর পাশেই প্রধান সড়ক অবস্থিত যা কাবুল থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে- ঐ পথ দিয়েই আপনার ভাই আসবে।

হুমায়ুন আর আহমেদ খান ওয়াসিম পাঠানকে অনুসরণ করে যে নিজের অবশিষ্ট হাতটা দিয়েই নিজের ঘোড়াটাকে আরও পাথর এবং বোল্ডারের ভিতর দিয়ে উঁচুভূমির শীর্ষভাগের দিকে এগিয়ে যায়। শীর্ষভাগে উপস্থিত হলে, জায়গাটা তখনও পুরু বরফের আবরণে ঢাকা, হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে নীচের রাস্তার উপরে সেটা একটা ভীষণ সুবিধাজনক অবস্থানের সৃষ্টি করেছে এবং কাবুলের দিকে অগ্রসরমান কোনো অসন্দিগ্ধ বাহিনী লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের জন্য তকিদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে নীচের পাথরের ফাটল একেবারে যথার্থ।

হুমায়ুন আক্রমণ পরিকল্পনা বলতে শুরু করে। কামরান আর তার বাহিনী আমাদের প্রত্যাশার পূর্বেই উপস্থিত হলে কোনো ধরনের জটিলতা পরিহারের উদ্দেশ্যে তবকিরা এইসব পাথরের ফাটলেই নিজেদের আহার আর নিদ্রার ব্যবস্থা করবে। আহমেদ খান অবিলম্বে তাদের নিজেদের অস্ত্র, বিছানা আর রসদ নিয়ে অবস্থান গ্রহণের আদেশ দেন। কিন্তু ওয়াসিম পাঠান আমরা বাকিরা কি করবো? আশেপাশে কি কোনো সমতল এলাকা রয়েছে- যেখানে উচ্চভূমি বরাবর আরো অগ্রসর হয়ে পর্যবেক্ষনের পূর্বে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করতে পারি? আমাদের এমন একটা স্থান খুঁজে বের করতে হবে যেখান থেকে আমরা কামরানের বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারি, যাতে তাঁরা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আমাদের তবকিদের গুলির কবলে পড়বে।

হ্যাঁ, সুলতান আছে। এখান থেকে আরো পৌনে একমাইল দূরে উচ্চভূমির পাশে বায়ুপ্রবাহের বিপরীত দিকে একটা সমতল এলাকা রয়েছে, যেখানে আমরা অস্থায়ী শিবির স্থাপন করতে পারবো। আমি সেখান থেকে পথ দেখিয়ে আপনাকে নীচের দিকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে আলগা পাথরে ভর্তি ঢাল অনেক সহনীয় ভঙ্গিতে নিচের চলাচলের পথের দিকে নেমে গিয়েছে এবং এই পথটা দিয়ে কোনো দক্ষ অশ্বারোহীর পক্ষে এঁকেবেঁকে না নেমে সরাসরি ধেয়ে নেমে এসে আক্রমণ করা সম্ভব।

পরের দিন সকাল হবার একঘন্টা আগে তীব্র শীতের ভিতরে যখন হুমায়ুন দুহাত দিয়ে নিজের পাজরের দুপাশে চাপড় মারছে নিজেকে উষ্ণ রাখতে এবং সামনের দীর্ঘদিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে, আহমেদ খান তাঁকে এসে জানায় যে তবকিদের একজন যে নীচের রাস্তা দেখা যায় এমন একটা বিশেষ উন্মুক্ত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেছিল রাতেরবেলা শীতের তীব্রতায় মারা গিয়েছে। আহাম্মকটার মরাই উচিত, আহমেদ খানের নির্দয় ব্যাখ্যা। ব্যাটা পানির বদলে সুরা নিয়ে গিয়েছিল আর পর্যাপ্ত কম্বল নিতেও তার মনে ছিল না।

 

পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

অন্য তবকিরা সজাগ আর সতর্ক রয়েছে?

হ্যাঁ, সুলতান।

তারা কি নিজেদের অস্ত্র পরীক্ষা করে অবস্থান গ্রহণ করেছে?

সেটাও করেছে, সুলতান।

দারুণ। বাকি লোকদের এখন ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত হতে বল। ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমি গতকাল ওয়াসিম পাঠানের সাথে যে পথটার সম্ভাব্যতা যাচাই করে এসেছিলাম সেই পথে যাত্রা করবো, যা কামরানের বাহিনীর পেছনের দিকে আক্রমণ করার জন্য সত্যিই একটা আদর্শ সূচনা বিন্দু। পথটা সংকীর্ণ এবং বরফাবৃত আর কয়েক স্থানে খাড়াভাবে নেমে গিয়েছে। আমার লোকদের বলবেন সতর্ক থাকতে, বিশেষ করে বাতাসের বেগ এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন, উত্তরদিক থেকে প্রবাহিত হিম শীতল বাতাসের কারণে তার মুখ পশমের গলবস্ত্র দিয়ে ভালোমতো আবৃত থাকা সত্ত্বেও তাঁর নাকের অগ্রভাগ অসাড় হয়ে উঠেছে, তাদের যাত্রা পথের সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটা মাত্র অতিক্রম করেছে, যা দুই ফিটেরও কম চওড়া আর দুপাশেই খাড়া ঢাল নীচের দিকে নেমে গিয়েছে, এমন সময় পেছন থেকে সে একটা আর্তনাদ শুনতে পায়, সেইসাথে একটা ভোঁতা শব্দ এবং তারপরে নীচ থেকে দ্বিতীয় আরেকটা ভারী পতনের শব্দ ভেসে আসে। সে তার ঘোড়ার পর্যাণের উপরে ঘুরে তাকিয়ে দেখে তাকে অনুসরণরত এক অশ্বারোহী উচ্চভূমির সংকীর্ণ অংশ থেকে ঘোড়াসহ নীচে পড়ে গিয়েছে, সম্ভবত ক্রমশ জোরাল হতে থাকা ভারী দমকা বাতাসের তোড়ে পড়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। হতভাগ্য লোকটার ভেড়ার চামড়ার আলখাল্লা পরিহিত দেহটা মাত্র ত্রিশ ফিট নীচে একটা সরু পাথরের তাকের উপরে চার হাতপা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে কিন্তু তার ঘোড়াটা আরো নীচে পাহাড়ের তীক্ষ্ণ অভিক্ষিপ্ত পাথুরে অংশে আছড়ে পড়েছে যা প্রাণীটার দেহ ছিন্নভিন্ন করে নাড়ীভুড়ি বের করে ফেলেছে।

হুমায়ুনের চোখের সামনেই আরেকজন আরোহী এবং তাঁর ঘোড়া পথের উপর থেকে উল্টে গিয়ে নীচের ধুসর তীক্ষ্ণ অভিক্ষিপ্ত অংশে আছড়ে পড়ে। হুমায়ুন দেরী না করে কণ্ঠস্বরে জরুরীভাব ফুটিয়ে তুলে আদেশ দিতে আরম্ভ করে। আমার কথা পেছনে পৌঁছে দাও। কোনো লোকের যদি নিজের উপর কিংবা তার ঘোড়া সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় তাহলে সে যেন ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে এবং ঘোড়াকে নিয়ে পায়ে হেঁটে সবচেয়ে সংকীর্ণ আর ফাঁকা অংশটা অতিক্রম করে। এর ভিতরে লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই।

এই আদেশের পরে, আর কোনো অসুবিধা হয় না, হুমায়ুনের বাকী লোকেরা নিরাপদে জায়গাটা অতিক্রম করে কেবল একজনের তামাটে বর্ণের ঘোড়া বরফের উপরে হোঁচট খায়, যখন সে লাগাম ধরে প্রাণীটাকে জায়গাটা পার করছিল। বিশাল প্রাণীটা শীতল বাতাসে পাগলের মতো চারপায়ের খুর আন্দোলিত করতে করতে আছড়ে পড়ার সময়, নিজের আরোহীকেও কালো দাড়িঅলা, ছোটখাট চেহারার এক বাদখশানি যোদ্ধা- পতনের শূন্যতায় টেনে নেয়, হতভাগ্য লোকটা মরীয়া হয়ে ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকায় সময়মতো হাতের লাগাম ছেড়ে দেয়ার আগেই সে নিজেও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং পথের জীবন থেকে মৃত্যুতে ঝাঁপ দেয়।

আধঘন্টা পরে, হুমায়ুন আর তাঁর লোকেরা নিজেদের এবং তাঁদের ঘোড়াগুলোকে সবুজাভ-ধুসর নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালের শীর্ষদেশে এলোমেলো পাথরের মাঝে তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখে, যেখান থেকে তারা কামরানের লোকদের অতর্কিতে আক্রমণ করার আশা করে। হুমায়ুন জানে তাদের বেশ কয়েক ঘন্টা এখানে অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর কাছে গুপ্তচরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী কামরানের লোকজন দুপুর দুইটা কি তিনটার আগে এই এলাকা দিয়ে অতিক্রম করবে না। সন্ধ্যা নামার ঠিক আগ মুহূর্তে জয় পরাজয় নির্ধারণী কোনো যুদ্ধের জন্য তারা খুব অল্প সময়ই পাবে।

বস্তুতপক্ষে ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘর অতিক্রম করার আরো কিছুক্ষণ পরে হুমায়ুন নিজে যখন মনোসংযোগের জন্য চোখ কুঁচকে একটা অতিকায় পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয় তখনই সে কামরানের অগ্রবর্তী বাহিনীর প্রথম দলকে নীচের রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের সাথে মনে হয় না যে কোনো প্রহরী বা গুপ্তদূতের দল রয়েছে এবং কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক সারিবদ্ধ বিন্যাসও তারা বজায় রাখার চেষ্টা করে না। স্পষ্টতই, অতর্কিত কোনো আক্রমণের ব্যাপারে তারা একেবারেই অসন্দিগ্ধ রয়েছে। হুমায়ুন ইঙ্গিতে আহমেদ খানকে কাছে আসতে বলে। আমি সংকেত না দেয়া পর্যন্ত আমার লোকেরা যেন আক্রমণ না করে- এই বার্তাটা সবার কাছে পৌঁছে দাও। তাঁদের পশ্চাদভাগে আমরা আক্রমণ করতে সক্ষম হবার আগে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ তাঁদের যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য সামনে এগিয়ে না যায়। আমরা যখন আক্রমণে যাব, সেটা যেন দ্রুত আর তীব্র হয়, কামরানকে নিজের লোকদের একত্রিত করার কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না।

কামরানের লোকদের অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হবার সুযোগ দিতে হুমায়ুন সম্ভবত মিনিট পনের অপেক্ষা করে, তারা গল্পগুজর আর হাসিঠাট্টা করতে করতে এগিয়ে যায়। ওঁত পেতে থাকার সময়ে হুমায়ুনের একবার মনে হয় সে সৈন্যসারির কেন্দ্রভাগে একটা বিশাল খয়েরী রঙের ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তাঁর সৎ-ভাইকে দেখেছে কিন্তু দূরত্ব বেশী হবার কারণে সে নিশ্চিত হতে পারে না। বাহিনীটার পশ্চাদ্ৰক্ষীরা এবং সৈন্যবাহিনীর পিছিয়ে পড়া অনুসরণকারীরা যখন তাঁর লুকিয়ে থাকা স্থানের নীচে দিয়ে অতিক্রম করতে শুরু করে, সে তার লোকদের ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত হতে আদেশ দেয়। তার আদেশ সাথে সাথে পালিত হয় এবং দস্তানা পরিহিত হাতের এক ঝটকায় সে তার চারশ অশ্বারোহীর মাঝে গতির সঞ্চার করে। পুরো দলটা ঢেউয়ের একটা ঝাপটার মতো নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালের উপর দিয়ে নীচের দিকে ধেয়ে যায়।

আশেপাশের অন্য এলাকা থেকে কম দুরারোহ হওয়া সত্ত্বেও, নীচের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাটা বেশ ঢালু এবং হুমায়ুন নীচের দিকে নামার সময় তার পর্যাণের উপরে পিছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঘোড়াটাকে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করার ফাঁকে সে দেখে তার লোকদের একজনের ঘোড়ার পা পিছলায় এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছাড় খায়, পিঠের আরোহী তাঁর গলার উপর দিয়ে ছিটকে যায় এবং মসৃণ আলগা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে গড়াতে থাকে। অবশ্য, হুমায়ুন আর তাঁর আক্রমণকারীবাহিনী প্রায় একই সময়ে কামরানের বাহিনীর পশ্চাক্ষীদের মাঝে পৌঁছে গিয়ে, আঘাত হানতে আর বেপরোয়া তরবারি ঘোরাতে আরম্ভ করে। আক্রমণের প্রথমক্ষণেই, হুমায়ুন কালো পাগড়ি পরিহিত এক যোদ্ধাকে তাঁর পর্যাণ থেকে ছিটকে নীচে ফেলে দেয়, বেচারা তখনও ভেড়ার চামড়ার নীচে থাকা ময়ানের ভিতর থেকে তরবারি বের করতে প্রাণপনে চেষ্টা করছে। সে আরেকজনের উরুতে আঘাত করে অস্ত্রধারণের পূর্বে এই লোকও আহত হয় এবং তৃতীয় আরেকজনের বাহুর গভীরে তরবারির ফলা বসিয়ে দেয়।

কামরানের অশ্বারোহীদের দেখে মনে হয় তারা এই আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সবচেয়ে পেছনের অশ্বারোহীরা সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাঁদের আক্রমণকারীদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করতে গেলে, সামনে তাঁদের সহযোদ্ধাদের উপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা তাঁদের নিজেদের ঘোড়াগুলোকে আকঙ্কিত করে তুলে এবং কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই উপত্যকার রাস্তা ধরে ঘোড়াগুলো প্রাণপনে দৌড়াতে শুরু করে। হুমায়ুন অচিরেই পাহাড়ের গায়ে উঁচুতে বড় বড় পাথরের আড়ালে যেখানে তার তবকিরা লুকিয়ে রয়েছে, সেখান থেকে গাদাবন্দুকের প্রথম গুলির শব্দ ভেসে আসতে শুনে। রণক্ষেত্রের ধূলো আর চাপানউতোরের ভিতরে হুমায়ুন তাঁর নিজের অবস্থান থেকে, গুলির প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করতে পারে না কিন্তু সে নিজের চারপাশে বিভ্রান্তি আর বিস্ময়কে অচিরেই চরম ভয় আর আতঙ্কে রূপান্তরিত হতে দেখে।

কামরানের যোদ্ধাদের অনেকেই দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাবার এবং বন্দুকের গুলির নিশানা থেকে বাঁচার অভিপ্রায়ে চেষ্টা করে নিজেদের ঘোড়াগুলোকে পেছনের দুইপায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে ঘুরিয়ে নিতে এবং পেছনে অবস্থিত আক্রমণকারীদের ভিতর দিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে বাধ্য করতে। তাদের কারো প্রয়াস সফল হয় না; তাঁদের প্রত্যেকেই হয় মৃত্যুবরণ করে কিংবা ঘোড়া থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে। অন্যরা চেষ্টা করে নুড়িপাথরেপূর্ণ খাড়া ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠতে। হুমায়ুন পেছন থেকে তাদের অনেককেই ঘোড়া থেকে ছিটকে মাটিতে পড়তে দেখে, খুব সম্ভবত তার তবকিরা তাদের গুলি করে ঘায়েল করেছে। মাত্র বিশ মিনিটের ভিতরে, কামরানের জোড়াতালি দেয়া সেনাবাহিনীর একাত্তবোধ আর নিয়মানুবর্তিতা উবে যেতে শুরু করে। স্থানে স্থানে তাঁর প্রাণ ভয়ে ভীত, আর জান বাঁচাতে বেপরোয়া লোকেরা নিজেদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে এবং আত্মসমর্পনের প্রতীক হিসাবে দুহাত মাথা উপরে তুলে রেখে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায়।

 

পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

হুমায়ুন নিজের কিছু সৈন্যকে তাঁর চারপাশে জড়ো করে, সে তার কালো ঘোড়াটাকে কামরানের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া বাহিনীর ভিতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায় তার সৎ-ভাইয়ের খোঁজে, সে এগিয়ে যাবার সময়ে ডানে বামে কোনো বাছবিচার না করে তরবারি চালায়। একবার হুমায়ুনের মনে হয়, সে তাঁকে তাঁর খয়েরী ঘোড়ায় উপবিষ্ট দেখতে পেয়েছে কিন্তু সে মরীয়া হয়ে কাছাকাছি যাবার পরে বুঝতে পারে ঘোড়াটার আরোহী এক তরুণ, সম্ভবত একজন পদস্থ যোদ্ধা যে পালাবার জন্য পাগলের মতো নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিতে থাকে কিন্তু সে তারপরেও তাঁর শিরস্ত্রাণবিহীন মাথা লক্ষ্য করে হুমায়ুনের তরবারির ক্রোধ এড়াতে পারে না এবং পাকা তরমুজের ন্যায় তার ছিন্নমস্তক মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

উত্তরদিক থেকে, যেখানে বৈরাম খানের নেতৃত্বে তাঁর মূল বাহিনীর অবরোধের আড়াল থেকে কামরানের পলায়নপর লোকদের মোকাবেলা করার কথা, চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলে বোঝা যায় যে সেখানেও লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটেছে। পাহাড়ের উপর থেকে নীচের জটলাবদ্ধ যোদ্ধাদের ভিতরে শত্রু এবং মিত্র ঠিকমতো সনাক্ত করতে না পেরে আর নিজেদের গাদাবন্দুকের ধোঁয়ায় নিজেরাই আপাতভাবে ঝাপসা দেখতে শুরু করলে হুমায়ুনের তবকিরা বন্দুক ফেলে দিয়ে ময়ান থেকে তরবারি বের করে মাথার উপরে আন্দোলিত করতে করতে নীচের এলোপাথাড়ি যুদ্ধের দিকে নুড়িপাথরের উপর দিয়ে পিছলে নামতে শুরু করে।

হুমায়ুন, এখনও নিজের সৎ-ভাইকে বন্দি করতেই বেশী আগ্রহী হওয়ায়, সে নিজের সাথে আরও ডজনখানেক যোদ্ধা নিয়ে সরে এসে সামনের অবরোধের দিকে এগিয়ে যায়। সে আধমাইলও যেতে পারেনি, সামনের অবরোধে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পেছনে তাঁদের দিকে পশ্চাদপসরণকারী কামরানের বিশজন যোদ্ধার একটা দল তাঁর সামনে এসে পড়ে। নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে হুমায়ুন গতি বৃদ্ধি করে। তার চারপাশে যারা ছিল তারাই একই কাজ করে। দুটো দল মুখোমুখি সংঘর্ষে মিলিত হয়। কামরানের একজন যোদ্ধা হুমায়ুনের মাথা লক্ষ্য করে তরবারি চালায় কিন্তু আঘাতটা তার শিরস্ত্রাণে লেগে পিছলে যায়। হুমায়ুনের তরবারির ফলাও একই সময়ে আক্রমণকারীর কনুইয়ের উপরে আঘাত হানে। কোনো ধরনের হামলার সম্মুখীন হবার জন্য প্রস্তুত না থাকায়, কামরানের অধিকাংশ যোদ্ধার পরণেই ইস্পাতের জালির তৈরী বর্ম নেই, ফলে হুমায়ুনের তরবারির ফলা গভীরে প্রবেশ করে, অস্থি দ্বিখণ্ডিত করে এবং হাতটা দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

দ্বিতীয় আরেক যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত ধারাল কস্তনী দিয়ে হুমায়ুনকে আঘাত করতে চেষ্টা করে। কস্তনীর শিকলের শেষপ্রান্তেযুক্ত গোলকের সাথে সংযুক্ত সুচালো কীলক তার মুখের সামনে বাতাস কেটে বের হয়ে যাবার সময় তাঁর নাকের অগ্রভাগে একটা আচড় কেটে যায়। তাঁর নাক অসাড় হয়ে পড়ে এবং সাথে সাথে রক্তে তাঁর মুখ আর কণ্ঠনালীর ভেতরের অংশ ভেসে যায়। সে, অবশ্য সাথে সাথে ঘোড়ার মুখ সবেগে ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁর আক্রমণকারীর পিছু ধাওয়া করলে সে তার হাতের কস্তনী তাকে লক্ষ্য করে আরো একবার সপাটে ঘোরায় কিন্তু এবার উদভ্রান্ত ভঙ্গিতে চালাবার কারণে হুমায়ুনের অনেকদূর দিয়ে সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হয়। হুমায়ুন লোকটাকে অতিক্রম করার সময়ে তাঁর ঘাড় বরাবর সপাটে তরবারি চালায়। আঘাতের প্রচণ্ডতায় আক্রমণকারীর শিরোস্ত্রাণ স্থানচ্যুত হয়ে, তরবারির গতি কিছুটা ব্যাহত হয় কিন্তু তারপরেও সেটা ঠিকই লোকটার ঘাড়ে আঘাত হেনে রক্তক্ষরণের জন্ম দেয়। লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকে যেতে সে তার ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারায় আর জন্তুটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে তাঁকে সবেগে মাটিতে আছড়ে ফেলে, সেখানে হতভাগ্য লোকটা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু অচিরেই তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয় এবং নিথর হয়ে সে মাটিতে পড়ে থাকে।

সুলতান, সাবধান, আপনার পেছনে! কামরানের আরেক যোদ্ধা মাথার উপরে নিজের বাঁকান তরবারি উঁচিয়ে ধরে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসতে, হুমায়ুন যথাসময়ে ঘুরে দাঁড়ায় তাঁকে মোকাবেলা করতে। হুমায়ুন এবার যান্ত্রিকভাবে এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে পাল্টা আঘাত হানে- তার আক্রমণকারীর ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে ভেসে গিয়ে তরবারির ফলা তার কুঁচকিতে আঘাত হানে। লোকটা নিমেষে ভূপাতিত হয়।

হুমায়ুন কাশতে কাশতে নোতা, ধাতব স্বাদযুক্ত রক্ত থুতুর সাথে মাটিতে ফেলতে ফেলতে চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে সে আর তার লোকেরা বিশজন আক্রমণকারীর ভিতরে আটজনকেই হত্যা করেছে এবং আরো লক্ষ্য করে, যারা তখনও বেঁচে রয়েছে তাদের যুদ্ধ করার শখ সহসাই উবে গিয়েছে এবং পালাবার পথ খুঁজছে। হুমায়ুন কিছুক্ষণের ভিতরেই আবার পাথুরে পথের চড়াই ভেঙে ঘোড়া ছোটাবার প্রয়াস নিতে গিয়ে প্রায় সাথে সাথে লক্ষ্য করে তার নিজস্ব পাঁচশত অশ্বারোহীর একটা বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বৈরাম খান তার দিকেই এগিয়ে আসছে, তার লাল নিশান গর্বিত ভঙ্গিতে বাতাসে উড়ছে।

বৈরাম খান তাঁর ফেনারমতো ঘামে ভেজা, নাক দিয়ে সজোরে শ্বাস ফেলতে থাকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, তাঁর মুখ বিজয়ের গর্বিত হাসিতে উদ্ভাসিত, সে বলে, কামরানের লোকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। হুমায়ুন তার চারপাশে ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে যে তার বিজয় হাসিল হয়েছে কিন্তু একে কি সত্যিকারের বিজয় বলা যাবে? সে তার সৎ-ভাইকে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছে। হিন্দুস্তান পুনরায় অধিকারের অভিপ্রায়ে তার বিশাল কর্মযজ্ঞ নিরাপদে শুরু করার আগে তাকে অবশ্যই এই কাজটা করতেই হবে।

রাতের অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসবার আগেই একটা বিষয় নিশ্চিত করবেন, আমার লোকেরা যেন কামরানের যত বেশী সংখ্যক লোককে ধাওয়া করে বন্দি করতে পারে। আমার চক্রান্তকারী সৎ-ভাইকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় আমার সামনে যে হাজির করতে পারবে তাঁকে স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ একটা থলে আমি উপহার দেব।

পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

cropped Bangla Gurukul Logo পাদিশাহ কামরান -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment