আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আগন্তুক মেহেরবান

আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আগন্তুক মেহেরবান

খয়েরী অশুভ দুর্গন্ধযুক্ত, পিচ্ছিল কাদা এখনও তাদের কেরাঞ্চির চাকা আটকে ধরে ভাবটা এমন যেন তাদের অতিক্রম করতে দিতে অনিচ্ছুক। খুররম প্রায় হতাশ একটা অনুভূতি টের পায়। মহানন্দা নদী অতিক্রম করার পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তারা যখন উত্তরপূর্বদিকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অভিমুখে রওয়ানা হবার পরে তাঁদের অগ্রসর হবার গতি যন্ত্রণাদায়কভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে, এমনও দিন গিয়েছে যেদিন তারা দিনে তিন কি চার মাইলের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারেনি। বর্ষাকাল অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু তার চিহ্ন এখনও এখানের, আর্দ্র বাতাস থেকে শুরু করে পচা পাতার পুরু গালিচায় এবং উপড়ে পড়া গাছপালার শাখাপ্রশাখায় এবং বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া জলাভূমির এখন বদ্ধ কালো পানির দীপ্তির ভেতর রয়েছে। ডাকাতের দল যদিও আর কোনো সমস্যার জন্ম দেয়নি এবং মহবত খানের উপস্থিতির কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি, তারপরেও চারপাশে বিপদ যেন ওঁত পেতে রয়েছে। গাছের নিচে জন্ম নেয়া ঝোঁপঝাড়ে বিষাক্ত সাপ ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার সময় বোঁ-বোঁ শব্দ করে মশার ঝাঁক হুল ফোঁটাতে উড়ে আসে, উষ্ণ রক্তের জন্য ক্ষুধার্ত। আর তার লোকদের ভিতরে এখন শুরু হয়েছে রোগের প্রাদুর্ভাব–গত দুই সপ্তাহে তাঁর ছয়জন লোক মারা গিয়েছে যাদের ভিতরে রয়েছে তার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ পরিচারক, শাহ্ গুল, যিনি আগ্রা থেকে তাঁর সাথে আনুগত্যের জন্য নির্বাসনে এসেছিলেন। প্রতিদিন সকালবেলা তার বাহিনীর লোকবল হ্রাস পায় কারণ লোকজন পালিয়ে যেতে শুরু করেছে, তারা নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে আগ্রহী।

হতাশার মাঝে নিজেকে আটকে রেখে, খুররম প্রতিটা গাছ থেকে ঝুলে থাকা সবুজ মসের সেঁতসেতে, রুক্ষ একটা জট ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দেয়। আরজুমান্দ পুনরায় গর্ভবতী হওয়ায় তাকে, আর তাঁর সন্তানদের নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। বাচ্চাদের সবাইকে অসুস্থ আর প্যাকাটে দেখায় এবং আরজুমান্দের নিজেরও চোখমুখ দুশ্চিন্তায় বসে গেছে, তাঁর চোখের নিচে কালি পড়েছে। মহানন্দা অতিক্রমের সময় তাঁর উৰ্দ্ধবাহুতে যে ক্ষত হয়েছিল সেটা পুরোপুরি কখনও নিরাময় হয়নি। ক্ষতস্থানটা এখনও তাজা আর ফোলা দেখায় এবং প্রায়ই সেখানে হলুদ পুঁজ জমে। তার কি করা উচিত? তার মাঝে মাঝে মনে হয় মহবত খানের বাহিনীর অবস্থানের ব্যাপারে সে যদি জানতে পারতো… এখন যখন শুষ্ক মওসুম এসে গিয়েছে, তারা কি তার পিছু পিছু আসছে নাকি বর্ষার সময়েই তারা ফিরে গিয়েছে। কোনো তথ্য জানা না থাকলে পরিকল্পনা করা অসম্ভব। দশদিন আগে সে গুপ্তদূতের দায়িত্ব দিয়ে যাদের পাঠিয়েছিল তাঁদেরও এখন পর্যন্ত ফিরে আসবার কোনো লক্ষণ নেই এবং তারা সম্ভবত আসছেও না–স্বপক্ষত্যাগের প্ররোচনা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকবেশি প্রলুব্ধকারী।

তাঁর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় এবং চোখ নামিয়ে সে ছেঁড়া, কাদার দাগ যুক্ত পোষাকের দিকে তাকায়, অনেকটাই তাঁর একসময়ের চৌকষ ঘোড়ার মলিন চামড়ার মত লাগে বেচারার পাঁজরের হাড় এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। সে চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে চায় জনবসতি ক্রমশ বিরল হয়ে আসছে। উপকূল থেকে তারা এখন নিশ্চয়ই খুব একটা দূরে নেই বা অন্ততপক্ষে গঙ্গার মোহনা থেকে যা নদীপথের একটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা। তারা যদি কোনোমতে একবার নদীগুলোর একটাকে খুঁজে বের করতে পারতো তাহলে সেটাকে ভাটিতে অনুসরণ করে সমুদ্রে… তাঁর ভাবনা যেন ভোজবাজির মত নিজেদের মূর্ত করে তুলে, নিকোলাস ব্যালেনটাইন আর তাঁর আরেকজন দেহরক্ষী সামনের সবুজ ছায়ার মাঝ থেকে আবির্ভূত হয়। সে তাঁদের সকালে পাঠিয়েছিল, নদীর তীরে ডাকাতদের সাথের তিক্ত অভিজ্ঞতা হবার পরে থেকে সে সবসময়েই সামনের পথটা এখন আগেই পর্যবেক্ষণ করে নেয়। কি অবস্থা? তাঁরা শ্রবণ সীমার ভেতর পৌঁছাতেই সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে।

তার জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল যখন সে দেখে তারা একা ফিরে আসেনি। তাঁদের বিশ গজ পেছনে একটা সুন্দর দেখতে সাদা খচ্চরের পিঠে উপবিষ্ট খয়েরী রঙের মোটা কাপড়ের তৈরি লম্বা একটা আলখাল্লা পরিহিত একজন মানুষ যার মুখটা একটা বিচিত্র, চওড়া কিনারাযুক্ত, একটা টুপির আড়ালে ঢাকা।

যুবরাজ, নিকোলাস দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসে, তাঁর অল্পবয়সী মুখটা ঘামে গোলাপি হয়ে রয়েছে। এই লোকটা একজন পর্তুগীজ পুরোহিত। আমরা এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে জ্বালানী কাঠ কাটতে থাকা একদল লোককে তত্ত্বাবধায়ন করা অবস্থায় তাকে আবিষ্কার করেছি। তার ভাষ্য অনুযায়ী আমরা হুগলীর পর্তুগীজ কুঠির খুব কাছেই অবস্থান করছি।’

হুগলী? খুররম ভ্রুকুটি করে। বাণিজ্য কুঠির বিষয়ে সে তাঁর আব্বাজানকে কথা বলতে শুনেছে। দরবারে গুজব রয়েছে যে সেখানের পর্তুগীজ পুরোহিতেরা স্থানীয় লোকজনকে জোর করে তাঁদের নিজেদের ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করছে আর তারচেয়েও বড় কথা পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা তাঁদের দাস ব্যবসায়ে যাদের জাহাজ সেখানে রয়েছে যারা সম্মতি না দেয় তাদের বিক্রিও করে দিচ্ছে… এই পুরোহিত কি জানে আমি কে?

না, যুবরাজ। তাকে কেবল জানানো হয়েছে যে আপনি একজন মোগল অভিজাত ব্যক্তি।

‘তাকে আমার কাছে আসতে বলো।

পুরোহিত যখন সামনের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে, তখন সে অভিবাদন জানাতে নিজের মাথা নত করে। খুররম পুরোহিতের চওড়া কিনারাযুক্ত টুপির নিচে ছোট করে ছাঁটা দাড়িযুক্ত লম্বা পাতলা বাঁশির মত নাক বিশিষ্ট একটা মুখে হলুদাভ চোখ দেখে। আমি বুঝতে পারছি আপনি হুগলীর একজন পর্তুগীজ পুরোহিত।

হ্যাঁ, জাঁহাপনা, লোকটা ফার্সীতে উত্তর দেয়।

আপনি আমাকে চেনেন?

‘আমার নাম ফাদার রোনাল্ডো। আমি কয়েক বছর পূর্বে আপনার আব্বাজানের দরবারে গিয়েছিলাম। আপনার আব্বাজান সেই সময়ে আমাদের ধর্মের–একমাত্র ধর্মবিশ্বাস–বিষয়ে বেশ আগ্রহ প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি সেই সময়ে আমার মত একজন জেসুইট পুরোহিতকে আপনার ছোট ভাইয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পর্যন্ত করতে চেয়েছিলেন।

খুররম মাথা নাড়ে। তার এখন মনে পড়েছে তার পিতামহ আকবরের ন্যায়–তাঁর আব্বাজানও এই জেসুইটদের বিষয়ে ঠিক কতটা আগ্রহী ছিলেন। একটা সময় ছিল যখন দরবাবে ঝাঁকে ঝাঁকে পুরোহিত দেখা যেত এবং যেনতেনভাবে প্রস্তুত কাঠের তৈরি বিশাল একটা ক্রুশ নিয়ে আগ্রার সড়কে তাঁদের মিছিলের ব্যাপারে আর গির্জা নির্মাণের জন্য তাদের নিরন্তর অনুরোধের বিষয়ে মোল্লারা ভীষণ আপত্তি জানিয়েছিল।

ফাদার রোনাল্ডো তাঁর পাতলা ঠোঁট কুঞ্চিত করে। সম্রাট তাঁর নিজের ধর্মমতের পুরোহিতদের গোড়া বিশ্বাসের কাছে, যারা আমাদের প্রভাবের কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিল আর ঈশ্বরের সত্যিকারের পথ প্রদর্শক হিসাবে আমাদের ভয় করতো, নিজেকে প্রভাবিত হতে দিয়েছেন।

খুররম কোনো উত্তর দেয় না। এটা ধর্মীয় আলাপের উপযুক্ত সময় না। তার আর তার পরিবারের সাহায্য প্রয়োজন এবং সেটা হয়ত এই লোকটার কাছে পাওয়া যেতে পারে। আপনি কি জানেন কি কারণে আমাকে বাংলায় আসতে হয়েছে? সে পুরোহিতের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে। হলুদাভ চোখের মণি চঞ্চল হয়ে উঠে।

‘আপনার আর আপনার আব্বাজানের ভিতরে কোনো কারণে একটা মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা শুনেছি, কিছুক্ষণ পরে ফাদার রোনাল্ডো উত্তর দেয়।

ব্যাপারটা মতানৈক্যের চেয়েও বড়। আমাদের ভিতরে প্রায় যুধ্যমান একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আমি আমার পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি কেবল একটা আশা নিয়ে যে আমি আমার বাহিনী পুনর্গঠিত করার সময় তাঁদের জন্য এখানে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাব। আমার সাথে এখনও অনেকের মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে।

‘আপনি আসলেই বিশ্বাস করেন যে বিষয়টা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে? পুরোহিতকে কেমন বিভ্রান্ত দেখায়।

‘আমি সেটা চাই না কিন্তু সেটাই হতে পারে। আমার আব্বাজান এখন আর কোনোমতেই স্বাধীন নন। তিনি আফিম আর সুরার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছেন এবং নিজের সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা নিজের স্ত্রীর হাতে অর্পন করেছেন।’

‘সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা? আমাদের বণিকদের সম্প্রতি নীল বাণিজ্যের অধিকার দিয়ে জারি করা একটা হুকুমনামায় তার সীলমোহর ছিল। আমরা তখন বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু ধারণা করেছিলাম যে সম্রাট অসুস্থ বলেই এমনটা হয়েছে।

‘না। তিনি নন এখন সম্রাজ্ঞীই শাসন পরিচালনা করছেন। আমি পরে আপনাকে সবকিছু খুলে বলবো কিন্তু তার আগে আমায় জানতে হবে যে হুগলীতে আপনি আর আপনার সাথী অন্যান্য পর্তুগীজরা কি আমার পরিবারকে শরণস্থল দান করবেন? আমরা কয়েকশ মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছি, অধিকাংশ সময়েই যা ছিল বিপদসঙ্কুল। আমার সন্তানদের বয়স অল্প আর আমার স্ত্রী অসুস্থ এবং সন্তানসম্ভবা। তাঁর বিশ্রাম প্রয়োজন।’

পুরোহিতকে এই প্রথমবার হাসতে দেখা যায়। যুবরাজ, আপনাকে সাহায্য করা খ্রিস্টান হিসাবে এটা আমাদের দায়িত্ব। আপনি যদি আপনার ইংরেজ পরিচারককে আমার সাথে আগে যাবার অনুমতি দেন, আমি তাহলে আমার পুরোহিত ভাইদের সাথে কথা বলতে এবং আপনার বসবাসের জন্য আমরা আবাসস্থল প্রস্তুত করতে পারি।

*

 

আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

হুগলী নদীর তীরে উঁচু খুটির উপরে অবস্থিত একটা সাধারণ একতলা, তালপাতার বাসার চুনকাম করা একটা কক্ষের মসলিনের পর্দা মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয় যেখানে আরজুমান্দ একটা নিচু নরম ডিভানে শুয়ে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর দৃষ্টি উল্টো দিকের দেয়ালে ঝুলন্ত রহস্যময় একটা চিত্রকর্মের উপরে স্থির থাকে যেখানে একটা কাঠের ক্রুশে একটা মানুষকে পেরেক দিয়ে আটকানো রয়েছে। লোকটা এতই কৃশকায় যে তার পাজরের সবগুলো হাড় বাইরের দিকে বের হয়ে আছে এবং একটা কাঁটাযুক্ত মুকুটের নিচে থেকে তাঁর মোমের মত ফ্যাকাশে মুখে যা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে রয়েছে, রক্ত গড়িয়ে নামছে যা এতই গাঢ় দেখতে যে প্রায় কালচে মনে হয়। তার দু’চোখ হতাশভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখের মণি দেখা প্রায় যায়ই না, কেবল শিরাযুক্ত সাদা অংশ চোখে পড়ে। একটা ভয়ঙ্কর চিত্রকর্ম এবং রাতের বেলা সে একটা সাদা কাপড় দিয়ে ছবিটা ঢেকে রাখে কিন্তু দিনের বেলা সে তার পর্তুগীজ পরিচারিকাদের মনে আঘাত দিতে চায় না বলে যারা ভীষণ মমতা নিয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত। পুরোহিতদের জন্য তাঁরাই খাবার রান্না করে আর সবকিছু ঝেড়েমুছে পরিষ্কার রাখে, এবং সেই সাথে এখানে পুরোহিতদের দেয়াল ঘেরা আঙ্গিণায় তাদের ছোট পরিবারের সব দায়িত্ব আর তাঁর এবং খুররমের সেবা শুশ্রূষার দায়িত্বও তারা নিয়েছে। তাঁরা প্রায়ই অবশ্য পর্তুগীজদের ভীষণ পছন্দের নোনতা মাছ যা এখানে শুঁটকি নামে পরিচিত তাঁদেরও খেতে দেয়। খুররমের সৈন্যরা হুগলীর তীরে বেশ আরামদায়কভাবেই শিবির স্থাপন করে অবস্থান করেছে যেখান থেকে প্রায় আধমাইল দূরে পর্তুগীজদের বাণিজ্য বহরগুলো নোঙর করে রাখা।

আগ্রার স্মৃতি এবং বিশেষ করে তার দাদাজান গিয়াস বেগের কথা, যাকে সে আর কোনোদিনই দেখতে পাবে না, প্রায়ই তার মনে এসে ভীড় জমায়। সে আর খুররম হুগলীতে পৌঁছাবার কিছুদিন আগেই একজন পর্তুগীজ বণিক এখানে এসেছিলেন যিনি পাদ্রীদের বলেছেন যে রাজকীয় কোষাধ্যক্ষ মারা গিয়েছেন এবং মোগল দরবার শোক পালন করছে। সে কথাটা একেবারেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাঁর জীবনে দাদাজানের উপস্থিতি–তাঁদের পুরো পরিবারের সবার কাছে–এতই ব্যাপক ছিল। সংবাদটা অনিবার্যভাবেই তার ভাবনাগুলোকে তাঁর ফুপুজান মেহেরুন্নিসার দিকে ধাবিত করে। মেহেরুন্নিসা নিশ্চিতভাবেই এখন শোকগ্রস্থ… নাকি তিনি? মেহেরুন্নিসার কারণেই, মোগল রাজপরিবার অতীতে বহুবার যেমন হয়েছে, পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, সৎ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে সৎ-ভাইয়ের মত, আবারও টুকরো হয়েছে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় যে তাঁদের এই পারিবারিক সমস্যা অনেকটা ফুলের ভেতরের কীটের মত, অলক্ষ্যে থেকে কুড়ে কুড়ে সবকিছু খায় যতক্ষণ না অনেক দেরি হয়ে যায়।

কক্ষের বাইরে থেকে নিজের সন্তানদের চিৎকারের শব্দ শুনে, সে ভাবে, তার নিজের সন্তানদের ভিতরে একতার এমন অভাব যেন কখনও দেখা না যায়। খুররম তার তিন পুত্রকেই ভীষণ ভালোবাসে এবং তারাও তাকে ভালোবাসে। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর ছেলেরা সবাই আপন ভাই, আলাদা আলাদা মায়ের সন্তান না যারা বিভিন্ন স্থানে বড় হবার কারণে তাদের ভিতরে ভ্রাতৃত্ববোধ কখনও পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে না, যাদের দেখাশোনা করার জন্য স্নেহময়ী এক মা আছেন। আর সেই সাথে যে বিপদ আর কষ্ট তারা সহ্য করেছে–সম্ভবত এখনও করছে–তাঁদের ভিতরে আরো গভীর বন্ধনের জন্ম দেবে।

নিজের ভিতরে একটা লাথি অনুভব করতে, সে নড়ে ওঠে। এই সন্তানটা কেমন হবে? আরেকটা ছেলে? এই সন্তানটা অনেক বড়–তার উদর আগে কখনও এত বিশাল হয়নি। সে গর্ভাবস্থায় সাধারণত ভালোই বোধ করে আর প্রতিটা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে সন্তান জন্ম দেয়াটা তার জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। কিন্তু এইবার গর্ভাবস্থার সময় সে অসুস্থবোধ করেছে এবং খানিকটা ভয়ও পেয়েছে। সে যতকিছু সহ্য করেছে এবং তার বাহুর ক্ষতটা যা এখনও পুরোপুরি সারেনি, তাঁর মাঝে ভীষণ দূর্বল একটা অনুভূতি জন্ম দেয়… সহসা একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়তে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

*

হুগলী নদীর তীর বরাবর কয়েক ঘন্টা শিকার করে ফুরফুরে মেজাজে খুররম যখন জেসুইট পাদ্রীদের আবাসিক এলাকার দিকে ঘোড়ায় চেপে ফিরে আসে সে একটা যুবককে তার দিকে দৌড়ে আসতে দেখে যাকে সে পাদ্রীদের পরিচারকদের একজন হিসাবে চিনতে পারে। সে একজন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান এবং সুতি কাপড়ের ধুতির পরিবর্তে তাঁর পরনে ইউরোপীয় রীতির কোট আর পাতলুন।

‘আপনার স্ত্রীর গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয়েছে, খুররম শুনতে পাবে এমন দূরত্বে পৌঁছান মাত্রই সে চিৎকার করে বলে।

খুররম তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে, তাঁর মনে কেবল একটা ভাবনাই আকৃতি লাভ করে–অনেক তাড়াতাড়ি… অনেকবেশি আগে… সে ঘোড়া নিয়ে দ্রুত আবাসিক এলাকার দিকে এগিয়ে যায়, ঘোড়া থেকে নামে এবং কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আরজুমান্দের কক্ষের দিকে দৌড়ে যায়। সে বন্ধ দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়, গর্ভযন্ত্রণার স্বাভাবিক কান্নাকাটি শুনতে চেষ্টা করে, কিন্তু সে সবের পরিবর্তে সেখানে নিরবতা বিরাজ করছে এবং বিষয়টা তার হাত পা ঠাণ্ডা করে দেয়। তারপরেই দরজা খুলে যায় এবং পর্তুগীজ পরিচারিকাদের একজন বাইরে আসে। কি হয়েছে? সে জানতে চায় কিন্তু পরিচারিকা মেয়েটা দুর্বোধ্য ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আরজুমান্দ রক্তে মাখামাখি অবস্থায় শুয়ে রয়েছে এবং ধাত্রী বসে ছোট আর নিথর কিছু একটা একটুকরো কাপড়ে জড়াচ্ছে।

সে মন্থর পায়ে শয্যার দিকে এগিয়ে যায়, তাকে কি দেখতে হতে পারে ভেবে ভীত। সে তারপরে আরজুমালের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

‘খুররম–আমি দুঃখিত। আমরা আমাদের সন্তানকে হারিয়েছি…’।

তাঁর কথা বলতে এক মুহূর্ত দেরি হয় এবং তখনও তার গলার স্বর কাঁপছে। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তুমি বেঁচে রয়েছে… পুরোটাই আমার দোষ। তোমায় এত কষ্টের ভিতরে ফেলাটা আমার উচিত হয়নি। আমার উচিত ছিল আগ্রায় আমাকে গ্রেফতার করার সুযোগ আব্বাজানকে দেয়া সেটা না করে তোমায় আর আমাদের সন্তানদের হিন্দুস্তানের প্রান্তরে টেনে নিয়ে এসেছি যতক্ষণ না আমরা পেছনে শিকারী কুকুরের ধাওয়া খাওয়া শিকারে পরিণত হয়েছি।’

না, সে ক্লান্ত স্বরে ফিসফিস করে বলে। এসব কথা বলবেন না। আমরা অন্তত একসঙ্গে রয়েছি, এবং আমরা যতক্ষণ একসঙ্গে আছি ততক্ষণ আমরা আশাবাদী।’

খুররম তাকে আলিঙ্গণ করে এবং আর কোনো কথা বলে না, কিন্তু তাঁর ভিতরে তিক্ততা বাড়তে থাকে। তাঁর সন্তানের এই অপমৃত্যুর জন্য একমাত্র তাঁর আব্বাজান এতটাই দায়ী যে তিনি যেন নিজ হাতে তাকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। তাকে আর তার পরিবারকে জাহাঙ্গীরের জন্য যদি এতটা যন্ত্রণা ভোগ না করতে হতো তাহলে আরজুমান্দকে কখনও পালিয়ে বেড়াতে হতো না, নদীতে দুর্ঘটনার শিকার হতে হতো না যা তাদের সন্তানকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত গর্ভে ধারণ করার পক্ষে তাকে ভীষণ দুর্বল করে ফেলেছিল।

*

 

আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘এটা কোনোভাবেই আপনার অভিপ্রায় হতে পারে না।’ খুররম ফাদার রোনাল্ডোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাস স্পষ্ট বোঝা যায়।

‘আমি দুঃখিত। আমরা আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব করেছি। আমরা তিনমাসের অধিক সময় আপনাদের আতিথিয়তা দান করেছি এবং আপনার এখন অবশ্যই চলে যাওয়া উচিত।’

‘আমার স্ত্রীর মাত্র গর্ভপাত হয়েছে। সে এখনও ভালো করে দাঁড়াতেই পারে না… এই শারীরিক অবস্থায় তাঁর পক্ষে ভ্রমণের ধকল সামলানো সম্ভব না।

‘আপনার স্ত্রীর গর্ভধারণের একটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সহানুভূতি আর পরহিব্রত আমাদের হাত বেঁধে রেখেছিল… আমরা আমাদের যতটা করা উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিমধ্যেই আপনার জন্য করেছি।’

‘আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। কি এমন ঘটেছে যা আপনাকে আমাদের প্রতি বিরূপ করে তুলেছে?’ খুররম অকপটে জানতে চায়।

ফাদার রোনাল্ডোকে এক মুহূর্তের জন্য বিব্রত দেখায় কিন্তু তারপরে তিনি নিজের কৃশকায় কাঠামোটা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। মহামান্য সম্রাট আপনার আব্বাজান জানেন যে আপনি হুগলীতে আমাদের এখানে রয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে আমাদের একটা জাহাজ দরবারের একটা বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে। আমাদের বলা হয়েছে যে আমরা যদি আপনাকে বহিষ্কার না করি তাহলে সম্রাট আমাদের বিরুদ্ধে তাঁর বাহিনী প্রেরণ করবেন আর এই কুঠি জ্বালিয়ে দেবেন। আমরা এটা ঘটতে দিতে পারি না। আমাদের ঈশ্বরের কাজ করতে হবে–অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মানবাত্মাকে মুক্তির আলোয় নিয়ে আসতে…’

‘আর মুনাফা করতে হবে, খুররম ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠে। আমার আব্বাজানের যত দোষই থাক আপনাদের ভণ্ড আর স্বার্থান্বেষী বাক্য চয়নের অসারতা বোঝার মত মানসিক স্থিরতা তার এখনও রয়েছে। আপনারা সবসময়ে যে প্রেমময় করুণার বিষয়ে কথা বলেন সেই খ্রিস্টান পরহিত এখন কোথায়? তিন দিন আগে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা একজন অসুস্থ মহিলাকে নিয়ে আপনারা আমায় অনিশ্চিতের পথে রওয়ানা হতে বলছেন।’

‘আমি দুঃখিত। বিষয়টা এখন আর আমার হাতে নেই। আমাদের সম্প্রদায়ের প্রধান আর আমাদের বণিকমণ্ডলীর সভাপতি সম্মিলিতভাবে আমাদের পরামর্শদাতাদের একটা বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

খুররম কোনো কিছু বোঝার আগেই সে টের পায় তার হাত কোমরে থাকা খঞ্জরের বাটে চেপে বসেছে। এই তোষামুদে, আত্ম-প্রবঞ্চক কণ্ঠস্বরটা থামিয়ে দিতে তার ভীষণ ইচ্ছে হয়। আপনি যে বার্তাটার কথা উল্লেখ করছেন–আমার আব্বাজানের স্বাক্ষর কি সেখানে রয়েছে?

না। পাদ্রী নিজের ধুলিধুসরিত স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। সম্রাজ্ঞীর স্বাক্ষর রয়েছে এবং তাঁর নিজস্ব সীলমোহর যেখানে তাঁর উপাধি নূর জাহান, দুনিয়ার আলো, উৎত্তীর্ণ রয়েছে।

‘আমি আপনাকে একটা কথা বলছি আর আপনার উচিত সেটা মনে রাখা। সম্রাজ্ঞী মোটেই আপনাদের বন্ধু নন। মোগল রসুইঘরের উচ্ছিষ্ট নিয়ে রাস্তার কুকুর যেমন নিজেদের ভিতরে কাড়াকাড়ি করে তিনি ঠিক সেইরকম ঘৃণা করেন প্রতিটা ইউরোপীয়কে। আপনি তার আদেশ পালন করে হয়ত তাঁর রোষের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন কিন্তু কোনো পুরষ্কার পাবেন না। আর আমি একদিন যখন মোগল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হব–আমি হবোই–আপনার আজকের এই নিশ্চেতন উদাসীনতার কথা তখন আমার স্মরণ থাকবে।

পাদ্রী বেত্রাহত কুকুরের মত কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়া মাত্র, নিজের জাত ভাইদের কাছে তাদের এই আলোচনার বিষয়টা জানাতে গিয়েছে সেটা নিয়ে খুররম নিঃসন্দেহ, সে দ্রুত চিন্তা করতে করতে সরাসরি নিজের শিবিরে ফিরে যায়। পর্তুগীজদের মাথায় যদি কোনো দুর্মতির উদয় হয়–যেমন তারা যদি তাকে বন্দি করার চেষ্টা করে যাতে তারা তাকে তাঁর আব্বাজানের কাছে সোপর্দ করতে পারবে, তাহলে কুঠি পাহারায় নিযুক্ত পর্তুগীজ সৈন্যদের যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবেলায় তাঁর সঙ্গের তিনশ সৈন্য যথেষ্ট। সে সিদ্ধান্ত নেয়, শিবিরের চারপাশে দুই সারির প্রহরী মোতায়েন করবে এবং আজ রাতে সে নিজে, আরজুমান্দ আর তাদের সন্তানদের নিয়ে পাদ্রীদের সাথে না থেকে শিবিরেই রাত্রিযাপন করবে। সে তার কাছে পরে গিয়ে সবকিছু খুলে বলে তাকে বোঝাবে আসলেই এখানে কি ঘটেছে কিন্তু তার আগে সে অন্য যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা তাকে অবশ্যই করতে হবে।

খুররম প্রয়োজনীয় আদেশ দিয়ে নিজের আবাসিক কক্ষে ফিরে আসে এবং তাঁর নিচু লেখার টেবিলের সামনে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে। সে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে চিন্তা করার পরে একটা কাগজ নিয়ে গজদন্তের অগ্রভাগযুক্ত লেখনী তাঁর জেড পাথরের দোয়াতদানিতে ডুবিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করে, প্রতিটা শব্দ কাগজে লেখার আগে তাঁদের গুরুত্ব খুব যত্ন নিয়ে যাচাই করে। সে চিঠিটা মুসাবিদা শেষ করার পরে যা লিখেছে বেশ কয়েকবার পড়ে দেখে। সে তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে প্রহরীদের একজনকে আদেশ দেয় নিকোলাস ব্যালেনটাইনকে ডেকে আনতে। ভিনদেশী কর্চি পাঁচ মিনিট পরে এসে উপস্থিত হয়, তাঁর মাথার উজ্জ্বল সোনালী চুল শক্ত করে বাঁধা একটা কালো পাগড়ির নিচে ঢাকা যা সে সম্প্রতি পরিধান করতে শুরু করেছে।

খুররম শক্ত করে তাঁর কাঁধ আঁকড়ে ধরে। তোমার প্রভু স্যার টমাস রো, হিন্দুস্তান ত্যাগ করার পূর্বে আমায় বলেছিল আমি যদি তোমায় আমার অধীনে নিয়োগ করি তুমি আন্তরিকতা আর আনুগত্যের সাথে আমার সেবা করবে। তিনি কি সত্যি কথা বলেছিলেন?

নিকোলাসের নীল চোখে তার বিস্ময় স্পষ্ট ফুটে উঠে। হ্যাঁ, যুবরাজ।

 

আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘আমার কথা মন দিয়ে শোন–আমি তোমায় সবকিছু খোলাখুলি বলছি। আমাদের পক্ষে হুগলীতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পর্তুগীজরা ভয় করছে যদি আমাদের আর বেশি দিন এখানে আশ্রয় দেয় তাহলে তারা হয়ত আমার আব্বাজানের কোপের সম্মুখীন হবে আর আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলেছে। আমি ভালো করেই জানি আমাদের পক্ষে ভবঘুরের মত বিচরণ করা সম্ভব না। আমার আব্বাজানের সৈন্যবাহিনী তাহলে অচিরেই আমাদের নাগাল পাবে আর কচুকাটা করবে। আমরা উপকূল থেকে জাহাজে চেপে পারস্যে বা অন্য কোথায় চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি আমার মাতৃভূমি থেকে এভাবে বিতাড়িত হতে চাই না। আর তাছাড়া আমার স্ত্রীর শরীরও নাজুক। আমাকে অবশ্যই তাঁর কথা চিন্তা করতে হবে। আমি তাই বিরোধের মীমাংসা করতে আমার আব্বাজানকে একটা চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি জানি না তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করবেন কিনা কিন্তু আমাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। তোমার কাছে আমার প্রশ্ন হল তুমি কি আমার বার্তাবাহক হতে রাজি হবে? একজন ভিনদেশী হবার কারণে আর সেই সাথে স্যার টমাস রো’র অধীনে কাজ করার কারণে যিনি আমার আব্বাজানের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, অন্য যেকোনো মোগল অমাত্যের চেয়ে আমার আব্বাজানের প্রতিহিংসার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা তোমার প্রায় নেই বললেই চলে। তুমি সেই সাথে দরবারের আচার আচরণের সাথে পরিচিত এবং জানো কীভাবে সেখানে সবকিছু সম্পন্ন করা হয়। তোমার পক্ষে তাই আমার আব্বাজানের হাতে চিঠিটা পৌঁছে দেয়ার একটা ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Bangla Gurukul Logo আগন্তুক মেহেরবান ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment