আবোল তাবোল বাংলা সাহিত্যের শিশু-কিশোর সাহিত্য ধারার এক অনন্য সৃষ্টি, যা লিখেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রসিক কবি সুকুমার রায়। এটি মূলত অর্থহীন কবিতা বা ননসেন্স রাইমস–এর এক অসামান্য সংকলন, যা অদ্ভুতুড়ে কল্পনা, হাস্যরস ও ব্যঙ্গাত্মক ইঙ্গিতের মিশেলে পাঠকদের এক স্বপ্নিল ও অদ্ভুত জগতে নিয়ে যায়।
১৯২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর, তাঁর লেখা এই অসাধারণ কবিতাগুলো “আবোল তাবোল” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটিতে মোট ৫৩টি কবিতা রয়েছে, যেখানে অসংখ্য কল্পিত চরিত্র, অদ্ভুত সব প্রাণী, আর অপ্রত্যাশিত ঘটনার বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করে। যেমন—“হযবরল”, “খিচুড়ি”, “কুমোরের ছেলে”, “গোঁফ চুরি” ইত্যাদি কবিতাগুলো আজও শিশুদের মুখে মুখে ফিরছে।
সুকুমার রায় তাঁর ব্যঙ্গাত্মক অথচ নির্ভেজাল হাস্যরসের মাধ্যমে শিশুদের বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি সমাজজীবনের নানা অসঙ্গতি ও মানুষের হাস্যকর দিকগুলো সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভাষার খেলায়, ছন্দের তালে, আর শব্দের অদ্ভুত মিলনে “আবোল তাবোল” হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ননসেন্স সাহিত্যের এক অনন্য মাইলফলক।
আজও এই বই শুধু শিশুদের নয়, প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের কাছেও সমান জনপ্রিয়—যেখানে কল্পনা, রসিকতা, ও বুদ্ধিদীপ্ত শব্দচাতুর্যের এক অসীম ভাণ্ডার উন্মোচিত হয়।
Table of Contents
আবোল তাবোল – সুকুমার রায়
আবোল তাবোল – ১ – সুকুমার রায়
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর।
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।
আয় ক্ষ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে–
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে।।
আবোল তাবোল – ২ – সুকুমার রায়
মেঘ মুলুকে ঝাপ্সা রাতে,
রামধনুকের আবছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কন্ঠ পুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন্ আকাশতলে
স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে,
সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে,
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্ব যা মোর চিত্তে লাগে-
নাই বা তাহার অর্থ হোক্না
ইবা বুঝুক বেবাক্ লোক।
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।
ছুটলে কথা থামায় কে?
আজকে ঠেকায় আমায় কে?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ তব্লা বাজে-
রাম-খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্
কথায় কাটে কথায় প্যাঁচ্ ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত,
মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভুত!
হ্যাংলা হাতী চ্যাং দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা!
মক্ষিরাণী পক্ষীরাজ-
দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ!
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
আবোল তাবোল – ৩ – সুকুমার রায়
এক যে ছিল রাজা- (থুড়ি,
রাজা নয় সে ডাইনি বুড়ি) !
তার যে ছিল ময়ূর- (না না,
ময়ূর কিসের ? ছাগল ছানা) ।
উঠানে তার থাক্ত পোঁতা-
-(বাড়িই নেই, তার উঠান কোথা) ?
শুনেছি তাত পিশতুতো ভাই-
-(ভাই নয়ত, মামা-গোঁসাই ) ।
বল্ত সে তার শিষ্যটিরে-
-(জন্ম-বোবা বলবে কিরে) ।
যা হোক, তারা তিনটি প্রানী-
-(পাঁচটি তারা, সবাই জানি !)
থও না বাপু খ্যাঁচাখেচি
-(আচ্ছা বল, চুপ করেছি) ।।
তারপরে যেই সন্ধ্যাবেলা,
যেম্নি না তার ওষুধ গেলা,
অম্নি তেড়ে জটায় ধরা-
-(কোথায় জটা ? টাক যে ভরা !)
হোক্ না টেকো তোর তাতে কি ?
গোমরামুখো মুখ্যু ঢেঁকি !
ধরব ঠেসে টুটির পরে
পিট্ব তোমার মুণ্ডু ধরে ।
এখন বাপু পালাও কোথা ?
গল্প বলা সহজ কথা ?