অজিতকুমার দত্ত

অজিতকুমার দত্ত (২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯০৭ – ৩০শে ডিসেম্বর ১৯৭৯)। একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অজিতকুমার দত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার ধারা নির্মাণে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি ‘কবিতা’ পত্রিকার অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন এবং তাঁর লেখায় রোমান্টিকতা, মানবতাবাদ ও দার্শনিক ভাবনা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

জন্ম ও শিক্ষা

অজিতকুমার দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার চাঁদশী গ্রামে। তাঁর পরিবার ছিল শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা। শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তাঁর।

তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. সম্পন্ন করেন। শিক্ষা জীবনেই তিনি সাহিত্যের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ও প্রতিভার প্রকাশ ঘটান।

সাহিত্যিক জীবন

অজিতকুমার দত্তের সাহিত্যজীবন শুরু হয় মূলত কবিতা দিয়ে। তিনি ‘কবিতা’ পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, যা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ আধুনিক কবিদের মাধ্যমে বাংলা কবিতার একটি নতুন ধারা নির্মাণে ভূমিকা রাখে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ চিরন্তন’ প্রকাশিত হয় ১৯৩০-এর দশকে। তাঁর কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, মৃত্যুচিন্তা এবং সমাজ-মনস্তত্ত্ব গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল প্রাবন্ধিকও। তাঁর গদ্য ছিল সুসংহত, যুক্তিপূর্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত। সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে তাঁর বহু প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে বিশেষ মূল্যবান।

উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম

কবিতার বই:

  • চিরন্তন
  • প্রবাহ
  • ত্রিকাল
  • কবিতাসংগ্রহ

প্রবন্ধ গদ্য রচনা:

  • সাহিত্যের সাধনা
  • জীবন দর্শন
  • পশ্চিম প্রাচ্য চিন্তা

তিনি বহু বিদেশি সাহিত্যকেও অনুবাদ করেছেন এবং বাঙালি পাঠকদের জন্য বিশ্বসাহিত্যের দ্বার উন্মোচন করেছেন।

সাহিত্যচিন্তা ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

অজিতকুমার দত্ত ছিলেন একজন গভীর মননের মানুষ। তিনি সাহিত্যে শুধু রূপ-সৌন্দর্য নয়, অন্তর্নিহিত চিন্তাধারাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কবিতা ও গদ্যে জীবন ও মৃত্যুর দার্শনিক প্রশ্ন, সময় ও অসীমের সম্পর্ক, আত্মা ও জগতের সংযোগ, এবং মানবতার অনন্ত সাধনার ছাপ পাওয়া যায়।

তিনি যুক্তিবাদী হলেও আধ্যাত্মিক ভাবনার প্রতিও সম্মান দেখিয়েছেন। তাঁর লেখায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়।

শিক্ষকতা ও অন্যান্য পেশা

অজিতকুমার দত্ত দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। তিনি কলকাতার সিটি কলেজ এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রদের মধ্যে চিন্তার স্বাধীনতা, সাহিত্যবোধ ও বিশ্লেষণশক্তি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।

  • সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (সম্ভবত প্রাবন্ধিক রচনার জন্য)
  • রবীন্দ্র পুরস্কার
  • বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মান

মৃত্যু

অজিতকুমার দত্ত ১৯৭৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর প্রয়াত হন। তবে তিনি রেখে গেছেন এক বিশাল ও গভীর সাহিত্যভাণ্ডার, যা আজও বাংলা সাহিত্যে আলো ছড়ায়।

 

অজিতকুমার দত্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের এক নির্জন সাধক। তিনি শব্দের কারিগর ছিলেন, যিনি ভাষা দিয়ে গড়েছিলেন চিন্তার রাজ্য। তাঁর সাহিত্যিক কৃতিত্ব, গভীর দার্শনিক উপলব্ধি এবং সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment