বর্ণনানুক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বর্ণনা পর্ব ১ – আবাজা (Abaza): আবাজা উত্তর-পশ্চিম ককেশাস অঞ্চলের ভাষা। ভাষাটি প্রধানত ব্যবহার করে রাশিয়ার স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র কারাসেয়-সেরকেসিয়া এবং অ্যাদিজিয়ার জনগণ। এর বাইরে জার্মানি, তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কিছু মানুষ কথা বলেন ভাষায়। আবাজাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। এ ভাষাটি আবখাজ (Abkhaz) ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রায় একই।
অন্যান্য ককেশীয় ভাষার মতো আবাজা ভাষার রয়েছে বেশি সংখ্যক ব্যাঞ্জনবর্ণ (৬৩টি) এবং অল্প কয়েকটি স্বরবর্ণ। ফলে ভাষাবিদদের মতে, এটি ককেশীয় ভাষাগুলোর মধ্য কঠিনতম একটি ভাষা। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে এ ভাষা লেখা হতো ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহার করে। ১৯৩৮ সাল থেকে এটি সিরিলিক (Cyrillic) বর্ণমালার একটি সংস্করণ দ্বারা লেখা হচ্ছে। যদিও তুরস্কে এটি এখনও ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহার করেই লেখা হয়।
Table of Contents
বর্ণনানুক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বর্ণনা পর্ব ১
অ্যাবেনাকি (Abenaki)
অ্যাবেনাকি একটি পূর্ব অ্যালগনকুইয়ান ভাষা। হাতেগোনা কিছু আদিবাসী ইন্ডিয়ান মানুষ দক্ষভাবে এ ভাষায় কথা বলতে পারেন। সঙ্গে আছে মোটামুটি বলতে পারা কয়েকশ মানুষ। এ ভাষার বেশিরভাগ মানুষই বাস করেন কানাডার কিউবেকের ওডানাক রিজারভেশনে এবং তারা অধিকাংশই বয়স্ক মানুষ। এ ভাষাটি মূলত ব্যবহার হয় ভারমন্ট, নিউ হ্যাম্পশায়রে এবং মেইনে।
ভাষাটিকে সংরক্ষণ এবং সচল রাখার চেষ্টা চলছে। ভাষাটির রয়েছে দুটি আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা: পশ্চিম অ্যাবেনাকি যা এখনও ব্যবহৃত হয় কিউবেকে এবং পূর্ব অ্যাবেনাকি যা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ব্যবহার করত পূর্বাঞ্চলীয় মেইনের কিছু পেনবসকই গোত্রের মানুষ।
আবখাজ (Abkhaz)
আবখাজ উত্তর-পশ্চিম ককেশীয় ভাষা। এটি আবাজা, আদিঘে, কাবারদিয়ান এবং উবিখ ভাষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জর্জিয়ার স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র আবখাজিয়ার
প্রায় এক লাখ মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। এছাড়া আরও লাখখানেক আবখাজ ভাষী মানুষ রয়েছেন তুরস্ক, জার্জিয়ার আদজারা, সিরিয়া, জর্ডান, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ ভাষায় রয়েছে দুটি প্রধান উপভাষা: উত্তর বজাপ এবং দক্ষিণ আবজাবা। দ্বিতীয়টির ওপর প্রকৃত আবখাজ ভাষার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। আবখাজ ভাষা প্রথম লিখিত রূপ প্রায় ১৮৬২-৬৩ সালে। এই লিখিত রূপটি তৈরি হয়েছিল বজাপ (Bzap) উপভাষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা উচ্চারণ পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং সিরিলিক বর্ণমালার মাধ্যমে।
লিখিত রূপটি উদ্ভাবন করেন রুশ সৈনিক-ভাষাতত্ত্ববিদ ব্যারন পিটার ভন উসলার। জর্জিয়ান, ল্যাটিন এবং সিরিলিক বর্ণমালা ব্যবহার করে আরেকটি উচ্চারণ পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটে ২০ শতকে। বর্তমান সিরিলিক বর্ণমালাভিত্তিক পদ্ধতিটি যা ১৯৫৪ সাল থেকে ব্যহৃত হচ্ছে, বেশ জটিল এবং অস্থিতিশীল।
তাই সাম্প্রতিক সময়ে ল্যাটিন বর্ণমালা ভিত্তিক একটি উচ্চারণ পদ্ধতি নির্মাণের পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। আবখাজ ভাষার প্রথম উপন্যাসটি লিখেছেন দারমিত গুলিয়া (১৮৭৪-১৯৬০)। দারমিতকে আবখাজ সাহিত্যের জনক বলা হয়। তিনিই প্রথম আবখাজ ভাষায় সংবাদপত্র চালু করেন। লিখেছেন কবিতা, নাটক। করেছেন অনুবাদ। তিবিলিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবখাজ ভাষায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিক লেখা লিখেছেন এবং লেকচার দিয়েছেন।
আদিঘে (Adyghe)
আদিঘে উত্তর-পশ্চিম ককেশীয় ভাষা। রুশ ফেডারেশনের রিপাবলিক অব আদিঘের প্রায় তিন লাখ মানুষ এ ভাষায় কথা বলেন। আদিখে পশ্চিম সিরকাসিয়ান নামেও পরিচিত; তুরস্ক, জর্ডান এবং ইসরায়েলেও এ ভাষা ব্যবহৃত হয়। আদিঘে ভাষাটি কাবারদিয়ান ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। একই সঙ্গে উবিখ, আবখাজ এবং আবাজা ভাষার সঙ্গেও আদিঘের সম্পর্ক রয়েছে। ইউনেস্কোর ওয়ার্লড’স ল্যাংগুয়েজেস ইন ডেঞ্জারের (২০০৯) ম্যাপ অনুসারে আদিঘে ভাষাটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ১৯৩৮ সাল থেকে সিরিলিক বর্ণমালার একটি ভার্সন ব্যবহার করে আদিঘে লেখা হচ্ছে। ১৯২৭ এবং ১৯৩৮ সালের মধ্যে এ ভাষাটি লেখা হতো ল্যাটিন বর্ণমালায় এবং ১৯২৭ সালের আগে এটি লেখা হত ফার্সি বর্ণমালায়। ভাষাটির বাস্তবিক ভিত্তিরয়েছে এর সেমগাই উপভাষার ওপর।
আফার (Afar)
আফার পূর্ব কুশিটিক ভাষা। ইথিওপিয়ার ১০ লাখ এবং জিবুতি ও ইরিত্রিয়ার প্রায় সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। এটি সাহো ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ ভাষার বর্ণমালা বা কাফার ফিরা (Qafar Feera) সৃষ্টি করেন দিমিস এবং রেদো দুজন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী ১৯৭০ সালে তারা তাদের এ কাজ প্রকাশ করেন।
আফ্রিকানস (Afrikaans)
আফ্রিকানস একটি ফ্রাংকোনিয়ান পশ্চিম জার্মান ভাষা, যার উৎপত্তি হয়েছে ডাচ ভাষা থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নামিবিয়ায় এ ভাষাটি প্রধানত ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি দেশে ভাষাটি ব্যবহৃত হয়-অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, কানাডা, জার্মানি, লেসোথো, মালাবি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে। এক কোটি মানুষ আফ্রিকানস ভাষায় কথা বলে তাদের প্রথম অথবা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে।
আরও বেশ কয়েক লাখ মানুষের রয়েছে এ ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান। ১৮ শতকের ডাচ ভাষার নানা বৈশিষ্ট্য এখনও ধরে রেখেছে আফ্রিকানস ভাষা। সঙ্গে আছে বিভিন্ন বান্টু ও খোইসান ভাষা এবং পর্তুগিজ ও মালয় ভাষার নানা শব্দ। আফ্রিকানস ভাষীরা সহজেই ডাচ ভাষা বুঝতে পারে, যদিও ডাচ ভাষীদের আফ্রিকানস বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। ১৮১৫ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলিম স্কুলগুলোর ভাষা হিসেবে আফ্রিকানস, মালয়কে প্রতিস্থাপিত করতে থাকে।
সে সময় এ ভাষাটি লেখা হতো আরবি বর্ণমালায়। ১৮৫০ সালের পর থেকে ল্যাটিন বর্ণমালায় লিখিত এ ভাষাটি সংবাদপত্র, এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে। ১৮৭৫ সালে কেপটাউনের আফ্রিকানসভাষীরা একটি গ্রুপ গঠন করে Genootskap vir Regle Afrikaanders (সোসাইটি ফর রিয়েল আফ্রিকানারস) এবং এ ভাষায় অনেক বই প্রকাশ করে যার মধ্যে আছে ব্যাকরণ, ডিকশনারি, ধর্মীয় উপাদান ও ইতিহাস।
এছাড়াও তারা প্যাট্রিয়ট নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। ২০ শতকের শুরুর বছরগুলোতে আফ্রিকানস ভাষাটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং ১৯২৫ সালে ভাষাটি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার কর্তৃক ডাচ ভাষায় স্ল্যাংয়ের পরিবর্তে স্বতন্ত্র পরিপূর্ণ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকে এ ভাষায় পরিবর্তন হয়েছে খুব সামান্য।

আইনু (Ainu)
জাপানের উত্তরাংশের হোক্কাইডো দ্বীপের ১৫টি পরিবার এ ভাষায় কথা বলে। এটি এক সময় বলা হতো কুরাইল দ্বীপ, হোনসুর উত্তরাংশে এবং শাখালিনের দক্ষিণার্ধে। শাখালিনের আইনু ভাষার শেষ মানুষটি ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আইনু একটি বিচ্ছিন্ন ভাষা, যা অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। প্রায় দেড় লাখ জাপানি জাতিগতভাবে আইনু কিন্তু তাদের বেশিরভাগ শুধু জাপানিজ ভাষায় কথা বলে।
আইনুদের জনসংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয় কিন্তু অনেকেই তাদের এই জাতিগত পরিচয়ের ব্যাপারে সচেতন নন এবং অনেকে বৈষম্যের ভয়ে নিজেদের এই জাতিগত পরিচয়কে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। বর্তমানে ভাষাটিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন অনেকে। এদের মধ্যে শিজেরু কায়ানোর নাম উল্লেখযোগ্য। শিজেরুর মাতৃভাষা আইনুর উপভাষা মিশিমা (একমাত্র জীবিত উপভাষা)। তিনি আইনু ভাষা শিক্ষা দেয়ার একটি স্কুল চালু করেছেন এবং আইনু ভাষার নিজস্ব ঐতিহ্য ধারণকারী গল্প সংগ্রহ করছেন।
আইনু ভাষা লেখা হয় জাপানি কাতাকানা বর্ণমালার একটি ভার্সন ব্যবহার করে। ল্যাটিন বর্ণমালার ভিত্তিতে তৈরি করা বর্ণমালাও রয়েছে। এ ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ মৌখিক সাহিত্য, ইউকার (Yukar নায়কের কাহিনী), কামুই ইউকার (Kamui Yukar দেবতার গল্প) এবং উইবেপেকার (Uwepeker প্রাচীন গল্প)।
আকান (Akan)
আকান ভাষাটি নাইজার-কঙ্গো ভাষার কাবা শাখার অংশ। পূর্ব আইভরি কোস্ট, দক্ষিণ-মধ্য ঘানা এবং মধ্য টোগোর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ আকান ভাষায় কথা বলে। এ ভাষার রয়েছে অসংখ্য উপভাষা-তবি, ফান্ডে, বোনো, বাসা, এনজেমা, বাউলে এবং আনই। এ উপভাষাগুলো পারস্পরিক বোধগম্যতার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে।
আকান ভাষা প্রধানত ব্যবহৃত হয়েছে ধর্মীয় প্রকাশনায়। ডাচ, জার্মান এবং ব্রিটিশ মিশনারিরা ১৭ এবং ১৮ শতকে ধর্মীয় প্রকাশনায় ভাষাটিকে ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে আসান্তে, আকুয়াপেম এবং ফান্ডে উপভাষার জন্য তিনটি আদর্শ বানানরীতিরয়েছে। ১৯৮০ সালে একটি একীভূত আকান বানানরীতি তৈরি হয়।
আলবেনিয়ান (Albanian)
আলবেনিয়ান একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা যেটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতে নিজস্ব শাখা তৈরি করেছে। এর কোনো নিকটাত্মীয় নেই। প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ এ ভাষায় কথা বলেন। এ ভাষা প্রধানত ব্যবহৃত হয় আলবেনিয়া এবং কসোভোতে। এছাড়া মেসিডোনিয়া, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়া, গ্রিস এবং ইতালির কিছু অংশে এ ভাষা ব্যবহৃত হয়।
অনেক ভাষাবিশেষজ্ঞ মনে করেন, আলবেনিয়ান ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার ইলিরিয়ান গ্রুপের বংশধর। ইলিরিয়ান ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত পশ্চিম বলকান এলাকায় প্রচলিত ছিল। আবার অন্য একটি বিশেষজ্ঞ দল মনে করে, এটি ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষার থ্রাসিয়ান বা দাসিয়ান গ্রুপের বংশধর। থ্রাসিয়ান ৫ম শতক পর্যন্ত বলকান এলাকার কিছু অংশে প্রচলিত ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে আলবেনিয়ান গ্রিক এবং ল্যাটিন থেকে অনেক শব্দ গ্রহণ করে নেয়। এরপর বলকান এলাকায় আবাস তৈরি করা স্লাভিক এবং জার্মান গোষ্ঠীগুলোর ভাষা দিয়ে প্রভাবিত হয়। এর সঙ্গে ৯ম শতকে প্রোটো-রোমানিয়ান বা ভুাচস থেকেও অনেক উপাদান যুক্ত হয় আলবেনিয়ানে।
আলবেনিয়ানের রয়েছে দুটি প্রধান উপভাষা-টস্ক (Toskesisht) ও ঘেগ (Gegerisht)। শকামবিন নদী এ দুটি উপভাষার মধ্যে ভেদরেখা টেনে দিয়েছে।
টসু, আলবেনিয়ার আনুষ্ঠানিক ভাষা। পাশাপাশি কসোভো এবং মেসিডেনিয়ার অন্যতম আনুষ্ঠানিক ভাষা এটি। দক্ষিণ আলবেনিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, ইতালিতে টস্ক বলা হয় অন্যদিকে সাইবেরিয়া, মন্টেনেগ্রো, কসোভো, মেসিডোনিয়া, উত্তর আলবেনিয়া এবং বুলগেরিয়ায় বলা হয় ঘেগ।
উপভাষা দুটির মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক বোধগম্যতা, মধ্য আলবেনিয়ায় ব্যবহৃত হয় আলবাজিয়ানের পরিবর্তিত একটি রূপ। ১৫ শতক থেকে বিভিন্ন বর্ণমালা ব্যবহার করে এ ভাষাটি লিখিত হতে থাকে। টস্ক লেখা হতো গ্রিক আর ঘেগ ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহার করে। একই সঙ্গে উভয়ই আরবি বর্ণমালার তুরস্কের ভার্সন ব্যবহার করেও লেখা হতো।
টস্ক উপভাষার ওপর ভিত্তি করে আলবেনিয়ানের একীভূত বাস্তবিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। এর বাইরে আলবেনিয়ান লিখতে আরও কিছু বর্ণমালা ব্যবহৃত হয় যেমন- এলবাসান, বেইথা কুকজু এবং তোধরি। ১৮ এবং ১৯ শতকে এগুলোর আবির্ভাব ঘটে কিন্তু কখনই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি।
আলেউট (Aleut)
আলেউট, এসকিমো-আলেউট ভাষা পরিবারের সদস্য। আলাস্কা এবং সাইবেরিয়ান কমান্ডার দ্বীপের শতিনেক মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। এ ভাষার বেশিরভাগ মানুষ বাস করেন আলাস্কার আলেউটিয়ান ও প্রিবিলফ দ্বীপে। ভাষাটির দুটি প্রধান উপভাষা রয়েছে-পূর্ব আলেউট এবং আটকান।
১৯ শতকে আলাস্কা যখন রাশিয়ার অংশ ছিল তখন আলেউট লেখা হতো সিরিলিক বর্ণমালার একটি ভার্সনের সাহায্যে। এটি চালু করেছিলেন একজন রুশ অর্থডক্স যাজক আইওয়ান ভেনিয়ামিনভ (১৭৯৭-১৮৭৯)। ভেনিয়ামিনভ আলেউট নিয়ে কাজ শুরু করেন ১৮২৪ সালে। তিনি বাইবেলের বেশ কিছু অংশ এবং অন্যান্য ধর্মীয় লেখা আলেউট ভাষায় রূপান্তর করেন। ১৮৪৬ সালে তিনি পূর্ব আলেউটের ব্যাকরণ প্রকাশ করেন।
এ ভাষার ল্যাটিন বানানরীতি গড়ে ওঠে ২০ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। একটি করেন নাট বার্গসল্যান্ড এবং তার সহযোগী ছিলেন উইলিয়াম ড্রিকস, মোজেস ড্রিকস এবং অন্য আলেউট ভাষীরা বার্গসল্যান্ড ১৯৯৪ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ আলেউট ডিকশনারি তৈরি করেন এবং এ ভাষার একটি বিশদ ব্যাকরণ প্রকাশ করেন ১৯৯৭ সালে।
আমহারিক (Amharic)
আমহারিক একটি সেমিটিক ভাষা। ইথিওপিয়ার জাতীয় ভাষা এটি। এ ভাষার আড়াই কোটি বা তার বেশি আমহারিকভাষীর বেশিরভাগই বাস করেন ইথিওপিয়ায়। অবশ্য ইরিত্রিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইডেনেও আমহারিকভাষীর মানুষ বাস করেন।
আমহারিক নামটি এসেছে ইথিওপিয়ার উত্তরাংশের একটি জেলা আমহারার নাম থেকে। আমহারা জেলাকে আমহারিক ভাষার ঐতিহাসিক উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আমহারিক লেখা হয় গি’জ (Ge’ez) বর্ণমালার একটি ভার্সনের মাধ্যমে। আমহারিক থেকে ল্যাটিন বর্ণমালায় লিপ্যন্তর/অক্ষরান্তর করার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। এর একটি তৈরি করেন আর্নস্ট হ্যামারশমিডট। এনসাইক্লোপিডিয়া এথিওপিকা তৈরি করে ইএই লিপ্যন্তর পদ্ধতি। এছাড়া আমহারিকে লেখা নামকে রোমান লিপিতে রূপান্তরের জন্য ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয় বিজিএন/পিসিজিএন পদ্ধতি।
বিজিএন = বোর্ড অন জিওগ্রাফিক নেমস (ইউএসএ)
পিসিজিএন = দ্য পারমানেন্ট কমিটি অন জিওগ্রাফিকাল নেমস ফর ব্রিটিশ অফিসিয়াল ইউজ।
অ্যাপাচি (Apache)
এটি উত্তর আমেরিকার অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানদের ভাষা। অ্যাপাচি একটি অ্যাথাবাস্কান ভাষা। আরিজোনা এবং নিউ মেক্সিকোতে অ্যাপাচিভাষীর প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বাস করেন। প্রকৃতপক্ষে অ্যাপাচি ভাষা দুটি পশ্চিম অ্যাপাচি এবং পূর্ব অ্যাপাচি। এদের রয়েছে অনেক উপভাষা। যেমন-জিকারিলা, লিপান, কিত্তবা অ্যাপাচি, সিরিকাহুয়া, মেসকালেরো।
অ্যাপাচি এবং নাভাহো ভাষা দুটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
ধারণা করা হয়, অ্যাপাচি নামটি এসেছে একটি ইউমা (Yuma) শব্দ থেকে যার অর্থ ‘ফাইটিং ম্যান’ অথবা অ্যাপাচু (Apachu) শব্দটি থেকে, যার অর্থ জুনি ইন্ডিয়ানদের ভাষায় শত্রু। নাভাহো ইন্ডিয়ানদের জুনিরা নামেই সম্বোধন করত। আর নিউ মেক্সিকোর স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা নাভাহোদের শত্রু সম্বোধন করতে গিয়ে বলত ‘অ্যাাটিস দে নাবাজু’ (Apaches de Nabaju)
আরাগোনেস (Aragonese)
আরাগোনেস প্রধানত প্রচলিত আছে স্পেনের আরাগোনে। এটি একটি রোমান ভাষা। আরাগোনেস ভাষীরা বাস করেন আরাগোন নদীর উপত্যকা, সোবরারবে, রিবাগোরজা এবং ক্যাটালেনিয়ার কিছু অংশে। জন্মগতভাবে এ ভাষায় কথা বলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে ৫০০ প্রবীণ শুধু এ ভাষাতেই কথা বলেন যাদের ভাষাবিজ্ঞানে বলা হয় মনোলিংগুয়াল। ২০ হাজার মানুষ এ ভাষাটিকে ব্যবহার করে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে।
আরানিজ (Aranese)
আরানিজ হচ্ছে ওকিটানের গ্যাসকন উপভাষার সামান্য পরিবর্তিত রূপ। স্পেনের উত্তর-পূর্বের ভ্যাল ডি আরানে প্রচলিত রয়েছে এ ভাষা। ভ্যাল ডি আরানের ৯০ শতাংশ অধিবাসী আরানিজ বুঝতে পারেন। ৬৫ শতাংশ বলতে পারেন। আরানিজ ভাষাটি স্প্যানিশ এবং ক্যাটালানের সঙ্গে কো-অফিসিয়াল মর্যাদা লাভ করেছে এবং ১৯৮৪ সাল থেকে স্কুলে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
আরবি (Arabic)
আরবি একটি সেমেটিক ভাষা। প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে এ ভাষা ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীতে আরবি ভাষার জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি ২০ লাখ। কথ্য বা চলিত আরবির আছে ৩০টির বেশি প্রকার। যেমন: মিশরীয়, আলজেরিয়, মাগরেবি, সুদানি, সাইদি, নাজদি প্রভৃতি। আরবি লিপির উদ্ভব হয়েছে নাবাতায়েআন (Nabataean) আরামায়িক লিপি থেকে।
লিখিত আরবির আছে দুটি প্রধান প্রকার। এক. ক্লাসিক্যাল আরবি, দুই, আধুনিক স্ট্যান্ডার্ড আরবি। ক্লাসিক্যাল আরবি হলো কুরআন এবং ইসলাম ধর্মীয় সাহিত্যের ভাষা। অন্যদিকে, আধুনিক স্ট্যান্ডার্ড হল ক্লাসিক্যাল আরবি থেকে ভঙ্গি এবং শব্দভাণ্ডারের সামান্য পার্থক্যসম্পন্ন সার্বজনীন একটি রূপ। বর্তমানকালে আরবি ভাষী সকল দেশে লেখা এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আধুনিক আরবি ব্যবহৃত হয়।
আরাপাহো (Arapaho)
আরাপাহো একটি অ্যালগনকুইয়ান ভাষা। এ ভাষার প্রায় ১ হাজার লোক বাস করেন ওমিং-এ এবং এদের অধিকাংশই বয়সে প্রবীণ। আরাপাহোরা এখন চেষ্টা করছেন তাদের ভাষা তরুণদের মধ্যে পুনরুজ্জীবন ঘটাতে এবং ছড়িয়ে দিতে। ভাষাটি গ্রস ভেনত্রে বা আনানিন ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দুটি ভাষার মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক বোধগম্য অংশ।
আরগোব্বা (Argobba)
ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার উত্তর-পূর্বের একটি এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এ ভাষায় কথা বলেন। ভাষাটি সেমিটিক ভাষার দক্ষিণ ইথিওপিয়ান শাখার সদস্য। ভাষাটির রয়েছে চারটি প্রধান উপভাষা-হারার বিলুপ্ত, আলিযু, আম্বা, শেবা রোবিট এবং শোনকে। বর্তমানে আরগোব্বা ভাষীরা ওরোমো বা আমহারিক ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এবং এ ভাষাগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইথিওপিক বর্ণমালার একটি ভার্সন দ্বারা আরগোব্বা লেখা হয়।
আর্মেনীয় (Armenian)
আর্মেনীয় ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। আর্মেনীয় ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখ। প্রধানত আর্মেনিয়া এবং দক্ষিণ ককেশাসের নাগোরবো কারাবাঘের মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। এছাড়া রাশিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, ইরান, সাইপ্রাস পোল্যান্ড এবং রোমানিয়ায় এ ভাষার কিছু মানুষ বাস করেন। এটি আর্মেনিয়া এবং নাগোরবো কারাবাঘের অফিসিয়াল ভাষা। সাইপ্রাস, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়ায় ভাষাটি সংখ্যালঘু ভাষা হিসেবে অফিসিয়ালি স্বীকৃত।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত আর্মেনিয়ার স্কুলগুলোতে আর্মেনিয়ান অথবা রুশ এর যে কোনো একটি দিয়ে পাঠদান হতো। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর রুশ মিডিয়াম স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং আর্মেনীয় ভাষা হয় শিক্ষার মাধ্যম। ২০১০ সালে আর্মেনীয়ায় পুনরায় রুশ ভাষা শিক্ষা চালু হয়েছে। খ্রিস্ট পরবর্তী ৫ম শতকে আর্মেনীয় ভাষার প্রথম লিখিত রূপ পাওয়া যায়। কিন্তু এ সময়ের আর্মেনিয়া ভাষা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। যদিও শিলালিপি থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে আর্মেনীয় জাতির অস্তিত্বের কথা।
খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে আর্মেনীয় ভাষার যে রূপটি মৌখিকভাবে বলা হতো এবং লিখিত হতো সেটি ক্লাসিক্যাল আর্মেনীয় ভাষা বলে পরিচিত। এটি আবার গ্রাবার পরিচিত। এতে ছিল বিভিন্ন ভাষা থেকে আগত অনেক শব্দ। যেমন-গ্রিক, সিরিয়াক ল্যাটিন, পার্থিয়ান, উরাটিয়ান ইত্যাদি। এই গ্রাবার ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত মার্জিত আর্মেনীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১১ শতক থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত আর্মেনিয় মধ্য আর্মেনিয় ভাষা বা মিজিন হেয়ারেন (Mijin hayeren) বলে পরিচিত। এতে আরবি, টার্কিশ এবং ল্যাটিন ভাষা থেকে নতুন করে আরও অনেক শব্দ যুক্ত হয়। ১৯ শতকে আর্মেনীয় ভাষার প্রধান দুটি আধুনিক রীতির আবির্ভাব ঘটে। এর কারণ এ সময় বহু যুগের আর্মেনীয় আবাসভূমি রুশ এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।
কনসট্যানটিনপোলের দিকে সরে যাওয়া আর্মেনীয় জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠে পশ্চিম আর্মেনীয় ভাষা এবং জার্জিয়ার তিবলিসে বসবাসকারীদের মধ্যে বিকশিত হয় পূর্ব আর্মেনীয় ভাষা। সামান্য পরিবর্তিত আর্মেনীয় ভাষার এ দুটি রূপেই অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং উভয় ভাষারই প্রচুর স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এসবের ফলে এ ভাষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং ক্লাসিকাল আর্মেনীয় ভাষার তুলনায় আধুনিক আর্মেনীয়তে অনেক বেশি সাহিত্যকর্ম রচিত হয়।
খ্রিস্ট পরবর্তী ৪র্থ শতকের শেষদিকে আর্মেনিয়ার রাজা ভ্রমশাপুহ (Vramshapuh) তার শাসন বিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং বিখ্যাত পণ্ডিত মেসরপ মাশটোটসকে আর্মেনীয় ভাষার জন্য নতুন বর্ণমালা তৈরির নির্দেশ দেন। এর আগে আর্মেনীয় লেখা হতো কুনিফর্ম (Cuneiform) বর্ণমালা ব্যবহার করে, যা আর্মেনীয় চার্চের ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক ছিল না।
এরপর মাশটোটস আলেকজান্দ্রিয়া যান এবং লেখার মৌলিক নিয়মরীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, গ্রিক বর্ণমালার ব্যবহারই সর্বোত্তম হবে। গ্রিক বর্ণমালার আদর্শ অনুসরণ করে তিনি আর্মেনিয়ার জন্য বর্ণমালা তৈরি করেন এবং ৪০৫ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনিয়ায় ফিরে তা সরকারের সামনে উপস্থাপন করেন। নতুন এই বর্ণমালা সাদরে গৃহীত হয় এবং ওই বছরই আর্মেনীয় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
অন্যান্য সাহিত্যকর্মও দ্রুত অনুবাদ হতে থাকে। বর্তমানে আর্মেনীয় ভাষার রয়েছে দুটি আদর্শ রূপ-পূর্ব আর্মেনীয়, যা ব্যবহৃত হয় প্রধানত আর্মেনিয়া, নাগোরনো-কারাবাখ, জর্জিয়া ও ইরানে এবং পশ্চিম আর্মেনীয় ব্যবহার করেন প্রবাসী আর্মেনিয়ানরা।
আরও পড়ুনঃ