হেমাপ্যাথি এ্যালাপ্যাথি – ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার জন্য শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত মেধা ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষায় যোগ্য করে তোলা মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষার্থীকে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত পটভূমির প্রেক্ষিতে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক করে তোলাও। মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত হয়েছে মাধ্যমিক স্তরের সকল পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তকগুলোর বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ, দেশপ্রেমবোধ, প্রকৃতি-চেতনা এবং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
হেমাপ্যাথি এ্যালাপ্যাথি
তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমাদের গাঁয়ে দুজন ডাক্তার ছিলেন। একজন হোমিওপ্যাথ আর একজন এ্যালোপ্যাথ। গাঁয়ের লোক ঠিক ঠিক বলতে পারত না-একজনকে বলত হেমাপ্যাথি আর একজনকে বলত এ্যালাপ্যাথি। দুজনের চিকিৎসার ধরন ছিল বাঁধা। ওষুধও দিতেন একরকম।
হোমিওপ্যাথ অধোর ডাক্তারের কাছে গেলেই একটুখানি সাদা ময়দার মতো গুঁড়োতে দু-তিন ফোঁটা স্পিরিট উপ টপ করে ফেলে তিন-চারটি পুরিয়া করে দিতেন। খেতে ভালোও লাগত না, মন্দও লাগত না। কখনো কখনো আবার স্রেফ টিউবওয়েলের পানিতে দু-তিন ফোঁটা স্পিরিট মিশিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘যা, খালে যা।’
ওষুধ হাতে নিয়ে, আমি হয়ত ফস করে জিজ্ঞেস করে বসতাম, ‘ভাক্তারবাবু ভালো হবে তো?’ অঘোর ডাক্তার দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে উঠতেন, ‘তালো হবে না মানে? ভালো হয়ে উপচে পড়বে। যা, ওষুধ খালে।’
আমি ফলতাম, ‘পেটের ভেতর গরগর করে।’
‘ও কিছু না, ব্যাঙ হয়েছে তোর পেটে।’
‘ওরে বাবা, ব্যাঙ হয়েছে আমার পেটে! গোঁ গোঁ শব্দ হয় যে ডাক্তারবাবু।’
‘ও কিছু না-ব্যাঙ ডাকে গোঁ গোঁ করে। আমার ওষুধ যেই এক পুরিয়া খাবি, দেখবি তখন ব্যাঙের লাফানি।’
‘কী করে দেখব? ব্যাঙ যে পেটের ভেতরে।’
অঘোর ডাক্তার তখন বলতেন, ‘ওরে বাবা, দেখবি মানে বুঝবি। বুঝবি ঠেলা।’
এই হচ্ছে আমাদের গাঁয়ের এক নম্বর ডাক্তার অঘোরবাবুর কথা।
এইবার দুই নম্বর তোরাপ ডাক্তারের কথা বলি। আগেই বলেছি, ইনি ছিলেন এ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। কী করে যে তিনি ডাক্তার হয়েছিলেন, কেউ জানে না। শোনা যায়, বাল্যকালে তিনি নাকি এক বড়ো ডাক্তারের হুঁকো সাফ করতেন। সে যাই হোক, তোরাপ ডাক্তারের একটা ছোট্ট শেয়াল-রঙের বেতো ঘোড়া ছিল। তার সামনের পা-দুটি ছাঁদনা দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত প্রায় সময়। এই বাঁধা পা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গাঁয়ের আশেপাশে চরে বেড়াত ঘোড়াটা। কারো ক্ষতি করতে দেখিনি কোনো দিন।
তোরাপ ডাক্তার খালি ডাক্তারিই করতেন না কিন্তু। নিজের হাতে হালচাষ করতেন। বর্ষা আর শীতের সময় ডাক্তারির ধার ধারতেন না তিনি। বর্ষাটা হচ্ছে চাষবাসের সময় আর শীতকালটা হচ্ছে ফসল কাটার মরশুম। এই সময় রোগী মরে গেলেও তোরাপ ডাক্তারকে পাওয়া যাবে না।
বর্ষা আর শীতে গাঁয়ের লোকদের রোগী হয়ে শুয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। এই দুই সময়ে কাজ করতে না-পারলে পেটে ভাত জুটবে না। কাজেই রোগটোগ সব শিকেয় তুলে রেখে দিতে হতো তাদের বাধ্য হয়ে। তারপর শরৎকাল এলে তোরাপ ডাক্তারের মোটামুটি অবসর হতো আর গাঁয়ের লোকদেরও রোগী হয়ে শুয়ে থাকার একটু-আধটু মওকা মিলত।
এই সময়ের জন্যেই যেন ওঁৎ পেতে থাকত ম্যালেরিয়া জ্বর। বাঘ যেমন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের টুটি কামড়ে ধরে, ঠিক তেমনি করে ম্যালেরিয়া জ্বর এসে গাঁয়ের গরিব লোকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এটা ঘটত আশ্বিন মাস থেকে।
ম্যালেরিয়ার মতো বাঘা জ্বর তখন আর কিছু ছিল না। ঘরে ঘরে মানুষ ছেঁড়া কাঁথা, ন্যাকড়া, ত্যানা গায়ে চাপিয়ে কোঁকাত। আর সে কী কাঁপুনি। কাঁপুনি থামাবার জন্যে পাথরের জাঁতা পর্যন্ত গায়ে চাপাতে দেখেছি।
এই সময়টায় ছিল তোরাপ ডাক্তারের মজা। ঘরে ঘরে লোক ম্যালেরিয়া জ্বরে খুঁকছে। চিকিৎসার জন্যে তোরাপ ডাক্তার ছাড়া গতি নেই। ম্যালেরিয়া পুরোনো হয়ে গেলে কিছুতেই সারতে চায় না। পেটের মধ্যে পিলে উঁচু হয়ে ওঠে, হাত-পা হয়ে যায় প্যাঁকাটির মতো সরু। তোরাপ ডাক্তারের এইরকম অনেক পিলে-ওঠা পুরোনো ম্যালেরিয়া-রোগী ছিল।
রোগের আর একটা সময় ছিল চোত-বোশেখ মাস। এই সময়টায় কলেরা আর বসন্ত হয়ে গ্রামকে গ্রাম সাফ হয়ে যেত। ম্যালেরিয়া আর কলেরার সব রোগী তোরাপ ডাক্তারের। এখানে অঘোর ডাক্তারের কোনো ভাগ ছিল না।
জ্বর হলে, সর্দি হলে, বেশি খেয়ে বা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে পেট ছেড়ে দিলে লোক অঘোর ডাক্তারের কাছে যেত। আনা দুই পয়সা দিলেই, তিনি দিয়ে দিতেন দুই-তিন পুরিয়া ওষুধ। পয়সা দিতে না-পারলে ধারেও দিতেন। এমনকি একটা লাউ বা দুটো শশা নিয়ে গেলেও তিনি রোগী ফেরাতেন না।
অঘোর ডাক্তারের চাষবাসও ছিল না, ভিনগাঁয়ে ‘কলে’ যাবার ঘোড়াও ছিল না। হোমিওপ্যাথি ওষুধ রাখার জন্য একটা কাঠের বাক্স ছাড়া চিকিৎসার সরঞ্জাম বলতে আর কিছুই ছিল না তাঁর। তবে ওরকম বাক্যবাগীশ লোক লাখে একটা মিলবে কিনা সন্দেহ।
তিনি বলতেন, ‘বলি, মরতে তোরা আমার কাছে আসিস কেন বল দিকিনি। তোরাপের কাছে যা না। তা তো যাবি না-গেলে যে ব্যাটা কসাই ঘাড়টি মটকে তাজা রক্ত খাবে তোদের। বলি, এ কী ডাক্তারি বল দিকিন তোরা? তুই বললি, আমার অসুখ করেছে, আর অমনি তোরাপ হয় ছুরি বার করবে, না-হয় কোদাল বার করবে, না-হয় কুড়াল বার করবে…
একজন রোগী হয়ত বাধা দিয়ে বলল, ‘না না ডাক্তারবাবু, তোরাপ ডাক্তার আবার কোদাল কুড়ুল কবে বার করলে।’
‘ওই হলো, লাঙলের ফালের মতো ছুঁচওয়ালা একটা বোতল বার করল। কী? না ইঞ্জেকশন দেব, গলা কাটব, মারব, ধরব। তারপর ওষুধ চাও, দেবে তোমাকে এক বোতল পিশাচের রক্ত। ওয়াক থু।
যেমন দুর্গন্ধ, তেমনি বিচ্ছিরি সোয়াদ-ছ্যা ছ্যা ছ্যা! আর আমাদের হোমিওপ্যাথ কী করছে? বাঘ যেমন ভেড়ার পাল তাড়িয়ে নিয়ে যায় ঠিক তেমনি করে একটি পুরিয়ার আমার এই ওষুধ তোমার পায়ের আঙুলের ডগা থেকে জীবাণু বাবাজিদের খেদাতে খেদাতে মাথার চুলের ডগা দিয়ে বার করে দিচ্ছে। অথচ তুমি জানতেও পারছ না।’
সে বছর শরৎকালে ধান কেবল ডাঁশিয়ে উঠছে, ধানের ভেতর সাদা দুধ জমে চাল বাঁধছে, বেশ ঝরঝরে আবহাওয়া, আকাশভর্তি রোদ, একটু একটু ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে-এমনি সময়ে হুড়মুড়িয়ে চলে এল ম্যালেরিয়া জ্বর।
ব্যস, ম্যালেরিয়া জ্বরে লোক দমাদম বিছানা নিতে লাগল। ছেলে-বুড়ো কেউই বাদ যায় না। ম্যালেরিয়া যাদের পুরোনো হয়ে গেছে তাদের তো খুব মজা। ঠিক বেলা দশটার সময় চোখে সূর্যটা একটু হলুদ হলুদ ঠেকে, তারপর পা একটু গরম হয়, চোখ দুটি সামান্য জ্বালা করে তবে তারপর হুড় হুড় করে এসে পড়ে জ্বর। সঙ্গে সঙ্গে কী পিপাসা। ঘটি ঘটি পানি খেয়ে পিপাসা কমে না।

পানি পেটে গিয়ে গরম হয়ে যায়, তারপর গা-টা গুলিয়ে ওঠে, তারপরেই বমি। বমি হয়ে গেলেই আবার পিপাসা। আবার ঘটি ঘটি পানি খাওয়া তারপর আবার বমি। জ্বর কমে আসে আস্তে আস্তে। রাত দশটার দিকে একদম জ্বর চলে গিয়ে গা ঠান্ডা।
গাঁয়ের অর্ধেকের বেশি লোক ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়ল। তোরাপ ডাক্তার হলুদ রঙের বড়ো বড়ো বিকট দাঁত বের করে এ্যাই বড়ো সিরিঞ্জ নিয়ে, রোগীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলেন। দুই পকেট ভর্তি ম্যাপাক্রিন বড়ি। সে যে কি ভয়ানক বড়ি ভাবা যায় না।
রোগী যেখানেই থাক, সে মাটির দাওয়াতেই হোক আর খোলা আকাশের নিচে উঠোনেই হোক বা ঘরের ভেতরেই হোক, গলায় স্টেথোটি ঝুলিয়ে ইনজেকশনের বাক্সটি হাতে নিয়ে তোরাপ ডাক্তার ঠিক হাজির। লোকেই-বা আর কী করে? কাজেই বাধ্য হয়ে তোরাপ ডাক্তারকে ডাকতেই হয়। বেচারা অঘোর ডাক্তারের গুঁড়োতে যে কোনো কাজই হয় না।
সে যাই হোক, ঘরে ঘরে ঢুকেই গোদা গোদা এ্যাকাব্যাঁকা আঙুল দিয়ে তোরাপ ডাক্তার রোগীর কজি চেপে ধরে কিছুক্ষণ নাড়ি পরীক্ষা করতেন।
রোগীরা সব বলাই সাধু। হয়ত জিজ্ঞেস করল, “তবে কি ‘ম্যালোরি’ জ্বর ডাক্তার সাহেব?”
তোরাপ ডাক্তার দাঁত কড়মড়িয়ে বলতেন, ‘তাছাড়া আর কী হবে? এই যে দেখাচ্ছি মজা, একটি ইনজেকশনে ম্যালেরিয়ার ভূত ছাড়াব। এই বলে আশেপাশের লোকদের আদেশ দিতেন, ‘ধর তো এটাকে চেপে, সুইটা দিয়ে দিই একবার। আর দুটো টাকা রাখ এখানে আমার সামনে, আমার ফি আর ওষুধের দাম। উঁহু আগে টাকা রাখ, তারপর অন্য কাজ।’
এই বলে তোরাপ ডাক্তার একদিকের পকেটে টাকা দুটো ভরতেন, আরেক পকেট থেকে বের করতেন ইনজেকশন দেবার সিরিঞ্জ। কী প্রচণ্ড সিরিঞ্জ। আর তার ছুঁচ তো নয়, ঠিক যেন মোষের লাঙলের ফলা। লোকের গায়ে ফুঁড়তে ফুঁড়তে ছুঁচের মাথা গিয়েছে ভোঁতা হয়ে। সেই ভয়ানক যন্ত্র দেখেই তো রোগী বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পালাবার চেষ্টা করত।
তোরাপ ডাক্তার চিৎকার করতেন, ‘ধর ধর, ঠেসে, চেপে ধর’-সঙ্গে সঙ্গে তিন- চারজন ষণ্ডাগোছের লোক গিয়ে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরত রোগীকে। তারপর কোমরের কাপড়ের কষিটা খুলে তোরাপ ডাক্তার মাংসের মধ্যে প্যাট করে ঢুকিয়ে দিতেন সেই মোটা ছুঁচ। সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সমস্ত পা-টা যেত অবশ হয়ে।
এইরকম করে ইনজেকশন দিয়ে সে-বছর শরৎকালে তোরাপ ডাক্তার দুহাতে টাকা রোজগার করতে লাগলেন। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ যত বাড়ে ততই বাড়ে তাঁর রোজগার। ইনজেকশন দিয়ে তিনি দু-তিনটে লোককে তো চিরদিনের জন্য খোঁড়া করে দিলেন। তাঁর ম্যাপাক্রিন বড়ি খেয়ে কয়েকজন তো চিরকালের জন্য কালা হয়ে গেল।
তবু লোকে বাধ্য হয়ে তাঁর কাছেই যেতে লাগল। হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে ম্যালেরিয়ার মতো দুর্দান্ত জ্বর ঠেকানের সাধ্য ছিল না অঘোর ডাক্তারের। তাঁর কাছে আর কেউ যায় না। তাঁর সংসার চলাই দায় হয়ে উঠল। শেষপর্যন্ত কী আর করেন তিনি!
একদিন অঘোর ডাক্তার চুপিচুপি জেলা শহরে গিয়ে একটা সিরিঞ্জ আর কিছু কুইনাইন ইনজেকশন কিনে আনলেন। মনে মনে বললেন, তোরাপটার বড্ড বাড় বেড়েছে। খুব দু-পয়সা করে নিচ্ছিস, না? কিন্তু আমি হচ্ছি সব্যসাচী, সে খবরটা তো জানিস না তোরাপ।
আমি দুই হাতে তির ছুড়তে পারি। ইচ্ছে হলে হোমোপ্যাথি করব আবার ইচ্ছে হলে এ্যালাপ্যাথি ইনজেকশন দেবো। মনে মনে এইসব কথা ভেবে তিনি সিরিঞ্জের ছুঁচ কিনলেন খুব মিহি দেখে। কাউকে কোনো কথা না-বলে সরঞ্জাম সব কিনে চুপি চুপি বাড়ি ফিরে এলেন সন্ধেবেলা।
পরের দিন সকাল বেলায় মুখটি ধুয়ে দাওয়ায় কাঠের টুল পেতে কেবল বসেছেন তিনি-এমন সময় ইদরিস আলীর বাড়ি থেকে লোক এল। ইদরিস আর তার পুরো পরিবার অনেকদিন থেকে তাঁর রোগী। শত অসুখ-বিসুখে তারা কোনোদিন তোরাপ ডাক্তারের কাছে যায় না, বলে, হেমাপ্যাথির ওপর ওষুধ আছে নাকি ডাক্তারবাবু? মরলে আপনার হেমাপ্যাথি খেয়েই মরব, তবু তোরাপ ডাক্তারের হাতে জান দিতে পারব না।
ইদরিস আলীর বাড়ির লোকের কাছ থেকে অঘোর ডাক্তার শুনলেন যে গত পাঁচ-সাত দিন থেকে ইদরিস নিদারুণ ম্যালেরিয়া জ্বরে বেহুঁশ। কিন্তু তোরাপ ডাক্তারের নাম করলেই তার হুঁশ ফিরে আসছে আর তখন সে বলছে, ‘আমি অঘোর ডাক্তারের হেমাপ্যাথি খেয়ে মরব, কিছুতেই এ্যালাপ্যাথি চিকিচ্ছে করাব না।’
কথা শুনে অঘোর ডাক্তার মিটিমিট হেসে বললেন, ‘কেন রে, এ্যালাপ্যাথি চিকিচ্ছেটা খারাপ হলো কোথায়? তোরাপ হলো ডাকাত, ও আবার ডাক্তার হলো কবে? এখন থেকে আমিই এক-আধটু এ্যালাপ্যাথি করব ভাবছি।’ ইদরিসের বাড়ির লোকটা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি এ্যালাপ্যাথি করবে কী গো? তুমি আবার সুঁই দেবে নাকি? অঘোর ডাক্তার রেগে বললেন, ‘কেন, দেব না কেন? সব বিদ্যাই জানা আছে আমার বুঝলি? চিকিচ্ছেটা
তোরাপের লাঙল চালানো নয়। কেমন মিহি সুই কিনেছি দেখবি। ইদরিসকে আজ ফুঁড়ব। তুই যা, আমি আসছি। আর শোন বাবা, দুটো টাকা আগে জোগাড় করে রাখিস। তোরাপও দু-টাকা করে নেয়, আমাকে দিবি না কেন?’ অঘোর ডাক্তার কুইনাইন ইনজেকশন দিবেন এই খবর দেখতে দেখতে সারা গাঁয়ে চাউর হয়ে গেল। গাঁয়ের যত সুস্থ মানুষ ছিল, সব ছুটল ইদরিসের বাড়ির দিকে।
ইদরিসের মেটেবাড়ির ছোট্ট ঘরে আর তিলধারণের জায়গা নেই-একটা লোক কোমরে চাদর জড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চেঁচাতে লাগল, ‘এই, এই সব বাতাস ছেড়ে দাও, বাতাস আসতে দাও।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে।
অঘোর ডাক্তার হেমাপ্যাথি ছেড়ে ইনজেকশন দেবে-এ কী সোজা কথা!
রোগা অঘোর ডাক্তার বহু কষ্টে ঘরে ঢুকে, ট্যাক থেকে সিরিঞ্জ, ওষুধ এইসব বের করলেন। লোকজনের দিকে তাকিয়ে তাঁর দুই হাঁটু থরথর করে কাঁপতে লাগল। মুখে অবশ্য তম্বি করলেন, ‘ভিড় কমাও, আলো আসতে দাও তোমরা।’
এই কথা বলে বহু কষ্টে সিরিঞ্জের মাথায় সুচ লাগালেন, তারপর ওষুধ ভরে রোগীর দিকে এগিয়ে গেলেন। ঠিক এই সময় জ্বরের ঘোর ভেঙে জবাফুলের মতো গোল দুটো চোখ মেলে ইদরিস বলল, ‘ডাক্তারবাবু শেষে আপনার এই কাজ!’
এই বলে ইদরিস চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে রইল। অঘোর ডাক্তার বললেন, ‘ধর বাবা তোরা, ইদরিসকে একটু ধর।’ চোখ না-খুলেই ইদরিস বলল, ‘কাউকে ধরতে হবে না ডাক্তারবাবু, আপনি ইনজিশন দ্যান-বরঞ্চ আপনাকে ধরতে হলে ওদেরকে বলুন।’
হঠাৎ কেমন বোকার মতো অঘোর ডাক্তার হাসলেন, তারপর ইদরিসের কোমরের নিচে মাংসে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘হেঁ হেঁ বড়ো মিহি কিনেছি ছুঁচটা, এই তুললাম’, এই কথা বলে সকলের দিকে চেয়ে প্রায় কাঁদো-কাঁদো গলায় আবার বললেন, ‘হেঁ হেঁ তোরাপের কম্ম নয়, তোমরা দ্যাখো একবার, এই তুললাম সিরিঞ্জ, এইবার, এইবার’-বলেই প্যাট করে সিরিঞ্জের সুচ ঢুকিয়ে দিলেন ইদরিসের কোমরের মাংসে।
হাত কাঁপতে লাগল তাঁর, বারবার বলতে লাগলেন, ‘গভীর করে ফুঁড়তে হবে, গভীর করে ফুঁড়তে,…. এই যাহ্।’ পট করে একটা আওয়াজ উঠল আর হাহাকার করে উঠলেন অঘোর ডাক্তার, ‘হায় হায়, ছুঁচ ভেঙে গেছে, ছুঁচ ভেঙে গেছে, গেল গেল, সর্বোনাশ হল, হায় হায়…।’
সূচটা তখন মাংসের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। অঘোর ডাক্তারের শীর্ণ দুই হাত আঁতিপাতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটাকে। তখন কোথা থেকে একটা জোয়ান ছেলে ছুটে এসে দাঁত দিয়ে কামড়ে তুলে ফেলল সুচটা ইদরিসের কোমর থেকে। সবাই চুপ করে আছে-ছেলেটা দাঁত থেকে খুলে হাতে নিল সুচটা, অঘোর ডাক্তারের দিকে চেয়ে বলল, ‘এই যে ডাক্তারবাবু পেয়েছি।’ অঘোর ডাক্তার দেখতে পেলেন না। ক্ষোভে দুঃখে তখন তাঁর চোখে অশ্রুর ঢল নেমেছে।
লেখক-পরিচিতি
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং শিশু-কিশোর রচনাসহ তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই ডজনেরও অধিক।
হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ও ‘জীবন ঘষে আগুন’, উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ এবং শিশুতোষ-গ্রন্থ ‘লালঘোড়া আমি’ ও ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ প্রভৃতি। সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমিসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একুশে ও স্বাধীনতা পদক।
পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব
এ গল্পে লেখক সরস ভাষায় গ্রাম্য দুজন হাতুড়ে ডাক্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছেন। হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের নাম ছিল অঘোর এবং এ্যালোপ্যাথ ডাক্তারের নাম ছিল তোরাপ। ম্যালেরিয়ার প্রকোপে গ্রামের ছেলেবুড়ো সকলে কাতর হলে তোরাপের আয় রোজগারের সুবিধা হতো; আর অঘোর ডাক্তারের কাছে কেউ যেতই না।
রোগীর অভাবে অঘোর ডাক্তারের সংসার চলাই দায় হয়ে উঠল। তাই অঘোর ডাক্তার একদিন গোপনে বাজার থেকে সিরিঞ্জ আর কুইনাইন ইনজেকশন কিনে এনে এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা শুরুর চেষ্টা করলেন। অঘোর ডাক্তার কাঁপা কাঁপা হাতে ইদরিস নামের এক রোগীর কোমরের গভীর মাংসে সিরিঞ্জের সূচ ঢুকিয়ে দিতে গিয়ে সুচটা ভেঙে ফেললেন। ওই সময়ে একটি বুদ্ধিমান ছেলে বিষয়টার ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে দাঁত দিয়ে সুচটা বের করে নেয়।
লজ্জা, ক্ষোভ, দুঃখ, অপমান ও অভিমানে অঘোর ডাক্তারের চোখে অশ্রু ঝরে। তিনি নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন। যার যেটা কাজ সেটাই করা উচিত, নয়তো দুঃখ ও অপমান বয়ে বেড়াতে হয়; গল্পটিতে এ ভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।
আরও দেখুনঃ