তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় – কবি আমাদের “বুকরিভিউ [ Book Review ]” সিরিজটিতে মূলত বিভিন্ন বই পাঠ ও এর রিভিউ করা হয়েছে। আজকের ভিডিওতে “তারাশঙ্কর -বন্দ্যোপাধ্যায় – কবি [ Kobi by Tarasankar Bandyopadhyay ]” বইটি পাঠ ও এর রিভিউ করা হয়েছে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় – কবি
কবি একটি বহুল আলোচিত বাংলা উপন্যাস। এর রচয়িতা বাংলাভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর -বন্দ্যোপাধ্যায়। কাহিনীর বিবেচনায় এটি একটি সামাজিক উপন্যাস। কবিয়াল, ঝুমুরদল সহ ঐ সময়ের জীবনযাত্রার প্রেক্ষিতে এই বিখ্যাত উপন্যাসটি রচিত হয়েছে।
লেখক উপন্যাসটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন কিভাবে একটা হত দারিদ্র্য পরিবার থেকে একজন কবি হইয়ে উঠেছেন। তার কবি হওয়ার পূর্বে লোকের নিন্দাও সমালোচনা। বাস্তবিক লেখক বর্তমানের সমাজ ব্যাবস্থাই ফুটেয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসটিতে। কেউ কারো উন্নয়ন চায়না। সবাইচাই দরিদ্ররা দরিদ্র থাকুক। যাতে তাদের থেকে অধিক সন্মানিত আরকেউ না হতে পারে।
‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে? কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?’
‘চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল।’ ডোম পরিবারের সন্তান নিতাই-এর কবি হওয়ার ঘটনাটা একটু আশ্চর্যের বৈকি। কারণ সেকালের কবিরা সচরাচর উঁচু বংশের হতেন। একে তো নিচু জাত, তার উপর দরিদ্র হওয়ায় নিজস্ব কোনো দল নিতাই-এর ছিল না। একটা ঝুমুর দলের সঙ্গে বিভিন্ন মেলায় ঘুরে সে তার স্বরচিত গান শোনায়।
উপন্যাসের নিতাই-এর ভালোবাসার দুটি স্বরূপ দেখা যায়। এক. বিবাহিত ঠাকুরঝির প্রতি এক ধরণের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালো লাগা আর দুই. ঝুমুর দলের দেহপসারিণী বসন্তের সঙ্গে মনের মানুষের সম্বন্ধ। তবে দুজনের অকাল মৃত্যুর কারণে নিতাই-এর মধ্যে ভিন্ন এক বোধ জাগ্রত হয় এবং সে রচনা করে-
‘এই খেদ আমার মনে- ভালোবেসে মিটল না এ সাধ, কুলাল না এ জীবনে! হায়- জীবন এত ছোট কেনে? এ ভুবনে?’
উপন্যাসের এই ছোট্ট লাইনের মাঝে যেন উপন্যাসের সকল রহস্য লুকিয়ে আছো তারাশঙ্কর -বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস ‘কবি’ আমাকে আশাহত করেনি। এক কথায় দারুণ ছিল। একনাগাড়ে পড়ার মতো উপন্যাস। বাংলা উপন্যাস ভান্ডারের এক অনন্য সংযোজন এই ‘কবি’ উপন্যাস।

উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয় বিখ্যাত চোর-ডাকাত বংশ ‘ডোম’-বংশের সন্তান নিতাই চরণের বিখ্যাত কবি হওয়ার স্বপ্ন লালনের মাধ্যমে। অবহেলিত, স্বল্প-শিক্ষিত ও নিচু বংশের সন্তান নিতাই চরণের বড় কবি হওয়ার স্বপ্ন যেন বামুন হয়ে চাঁদ ধরার মতোই ব্যাপার৷
উপন্যাসের দুই প্রধান নারী চরিত্র একজন নিতাই চরণের বন্ধু রাজার বিবাহিত শালিকা যাকে উপন্যাসে আমরা ঠাকুরঝি নামে চিনি আর অপর জন হলো ঝুমুর দলের নাচনী ওয়ালী বসন (বসন্ত)। নিতাই চরণের কবি হওয়ার পথে প্রথমে ঠাকুরঝি ও পরে বসনের জীবনের সংঙ্গে সংপৃক্ততা ও তাদের জীবনের বাস্তবতা ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন অসামান্য শৈল্পিক দক্ষতায়।
কবিয়াল হওয়ার নেশায় নিতাই চরণকে মাতৃত্বের সম্পর্ক ও আপন বংশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। অকৃত্রিম বন্ধু রাজার আশ্রয়ে স্টেশনে কুলির কাজ করে জীবীকা নির্বাহের পাশাপাশি তার স্বপ্ন লালনে ব্যাস্ত। রাজা তার স্বপ্ন লালনের অনুপ্রেরণা। দুয়েকটা কবি গানের আসরের জন্য বায়নাও আসে মাঝে মধ্যো এইসময়ে ভাব জমে ওঠে রাজার বিবাহিত শালি ঠাকুরঝি’র সাথে। এক রাতে ঝুমুর দলের নাচনী ওয়ালী বসনের সাথে নিতাইকে বদ্ধ ঘরে দেখতে পেয়ে ঠাকুরঝি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলো ছড়িয়ে পড়ল কবিয়াল নিতাই চরণ ঠাকুরঝিকে মন্ত্র করেছে।
ঠাকুরঝি’র সংসার ভাঙা আর লোকের নিন্দার কথা ভেবে নিতাই চরণ বসনের নিমন্ত্রণে সারা দিয়ে চলে যায় ঝুমুরদলের সঙ্গে৷ ঝুমুর দল ত্যাগ করবে করবে ভেবেও হয়ে ওঠে না। বসনের সাথে গাঁট বাঁধে নিতাই চরণ। বসনের মৃত্যু হয়। বসনের মৃত্যুর সাথে যেন নিতাই চরণের জীবনেরও একপ্রকারে মৃত্যু ঘটে যায়। নিতাই চরণ দল ত্যাগ করে বৈরাগ্যের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাশী চলে যায়। অতঃপর নিতাই চরণ ফিরে আসে সেই অকৃত্রিম বন্ধু রাজার কাছে, সেই পুরনো দিনের আস্তানা -স্টেশনে।
শেষ পর্যন্ত নিতাই চরণ কি পেরেছেন বড় কবির খ্যাতি অর্জন করতে? বসনকে সংঙ্গে নিয়ে তার ঝুমুর দলের যাত্রা কেমন ছিল? ঠাকুরঝি’র শেষ পরণতি কী হয়েছিল? নিতাইয়ের সাথে কি ঠাকুরঝি’র আবারও দেখা হয়েছিল কি? সেইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য উপন্যাসটি পড়ে দেখতে হবে আপনাকেও।
তারাশঙ্কর সাহেব বইয়ের শেষে আসিয়া একখানা টুইস্টও মারিয়াছেন। যদিও থ্রিলার বই এবং মুভি দেখিতে দেখিতে এইরকম টুইস্ট অতি নগন্য লাগিতেও পারে কিংবা নগন্য হইলেও বই পড়ার তৃপ্তিও আনিয়া দিতে পারে।
সবার শেষে বলা চলে—কবি হওয়ার অনেক জ্বালা। বারি সিদ্দিকীর গানের মতো বলিতে হয়, “আমার ঘরেও জ্বালা বাইরেও জ্বালারে।”
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় – কবি আবৃত্তি ঃ
আরও দেখুন: