আজকের আলোচনার বিষয়ঃ নারী কবিতা । যা সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতা। ‘নারী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। সাম্যবাদী কবি ‘নর-নারী’ উভয়কেই মানুষ হিসেবে দেখেন।
Table of Contents
নারী কবিতা । কাজী নজরুল ইসলাম
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের পায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয় নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।

সে-যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না কো, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও উঠিছে ডঙ্কা বাজি ।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই—
পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই ।
[সংক্ষেপিত]
নারী কবিতা আবৃত্তি ঃ
শব্দার্থ ও টীকা
সাম্য – সমতা, সমান অধিকার।
অশ্রুবারি – চোখের জল।
ভগ্নি – বোন ।
মহীয়ান – সুমহান, এখানে মহিমান্বিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ।
রণ – যুদ্ধ, লড়াই।
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর – অসংখ্য নারী স্বামীকে হারিয়েছে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি – হৃদয়ভরা মমতা দিয়ে উৎসাহিত করল নারী।
স্মৃতিস্তম্ভ – স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি কাঠামো।
বিজয়-লক্ষ্মী নারী – জয়ের নিয়ন্তা দেবী হিসেবে নারীকে কল্পনা করা হয়েছে।
ডঙ্কা – জয়ঢাক।
রচা – রচনা করা হয়েছে এমন, সৃষ্টি করা হয়েছে এমন ।
পীড়ন – অত্যাচার, নির্যাতন, শারীরিক কষ্ট প্রদান।
পীড়া – যন্ত্রণা, কষ্ট, বেদনা ।
পাঠের উদ্দেশ্য
কবিতাটি পাঠ করে শিক্ষার্থীরা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। মানব সভ্যতায় নারীর অবদান যে পুরুষের চেয়ে কম নয় তা জেনে নারীর অধিকারের প্রতি সচেতন হবে।
পাঠ-পরিচিতি
‘নারী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। সাম্যবাদী কবি ‘নর-নারী’ উভয়কেই মানুষ হিসেবে দেখেন। তিনি জগতে নর ও নারীর সাম্য বা সমান অধিকারে আস্থাবান। তাঁর মতে, পৃথিবীতে মানবসভ্যতা নির্মাণে নারী ও পুরুষের অবদান সমান। কিন্তু ইতিহাসে পুরুষের অবদান যতটা লেখা হয়েছে নারীর অবদান ততটা লেখা হয় নি। কিন্তু এখন দিন এসেছে সম অধিকারের। তাই নারীর ওপর নির্যাতন চলবে না, তাঁর অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা চলবে না। নারী-পুরুষ সবাইকে সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করতে হবে সম্মিলিতভাবে।
কবি-পরিচিতি
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করতে পারেন নি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্কুল ছেড়ে বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল কলকাতায় ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
এ সময় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কবিতায় পরাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উচ্চারিত হয়েছে। অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল প্রতিবাদ করেন। এজন্য তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তাঁর রচনাবলি অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কবিতা, সংগীত, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গল্প— সাহিত্যের সকল শাখায় আমরা তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল পরিচয় পেয়ে থাকি। তিনি সাম্যবাদী চেতনাভিত্তিক কবিতা, শ্যামাসংগীত, ইসলামি গান ও গজল লিখে প্রশংসা পেয়েছেন। তিনি আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে কুশলতা দেখিয়েছেন। দুর্ভাগ্য যে, মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন এবং তার সাহিত্যসাধনায় ছেদ ঘটে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে সপরিবারে ঢাকায় আনা হয় । ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি লাভ করেন । ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং একুশে পদক পান । তিনি আমাদের জাতীয় কবি।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, কাব্যগ্রন্থ : ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক’; উপন্যাস : ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’; গল্পগ্রন্থ : ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’ ‘শিউলিমালা’ ; প্রবন্ধগ্রন্থ : ‘যগবাণী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’ ; নাটক : ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’ ইত্যাদি। কবি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
কৰ্ম-অনুশীলন
ক. তোমার পরিচিতজনদের মধ্যে এমন কোনো নারীর জীবনালেখ্য রচনা কর— যার কর্মজগৎ নিয়ে তুমি গর্ব করতে পার (একক কাজ)।
খ. নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদের স্বরূপ চিহ্নিত করার জন্য তোমার সহপাঠীদের মধ্যে একটি গবেষণা চালাতে পার। এর জন্য শিক্ষকের সহযোগিতায় প্রথমেই প্রশ্নমালা তৈরি করতে হবে। যেমন— ১.সংসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কে? উত্তর হতে পারে নারী, পুরুষ, অথবা উভয়ই।
নমুনা প্রশ্ন
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. কাজী নজরুল ইসলাম কত সালে মৃত্যুবরণ করেন ?
ক. ১৯১৯
খ. ১৯৭২
গ. ১৯৭৫
ঘ. ১৯৭৬
২. বীরের স্মৃতিস্তম্বের গায়ে কোনটি লেখা নেই?
ক. বোনের সেবা
খ. নারীর সিঁথির সিঁদুর
গ. ভগ্নির আত্মত্যাগ
ঘ. বধূদের আত্মত্যাগ
৩. ‘পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই’–চরণটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ প্রবাদবাক্য—
i. ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়
ii. যেমন কর্ম তেমন ফল
iii. মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
লোকশিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া জীবিকার তাগিদে কোদাল-টুকরি নিয়ে পুরুষ শ্রমিকদের সাথে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটি কাটেন। দিন শেষে মজুরি নিতে গিয়ে দেখেন পুরুষ শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে দু-শ টাকা আর তাকে দেওয়া হলো একশ টাকা। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে মালিক বলে— এটাই নিয়ম!
8. প্রদত্ত উদ্দীপকটির সাথে ‘নারী’ কবিতার ভাবগত ঐক্যের দিকটি হলো—
i. বৈষম্য
ii. শোষণ
iii. সাম্য
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
৫. উদ্দীপকের ভাব নিচের কোন চরণে প্রকাশ পেয়েছে ?
ক. অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর
খ. কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে
গ. বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি
ঘ. কোন কালে একা হয় নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. নারীদের প্রেরণাদায়ক একটি নাম আনোয়ারা। একজন নারী হয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন-সংক্রান্ত কাজ করেছেন। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ তিনি কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করেছেন। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে তিনি অন্য পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে যথাযথ সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন। নারী বলে কোথাও তাকে সমস্যায় পড়তে হয় নি।
ক. ‘নারী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত ?
খ. কবি বর্তমান সময়কে ‘বেদনার যুগ’ বলতে কী বুঝিয়েছেন ?
গ. আনোয়ারার কার্যক্রমে ‘নারী’ কবিতার যে দিকটি উদ্ভাসিত হয়েছে তার বর্ণনা দাও।
ঘ. উদ্দীপকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটলেও ‘নারী’ কবিতায় কবি আরও বেশি বাঙ্ময় বক্তব্যটি বিশ্লেষণ কর। –
২. জনৈক সমালোচকের মতে— ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গীয় মুসলমান নারীসমাজ ছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিধি-নিষেধের নিগড়ে আবদ্ধ। নিরক্ষরতা, অশিক্ষা ও সামাজিক ভেদ-বুদ্ধিও ছিল তাদের জন্য নিয়তির মতো সত্য। অবরুদ্ধ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এক অসহায় জীবে তারা পরিণত হয়েছিলেন। এদেরকে আলোর জগতে আনার জন্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর বক্তব্য- ‘আমরা সমাজেরই অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীভাবে ? কোন এক পা বাধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে— একই ।
ক. ‘বিজয়-লক্ষ্মী নারী’- অর্থ কী ?
খ. ‘সাম্যের গান’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ?
গ. জনৈক সমালোচকের মতটি ‘নারী’ কবিতার কোন দিকটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ—ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. বেগম রোকেয়ার বক্তব্য যেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতারই প্রতিধ্বনি—উক্তিটি মূল্যায়ন কর।
আরও দেখুনঃ