উমর ফারুক কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম

উমর ফারুক কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি।

তার জীবন শুরু হয়েছিল অকিঞ্চিতকর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

 

উমর ফারুক কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম
উমর ফারুক কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম

উমর ফারুক কবিতা

 

তিমির রাত্রি –‘এশা’র আজান শুনি দূর মসজিদে
প্রিয়া-হারা কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়া বিঁধে!
আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি – জানে না মুয়াজ্জিন!
তকবির শুনি শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই – উঠিয়াছে কি রে গগনে মরুর শশী?
ও-আজানা ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারই সে আহ্বান?
আবার লুটায়ে পড়ি!
‘সেদিন গিয়াছে’–শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি!
উমর! ফারুক! আখেরি নবির ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয় – রূপ ধরে এসো! – গ্রাসে অন্ধতা-রাহু
ইসলাম-রবি, জ্যোতি আজ তার দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া – জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ!
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের,
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এসো তুমি সেই শমশের ধরি,
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে লাল হয়ে মরি!
নওশার বেশে সাজাও বন্ধু মোদের পুনর্বার
খুনের সেহেরা পরাইয়া দাও হাতে বাঁধি হাতিয়ার!
দেখাইয়াদাও – মৃত্যু যথায় রাঙা দুলহিন৬ -সাজে
করে প্রতীক্ষা আমাদের তরে রাঙা রণ-ভূমি মাঝে!
মোদের ললাট-রক্তে রাঙিবে রিক্ত সিঁথি তাহার,
দুলাব তাহার গলায় মোদের লোহু-রাঙা তরবার!
সেনানী! চাই হুকুম!
সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে মৃত্যু-বধূর ঘুম
টুটিয়াছে ওই যক্ষ-কারায় সহে নাকো আর দেরি,
নকিব কণ্ঠে শুনবি কখন নব অভিযান ভেরি!…
নাই তুমি নাই, তাই সয়ে যায় জমানার অভিশাপ,
তোমার তখ‍্‍তে বসিয়া করিছে শয়তান ইনসাফ !
মোরা ‘আসহাব-কাহাফের’ মতো দিবানিশি দিই ঘুম,
‘এশা’র আজান কেঁদে যায় শুধু – নিঃঝুম নিঃঝুম!

কত কথা মনে জাগে,
চড়ি কল্পনা-বোররাকে যাই তেরশো বছর আগে
যেদিন তোমার প্রথম উদয় রাঙা মরু-ভাস্কর,
আরব যেদিন হল আরাস্তা, মরীচিকা সুন্দর।
গোষ্ঠে বসিয়া বালক রাখাল মহম্মদ সেদিন
বারে বারে কেন হয়েছে উতলা! কোথা বেহেশ‍্‍তি বীণ
বাজিতেছে যেন! কে যেন আসিয়া দাঁড়িয়েছে তাঁর পিছে,
বন্ধু বলিয়া গলা জড়াইয়া কে যেন সম্ভাষিছে!

মানসে ভাসিছে ছবি –
হয়তো সেদিন বাজাইয়া বেণু মোদের বালক নবি
অকারণ সুখে নাচিয়া ফিরেছে মেষ-চরণের মাঠে!‌
খেলায়েছে খেলা বাজাইয়া বাঁশি মক্কার মরু বাটে!
খাইয়াছে চুমু দুম্বা শিশুরে জড়াইয়া ধরি বুকে,
উড়ায়ে দিয়েছে কবুতরগুলি আকাশে অজানা সুখে!
সূর্য যেন গো দেখিয়াছে – তার পিছনে অমারাতি
রৌশন-রাঙা করিছে কে যেন জ্বালায়ে চাঁদের বাতি।
উঠেছিল রবি আমাদের নবি, সে মহা-সৌরলোকে,
উমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে!
কে বুঝিবে লীলা-রসিকের খেলা! বুঝি ইঙ্গিতে তার
বেহেশ‍্‍ত-সাথি খেলিতে আসিলে ধারার পুনর্বার।
তোমার রাখাল-দোস্তের মেষ চরিত সুদূর গোঠে,
হেথা ‘আজনান’ -ময়দানে তব পরাণ ব্যথিয়া ওঠে!
কেন কার তরে এ প্রাণ-পোড়ানি নিজেই জান না বুঝি,
তোমার মাঠের উটেরা হারায়, তুমি তা দেখ না খুঁজি!
ইহারাই মাঝে বা হয়তো কখন দুঁহুঁ দোঁহা দেখেছিলে,
খেজুর-মেতির গল-হার যেন বদল করিয়া নিল,
হইলে বন্ধু মেষ-চারণের ময়দানে নিরালয়,
চকিত দেখায় চিনিল হৃদয় চির-চেনা আপনায়!
খেলার প্রভাত কাটিল কখন, ক্রমে বেলা বেড়ে চলে,
প্রভাতের মালা শুকায়ে ঝরিল খর মরু বালুতলে।
দীপ্ত জীবন মধ্যাহ্নের রৌদ্র তপ্ত পথে
প্রভাতের সখা শত্রুর বেশে আসিল রক্ত-রথে।
আরবে সেদিন ডাকিয়াছে বান, সেদিন ভূবন জুড়ি,
‘হেরা’-গুহা হতে ঠিকরিয়া ছুটি মহাজ্যোতি বিচ্ছুরি!
প্রতীক্ষমাণ তাপসী ধরণি সেদিন শুদ্ধস্নাতা
উদাত্ত স্বরে গাহিতেছিল গো কোরাণের সাম-গাথা!
পাষাণের তলে ছিল এত জল, মরুভূমে এত ঢল?
সপ্ত সাগর সাতশত হয়ে যেন করে টলমল!
খোদার হাবিব এসেছে আজিকে হইয়া মানব-মিতা,
পুণ্য-প্রভায় ঝলমল করে ধরা পাপ-শঙ্কিতা ।
সেদিন পাথারে উঠিল যে মৌজ তাহারে শাসন-হেতু
নির্ভীক যুবা দাঁড়াইলে আসি ধরি বিদ্রোহ-কেতু!

উদ্ধত রোষে তরবারি তব ঊর্দ্ধে আন্দোলিয়া
বলিলে, “রাঙাবে এ তেগ মুসলমানের রক্ত দিয়া !”
উন্মাদ বেগে চলিলে ছুটিয়া! – একী এ কী ওঠে গান?
এ কোন লোকের অমৃত মন্ত্র? কার মহা আহ্বান?
ফতেমা – তোমার সহোদরা – গাহে কোরান-অমিয়-গাথা,
এ কোন মন্ত্রে চোখে আসে জল, হায় তুমি জান না তা!
উন্মাদ-সম কেঁদে কও, “ওরে, শোনা পুন সেই বাণী!
কে শিখাল তোরে এ গান সে কোন বেহেশ‍্‍তে আনি
এ কী হল মোর? অভিনব এই গীতি শুনি হায় কেন
সকল অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিছে আবেশে যেন!
কী যেন পুলক কী যেন আবেগ কেঁপে উঠি বারে বারে,
মানুষের দুঃখে এমন করিয়া কে কাঁদিছে কোন পারে?”

“আশহাদু আন-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” বলি
কহিল ফাতেমা–“এই যে কোরান, খোদার কালাম গলি
নেমেছে ভুবনে মহম্মদের অমর কণ্ঠে, ভাই!
এই ইসলাম, আমরা ইহারই বন্যায় ভেসে যাই!”…
উমর আনিল ইমান। – গরজি গরজি উঠিল স্বর
গগন পবন মন্থর করি –“আল্লাহু আকবর!”
সম্ভ্রমে-নত বিশ্ব সেদিন গাহিল তোমার স্তব –
“এসেছেন নবি, এত দিনে এল ধরায় মহামানব!”

পয়গম্বর রবি ও রুসল – এঁরা তো খোদার দান!
তুমি রাখিয়াছ, হে অতি-মানুষ, মানুষের সম্মান!
কোরান এনেছে সত্যের বাণী, সত্যে দিয়াছে প্রাণ,
তুমি রূপ – তব মাঝে সে সত্য হয়েছে অধিষ্ঠান।

ইসলাম দিল কি দান বেদনা-পীড়িত এ ধরণিরে,
কোন নব বাণী শুনাইতে খোদা পাঠাল শেষ নবিরে, –
তোমারে হেরিয়া পেয়েছি জওয়াব সেসব জিজ্ঞাসার!
কী যে ইসলাম, হয়তো বুঝিনি, এইটুকু বুঝি তার
উমর সৃজিতে পারে যে ধর্ম, আছে তার প্রয়োজন!
ওগো, মানুষের কল্যাণ লাগি তারই শুভ আগমন
প্রতীক্ষায় এ দুঃখিনী ধরা জাগিয়াছে নিশিদিন
জরা-জর্জর সন্তানে ধরি বক্ষে শান্তিহীন!
তপস্বিনীর মতো
তাহারই আশায় সেধেছে ধরণি অশেষ দুখের ব্রত।
ইসলাম – সে তো পরশ-মাণিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি!
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি – কেন কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর –
“মোর পরে যদি নবি হত কেউ, হত সে এক উমর!”

পাওনিকো ‘ওই’, হওনিকো নবি, তাইতো পরান ভরি
বন্ধু ডাকিয়া আপনার বলি বক্ষে জড়ায়ে ধরি!
খোদারে আমরা করি গো সেজদা, রসুলে করি সালাম,
ওঁরা ঊর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে নিই তাঁহাদের নাম,
তোমারে স্মরিতে ঠেকাই না কর ললাটে ও চোখে-মুখে
প্রিয় হয়ে আছ তুমি হতমান মানুষ জাতির বুকে।
করেছ শাসন অপরাধীদের তুমি করনিকো ক্ষমা,
করেছ বিনাশ অসুন্দরের। বলনিকো মনোরমা।
মিথ্যাময়ীরে। বাঁধনিকো বাসা মাটির ঊর্ধ্বে উঠি।
তুমি খাইয়াছ দুঃখীর সাথে ভিক্ষার খুদ খুঁটি!

অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখ‍্‍তে বসি
খেঁজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুঠির, তুমি পড়নিকো নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা – পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভুঁয়ে!
শত প্রলোভন বিলাস বাসন ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব, ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমিছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে!

হেরি পশ্চাতে চাহি –
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনা দল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা, বলেছে শত্রু শেষে –
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে।
হায় রে আধেক ধরার মালিক আমিরুল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দুখানা শুকনো ‘খবুজ’ রুটি,
একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু-তিন মুঠি!
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলিছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্টের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উট হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, “ভাই
পেরেশান বড়ো হয়েছে চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বসো উটে ;
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে!”

…ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল “উমর! কেমনে এ আদেশ করো তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি”
খলিফা হাসিয়া বলে,
“তুমি জিতে গিয়ে বড়ো হতে চাও, ভাই রে এমনই ছলে!
রোজ-কিয়ামতে আল্লা যেদিন কহিবে “উমর! ওরে,
করেনি খলিফা মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে!”
কী দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই?
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু! মোর অধিকার নাই
আরাম সুখের, – মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা!
ইসলাম বলে সকলে সমান, কে বড়ো ক্ষুদ্র কেবা!
ভৃত্য চড়িল উটের পিঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্পবৃষ্টি হইল কিনা,
কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি বিশ্ববাণী!
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব, –
অনাগত কাল গিয়েছিল শুধু, “জয় জয় হে মানব!”…

আসিলে প্যালেস্টাইন, পারায়ে দুস্তর মরুভূমি,
ভৃত্য তখন উটের উপরে, রশি ধরে চল তুমি!
জর্ডন নদী হও যবে পার, শত্রুরা কহে হাঁকি –
“যার নামে কাঁপে অর্ধ পৃথিবী, এই সেই উমর নাকি?”
খুলিল রুদ্ধ দূর্গা-দুয়ার! শত্রুরা সম্ভ্রমে
কহিল –“খলিফা আসেনি, এসেছে মানুষ জেরুজালমে!”
সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি শত্রু-গির্জা-ঘরে
বলিলে, “বাহিরে যাইতে হইবে এইবার নামাজ তরে!”
কহে পুরোহিত, “আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়,
পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায় ?”

হাসিয়া বলিলেন, “তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ
নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোক-সমাজ
ভাবিবে – খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি
আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি!
ইসলামের এ নহেকো ধর্ম, নহে খোদার বিধান,
কারও মন্দির গির্জারে করে মজিদ মুসলমান!”
কেঁদে কহে যত ইসাই ইহুদি অশ্রু সিক্ত আঁখি –
“এই যদি হয় ইসলাম – তবে কেহ রহিবেনা বাকি,
সকলে আসিবে ফিরে
গণতন্ত্রের ন্যায় সাম্যের শুভ্র এ মন্দিরে!”
তুমি নির্ভীক এ খোদা ছাড়া করনিকো কারে ভয়
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষরই অপমান
তাই মহাবীর খালেদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
ধরাধাম ছাড়ি শেষ নবী যবে করিল মহাপ্রয়াণ,
কে হবে খালিফা – হয়নি তখনও কলহের অবসান,
নব-নন্দনী বিবি ফাতেমার মহলে আসিয়া সবে
করিতে লাগিল জটলা – ইহার পরে কে খালিফা হবে!
বজ্রকণ্ঠে তুমিই সেদিন বলিতে বলিতে পারিয়াছিলে –
“নবিসূতা! তবে মহল জ্বালাব, এ সভা ভেঙে না দিলে!”

মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে যত মহত্ত্ব-কথা – সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুঃখিণী মাতা ছেলেরে ভুলাতে, হায়,
উনানে শূণ্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকূলে চায়!
শুনিয়া সকল – কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বয়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, “এসব চাপাইয়া দাও আর পিঠের পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে।”
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, “বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বলো আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজই তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি!” – চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে –

এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনিকো অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের পরে।
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি –
“অপরাধ করে তোরই মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী!”
আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।

খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
‘কোথায় খলিফা’ কেবলই প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে!
… হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই!
বন্ধু গো, প্রিয়, এ হাত তোমারে সালাম করিতে গিয়া
ওঠে না ঊর্ধ্বে, বক্ষে তোমারে ধরে শুধু জড়াইয়া!…

মাহিনা মোহররম –
হাসেন হোসেন হয়েছে শহিদ, জানে শুধু হায় কৌম,
শহিদি বাদশা! মোহর্‌রমে যে তুমিও গিয়াছ চলি
খুনের দরিয়া সাঁতারি – এজাতি গিয়াছে গো তাহা ভুলি!
মোরা ভুলিয়াছি, তুমি তো ভোলনি! আজও আজানের মাঝে
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে বন্ধু, তোমারই কাঁদন বাজে
বন্ধু গো জানি, আমাদের প্রেমের আজও ও গোরের বুকে
তেমনি করিয়া কাঁদিছ হয়তো কত না গভীর দুখে‌!
ফিরদৌস হতে ডাকিছে বৃথাই নবি পয়গম্বর,
মাটির দুলাল মানুষের সাথে ঘুমাও মাটির পর!
হে শহিদ! বীর! এই দোয়া কর আরশের পায়া ধরি –
তোমারই মতন মরি যান হেসে খুনের সেহেরা পরি।

মৃত্যুর হতে মরিতে চাহি না, মানুষের প্রিয় করে
আঘাত খাইয়া যেন গো আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়ে!

 

উমর ফারুক কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম :

 

 

॥ ১ ॥

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আমরা কখনো কখনো দেখি একাধিক কবি একই বিষয়ের উপর কবিতা লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ সপ্তদশ শতাব্দির ইংরেজ কবি Robert Herrick এবং ঊনিশ শতকের ইংরেজ কবি William Wordsworth ড্যাফোডিল ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন। Wordsworth এবং তাঁর সমসাময়িক কবি শেলী উভয় স্কাইলার্ক পাখি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তবে উল্লেখ করা দরকার যে বিষয়বস্তু এক হলেও তাদেরtheme বা মূল বক্তব্য এক নয়। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন, যেমন Herrick তাঁর কবিতায় বলেছেন যে, ড্যাফোডিল সকালে ফোটে এবং সন্ধ্যায় ঝরে যায়। মানুষের জীবনও তাই। আমাদের জীবন ড্যাফোডিল ফুলের মত ক্ষণস্থায়ী। কবি ড্যাফোডিল ফুলকে মানব জীবনের প্রতীক হিসাবে দেখেছেন। পক্ষান্তরে, Wordsworthড্যাফোডিল ফুল নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এই ফুল তাঁর জীবনে একটি মূল্যবান সম্পদ হয়ে আছে। উভয় কবির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আমাদের জীবনবোধকে সম্প্রসারিত করে এবং তাদের প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য আমাদের নান্দনিকবোধকে শানিত করে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

॥২॥

এই সত্যটি আমরা দেখতে পাই নজরুল ইসলামের ‘উমর ফারুক’ ও ফররুখ আহমদের ‘উমর দরাজ দিল’ কবিতাদ্বয়ের মধ্যে। এখানে এ দু’টি কবিতার একটি তুলনামূলক আলোচনা করার প্রয়াস পাবো।

নজরুলের কবিতাটি শুরু হয়েছে অনেকটা নাটকীয়ভাবে বক্তার ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ‘তিমির রাত্রি’। দূর মসজিদে এশার আজান প্রিয়-হারা কার কান্নার মত বক্তার বুকে এসে বিঁধছে। আজান শুনে তিনি উঠে পড়লেন কারণ আজানের মধ্যে উমরের স্মৃতি বিজড়িত। উমরের পরামর্শেই মহানবী (সা.) আজানের প্রচলন করেন যদিও মোয়াজ্জিন তা জানে না। তিনি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। অনেকগুলো প্রশ্ন তার মনে উদয় হলো। তার একটি হলো: মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে কি আহ্বান? বক্তা আবার বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন। ‘সেদিন গিয়েছে-শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি’। ওমরের স্মৃতি বক্তার মনে ভেসে উঠলো। তিনি ছিলেন মহানবীর (সা.) একজন অত্যন্ত প্রিয় সাহাবা। বক্তা তাকে আহ্বান নয়-রূপ ধরে আসার জন্য আবেদন করছেন, কারণ অন্ধতা-রাহু ইসলাম রবিকে গ্রাস করেছে- তার জ্যোতি দিন দিন ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হচ্ছে। বক্তা বলেন :

নাই তুমি নাই, তাই সয়ে যায় জামানার অভিশাপ,
তোমার তক্তে বসিয়া করিছে শয়তান ইনসাফ।
মোরা আসহাব-কাহাফের মতো দিবানিশি দেই ঘুম
এশার আজান কেঁদে যায় শুধু-নিঝুম নিঝুম।

বক্তার মনে নানা কথা জেগে উঠছে। তিনি কল্পনা-বোররাকে চড়ে তেরশো বছর আগে ফিরে গেছেন যেদিন আরবে প্রথম মরু-ভাস্কর মহম্মদ (সা.)-এর উদয় হয়েছিল। এ পর্যায়ে তিনি মহানবীর শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করেছেন এবং উমরকে তার সাথী হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এরপর বক্তা উমরের জীবনের কতকগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনার নাটকীয় বিবরণ দিয়েছেন। প্রথমে আছে বিদ্রোহের ধ্বজা ধরে ভগিনী ফাতেমার বাড়িতে তার আগমন। ফাতেমা তখন কুরআন পড়ছিলেন। পাগলের মত তিনি কেঁদে বললেন :

ওরে, শোন। পূণ্য সেই বাণী
কে শেখালো তোরে এ গান কোন বেহেশত হতে আনি
এ কি হ’ল মোর? অভিনব এই গীতি শুনি হায় কেন
সকল অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিছে আবেগে যেন।
এরপর তিনি ঈমান আনলেন। ‘আল্লাহু আকবর’ রবে গগণ পবন মুখরিত হয়ে উঠলো। বক্তা বলেন:
ইসলাম- সে ত পরশ-মানিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি
পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি- কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
‘মোর পরে যদি নবী হতো কেউ হত সে এক ওমর।’

বক্তা আরও বলেন যে, তুমি অহি পাওনি, নবী হওনি সেই জন্য তোমাকে বন্ধু বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারি। খোদাকে আমরা সেজদা করি, নবীকে আমরা সালাম করি। তারা ঊর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে তাঁদের নাম উচ্চারণ করি। কিন্তু তুমি প্রিয় হয়ে আছো হতমান মানুষের বুকে। তুমি অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেছ ধুলার তখতে বসি। সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া তুমি ছিলে নিচে।

বক্তার স্মৃতিতে এর পর এক ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে উমরের জেরুসালেম যাত্রার নাটকীয় বিবরণ ভেসে এসেছে। কখনো তিনি নিজে উটের পীঠে চড়েছেন, ভৃত্য উটের রশি টেনে নিয়ে গেছে, আবার কখনো ভৃত্য উটের পিঠে বসে আছে। খলিফা উট টেনে নিয়ে গেছেন। তারা যখন জেরুসালেমে পৌঁছান তখন সেখানকার লোকেরা দেখলো ভৃত্য উটের পিঠে বসে আছে এবং খলিফা উটের রশি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। অবাক বিস্ময়ে তারা বললো, এতো খলিফা নয়-এতো মানুষ। সন্ধিপত্র সই করার পর নামাজ পড়ার জন্য তিনি গীর্জার বাইরে যেতে চাইলেন। তাকে গীর্জায় নামাজ আদায় করার অনুরোধ জানানো হলো। তিনি রাজি হননি। বললেন, এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে হয়তো মুসলমানরা জোর করে গীর্জাকে মসজিদ বানাবে।

এসব অসাধারণ ঘটনা বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে বক্তা উমরের চরিত্রের অনেক দিকের প্রতি সরাসরি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এতে উমরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের বিবরণে বৈচিত্র্য এসেছে। কখনোও কাহিনী বলেছেন, কখনো সরাসরি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

জেরুসালেমের ঘটনা বর্ণনার পর আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ আছে। এর একটি হলো নিজের পিঠে এক দুখিনী মায়ের জন্য খাবার বয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এ ব্যাপারে অন্যের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা। অন্য ঘটনাটি হলো : কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়েও তিনি অপরাধ ক্ষমা করেননি। মদ্যপানের জন্য নিজ পুত্রকে দোররা মেরে হত্যা করেছেন। এসব কাহিনী বর্ণনায় উমরের চরিত্র- বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল রেখায় ফুটে উঠেছে। বক্তা আক্ষেপ করে বলছেন যে, আমরা তাঁকে ভুলে গেছি। কিন্তু তিনি আমাদের ভোলেননি।

আজো আজানের মাঝে
মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে বন্ধু তোমারি কাঁদন বাজে।
তাকে বক্তা শহীদ বীর বলে অভিবাদন জানিয়েছেন এবং তার মত তিনিও শহীদ হতে চান। তিনি এই বলে শেষ করছেন:
মৃত্যুর হাতে মরিতে চাহিনা, মানুষের প্রিয় করে
আঘাত খাইয়া যেন গো আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়ে।

 

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White উমর ফারুক কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম

 

॥৩॥
ফররুখের কবিতাটিও নজরুলের কবিতার মত নাটকীয়ভাবে শুরু হয়েছে। উমরের যে চিত্রকল্পটি তিনি প্রথমে ব্যবহার করেছেন সেটি একজন মুসাফিরের:

দেখি সে চলেছে… মরু মুসাফির… কোথায় কে জানে
পিঠে বোঝা নিয়ে মৃত বিয়াবান ছাড়ায়ে কী টানে!

সে চলেছে পাহাড়, পর্বত সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে দুর্গমতার শিখরে যেখানে মানুষের ঘর। সম্ভবত দুঃখিনী মায়ের বাসায় খাবার নিয়ে। একই সঙ্গে অন্য এক ভ্রমণের কথাও বলা হয়েছে, জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে এক ভৃত্য সঙ্গে নিয়ে। নজরুলের কবিতায় এই দু’টি ভ্রমণের বিস্তৃত নাটকীয় বিবরণ আছে। কিন্তু এখানে এ বিবরণ সংক্ষিপ্ত অনেকটা ঃবষবংপড়ঢ়রপ. ফররুখ নিশ্চয়ই নজরুলের কবিতাটি পড়েছিলেন। তাই ঘটনা দুটোর বিস্তৃত বিবরণ দেয়া প্রয়োজন মনে করেননি। মরু-মুসাফির বেশে উমরের যাত্রাকে একত্রে উল্লেখকে তিনি একটি নাটকীয় কৌশল হিসাবে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়।

এরপর একটি বিপরীত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। উমরকে সম্বোধন করে বক্তা বলছেন যে সেদিন আর এদিনের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। সেদিন উমর নিষ্প্রাণ মরুতে প্রাণবহ্নিতুফান ঢেলে চলেছেন।আজ এখানে আধার রাত ঘনিয়েছে। এখানে কেবল আর্তস্বর-আজকে এখানে নাই উমর। তবু ধূলিলুণ্ঠিত জনতা থামে না- তারা উমরের খেলাফাত খুঁজে ফিরছে। বক্তা জানতে চান কেমন করে উমর এই জনতাকে একত্রিত করে উজ্জীবিত করেছিলেন, কেমন করে এক বিবর্ণ মরু রঙিন হয়ে উঠেছিল, কেমন করে সাম্যের খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কেমন করে মরুভূমির বেদুইনদের মধ্যে প্রাণের ঝড় তুলেছিলেন। এ পর্যায়ে বক্তা উমরের দু’টি বিপরীত ধর্মী চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। একদিকে তিনি ছিলেন কঠোর, অন্যদিকে কোমল। জালিম, পাপী, অত্যাচারির বিরুদ্ধে তার শানিত তরবারী চমকাত। বিপুল ছিল তাঁর তরবারীর প্রতাপ :

অপারজেয় ফিরে আসতো ঘরে শান্তির পতাকাধারী
সে কী পৌরুষ! শান্তিদীপ্ত
দরাজ বক্ষে সে কী পূলক
মিথ্যা হতে সে সত্যে ফারুক
করে পৃথক।

অন্যদিকে, তাঁকে দেখা যায় ক্ষুধিত মানুষের শিয়রে একাকী ক্রন্দনরত। পিঠে কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় বোঝা, মানবতার ক্ষীয়মান শিখা মরুতে সঙ্গিহীন উমর তার দরদী বন্ধু, আখেরী নবীর প্রিয় কাফেলার উত্তরাধিকারী। শ্রেষ্ঠ খাদিম, সেরা চাকর। উমরের আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের কথা বক্তা উল্লেখ করেছেন : জনতা তার কাছে দাবি আদায়ের জন্য আসে। তিনি হাসিমুখে সে দাবি মেটান। দুর্ভিক্ষ দুর্দিনে তিনি কাটান ক্ষুধিত অর্ধাহারে।

বক্তা আরো বলেন, আজকে উমরপন্থী লোকের প্রয়োজন যারা পিঠে বোঝা নিয়ে যাবে পার হয়ে মরু প্রান্তর, যারা অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল, যাদের হাতের দোররা পড়ে জালিমের ঘাড়ে, যারা লাথি মারে অত্যাচারীর ঘাড়ে, যাদের বুকের পাজরে পাজরে বহে দরদের বান, যারা খুলেছে রুদ্ধ মনের সংকীর্ণতার খিল। বক্তা নিজের হাতে খলিফার দোররা বেজে উঠুক বলে কামনা করছেন।
এরপর তিনি একটি VISION– একটি কাল্পনিক কাফেলা বা শোভাযাত্রার বিবরণ দিয়েছেন। এই কাফেলা ‘শব্দিত নৈঃশব্দের মাঝে অনন্ত নিশিদিন চলছে।’ কাফেলার একটি শব্দ থাকে, কিন্তু এ শোভাযাত্রা বাস্তব মানুষের নয় বলে এটাকে ‘শব্দিত নৈঃশব্দ’ মাঝে বলা হয়েছে। এ কল্পিত শোভাযাত্রার নায়কের হাতে সংগীন দিবালোকে চমকায়, উটের পায়ের আঘাতে ধুলা উড়ে চলেছে, তীব্র গতির বেগে জাগে মহারণ্যের ঝড়। এ কাফেলার পুরোভাগে আছেন উমর যিনি সত্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দিন রাত্রি সংকেতে চালনা করেছেন বিরাট জনতা। তিনি খলিফাতুল মুসলেমিন, তিনি মুমিনের প্রতিনিধি। তার বুকে সব মানুষের কল্যাণের ছবি। তিনি মদিনা মসজিদের সুমহান ঝাড়ুদার। তার ঝাড়ুর আঘাতে মানবতার ক্লেদ উড়ে যায়। সব অসাম্য, সব বিভেদের অবসান ঘটিয়ে তিনি পুলকিত বুকে তোলেন গোলাপের গান। এ অসাধারণ কাফেলার আরো বিবরণ অলংকার-খচিত ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে নিন্মোক্ত স্তবকে :

মহাজীবনের বিকশিত ফুল নিয়ে সকলের আগে
তার কাফেলার বাঁশি বেজে চলে দুর্বার অনুরাগে,
কী বিচিত্র জৌলুসে রাঙে নিথর রাত্রিতল,
জমাট পাথর জুলমাত ছিঁড়ে জাগে শিখা প্রোজ্জ্বল।
নতুন পথের মোবারক-বাদে আগ্নেয় বোররাক
সাত সাহারার সাইমুমে শোনে খোর্মবিথির ডাক,
লাখো সিতারার মাঝে সে উজালা প্রদীপ্ত রোশনিতে
উমর স্মৃতির আতশী বেদনার মখলুকাতের ভিতে।

এখানে উমরের কাফেলার যেvision, যে স্বপ্ন, যে কাল্পনিক চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, তা অসাধারণ কাব্য- সৌন্দর্যে মন্ডিত। মহাজীবনের বিকশিত ফুল, কী বিচিত্র জৌলুসে রাঙ্গানো নিথর ধরণীতল, জমাট পাথর জুলমাত ছিঁড়ে প্রোজ্জ্বল আলোর শিখা, মোবারকবাদে মুখরিত আগ্নেয় বোররাক, সাত সাহারার সাইমুম, লাখো সিতারার মাঝে প্রদীপ্ত রোশনাই, উমর স্মৃতির আতশী বেদনা ইত্যাদি চিত্রকল্প কবির অনবদ্য কল্পনা শক্তির পরিচয় বহন করে।

কিন্তু যেvision তিনি এঁকেছেন সেটা তো বাস্তব নয়। কবি কীটস Ode to Nightingale কবিতায় যে স্বপ্ন জগত সৃষ্টি করেছিলেন সেটা আমাদের মুগ্ধ করে, কিন্তু সেটা সাময়িক। কবিকে বাস্তব জগতে ফিরে আসতে হয়েছিল। আর বাস্তব জগত বড় রূঢ়। ফররুখ যেvision এঁকেছেন সেটা একটা স্বপ্ন। একথা তিনি ভোলেন নি। তাই কবিতার শেষে বাস্তব জগতে ফিরে এসেছেন। বলছেন :

আজকে এখানে মৃত মরুভূমি অচল এ মরুপোত
বহে অসংখ্য বালু তুফানে দিন রাত্রির স্রোত
লু হাওয়ায় হেথা তীব্র পিপাসা, মৃত্যুর হাহাকার
আজকে এখানে নিশীথ-প্রহরী উমর জাগেনা আর
এ সর্বনাশা বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের বক্তা বা কবি হতাশ হননি। কবিতার শেষ লাইন দুটো এই ঃ
তবু অতীতের প্রশ্বাসে আজো ভরে, নিখিল,
দরদী উমর! বন্ধু উমর! দরাজ দিল॥

 

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px Dark উমর ফারুক কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম

 

॥ ৪ ॥
নজরুল ও ফররুখের কবিতা দু’টি Wordsworth এবং Milton কে উদ্দেশ্য করে লেখা ÒLondon 1802Ó কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

এটি একটি সনেট। এ সনেটে Wordsworth ইংল্যান্ডের তৎকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে Milton এর গুণাবলী উল্লেখ করে তার বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন। কবিতাটি এই :

London, 1802

By William Wordsworth

 

Milton! thou shouldst be living at this hour:

England hath need of thee; she is a fen

Of stagnant waters: altar, sword, and pen,

Fireside, the heroic wealth of hall and bower,

Have forfeited their ancient English dower

Of inward happiness. We are selfish men;

Oh! raise us up, return to us again;

And give us manners, nirtue, freedom, power.

Thy soul was like a Star, and dwelt apart:

Thou hadst a voice whose sound was like the sea:

Pure as the naked heavens, majestic, free,

So didst thou travel on life’s common way,

In cheerful godliness; and yet thy heart

The lowliest duties on herself did lay.

 

এ কবিতায় ঊনিশ শতকের ইংরেজ কবি

Wordswort সপ্তদশ শতকের কবি

Milton কে আবার ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, কারণ ইংল্যান্ড তখন একটা বদ্ধ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখানকার মানুষ হয়ে পড়েছে স্বার্থপর। তারা পুরানো মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে। এতে কবি আফসোস করছেন। তিনি মিলটনের কতকগুলো অনুকরণীয় গুণাবলীর প্রশংসা করেছেন এবং সেগুলো অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

Wordsworth এর কবিতাটি একটি সনেট-মাত্র ১৪ লাইনে সীমিত। পক্ষান্তরে, নজরুল ও ফররুখের কবিতাটি দুটি বেশ দীর্ঘ। তবু তিনটি কবিতার প্যাটার্ন মোটামুটি একÑ কোন ব্যক্তির প্রশংসা, আমাদের দুরবস্থার বিবরণ এবং সেই প্রেক্ষিতে প্রশংসিত ব্যক্তির পুনরাবির্ভাবের আবেদন।নজরুলের কবিতাটি দীর্ঘ হলেও এর একটি সুদৃঢ় কাঠামো আছে। এশার আজান শুনে বক্তা উঠে পড়েছেন। আজানের সঙ্গে উমরের সম্পৃক্ততার উল্লেখ করেছেন। উমরের কালের সঙ্গে আমাদের কালের তফাৎ উপলব্ধি করে বেদনায় কাতর হয়েছেন। আজানের সূত্র ধরে উমরের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার নাটকীয় বিবরণ দিয়েছেন এবং সে বিবরণের মধ্যে তিনি উমরের উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি গেয়েছেন। শেষে আবার আজানের উল্লেখ করে তার সঙ্গে একাতœতা প্রকাশ করেছেন এবং উমরের মত শহীদ হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। তার ভাষায় :হে শহীদ! বীর! এই দোওয়া করো আরশের পায়া ধরি,তোমারি মতন মরি যেন হেসে খুনের সেহারা পরি। ফররুখের কবিতাটিও দীর্ঘ। তবে এর কাঠামো নির্মিত হয়েছে কিছুটা ভিন্নভাবে। ফররুখ নজরুলের মত উমরের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ দেননি। তার কবিতাটি প্রশস্তিমূলক যদিও প্রথমে তিনি কাহিনী দিয়ে শুরু করেছেন। তবে এ কাহিনী অতি সংক্ষিপ্ত। নজরুল যেখানে আমাদের কালের দুর্দশার আভাস দিয়েছেন মাত্র, ফররুখ সেখানে এ দুর্দশার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন এবং আজকের দিনে উমরপন্থী লোকের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার কবিতার শেষের দিকে তিনি একটি

vision – স্বপ্নের কাফেলার কথা বলেছেন- যে কাফেলার পুরোভাগে আছেন উমর নিজে। এ

vision এর মধ্য দিয়ে কবি আমাদের সামনে একটি ভবিষ্যতের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তবে তাকে পুরোপুরি স্বাপ্নিক বলা যাবে না কারণ শেষে তিনি বাস্তব জীবনে ফিরে এসেছেন এবং বর্তমান অবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন যার মধ্যে আমাদের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে তিনি হতাশায় ভেঙ্গে পড়েননি। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও কবিতা দুটো বস্তুনিষ্ঠ নয়, আবেগঘন, ভক্তিরসে সিক্ত, ইসলামী আদর্শে দীপ্ত, সর্বোপরি কাব্য-সুষমায় মন্ডিত।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment