ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রবন্ধটির লেখক আবুল ফজল। আবুল ফজল (১ জুলাই ১৯০৩-৪ মে ১৯৮৩) বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি মূলত একজন চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার। তার প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
ধর্ম ও রাষ্ট্র
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ও বাদানুবাদের অন্ত নেই। আর সমস্যাটা হালেরও নয়, বহু পুরোনো। একটাকে আর একটার ওপর নির্ভরশীল করে তুললে–ধর্ম বা রাষ্ট্র কোনো পক্ষের ফায়দা হয়েছে কিনা, হচ্ছে কিনা, হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা বিচার করতে হলে নিরপেক্ষ সত্যসন্ধিৎসা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম বা রাষ্ট্র কোনো ব্যাপারেই নির্ভেজাল সত্যসন্ধিৎসা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র পরিচালকদের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ্য মোকাবিলা এক রকম অসম্ভব বললেই চলে। তাই এ সম্বন্ধে সত্যসন্ধিৎসুর সচেতন বুদ্ধিজীবীরাও চুপ থাকতে বাধ্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এ পরিবেশের জন্যই আমাদের দেশে শ’, রাসেল কী হাক্সলির মতো বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব কল্পনাই করা যায় না।
ধর্মের সঙ্গে এমন একটা বুদ্ধি-বিচারহীন অন্ধ আবেগ মিশে রয়েছে যে, তাকে উপেক্ষা করার সাহস কেউই সঞ্চয় করতে পারছে না। গণতন্ত্রকে যদি রাষ্ট্রীয় আদর্শ বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে জনসাধারণ যত স্থল ও বিচারবুদ্ধিহীন আর তাদের দাবি যতই যুক্তিহীন হোক না কেন রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষীরা তাদের দাবি যে শুধু মেনে নেবে তা নয়, পদে পদেই দেবে ওইসব দাবিকে প্রশ্রয়। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এ প্রশ্রয়ের নজির অনেক বেশি খোলাসা। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর কোনো রকম রাষ্ট্রীয় উচ্চাভিলাষ হয়তো নেই, কিন্তু দেহটার মায়া তো আছে। তাই আত্মঘাতী জেনেও অন্ধ আবেগকে সমীহ না করে তাদেরও উপায় নেই। ফলে এ দুই শ্রেণী–রাষ্ট্রবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে পদে পদেই গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। গোঁজামিল দিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকা যায় বটে, কিন্তু বড় কিছু করা যায় না–না রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, না সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রে, না মননশীলতায়। ধর্ম যাকে বলে স্টেটিক, অচল-অনড় একটা অচলায়তনের নিগড়ে তা আবদ্ধ–ধর্মকে বলা হয় অলৌকিক অপৌরুষের খোদায়ী! অত্যন্ত অসন্দিন্ধ ভাষায় বলা হয়েছে হযরত মোহাম্মদ শেষ নবী, কোরানের পর আর কোনো ঐশী কেতাব নাজেল হবে না।
কাজেই এক অলঙ্ঘনীয় সীমা ও গণ্ডি টেনে দেওয়া হয়েছে মানুষের সামনে–ধর্মের ক্ষেত্রে এর বাইরে পা বাড়াবার অধিকার মানুষের নেই। এর ভালোমন্দ যাচাইয়ের বা এ-সম্বন্ধে মতামত দেওয়ার অধিকার থেকেও মানুষ বঞ্চিত। ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক ও সুনির্দিষ্ট। আমার যতটুকু ধারণা, ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মানুষের মনে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে তোলা, তাকে ভেতরে-বাইরে সৎ ও আল্লাভক্ত রূপে গড়ে তোলা। ‘সৎ’ কথাটা নিয়েই মুশকিল। আধ্যাত্মিকতা বা আল্লা ভক্তি এমন একটা অশরীরী ব্যাপার যে তাকে ধরা-ছোঁওয়া, দেখা-শোনা, বাছ-বিচার কী পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায়–কিছুতেই আনা যায় না।
এ সব ক্ষেত্রে শুধু মানুষ, সমাজ বা রাষ্ট্রকে যে ফাঁকি দেওয়া যায় তা নয়, নিজের মনকেও চোখ ঠারানো যায় সহজে। কিন্তু সৎ ও সজ্জীবনের দাবি এমনি প্রত্যক্ষ ও লক্ষ্যগোচর যে, তাতে নিজেকে কিছুটা ফাঁকি দেওয়া গেলেও সচেতন মানুষ বা সমাজকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায়ই থাকে না। লোকটা সৎ কিনা, সঞ্জীবন যাপন করে কিনা তা সহজেই বিচার করে দেখা যেতে পারে। কারণ, সঞ্জীবন ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারিক জীবনেরই ফুল। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা বা খোদাভক্তির ব্যাপারে তা কি বলা। যায়? যে লোক আল্লার একত্বে আর নবীদের প্রেরিতত্বে বিশ্বাস করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানে রোজা রাখে, সামর্থ থাকলে কোরবানি আর হজ্ব করে ও যাকাত দেয়–তাকে প্রচলিত অর্থে ধার্মিক বা খোদাভক্ত বলে স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু এমন লোক সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় অর্থে সৎ নাও হতে পারে। নিরপেক্ষ বিচারে এমন লোকও কি অহরহ দণ্ডিত হচ্ছে না? অর্থাৎ দণ্ডের উপযুক্ত অপরাধ কি করছে না? মানুষকে ধার্মিক বা খোদাভক্ত করে তোলার জন্য প্রত্যেক ধর্মেই নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের ব্যবস্থা আছে, যারা তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে তাদের ধার্মিক বা খোদাভক্ত না বলে উপায় নেই কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে পালনীয় নীতি-নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কহীন এই আনুষ্ঠানিক স্বধর্মনিষ্ঠার মূল্য কতটুকু? আমাদের প্রত্যেক কোর্ট-কাছারির সঙ্গে বা ধারে কাছে এক বা একাধিক মসজিদ আছে। এসব মসজিদে যাদের নিয়মিত দেখা যায় তাদের অনেককে আবার আসামির কাঠগড়ায়ও কি দেখতে পাওয়া যায় না? এও কি এক রকম গোঁজামিলের। ফল নয়? রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এ গোঁজামিলের নজির আরো ব্যাপক। উদাহরণ দিয়ে নিজের ও সমকালের বিপদ ডেকে আনতে চাই না। আগে যে একবার দেহের মায়ার কথা বলেছি হয়ত সে মায়ায় আমিও এখানে গোঁজামিল দিতে বাধ্য হচ্ছি। মোটকথা ধর্মে, সাহিত্যে, রাষ্ট্রে সর্বত্রই আজ গোঁজামিলের রাজত্ব। আমরা যারা লিখে থাকি আমরাও, গোঁজামিল দিয়ে দিয়েই লিখি। আনুষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে সঞ্জীবনের মিল হলে তা যে সোনায় সোহাগা হয় তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সোনার সঙ্গে সোহাগ মেশাবে কে? রাষ্ট্র? এটিই আমার এক বড় প্রশ্ন। রাষ্ট্র যদি যে অন্ধ আবেগের কথা সূচনায় বলেছি, তার খপ্পরে পড়ে এ দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসে–সে দায়িত্ব রাষ্ট্র আদৌ পালন করতে পারবে কিনা, পারা সম্ভব কিনা? পারলে কতটুকু পারবে? এসব সঙ্গত প্রশ্নের উত্তরের সম্মুখীন না হয়ে এড়িয়ে চললে অধিকতর গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে আমরা বাধ্য হবো। তাতে ধর্ম বা রাষ্ট্র কারো ফায়দা হবে না। মানুষ হবে নাজেহাল।
ধর্ম এক নয়, কিন্তু এখন সব সভ্য ধর্মই স্রষ্টার একত্বে বিশ্বাস করে। তবে এ একত্বের স্বরূপ ভিন্নতর। মুসলমানের আল্লাহ্ সম্বন্ধে ধারণা ও উপলব্ধির সঙ্গে হিন্দুর ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা ও উপলব্ধির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, তেমনি খ্রিস্টানদের গডের ধারণা আর উপলব্ধিও অন্যরকম। আবার বৌদ্ধরা তো বুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো অশরীরী শক্তিকেই আমল দেয় না। সম্ভবত এক সৌদি আরব ছাড়া পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বাস করে না। আশ্চর্য এমন সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব তাদের রাষ্ট্রের নামের আগে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করে নি। ইসলামের জন্মস্থান ও তার ধর্মীয় কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও আরবের রাজা ও রাজকুমারদের জীবনযাত্রার যে সব চমকপ্রদ কাহিনী শোনা যায় ও কাগজপত্রে পড়া যায় তা আংশিক সত্য হলেও তার সঙ্গে ইসলামের বিধি-বিধানের বিশেষ যে মিল নেই তা সহজেই অনুমেয়। তাঁদের জীবন আর ধর্মের মধ্যে যে আত্মবিরোধ রয়েছে তারা হয়ত তা বুঝে গোঁজামিলের শিকার হতে চান নি। এটুকু আন্তরিকতা আর কাণ্ডজ্ঞানের জন্য তারা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
গণতন্ত্র মানে সংখ্যা। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে গেলে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের যে ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি তাদের ধর্মানুসারেই রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে। সে ধর্মই হবে রাষ্ট্রের ধর্ম–রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতিভূ। সে হিসেবে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বিশেষিত করা সঙ্গতই হয়েছে। কিন্তু নামকরণ এক কথা আর নামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে বাস্তবায়িত করা অন্য কথা। যে কোনো নাস্তিকেরও নাম নূরুল ইসলাম কি শামসুল ইসলাম হতে পারে; কিন্তু তাই বলে নামের বরকতে সে যে একদিন পাকাপোক্ত মুসলমান হয়ে উঠবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী কি করা যায়? খোদাবক্সও যে খোদাভক্ত হয় না তার নজির দেদার। বিশেষত, রাষ্ট্র একটি সমষ্টিগত ব্যাপার, অগণিত মানুষের জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক। আর আজকের দিনের কোনো সভ্য রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন ও একক নয়–তাবৎ পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের সম্বন্ধ। যে মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে রাষ্ট্রের কারবার সে মানুষ ও তার জীবন চলিষ্ণু, পরিবর্তনশীল ও জঙ্গম। অথচ ধর্ম হচ্ছে তার বিপরীত। চোদ্দ শত বছর আগেও ধর্ম যা ছিল এখনো তাই আছে, চোদ্দ শত বছর পরেও তাই থাকবে। যে কোরান-হাদিসের নির্দেশ মতো রাষ্ট্রীয় আইন কানুন প্রণয়নের দাবি উঠেছে, মানুষের জীবনে সহস্র রদবদল ঘটলেও তার রদবদল ঘটানো মানুষের সাধ্যাতীত। অথচ আজকের মানুষ আর চোদ্দ শত বছর আগের মানুষ কখনো এক নয় এবং চোদ্দ শত বছর পরের মানুষও এ মানুষ থাকবে না। তাদের জীবনের প্রয়োজন ও চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, রুচি ও মূল্যবোধ স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। জীবনের সমস্যাও হবে ভিন্নতর।
ইসলামের বিধি-নিষেধের দূরতম ব্যাখ্যার দ্বারাও প্রচলিত সিনেমা ইত্যাদিকে সমর্থন করা যায় না, তবুও এসব কি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় নি, পাচ্ছে না? রাষ্ট্রের নাম ইসলামি করার দাবি যারা তুলেছেন তারাও এ যাবৎ সিনেমাকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান নি। অর্থাৎ এখানেও সে গোঁজামিল।
আমাদের শাসনতন্ত্র রচিয়তা আর রাষ্ট্র পরিচালকগণ কেউই ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত নন, কিন্তু তারা অনেকেই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সুপরিচিত। তাই তারা পাকিস্তানকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ওপরই জোর দিচ্ছেন অথচ এদিকে গণতন্ত্রের ভয়ে ধর্মীয় আবেগের কাছে নতি স্বীকার না করেও পারছেন না। তাই রাষ্ট্রের নামে ইসলামি বিশেষণ বার বার জোড়া ও ছাড়া হচ্ছে। যারা ছাড়ছেন তারাই আবার জুড়ছেন। এ শুধু অন্তর্দ্বন্দ্ব বা গোঁজামিলের নিদর্শন নয়–ধর্মকে রাষ্ট্র ও সামাজিক ব্যাপারে টেনে নিয়ে এলে এ রকম গোঁজামিলের আশ্রয় নিতেই হবে এবং তার সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে যাবে। রাষ্ট্র শাসিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় কতগুলি আইন ও বিধি-বিধানের দ্বারা, যার রচয়িতা মানুষ। আর এ সব আইন ও বিধি-বিধান রচিত হয়েছে রাষ্ট্রের অন্তর্গত মানুষের সুখ-সুবিধা-নিরাপত্তা ও ক্রমোন্নতির দিকে লক্ষ্য রেখে। বলা বাহুল্য, এ সম্পূর্ণভাবে জাগতিক পার্থিব ব্যাপার, এর সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্কই নেই। আগেই বলেছি, আধ্যাত্মিকতা অশরীরী ব্যাপার। অশরীরী কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রের হাত দিতে যাওয়া মানে চোরাবালিতে পা দেওয়া–গোঁজামিলের আড়ালে উটপাখি হওয়া। ভূত-পরী ও দেও-জ্বীনকে কি আইনের এক্তিয়ারভুক্ত করা সম্ভব?
একটা দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাপারটি বুঝতে চেষ্টা করা যাক। আমাদের শাসনতন্ত্রের মূলসূত্র ও আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, পৃথিবীর তথা পাকিস্তানের যাবতীয় ধন-সম্পদের একমাত্র মালিক আল্লাহ। কথাটা অতি উত্তম–শুনতেও মধুর। এক শ্ৰেণীর ধর্মীয় আবেগের এ এক চরম অভিব্যক্তি। তবে অধিকাংশ সস্তা বুলির মতো এও কি এক অবাস্তব উক্তি নয়? কথাটা মিথ্যা বলছি না। আল্লাহ সমস্ত বিশ্বের স্রষ্টা ও মালিক এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্তত ঈমান ও বিশ্বাসের দিক থেকে এ বিষয়ে বোধ করি কোনো মুসলমানের মনেই দ্বিমত আশা করা যায় না। কিন্তু শাসনতন্ত্র তো ব্যবহারিক জীবনের জন্য–তার ঘোষিত বিধি-বিধান ও উদ্দেশ্য যদি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা না যায়, অন্তত প্রয়োগের ব্যবস্থা করা না হয় তা হলে এ সব ঘোষণা ও উক্তি কি ফাঁকা বুলিতে পর্যবসিত হয় না? বিশ্বের ওপর আমাদের যখন কোনো কর্তত্ব নেই, বিশ্বের কথা আপাতত মুলতুবিই থাক। পাকিস্তানের যাবতীয় সম্পদের মালিক যদি আল্লাহই হন আর তা যদি আমরা রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রে স্বীকার করে নেই তা হলে যুক্তিসঙ্গতভাবে আমাদের এ-ও স্বীকার করে নিতে হয় যে, আল্লাহর যে সব বান্দা পাকিস্তানে বাস করে তাদের সকলেরই পাকিস্তানের যাবতীয় সম্পদের ওপর সমান হক ও অধিকার রয়েছে। এ না মানলে পূর্বোক্ত ঘোষণা কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না? আর শাসনতন্ত্রের বিধি-বিধান ও আইনের দ্বারা তাকে বাস্তবায়নের যদি ব্যবস্থা করা না হয় তা হলে স্বভাবতই বুঝতে হবে নেহাত ফাঁকি আর গোজামিল দিয়ে জনগণের অন্ধ আবেগকে পরিতৃপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে শুধু ওই উচ্চরোল ঘোষণার মারফত; আর বুঝতে হবে শাসনতন্ত্রের মূল সূত্র ও আদর্শকে বাস্তবায়নের মতলব কারো নেই–না শাসনতন্ত্র রচয়িতাদের, না যারা এ শাসনতন্ত্রকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদের। অথবা এ যত বড় মহৎ আদর্শই হোক, একে বাস্তবায়ন যে কোনো রাষ্ট্রেরই সাধ্যাতীত। কোনটা সত্য?
আমার বিশ্বাস, মূল সূত্র ও আদর্শের সঙ্গে যদি শাসনতন্ত্রের সঙ্গতি থাকতো তা হলে তাকে বাস্তবায়নের বিধিবিধানও শাসনতন্ত্রে সন্নিবিষ্ট হতো এবং পাকিস্তানের সমস্ত ধনসম্পদকে নাগরিকদের মধ্যে সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত আইন কানুনও এতদিনে রচিত হতো। অন্তত তার আলামত দেখা যেতো। ধন বণ্টনের পাঁচসালা। কি দশমালা পরিকল্পনার চেহারা আমরা নিশ্চয় দেখতে পেতাম। এতদিনে কোনো নির্বাচিত গ্রাম কি থানা বা জেলার অথবা কোনো প্রশাসনিক বিভাগে এ সমতা বিধানের অর্থাৎ আল্লাহর সম্পদকে সকল বান্দার মধ্যে সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যেতো! কিন্তু তার কোনো পরিচয় বা আভাস কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কি? বরং দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অতি অল্পসংখ্যক লোক, ঘটনাচক্রে যারা রাষ্ট্রের ওপরতলায় স্থান পেয়েছেন, তারা যে আইন বা রোজগারের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন অধিকাংশ নাগরিক তার শতাংশ থেকেও বঞ্চিত। এ অবস্থার রদ-বদলের কোনো পরিকল্পনাই যেখানে নেই, সেখানে সব ধনসম্পদের মালিক আল্লাহ্–এ কথা ঘোষণার কোনো মানে হয় কি? স্রেফ এ ঘোষণার দ্বারা আল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা কারো ফায়দা হচ্ছে কিনা তাও জিজ্ঞাস্য। অবশ্য এটুকু ফাঁকা কথায় অনেকের ধর্মীয় আবেগ যে চরিতার্থ হয়েছে ও হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা বিশদভাবে বুঝতে চেষ্টা করলে ধর্মকে কীভাবে ফাঁকি ও গোঁজামিলের হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে তা আরো বেশি করে ধরা পড়বে। ইসলাম অশরীরী, খেয়ালি বা ভৌতিক কিছু নয়। ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর একত্বে ও নবীর প্রেরিতত্বে বিশ্বাস ইসলামের সর্বপ্রধান শর্ত এবং একমাত্র এটিই অপ্রত্যক্ষ অর্থাৎ এটাকে চোখে দেখে সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। ফলে, ফাঁকি দেওয়াও সহজ। এমন ফাঁকিবাজ বা মুনাফেকদের কথা কোরানে একাধিক জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বিশ্বের তাবৎ সম্পত্তির মালিক–ঈমানের মতো এটাও একটা অপ্রত্যক্ষ বিশ্বাসের কথা। রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে এ বিশ্বাসকে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না করলে এখানেও ফাঁকির ক্ষেত্র থেকে যায় প্রশস্ত। এ কথা ওপরে একবার উল্লেখ করা হয়েছে। ধনসম্পদকে আইন করে বণ্টন করা এমন অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু যেটা নিছক বিশ্বাসের ব্যাপার তাকে আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধির আওতায় আনা কিছুতেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত স্বীকৃতি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য রকম সাক্ষী বা প্রমাণও অচল। অথচ ব্যক্তিগত স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ওপর আইন বা দণ্ডবিধি নির্ভর করতে পারে না। অন্য সাক্ষী-প্রমাণ থাকলে চোরের অস্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে তাকে চৌর্যাপরাধ থেকে অব্যাহতি কোনো দেশের আইনই দেবে না। কি ঈমান বা বিশ্বাসের বেলায় তেমন সাক্ষী-প্রমাণের সুযোগ কোথায়? আর তেমন অপরাধের স্তরবিভাগও করা যাবে কী করে? ধরুন, কোনো রাষ্ট্রে যদি এমন আইন করা হয়, যে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়বে না সে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে। সে জাতীয় পরিষদের সদস্য হতে পারবে না এবং পারবে না মন্ত্রী হতে। তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখা যেতে পারে। যে কোনো ইসলামি রাষ্ট্রে এমন আইন যে শুধু যুক্তিসঙ্গত তা নয়, অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়ও। রাষ্ট্রের নাম ইসলামি দিয়ে বাহবা কুড়াবেন অথচ যে বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের ওপর ইসলামের প্রতিষ্ঠা তাকে আইন ও রাষ্ট্র বিধানে আমল দেবেন না, একি এক মস্ত স্ববিরোধী ব্যাপার নয়? দিলেও বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কি? আল্লাহ রসুলে একদম বিশ্বাস করেন না এমন নাম মাত্র মুসলমান, মুসলমান সমাজেও কম নেই–আর তাঁরাও যে জাতীয় পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী হতে চাইবেন তাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর তা হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা যে শুধু নামাজ পড়বেন তা নয়, পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ তারা জমাতের সঙ্গেই পড়বেন এবং আমি জোর করে বলতে পারি পল্টন-ময়দানের জমাতে তারা বিনা অজুতেও শরিক হবেন। তারা যে বাড়ি থেকে অজু করে আসেন নি তা আপনি প্রমাণ করবেন কী করে? এ আইন প্রয়োগের জন্য আলাদা একটা আই বি ডিপার্টমেন্ট খুললেও সন্তোষজনক ফল পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
শুনেছি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ওলেমাদের এক প্রতিনিধিদল কায়েদে আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নামাজকে সারা পাকিস্তানে অর্ডিনেন্সের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান যখন মুসলিম রাষ্ট্র তখন তাকে ইসলামি আদর্শে গড়ে তুলতে হলে ইসলামের প্রধান স্তম্ভ নামাজকে বাধ্যতামূলক করা উচিত–এটাই ছিল তাদের প্রধান যুক্তি। উত্তরে কায়েদে আজম নাকি বলেছিলেন, এ করতে গেলে এ নতুন রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজ বন্ধ করে দিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি এ অর্ডিনেন্স প্রয়োগেই নিয়োগ করতে হবে আর শহরে-বন্দরে, গ্রামে মহল্লায় সর্বত্র খালি জেলখানাই তৈরি করতে হবে আর মোতায়েন করতে হবে পুলিশ। তার সহজ কাণ্ডজ্ঞানের দ্বারা কায়েদে আজম সেদিন এভাবে ওলেমাদের ধর্মীয় আবেগ নিবৃত্ত করেছিলেন। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতার অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব সেদিন তার সহায় হয়েছিল। যদি তর্কের খাতির আমরা মেনেও নেই যে, অর্ডিনেন্স বা আইনের সাহায্যে নামাজকে যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, তা হলে পাকিস্তানের সব মুসলিম নাগরিকই নামাজ পড়তে শুরু করবেন–আল্লাহর ভয়ে না হলেও আইনের ভয়ে তো বটেই। তা হলেও সমস্যা অন্যদিক থেকে দেখা দেবে, অত লোকের নামাজের জায়গা কোথায়? নামাজের বয়সী অন্তত পাঁচ ছ কোটি লোকও যদি থাকেন আর তারা যদি নামাজ পড়তে চান তা হলে কতটা মসজিদ দরকার তা একবার ভেবে দেখুন। রাষ্ট্রের সমস্ত রাজস্ব এ খাতে ব্যয় করলেও তাতে কুলাবে কিনা বিবেচ্য। নামাজ অবশ্য ঘরেও পড়া যায় কিন্তু তা হলেও ঘরে ঘরে পুলিশ মোতায়েন কি সম্ভবপর? যে কোনো আইন মানা ও প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকের ব্যবস্থা না থাকলে দু দিনেই তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। চুরি-ডাকাতি, খুন-জখম ইত্যাদি অপরাধ সম্পর্কীয় আইন তদারক করার জন্য যদি পুলিশ, থানা, বিচার ও দণ্ডের ব্যবস্থা না থাকত তবে এসব অপরাধ কীভাবে বেড়ে যেত একবার কল্পনা করে দেখা যেতে পারে। এ সব অপরাধ সম্বন্ধে কোরান-হাদিসে নিষেধ আর হুঁশিয়ারির তো অন্ত নেই। তাতে কুলাচ্ছে না বলেই তো আইনের আশ্রয় গ্রহণ। নামাজের বেলায় কি তা হবে না?
নামাজকে আইনের এক্তেয়ারভুক্ত করলে (তা না করলে ইসলামি রাষ্ট্র যা অনৈসলামিক রাষ্ট্রও তা, কারণ কোরান-হাদিসের নিদের্শ সব দেশেই সমান প্রযোজ্য) রাষ্ট্রকে কী রকম অসাধ্য অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে তার যে ইঙ্গিত ওপরে দিয়েছি তা কাল্পনিক বিবেচিত হতে পারে এবং আপাতত তা যে কাল্পনিক আমি নিজেও তা স্বীকার করছি। কিন্তু হজ্বের ব্যাপার তো মোটেও কাল্পনিক নয়, আর হজ্বও তো ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ, সক্ষম ও সমর্থ মুসলমানের অন্যতম অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সে হজুও কি আজ মানুষ অবাধে পালন করতে পারছে? রাষ্ট্র নিজেই কি তার এক বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি? ধরুন পাকিস্তানের আট কোটি মুসলমানের মধ্যে অন্তত বিশ লক্ষ লোকের ওপরও যদি হজ্ব ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ধময়ি কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়–ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সবাই হজ্ব করার সুযোগ পাবে কিনা সন্দেহ। এ দশ বছরে এদের এক মোটা অংশ যে মারা যাবে তাও বোধ করি সহজে অনুমান করা যায়। ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও স্রেফ রাষ্ট্রীয় বাধার ফলে এরা যে ইসলামের অবশ্য পালনীয় একটি ধর্মীয় কর্তব্য করতে পারল না, আল্লাহর কাছে তার জন্যে যদি জবাবদিহি করতে হয় তা কে করবে? রাষ্ট্র না সে গুনাহগার বান্দা? কিন্তু এ গুনাহর জন্য সে তো মোটেও দায়ী নয়। সে তো অত্যন্ত আহাল দিলেই হজে যাওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছিল, (এমন কি শরিয়তের নিষেধ অমান্য করে পাসপোর্ট সাইজ ফটোও তুলেছিল) প্রয়োজনীয় টাকা সরকারি ব্যাঙ্কে দিয়েছিল জমা, তবুও হজ্ব করার অনুমতি মিলল না তার। কোরান হাদিসের নির্দেশে ধর্ম-কাজ করার জন্যে সরকারি কর্মচারীর কাছে (যার অধিকাংশই হয়তো শরিয়ত মোতাবেক জীবন-যাপন করে না) দরখাস্ত করা তথা অনুমতি ভিক্ষা কি ধর্মের সঙ্গে একটা বড় রকমের রাষ্ট্রীয় পরিহাস নয়? স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকরা যদি স্বেচ্ছামতো স্বাধীনভাবে ইসলামের নির্দেশ পালনে রাষ্ট্রের কাছ থেকেই বাধা পায় তা হলে ‘স্বাধীন’ আর ‘ইসলামি’ কথাটার অর্থ হয় কী? আসল কথা ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে আর রাষ্ট্রকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিতে গেলেই এ অদ্ভুত গোঁজামিল ও স্ববিরোধিতার সম্মুখীন হতেই হবে। কারণ, ধর্ম অলঙ্ঘনীয়, তার নির্দেশ ও বিধান অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র স্থাণু নয়–প্রগতিশীল বলেই তা পরিবর্তনশীল। আর বিচ্ছিন্ন নয় বলে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নানা স্বার্থে ও বিচিত্র আইন-কানুনে তা শৃঙ্খলিত। পাসপোর্ট, ভিসা, যানবাহন সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রা ইত্যাদি সব কিছুই আধুনিক রাষ্ট্রের এক একটি শৃঙ্খল। আধুনিক রাষ্ট্র অনায়াসে ধর্মের শৃঙ্খল বা বিধিবিধান ভেঙে চুরমার করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিধানে বিশেষ করে যে সব বিধানের সঙ্গে অন্য দেশের রাষ্ট্রীয় নীতির সম্পর্ক রয়েছে তার পান থেকে চুন খসাতেও অক্ষম। হজ্বের ব্যাপার তার একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ। অথচ পাকিস্তান ও সৌদি আরব দুইই মুসলিম রাষ্ট্র।
নামাজ এবং রোজাকেও আইনের আওতায় আনতে গেলে ওই একই সমস্যা দেখা দেবে। বলা বহুল্য, যে কোনো রচিত আইনের প্রতি রাষ্ট্রের যদি কিছুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে তাহলে এ দুপক্ষের মোকাবিলা রাষ্ট্রকে করতেই হবে। এক পক্ষের জন্য গ্রামে গ্রামে বানাতে হবে মসজিদ আর অন্য পক্ষের জন্য জেলখানা। আর লোক-সংখ্যানুপাতে মোতায়েন করতে হবে পুলিশ–এ আইন পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য। ফলে এমন অবস্থাও হতে পারে যে, দেশের অর্ধেক লোক জেলে আর অর্ধেক নেবে পুলিশের চাকরি। এ করে দেশে ইসলামি শাসন কায়েম হবে কিনা জানি না; তবে দেশের মানুষের খাওয়া-পরার সমস্যা যে অনেকখানি চুকে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। দেশে তখন কয়েদি আর পুলিশ এ দুই শ্রেণী ছাড়া যে লোক থাকবে তার সংখ্যা নেহাত নগণ্য হতে বাধ্য। আধুনিক রাষ্ট্র এক জটিল ব্যাপার, তার আইন-কানুনও জটিলতর। পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে হজ্বে যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসা কি বৈদেশিক মুদ্রার সমস্যার মোকাবিলা করতে হতো না কারো। তখন যানবাহনের সমস্যা ও তার আইন-কানুন ছিল না এত তীব্র ও কঠোর। আজকের দিনে যা সমস্যা তা আধুনিক রাষ্ট্রের সমস্যা। আধুনিক রাষ্ট্র এসব সমস্যা কিছুতেই এড়াতে পারে না। পারে না বলেই হজ্বের মতো ধর্মীয় ব্যাপারেও পাকিস্তান রাষ্ট্র (ইসলামি হয়েও) নানা বিধি-বিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে, ফটো ও লটারির মতো শরিয়ত-বিরোধী পথে না গিয়ে মানুষ আজ অবশ্য পালনীয় শরিয়ত কর্মও করতে পারছে না।
অন্য ধর্মের মতো ইসলামেও সম্প্রদায়ের অন্ত নেই এবং এদের মধ্যে ধর্মীয় আচার। অনুষ্ঠানের তারতম্যও কম নয়। তবুও দেশের রাষ্ট্রবিদরা যখন কোরান-হাদিসের দোহাই দিচ্ছেন তখন ধরে নিতে হবে তারা এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ কোরান-হাদিসের ইসলামকেই পাকিস্তানে বাস্তবায়িত হতে দেখতে চান। ওপরে ইসলামের যে পাঁচ স্তম্ভের কথা বলেছি তা নিশ্চয়ই কোরান-হাদিস সমর্থিত ও নির্দেশিত এবং এগুলির বাইরে বা এগুলিকে বাদ দিয়ে কোনো ইসলামের ধারণা করতে আমি অন্তত অক্ষম। ইসলামি শাসন মানে, আমি মনে করি, ইসলামের এই পাঁচ হুকুম আহকামকে জীবনে রূপায়িত করা, কোরান-হাদিসের নির্দেশ অনুসারে দেশের যাবতীয় আইন প্রণয়ন করে সে আইনের দ্বারা দেশকে শাসন করা অর্থাৎ কোরান-হাদিসে যে যে অপরাধে যে যে দণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবে দেশের দণ্ডবিধিকে সংশোধন করে তা প্রয়োগ করা। এর বাইরে ইসলাম কী বস্তু তা আমার জানা নেই। এ সবকে বাদ দিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র সোনার পাথর-বাটির চেয়েও স্ববিরোধী উক্তি বলেই আমার বিশ্বাস। আশ্চর্য, ইসলামে যাকে, পঞ্চখুঁটি বলা হয় তার সঙ্গে যাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই তারাই আজ মোটা গলায় দাবি তুলেছেন ইসলামি রাষ্ট্রের। এঁরা ইসলামি রাষ্ট্র বলে দাবি করছেন বটে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাভাবিক দাবিটুকু করছেন না যে, শাসনতন্ত্র রচনা করবেন আর শাসনতন্ত্রকে যারা বাস্তবায়িত করবেন, এ রাষ্ট্রের এ ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রকে যারা দিনে দিনে পরিচালিত করবেন তাদের সকলকেই কোরান-হাদিস অনুসারে জীবন যাপন করতে হবে। অন্তত ইসলামের যে পাঁচ রোকন তা যাঁরা পালন করবেন না তাঁরা কোনো রাষ্ট্রীয় পদেই বহাল থাকতে পারবেন না।
![ধর্ম ও রাষ্ট্র - আবুল ফজল [ প্রবন্ধ ] 2 আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news-300x225.jpg)
অথচ তেমন দাবি উঠেছে বলে এ যাবৎ শুনি নি এবং তেমন আইন-কানুন রচিত হয়েছে বা রচনার উদ্যোগ চলছে বলেও জানা যায় নি। খাঁটি মুসলমান ছাড়া ইসলামি শাসন বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে কে? যে হাকিম নিজে নামাজ পড়ে না সে হাকিম নামাজ না পড়ার জন্য শান্তি দেবে অন্যকে–কথাটা এক বড় রকমের পরিহাস নয় কি? দাবি জানানো হচ্ছে কোরান-হাদিসের পরিপন্থী কোনো আইন করা চলবে না। এও তো এক নেতিবাচক কথা। যদি দাবি করা হতো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ও আইন-কানুন সব কিছু কোরান হাদিসের নির্দেশানুসারেই রচিত হবে বা রচিত হোক তা হলেই অধিকতর সঙ্গত হতো। আগেই বলেছি, আমাদের রাষ্ট্রবিদরা প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা মনে মনে ভালো করেই জানেন, এ যুগে শাস্ত্রীয় নির্দেশানুসারে কোনো রাষ্ট্রের আইন ও শাসনবিধি রচিত হলে তার সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বাধা ও সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই ফাঁকি ও গোঁজামিলের মুখোশ পরে জনসাধারণের তথাকথিত ধর্মীয় আবেগকে ঘুম পাড়িয়ে তারা সস্তায় কাজ হাসিল করতে চান। এ না হলে তাদের রাজনৈতিক জীবনই যে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তারা ভাল করেই জানেন নামাজি-কালামি হওয়ার চেয়ে মন্ত্রী হওয়ার মূল্য ঢের বেশি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজির চেয়ে বেনামাজি মন্ত্রীর দাপট যে কতখানি বেশি তা কারও অজানা বা অদেখা নয়। বলেছি আধুনিক রাষ্ট্রীয় নীতি ও ধারণার সঙ্গে ধর্মীয় বিধিবিধানের সংঘর্ষ অনিবার্য। এ সংঘর্ষের স্বরূপ আমরা হজের বেলায় দেখেছি, আরো বেশি যদি দেখতে চান তো সুদের বেলায়, সিনেমা ও নাচগানের বেলায়ও দেখতে পাবেন। এ সবই পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। সুদও তো আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যক্তিগতের সীমা ছাড়িয়ে নামাজ-রোজাকেও রাষ্ট্রীয় আইনের এক্তেয়ারে নিয়ে এলে তাও নতুন নতুন সংঘর্ষেরই সৃষ্টি করবে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় একবার রমজান মাসে সলিমউল্লাহ মুসলিম হলের ডাইনিং হল বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক নাছোড়বান্দা ছাত্র আদালতে নালিশ করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, বিচারে ছাত্রটিরই জয় হয়েছিল। আধুনিক কালে আইনের সাহায্যে জোর করে ধর্ম পালন করা যাবে কিনা এও এক রীতিমতো বিরাট প্রশ্ন। একদিকে বছর বছর ঘটা করে মানবাধিকার দিবস পালন করা অন্যদিকে নামাজ-রোজাকে রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করা হলে তাতে মতামত ও উপাসনার স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষিত হবে কিনা, বিশ্ব রাজনীতির পটভূমিতে সে প্রশ্নও উঠতে পারে।
আজ প্রায় সব সভ্য রাষ্ট্রই বিশ্ব জাতি সংস্থার (U. N. O) সদস্য আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সব আইন কোনো ধর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসরণ করে রচিত হয় নি–রচিত হয়েছে আধুনিক জীবনের চাহিদা ও প্রয়োজনানুসারে এবং এসবই আধুনিক রাষ্ট্রীয় আর্দশ ও ধারণার পরিপূরক। ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণী খ্রিস্টান, অধিকাংশ নাগরিকও খ্রিস্টান–এ অজুহাতে হঠাৎ যদি সেখানে আইন করা হয় যে, সব ইংরেজকেই প্রতি রবিবার গির্জায় হাজির হতে হবে এবং মানতে হবে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের সন্তান তা হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ইংরেজ শুধু যে বিদ্রোহ করবে তা নয়–আন্তর্জাতিক আদালতে এ আইনের বিরুদ্ধে নালিশও উঠতে পারে। সে আদালতের অধিকাংশ বিচারক খ্রিস্টান হলেও তাতে বাইবেলের নির্দেশ যে হালে পানি পাবে না। তাও সুনিশ্চিত। ভারতে হিন্দু ধর্মানুসারে পূজা-অর্চনা আর পাকিস্তানে নামাজ-রোজা আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করলেও একই অবস্থার বরং এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবেই। আসল কথা, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক হতে পারে না, পারবে না। করতে গেলেই ধর্মকে ফাঁকি ও গোঁজামিলের আড়ালে মুখ ঢাকতে হবে। তাই আমার বিশ্বাস, ধর্ম ও তার ফাঁকি ও শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ নিয়ে আধুনিক কোনো রাষ্ট্রই হালে পানি পাবে না। দুষ্টান্ত আগেও দিয়েছি, আরো দিচ্ছি। সুদ, প্রাণীর ছবি, মদ, বেশ্যা–এ সবই কোরান-হাদিসে সুকঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মুসলিম বা ইসলামি রাষ্ট্র’ হয়েও পাকিস্তানে এ সব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় অনুমতি ছাড়া নগ্ন বা অর্ধনগ্ন কোনো ছবিই আমদানি করা যায় না, তেমনি লাইসেন্স ছাড়া মদ আমদানি বা বিক্রিও অসম্ভব। বহু শহরে-বন্দরে যে সব বেশ্যা নিবাস রয়েছে তাও রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত–অনুমোদিত। বলা বাহুল্য, এ সবই আধুনিক রাষ্ট্রের অনুষঙ্গ। ধর্মের দোহাই বা নির্দেশ এগুলিকে কিছুতেই বাতিল করতে পারে না। পারলে রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করার আগে পাকিস্তানে কোরান-হাদিসের বরখেলাপকারী সব কিছুকে নিশ্চিহ্ন করা উচিত ছিল। তা করা কি সম্ভব? ( রাষ্ট্রীয় দফতর থেকে যে খতিয়ান বের হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের মদের পরিমাণ বছর বছর বেড়েই চলেছে–সরকারি অনুমতি ছাড়া একি সম্ভব?) তা করতে হলে সমস্ত পৃথিবীটাকেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে–করতে হবে নতুন সমাজ বিন্যাস, বিশেষ করে বর্তমান অর্থনীতিকে বদলাতে হবে গোড়া থেকে আগা অবধি। বর্তমানে স্বাধীন দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এ করার ক্ষমতা আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে পাকিস্তানের যে সে ক্ষমতা নেই সে সম্বন্ধে আমি সুনিশ্চিত।
কোরান-হাদিসের বাইরে যে ইসলাম, সে ইসলাম সম্বন্ধে আমার ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা সত্য, ন্যায়, সামাজিক সুবিচার, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ইত্যাদি যে সব বড় বড় বুলি শোনা যায় এর কোনোটাই ইসলামের একচেটিয়া নয়। সব ধর্ম ও সব রাষ্ট্রেই এগুলি স্বীকৃত–এমন কি কাফিরি রাষ্ট্রেও ‘মিথ্যা’ শুধু নিন্দনীয় নয়, দণ্ডনীয়ও। খ্রিস্টানি মুলুক ইংল্যান্ড-আমেরিকা আজ ‘মাঙ্গলিক’ দেশে পরিণত, যেখানে ধনী-দরিদ্র কারো চিকিৎসার খরচ লাগে না। আর পাকিস্তানে ইসলামের সামাজিক ন্যায় বিচার এখনো রাষ্ট্রবিদদের উচ্চরোল বক্তৃতা আর কেতাব-কোরানেই সীমাবদ্ধ। চিকিৎসার মতো মানবীয় ব্যাপারেও পাকিস্তানে ধনী-দরিদ্রের সুযোগ-সুবিধার আসমান-জমিন পার্থক্য বোধ করি কারো নজর এড়ানোর কথা নয়। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি সুবিচার ইত্যাদি জীবন ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন বড় বড় বুলি না আউড়িয়ে যা কিছু সর্বমানবীয় সত্য তার দিকে আমাদের রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হলে একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়েরই মঙ্গল হতো। তা ছাড়া ছোট-বড় সব বুলিই ফাঁকা ও ফাঁকি হতে বাধ্য। কারণ তার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। কথার বাইরে তার অস্তিত্ব অনুপস্থিত।
‘স্বর্গ-রাজ্য’, ‘ধর্ম-রাজ্য’, ‘রাম-রাজ্য’, ইত্যাদি বহু বুলিই শোনা গেছে। এ সবের কী অর্থ আমি প্রশ্ন করে এ যাবৎ কোন সদুত্তর পাই নি। যারা এ সব বুলি আওড়ান তাদের নিজেদেরও এ সব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা নেই। ঢাকায় একবার এক সেমিনারে জনৈক সুপণ্ডিত অধ্যক্ষ এক প্রবন্ধ পড়েছিলেন। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আশা প্রকাশ করেছিলেন—’অচিরে পাকিস্তান স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।’ সভাশেষে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম–ভাই, স্বর্গরাজ্য কাকে বলে? তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়েই রইলেন আমার দিকে, কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। মোট কথা, স্বর্গরাজ্য সম্বন্ধে তার নিজেরই কোনো ধারণা নেই–না থাকারই কথা। স্বর্গরাজ্য আমি যেমন দেখি নি তিনিও দেখেন নি। একটা ‘পবিত্র আশা’ প্রকাশ করতে হবে তাই করা। আসলে ওই বুলি একটা আকাশকুসুম মাত্র। ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটাও যাঁরা বলেন তাদের মনেও ওই রাষ্ট্র সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা যে আছে তা নয়, তারাও ওই শব্দ দুটির আড়ালে আর এক রকম আকাশকুসুমেরই চাষ করে থাকেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জড়িত রয়েছে বলে আপাতত এর চাষ জমছে ভালো।
[‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ প্রথম প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার বৈশাখ ১৩৭০ সংখ্যায়। পরে এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন এবং মানবতন্ত্র গ্রন্থে স্থান পায়।]