ধ্বনির পরিবর্তন

ধ্বনির পরিবর্তন আজকের আলোচনার বিষয়| এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের ধ্বনিতত্ব বিভাগের, ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ব – পাঠের অংশ।

ধ্বনির পরিবর্তন

Table of Contents

ধ্বনির পরিবর্তন

ভাষার পরিবর্তন ধ্বনির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উচ্চারণের সময় সহজীকরণের প্রবণতায় শব্দের মূল ধ্বনির যেসব পরিবর্তন ঘটে তাকে বলা হয় ধ্বনির পরিবর্তন। ধ্বনির পরিবর্তন নানা প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। সাধারণত জিভের আলসেমি, অনবধান, অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি, সহজে উচ্চারণ করার প্রবণতা ইত্যাদি কারণে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে উচ্চারণের সময় এক ধ্বনির জায়গায় অন্য ধ্বনি আসে, পরের ধ্বনিকে আগেই উচ্চারণ করা হয়, যুক্তধ্বনি ভেঙে দেয়া হয়, মূল শব্দে বাড়তি ধ্বনি আনা হয়, এমনিভাবে ধ্বনির নানান ওলটপালট ঘটে। তবে ধ্বনি-পরিবর্তন খেয়ালখুশি মত যথেচ্ছাচারিতার অধীন নয়, বিশেষ রীতির পরিবর্তন-প্রকৃতি মান্য করে বিশেষ বিশেষ ধ্বনি পরিবর্তিত হয় ।

যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ রীতি | ধ্বনির পরিবর্তন | ধ্বনি-পরিবর্তনের সম্ভাব্য বহু ধারা | ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

 

ভাষাতাত্ত্বিকগণ এই পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে কতকগুলো রীতি লক্ষ করেছেন। এতে দেখা যায়— কতকগুলো শব্দের আদিতে, কতকগুলোর মধ্যভাগে এবং কিছু কিছু শব্দের শেষ ভাগে পরিবর্তন ঘটে। আবার কখনো কখনো শব্দের মধ্যকার ধ্বনির পরস্পর পরিলক্ষিত হয়। ফলে ভাষা বিরোনিগান পরিবর্তন সাধিত হয়। আবার অঞ্চলভেদেও ধ্বনি পরিবর্তনের পার্থক্য এই সকল পরিবর্তন-প্রকৃতিগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে বিশেষ বিশেষ সূত্রে সেগুলো আবদ্ধ করেছেন, সেইসঙ্গে পরিবর্তনের স্বরূপ-স্বভাব অনুযায়ী বিশেষ পারিভাষিক নামও দিয়েছেন। অবশ্য সব ধ্বনি-পরিবর্তনকেই সূত্রের কোঠায় বেঁধে ফেলা সম্ভব হয় নি, কিছু কিছু ব্যতিক্রম থেকে গেছে।

ও ধ্বনি দ্বিবিধ- স্বর ও ব্যঞ্জন। পরিবর্তন হয় স্বর ও ব্যঞ্জন উভয় ক্ষেত্রে। স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনি পরিবর্তনের রীতি-প্রকৃতি প্রধানত তিন রকমের : ১। ধ্বন্যাগম ২। ধ্বনিলোপ এবং ৩। ধ্বনির রূপান্তর। এই ত্রিবিধ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত যেসব সূত্র বা নিয়ম রয়েছে তার পারিভাষিক নাম, সংজ্ঞার্থ ও উদাহরণ নিচে আলোচিত হল।

১। আদিস্বরাগম (Prothesis):

উচ্চারণের সুবিধার জন্যে বা অন্য কোনো কারণে শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি এলে তাকে বলে আদিস্বরাগম।

যেমন- স্কুল > ইস্কুল, স্টেশন > ইস্টিশন; এ রূপ— আস্তাবল, আস্পর্ধা ইত্যাদি।

২। স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বা মধ্যস্বরাগম (Anaptyxis বা Vowel insertion):

উচ্চারণের সুবিধার জন্যে যুক্ত-অক্ষরের মধ্যে আমরা স্বরধ্বনি এনে ফেলি। ধ্বনি পরিবর্তনের ধারাকে বলে। বিপ্রকর্ষ যুক্তব্যঞ্জন উচ্চারণে বাগ্যন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। সেজন্য বাংলা ভাষার সম্ভাব্য ক্ষেত্রে যুক্তব্যঞ্জনকে ভেঙে তার মাঝে স্বরধ্বনি এনে উচ্চারণকে সহজ ও সরল করার প্রবণতা দেখা যায়। ‘ভক্তি’ শব্দের অর্থ ‘বিভাজন’। ‘স্বরভক্তি’ শব্দের অর্থ- ‘স্বর সহযোগে বিভাজন’। ‘বিপ্রকর্ষ’র অর্থ ‘দূরবর্তী হওয়া’।

সুতরাং স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ যুক্তব্যঞ্জনকে ভেঙে দূরবর্তী করে তার মাঝে স্বরধ্বনির আগমন ঘটায়। বিশ্লিষ্ট দুই ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝে স্বরের আগম হয় বলে, একে ‘মধ্যস্বরাগম’ও বলা হয়। যেমন—

গ্রাস > গেরাস

[গ্+র্+আ+স্]> [গ্+এ+র্+আ+স্]

‘গ্রাস’ শব্দটিতে ‘র্’ র-ফলা হয়ে ‘গ’-এর সঙ্গে যুক্ত আছে। ‘গ্’ ও ‘র্’ এর মাঝে কোনো স্বরধ্বনি নেই। সহজ করে উচ্চারণের উদ্দেশ্যে ‘গ্রাস’ যখন ভেঙে ‘গেরাস’ হয়েছে, তখন ‘গ্’ ও ‘র্’-এর মাঝে ‘এ’ স্বরধ্বনি এসেছে।

স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ উচ্চারণকেই শুধু সহজ করে না, শব্দকেও শ্রুতিমধুর করে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষায় এই রীতির প্রচলন ছিল। তখনকার প্রকাশমাধ্যম ছিল পদ্য। ছন্দ ও সুরমাধুর্যের খাতিরে এই রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। আধুনিক চলিত ভাষায় কিছু কিছু তৎসম শব্দ থেকে তদ্ভব বা অর্ধতৎসম রূপের ক্ষেত্রে কিংবা কিছু বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে এই রীতির প্রয়োগ হয়ে থাকে।

ছন্দ ও সুরের প্রয়োজনে কিংবা চলিত ভাষায় সহজ করে উচ্চারণের প্রবণতাবশত সংযুক্তব্যঞ্জনকে ভেঙে তার মাঝে স্বরধ্বনি আনয়নের রীতিকে স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বা মধ্যস্বরাগম বলে। স্বরভক্তিতে অ, ই, উ, এ, ও স্বরধ্বনির আগম দেখা যায় ।

অ স্বরধ্বনির আগম :

শক্তি > শকতি, লগ্ন > লগন, রত্ন > রতন, নির্জন > নিরজন, ভক্তি > ভকতি, প্রাণ > পরান, বর্ষিল > বরষিল, সূর্য > সুরুজ, জন্ম ≥ জনম, দর্শন > দরশন, হর্ষ, হরষ, গর্জন > গরজন, মর্ম > মরম, ধর্ম ≥ ধরম, স্বপ্ন > স্বপন ইত্যাদি।

ই স্বরধ্বনির আগম :

প্রীতি > পিরিতি, স্নান > সিনান, বর্ষণ > বরিষন, ত্রিশ > তিরিশ, ক্লিপ > কিলিপ, ফিল্ম > ফিলিম ইত্যাদি।

উ স্বরধ্বনির আগম :

ভ্রু > ভুরু, দুর্জন > দুরুজন, শুক্রবার > শুক্‌কুরবার, মুক্তা > মুকুতা, তুর্ক, তুরুক ইত্যাদি।

এ স্বরধ্বনির আগম :

গ্রাম > গেরাম, ধ্যান > ধেয়ান, ব্যাকুল > বেয়াকুল, প্রায় পেরায়, ঘ্রাণ > ঘেরান, ব্ল্যাক বেল্যাক, স্রেফ > সেরেফ ইত্যাদি।

ও স্বরধ্বনির আগম :

শ্লোক > শোলোক, কুর্ক > কোরোক ইত্যাদি।

প্রয়োগ

‘মুকুতা [মুক্তা>মুকুতা] ফলের লোভে ডুবে রে অতল জলে যতনে [যত্নে>যতনে] –  ধীবর।’ – মধুসুদন।

‘মাগো আমার শোলোক [শ্লোক>শোলোক] বলা কাজলা দিদি কই। ’

‘ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে [হর্ষে হরষে]।’

‘আকুল শরীর মোর বেয়াকুল [ব্যাকুল>বেয়াকুল] মন। ‘

‘গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরান [ প্রাণ>পরান] যাবে।’

‘যমুনা সিনানে [স্নানে>সিনানে] যাই আঁখি মেলি নাহি চাই।’

‘সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে [স্বপ্নে>স্বপনে]।’

৩। অন্ত্যস্বরাগম (Apothesis):

কোনো কোনো সময় শব্দের শেষে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি আসে। এ রূপ স্বরাগমকে বলা হয় অন্ত্যস্বরাগম। যেমন- দিশ্ > দিশা, পোখত্ > পোক্ত (উচ্চারণ : পোতো), বেঞ্চ > বেঞ্চি, সত্য > সত্যি ইত্যাদি।

৪। স্বরসঙ্গতি (Vowel harmony):

মৌখিক ও চলিত বাংলায় শব্দে অবস্থিত অসম স্বরধ্বনির সাম্য বা সঙ্গতি লাভের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন— দেশি > দিশি। এ, ই স্বরধ্বনি সাম্য বা সঙ্গতি লাভ করে ই হয়েছে। কিন্তু সঙ্গতি লাভের প্রয়াসে স্বরধ্বনির এই-যে পরিবর্তন বা রূপান্তর, তা খেয়াল-খুশি মতো চলে না। এর কিছু বিজ্ঞানসম্মত রীতি-পদ্ধতি আছে। সাধারণত পূর্ববর্তী স্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বরের কিংবা পরবর্তী স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার প্রবণতা দেখা যায়।

যদিও আমাদের বাংলা ভাষায় ১১টি স্বরবর্ণ আছে, তাহলেও মৌখিক উচ্চারণে বা শিষ্ট চলিত ভাষায় মাত্র সাতটি ংলা ভাষা মৌলিক স্বরধ্বনি (ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ) উচ্চারিত হয়। এই সাতটি মৌলিক স্বরধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান অনুযায়ী নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে স্বরধ্বনিগুলোকে সাজানো যায়।

 [ ডায়াগ্রাম]

অবশ্য বাংলা বানানে হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ঈ দুরকম ই-স্বরের এবং হ্রস্ব উ, দীর্ঘ উ দুরকম উ-স্বরের ব্যবহার আছে।

ই, এ, অ্যা ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ সামনের দিকে এগোয়, বিপরীতপক্ষে উ, ও, অ ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ পেছনের দিকে পিছোয়। আ ধ্বনি উচ্চারণে জিভ থাকে মধ্য অবস্থায়। আবার ই, উ উচ্চারণে জিভ উঠে ওপরে, সেজন্য উচ্চ অবস্থান। এ, ও উচ্চারণে জিভের অবস্থান তার কিছুটা নিচে, সেজন্য উচ্চ-মধ্য। অ্যা, অ উচ্চারণে জিভের অবস্থান একেবারে নিচে নয়, নিচের কাছাকাছি, সেজন্য নিম্ন-মধ্য। আ উচ্চারণে জিভের অবস্থান একেবারে নিচে, সেজন্য নিম্ন।

স্বরসঙ্গতির কথাতে আবার আসা যাক। শব্দস্থ স্বরধ্বনির মধ্যে উল্লিখিত অবস্থানগত দূরত্ব বেশি থাকলে উচ্চারণকালে জিহ্বা অত ক্লেশ স্বীকার না করে একটু আরাম পেতে চায়। যেমন— মিথ্যা। এই শব্দে দুটি স্বরধ্বনি আছে, যথাক্রমে ই, আ। অবস্থানগত দিক থেকে ই ওপরে আ নিচে। জিহ্বা অতটা ওপর-নিচ হতে নারাজ। সুতরাং, মিথ্যা মি > মিথ্যে । উচ্চ-স্বরের প্রভাবে নিম্ন-স্বর যেমন টানা হয়ে ওপরে ওঠে, তেমনি নিম্ন স্বরের প্রভাবে উচ্চ-স্বর অধোগামী হয়। যেমন— গিলা > গেলা।

পরবর্তী নিম্ন-অবস্থিত আ স্বরধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চ-অবস্থিত ই স্বরধ্বনি হয়েছে উচ্চ- মধ্যে অবস্থিত এ। যাই হোক, স্বরসঙ্গতির ফলে ধ্বনি-পরিবর্তনগত এই প্রকরণ বাংলা ভাষার চলমানতার বিশিষ্ট লক্ষণ। আধুনিক বাংলার মৌখিক ও শিষ্ট চলিত ভাষায় এর ভূমিকা সর্বাধিক। বাঙালির নিজস্ব উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য এতে এত নিঁখুতভাবে পরিস্ফুট যে, অবাঙালির উচ্চারণে তা একেবারে অসম্ভব বলা চলে। পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্বরের প্রভাবে শব্দের মধ্যে অপর স্বরধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে প্রভাবকারী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করলে, এই রীতিকে বলা হয় স্বরসঙ্গতি।

যথা—

ইচ্ছা > ইচ্ছে

[ই+ছ্+আ] > [ই+ছ্+এ]

পূর্ববর্তী ই স্বরধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী আ স্বরধ্বনি এ হয়েছে। এ রূপ— দেশি > দিশি, বিলাতি > বিলিতি, মূলা > মুলো । প্রধানত চার পদ্ধতিতে স্বরসঙ্গতি হয়ে থাকে। যথা- (ক) প্রগত স্বরসঙ্গতি, (খ) পরাগত স্বরসঙ্গতি, (গ) মধ্যগত স্বরসঙ্গতি ও (ঘ) অন্যোন্য স্বরসঙ্গতি

ক. প্রগত স্বরসঙ্গতি:

পূর্ববর্তী স্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বরের পরিবর্তন তথা পূর্ববর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা। যথা— মূলা মুলো, শিকা > শিকে, তুলা > তুলো ইত্যাদি।

(i) পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত ই-স্বরের প্রভাবে পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বরে পরিণত হয় (ই → আ > এ) : মিথ্যা ? মিথ্যে, মিঠা > মিঠে, ফিতা > ফিতে, বিলাত > বিলেত, ছিলাম > ছিলেম ইত্যাদি।

(ii) পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ (ক্ষেত্র বিশেষে ঊ)-স্বরের প্রভাবে নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত ও-স্বরে পরিণত হয় (উ → আও) : খুড়া খুড়ো, জুতা > জুতো, বুড়া > বুড়ো, রুপা > রুপো, পূজা > পুজো, কুমড়া > কুমড়ো, ফুটা > ফুটো, ফুলা > ফুলো ইত্যাদি।

(iii) পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ-স্বরের প্রভাবে নিম্নাবস্থিত আ-স্বরের উচ্চাবস্থিত উ—স্বরে রূপান্তর ঘটে (উ → আ > উ) : উনান > উনুন, কুড়াল > কুড়ুল, উড়ানি > উড়ুনি, ধুনারি > ধুনুরি ইত্যাদি।

(iv) পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ-স্বরের প্রভাবে নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ-স্বরের উচ্চাবস্থিত উ-স্বরে রূপান্তর ঘটে (উ → অ > উ) : পুত্র > পুত্তুর, নমঃশূদ্র > নমশুদ্দুর ইত্যাদি।

(v) পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত ই-স্বরের প্রভাবে নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চাবস্থিত ই-স্বরে পরিণত হয় (ই → আ > ই) : ভিখারি > ভিখিরি, বিলাতি > বিলিতি, বিকাকিনা > বিকিকিনি ইত্যাদি ।

(vi) পূর্ববর্তী নিম্নাবস্থিত আ নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ, উচ্চাবস্থিত ই কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ঔ-এর প্রভাবে পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আ, নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ উচ্চ-মধ্যাবস্থিত ও-স্বরে পরিণত হয় :

(অ → অ > ও) : গরম > গরোম, গরব > গরোব, অনল > অনোল, খবর > খবোর ইত্যাদি।

(আ → অ > ও) : কাঁদন > কাঁদোন, কাগজ > কাগোজ, আসল > আসোল ইত্যাদি।

(ই → অ > ও) : বিষম > বিষোম, পিতল > পিতোল, নিয়ম > নিয়োম ইত্যাদি।

(ঔ → আ > ও) : চৌকা > চৌকো, মৌজা > মৌজো, নৌকা > নৌকো ইত্যাদি ।

(ঔ → অ > ও) : দৌলত > দৌলোত, সৌরভ > সৌরোভ ইত্যাদি।

খ. পরাগত স্বরসঙ্গতি:

পরবর্তী স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরের পরিবর্তন তথা পরবর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা। যেমন- দেশি > দিশি ইত্যাদি। পরিণত

(i) পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আ-স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত ও স্বরে হয় (আ → উ > ও) : বুনা > বোনা, খুদা > খোদা, বুঝা > বোঝা, ভুলা > ভোলা, শুনা ≥ শোনা, ফুলা> ফোলা ইত্যাদি।

(ii) পরবর্তী নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ, নিম্নাবস্থিত আ বা উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত ই-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বরে পরিণত হয় (অ, আ, এ ই এ) : শিখা > শেখা, শিখে > > শেখে, লিখা > লেখা, লিখে > লেখে, মিলা > মেলা, ফিরা > ফেরা ইত্যাদি।

(iii) পরবর্তী উচ্চাবস্থিত ই (ক্ষেত্রবিশেষে ঈ) স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চাবস্থিত ই স্বরে, উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বর উচ্চাবস্থিত ই স্বরে পরিণত ত হয় (ই→ আ, এ > ই) : সন্ন্যাসী > সন্নিসি, বেটি > বিটি, দেশি > দিশি ইত্যাদি।

(iv) পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আ, উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ আর ও স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ স্বরের বিকৃত উচ্চারণ অ্যা হয় (আ, এ, ও→ এ > অ্যা) : খেলা > খ্যালা, ঠেলা ঠ্যালা, দেখে দ্যাখে, গেল > গ্যালো।

গ. মধ্যগত স্বরসঙ্গতি:

পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বরের প্রভাবে মধ্যে অবস্থিত স্বর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে। যথা— আগের ও পরের ই স্বরের প্রভাবে মাঝের আ-স্বর ই-স্বরে পরিণত হয় : বিলাতি > বিলিতি, ভিখারি > ভিখিরি, জিলাপি > জিলিপি ইত্যাদি ।

ঘ. অন্যোন্য স্বরসঙ্গতি:

পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বর পরস্পরকে প্রভাবিত করে উভয়ে পরিবর্তিত হয়। যেমন— মোজা > মুজো, ধোঁকা > ধুঁকো, পোষ্য > পুষ্যি ইত্যাদি। কিছু কিছু শব্দের স্বরসঙ্গতিতে একাধিক বার স্বরসঙ্গতিজনিত পরিবর্তন ঘটে। যথা— হিসাবি > হিসেবি > হিসিবি, উড়ানি > উড়োনি > উড়ুনি, বিলাতি > বিলেতি > বিলিতি ইত্যাদি।

প্রয়োগ:

“অদৃষ্টেরে শুধালেম [শুধালাম শুধালেম] চিরদিন পিছে অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে। ’ ‘শোনা [শুনা>শোনা] কথা, বোনা [বুনা>বোনা] ধান ৷ ‘ ‘মালীকে বলতে হবে, এটা উপড়ে ফেলে দেবে [দিবে দেবে]।” “এই দ্যাখো [দেখ দ্যাখো] খোকা, রেলের রাস্তা।

‘ চলিত ভাষায় স্বরসঙ্গতি : ৪ সেনের রাস্তা।” । > গেলা, মিলামিশা > মেলামেশা, মিঠা > মিঠে, ইচ্ছা > ইচ্ছে ইত্যাদি। পূর্বস্বর : গিলা > উ-কার হলে পরবর্তী স্বর আ-কার হয় না, ও-কার হয়। যেমন— মুড়া মুড়ো, চুলা > চুলো ইত্যাদি। বিশেষ নিয়মে— উড়ুনি > উড়নি, এখনি > এখুনি হয়।

৫। অপিনিহিতি (Epenthesis):

শব্দের মধ্যে ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত ‘ই’ বা ‘উ’ উচ্চারণের সময় স্বস্থানে উচ্চারিত না হয়ে যে ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত অব্যবহিত পূর্বে উচ্চারিত হলে ওই রীতিকে অপিনিহিতি বলে। যেমন— আজি (aji) > আইজ (aij), সাধু সাউধ, রাখিয়া > রাইখ্যা, বাক্য > বাইক্য, সত্য > সইত্য, চারি > চাইর, মারি > মাইর ইত্যাদি।

সাধু > সাউধ

[স্+আ+ধূ+উ] > [স্+আ+‘উ’+ব্]

এই শব্দে ‘ধ’-এর সঙ্গে যুক্ত ‘উ’ ‘ধৃ’-এর পরে উচ্চারিত না হয়ে ‘ধ’-এর আগে উচ্চারিত হয়েছে। এখানে ‘উ’- এর অপিনিহিতি হয়েছে। ধ্বনি-পরিবর্তনের এই পারিভাষিক নাম দিয়েছেন ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি Epenthesis শব্দের প্রতিরূপ ‘অপিনিহিতি’ বলে নির্দেশ করেছেন। ‘ep’-প্রতিরূপ ‘অপি’, ‘en’-এর প্রতিরূপ ‘নি’, ‘thesis’-এর প্রতিরূপ ‘হিতি’। ‘অপিনিহিতি’ শব্দের অর্থ ‘আগে স্থাপন’। ‘সাধু > সাউধ’ শব্দে ‘উ’-এর অপিনিহিতি হয়েছে, তার অর্থ ‘উ’ ‘ধৃ’-এর আগে স্থাপিত হয়েছে। ধ্বনি-বিপর্যয়ের মতো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে অপিনিহিতি ধ্বনি-বিপর্যয় নয়।

ই-ধ্বনির অপিনিহিতি : আজি > আইজ, রাতি > রাইত, রাখিয়া > রাইখ্যা, জালিয়া > জাইল্যা, চারি > চাইর, চলিয়া > চইলা, গাঁটি > গাইট, মাটিয়া > মাইট্যা, গাঁতি > গাঁইতি, ভাসিয়া > ভাইস্যা ইত্যাদি। য-ফলার অন্তর্নিহিত ই-ধ্বনির অপিনিহিতি : সত্য > সইত্য, কন্যা > কইন্যা, কাব্য > কাইব্য ইত্যাদি। উ-ধ্বনির অপিনিহিতি : মাছুয়া > মাউছ্যা, গাছুয়া > গাউছ্যা, চালু > চাউল, হাটুয়া > হাউট্যা ইত্যাদি । (i) ক্ষ ও জ্ঞ-এর অন্তর্নিহিত ই-ধ্বনির অপিনিহিতি : সাক্ষাৎ > সাইক্খাৎ, লক্ষ > লইক্‌খ, বক্ষ > বইখ ইত্যাদি।

[ ডায়াগ্রাম ]

কয়েক শ’ বছর আগে সমগ্র বঙ্গদেশে অপিনিহিতির ব্যাপক প্রচলন ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষায় অপিনিহিতির এখনো বহুল প্রচলন আছে। পশ্চিমবঙ্গের কথ্য উচ্চারণে অপিনিহিতির · ব্যবহার লোপ পেয়েছে।

প্রয়োগ :

‘না আইলি পারতি কুবির আইজ [আজি আইজ]।” ‘আমাদের পাচী গেছিল, আইসা [আসিয়া আইস্যা বা আইসা] কয় কি।

‘ ‘কোণ দিয়া পড়ছে তাই বাঁচান, না তো জিনিসপত্তর সব ভাইসা [ভাসিয়া > ভাইস্যা বা ভাইসা] যাইত।’

৬। অভিশ্রুতি (Umlaut, Vowel mutation):

অভিশ্রুতি অপিনিহিতির পরবর্তী পর্যায়। কথ্য বা চলিত বাংলায় অপিনিহিতি ও অভিশ্রুতি-জনিত কারণে ধ্বনি পরিবর্তনের অনেক নিদর্শন আছে। অপিনিহিতির ‘ই’ বা ‘উ’ পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সঙ্গে একপ্রকার সন্ধিতে মিলিত হলে এবং তার প্রভাবে পরবর্তী স্বরের সঙ্গতি বা বিকৃতি ঘটলে, তাকে বলা হয় অভিশ্রুতি।

যেমন—

রাখিয়া > রাইখা (অপিনিহিতি) > রেখে (অভিশ্রুতি)

[আ-ই-আ] [এ-এ]

অপিনিহিতির ‘ই’ ও পূর্ববর্তী ‘আ’ এই দুই স্বর মিলিত হয়ে সন্ধির ফলে ‘এ’ হয়েছে। অভিশ্রুতি-জনিত পূর্ববর্তী ‘এ’ স্বরের প্রভাবে পরবর্তী ‘আ’-‘এ’ হয়ে স্বরের সঙ্গতি রক্ষা করেছে। এ রূপ- করিয়া > কইর্যা > করে, শুনিয়া > শুইন্যা > শুনে, বলিয়া > বইল্যা > বলে, হাটুয়া > হাউট্যা > হেটো, মাছুয়া > মাউছ্যা > মেছো ইত্যাদি।

নিয়ম হল :

অপিনিহিতির ‘ই’ বা ‘উ’ পরবর্তী স্বরধ্বনির সঙ্গে মিশে হয় নতুন স্বরধ্বনিতে পরিণত হয়, না হয় তা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়।

একটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করা যাক:

‘মাখিয়া’ শব্দটির অপিনিহিতির পরিবর্তন নিম্নরূপ দেখানো যায় :

মাখিয়া > [মা-খি-য়া] > [মা-খ্-ই-য়া] > [মা-ই-খ্-য়া] > মাইখ্যা

অর্থাৎ, ‘মাখিয়া’ শব্দটি অপিনিহিতির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে ‘মাইখ্যা’ শব্দটিতে। এতে ‘মা’ এর পরের ই-কারটি হল অপিনিহিতির ‘ই’। অভিশ্রুতি শুরু হয় এই ই-কার থেকে। মাইখ্যা শব্দটিতে ই-ছাড়া আর দুটি স্বরধ্বনি আছে— ম্-এর সঙ্গে ‘আ’ এবং খ্-এর সঙ্গে ‘অ্যা’। অভিশ্রুতিতে এই ‘আ+ই+অ্যা’ সন্ধি হয়ে পরিণত হয় ‘এ+এ’-তে। ফলে শব্দটির নতুন রূপ হয় ‘মেখে’। এটিই ‘মাখিয়া’ শব্দের শিষ্ট চলিত রূপ। তাহলে পরিবর্তনটি নিম্নরূপ দেখানো যায় : মাইখ্যা > [ম্−(আ-ই)-খ্–(অ্যা)] > [ম্−(এ)-খ্-অ্যা)]> মেখ্যা > মেখে।

এই হল অভিশ্রুতির মূল কথা। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে-অপিনিহিতির ই-কার বা উ-কার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্বরের সঙ্গে মিশেই নতুন রূপ ধারণ করেছে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, অভিশ্রুতির আগে অপিনিহিতির কাজ ঘটে। কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ করা যাক : আজি > আইজ > আজ; মানিয়া > মাইন্যা > মেনে; হাসিয়া > হাইস্যা > হেসে, আসিয়া > আইস্যা > এসে, ভাবিয়া > ভাইব্যা > ভেবে ইত্যাদি।

অভিশ্রুতির প্রভাবে শিষ্ট লেখ্য চলিত শব্দ ও ক্রিয়াগুলো সংক্ষিপ্ত আকারের হয়ে ভাষাকে তীক্ষ্ণ ও সজীব করেছে।

৭। সমীভবন বা সমীকরণ (Assimilation):

শব্দের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত অসম ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সুবিধার্থে একে অপরের প্রভাবে সঙ্গতি বা সাম্য লাভ করলে, তাকে বলা হয় সমীভবন বা সমীকরণ। যেমন— জন্ম > জন্ম, কাঁদনা > কান্না ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে সমীভবন স্বরসঙ্গতিরই মতো ব্যঞ্জনসঙ্গতি। সেজন্য সমীভবনকে ব্যঞ্জনসঙ্গতিও বলা হয়।

(i) বিল্ব > বিলু। পূর্ববর্তী ‘ল’-এর প্রভাবে পরবর্তী ‘ব’ হয়েছে ‘ল’।

(ii) গল্প > গল্প। পরবর্তী ‘প’-এর প্রভাবে পূর্ববর্তী ‘ল’ ‘প’ হয়েছে।

(iii) কুৎসিত > কুচ্ছিত। এখানে পাশাপাশি অবস্থিত ‘ৎ’, ‘স’ পরস্পরকে প্রভাবিত করে ‘চ্ছ’ হয়েছে। সুতরাং সমীভবন তিন রীতির হয়। যথা- (ক) প্রগত সমীভবন, (খ) পরাগত সমীভবন, (গ) অন্যোন্য সমীভবন।

ক. প্রগত সমীভবন (Progressive Assimilation):

পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী অসম ব্যঞ্জনধ্বনি পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির সমতা প্রাপ্ত হয়। যেমন— পৰ্ব্ব > পক্ক, পূর্ববর্তী ‘ক’-এর প্রভাবে পরবর্তী ‘ব’ উচ্চারণে ‘ক’-তে রূপান্তরিত হয়ে সাম্য লাভ করেছে। একইভাবে, চন্দন > চনুন, গলদা > গল্লা, পদ্ম > পদ্দ, রাজ্য > রাজ্জ, চক্র > চক্কর, লগ্ন > লগ ইত্যাদি।

খ. পরাগত সমীভবন (Regressive Assimilation):

পরবর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী অসম ব্যঞ্জনধ্বনি পরবর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির সমতা লাভ করে।

যেমন- কাঁদনা > কান্না। পরবর্তী ‘ন’-এর প্রভাবে পূর্ববর্তী ‘দ্’ ‘ন্’-তে রূপান্তরিত হয়ে সাম্য লাভ করেছে। একইভাবে, কর্ম > কৰ্ম্ম, কর্তা > কত্তা, যতদূর > যদ্দুর, সর্প > সম্প, করতাল > কত্তাল, ধর্ম > ধৰ্ম্ম, পাঁচসের > পাসের, ডাকঘর > ডাঘর, তৎ + জন্য > তজ্জন্য, বিপদ + জনক > বিপজ্জনক, উৎ + মুখ > উন্মুখ (উচ্চারণ— উম্মুখ) ইত্যাদি।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

গ. অন্যোন্য সমীভবন (Mutual or Reciprocal Assi Assimilation) :

পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অসম ব্যঞ্জনধ্বনি পরস্পরকে প্রভাবিত করে উভয়ে রূপান্তরিত হয়ে সাম্য লাভ করে। যেমন— বৎসর > বচ্ছর। পাশাপাশি অবস্থিত ‘ৎ’ ও ‘স’ পরস্পরকে প্রভাবিত করে যথাক্রমে ‘চ’ ও ‘ছ’ হয়েছে। একইভাবে, মহোৎসব > মোচ্ছব, চিকিৎসা > চিকিচ্ছা, বিশ্রি > বিচ্ছিরি, কুৎসিত > কুচ্ছিত, উৎসন্ন » উচ্ছন্ন; সংস্কৃত সত্য > প্রাকৃত সচ্চ, সংস্কৃত বিদ্যা > প্রাকৃত বিজ্জা ইত্যাদি।

মৌখিক বাংলায় সমীভবনের প্রচলন বেশি। আধুনিক সাহিত্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন—

‘কদ্দুর [কতদূর কদ্দুর] যাবেন ?” ‘এই টাকায় যদ্দুর [যতদূর > যদ্দুর] …’

‘একটা পান সেজে দে তো দুগ্‌গা [দুর্গা দুগ্‌গা] । ‘

 

৮। বিষমীভবন (Dissimilation):

সমীভবনের বিপরীত রীতি বিষমীভবন। শব্দের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত সমান দুই ব্যঞ্জনের মধ্যে যে-কোনো একটি বদলে গেলে, ধ্বনি-পরিবর্তনের এই রীতিকে বলা হয় বিষমীভবন। যথা— শরীর > শরীল, লাল > নাল, লাঙ্গল > নাঙ্গল, লেবু মৌখিকে ব্যবহৃত হয় । তরবার > তরোয়াল ইত্যাদি। বিষমীভবনের ব্যবহার লেখ্য ভাষায় বিরল। প্রধানত মৌখিকে ব্যবহৃত হয়।

৯। ধ্বনি-বিপর্যয় (Metathesis):

উচ্চারণের সময় কিছু কিছু শব্দস্থিত ধ্বনির স্থানপরিবর্তন ঘটে। আগের ধ্বনি পরে যায় ও পরের ধ্বনি আগে আসে— এরকম অবস্থানগত বিপর্যয় দেখা যায়। যেমন— পিশাচ > পিচাশ। ‘শাচ’ ধ্বনি দুটি (শা + চ) স্থান বদলে হয়েছে ‘চাশ’ (চা + শ) ।

উচ্চারণের সময় শব্দস্থিত ধ্বনি স্থান পরিবর্তন করলে, তাকে ধ্বনিবিপর্যয় বা বর্ণবিপর্যয় বলে। যেমন : বাক্স > বাস্ক, তলোয়ার > তরোয়াল, মগজ > মজগ, রিকশা > রিশকা, লাফ > ফাল, ডেস্ক > ডেক্স ইত্যাদি।

মৌখিক ভাষাতেই সাধারণত উচ্চারণদোষে ধ্বনি-বিপর্যয় ঘটে। এ রীতি অতি প্রাচীন। সংস্কৃতে এরকম দৃষ্টান্ত মৌখিক ভ আছে। যেমন— করেণু > কণেরু। বিদেশি শব্দের বাংলা উচ্চারণে ধ্বনি-বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত নিতান্ত অল্প নয়। যেমন : Box = বাক্স > বাস্ক, Desk = ডেস্ক > ডেক্স, Signal = সিগন্যাল সিগ্যাল > সিঙ্গেল ইত্যাদি।

১০। নাসিক্যীভবন (Nasalization):

নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ঙ (ং), ঞ, ণ, ন, ম লোপ পাওয়ার ফলে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি সানুনাসিক হলে, পরিবর্তনজনিত এই প্রক্রিয়ার নাম নাসিক্যীভবন।

নাসিক্যীভবনে সানুনাসিক স্বরধ্বনি নাসাপথে অনুরণিত হয়ে বহির্গত হয়। ভণ্ড > ভাঁড়, গুম্ফ, গোঁফ, কঙ্কণ কাঁকন, হংস > হাঁস ইত্যাদি নাসিক্যীভবনের উদাহরণ।

নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির লুপ্তির ফলে পূর্ববর্তী স্বরের নাসিক্যীভবনের আরো কিছু উদাহরণ :

১. ‘ঙ’ লোপের ফলে নাসিক্যীভবন : অঙ্ক > আঁক, কঙ্কণ > কাঁকন, কঙ্কর > কাঁকর, বঙ্ক > বাঁক, পঙ্ক > পাঁক, শঙ্খ > শাঁখ,ইত্যাদি। ব্যতিক্রম : শৃঙ্খল > শিকল ।

২. অনুস্বারযুক্ত নাসিক্য ব্যঞ্জনের নাসিক্যীভবনের প্রবণতা : হংস > হাঁস, বংশ > বাঁশ, দংশ > ডাঁশ, অংশু > আঁশ ইত্যাদি।

৩. ‘ঞ’ লোপের ফলে নাসিক্যীভবন : পঞ্জর > পাঁজর, পঞ্জিকা > পাঁজি, অঞ্চল, আঁচল, পঞ্চ > পাঁচ ইত্যাদি।

৪. ‘ণ’ লোপের ফলে নাসিক্যীভবন : কণ্টক > কাঁটা, ভণ্ড > ভাঁড়, ষণ্ড > ষাঁড়, দণ্ড > দাঁড়, চণ্ডাল > চাঁড়াল।

৫. ‘ন’ লোপের ফলে নাসিক্যীভবন : চন্দ্র > চাঁদ, সন্ধ্যা > সাঁঝ, বন্ধ > বাঁধ, ফন্দি > 1 > ফাঁদ, দন্ত > দাঁত, ক্রন্দন > কাঁদন, বন্ধন > বাঁধন, স্কন্ধ > কাঁধ ইত্যাদি।

৬. ‘ম’ লোপের ফলে নাসিক্যীভবন : গুম্ফ > গোঁফ, চম্পক > চাঁপা, কম্প > কাঁপা, তাম্মু > তাঁবু ইত্যাদি ।

৭. বাস্তব ধ্বনির অনুকরণে সৃষ্ট কিছু কিছু ধ্বন্যাত্মক শব্দের উচ্চারণে নাসিক্যীভবন : ঝাঁ ঝাঁ, চোঁ চোঁ, ভোঁ ভোঁ, শোঁ শোঁ, খাঁ খাঁ, বোঁ বোঁ ইত্যাদি।

৮. নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বরধ্বনি সানুনাসিক হয়। এই প্রবণতাকে বলা হয় স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বতোনাসিক্যীভবন। যেমন- হাসি হাঁসি, আখ, আঁখ, পুথি, পুঁথি, সূচ > সূঁচ, আচ > আঁচ, পেচা > পেঁচা/প্যাচা ইত্যাদি ।

৯. সম্মানসূচক সর্বনাম পদে স্বতোনাসিক্যীভবনের প্রয়োগ দেখা যায়। যথা— যাঁহারা > যাঁরা, যাঁহার তাহার > তাঁর ইত্যাদি।

১০. বিদেশি শব্দের বাংলা উচ্চারণে স্বতোনাসিক্যীভবন : হুক-ক > হুঁকা, পিয়াজ > পিঁয়াজ, পাপায়া > পেপে > পেঁপে, হস্পিটাল > হাসপাতাল > হাসপাতাল ইত্যাদি। যেমন- বাসা, বাসা,

১১. রাঢ়ি ও ঝাড়খণ্ডি উপভাষায় কিছু কিছু শব্দে স্বতোনাসিক্যীভবনের ঝোঁক দেখা যায়। যেমন— বাসা > সাজ > সাঁজ, খোকা > খোঁকা, কুকুর > কুকুর ইত্যাদি।

১২. স্বতোনাসিক্যীভবনের ফলে কিছু কিছু শব্দের অর্থ-পার্থক্যও ঘটে। যেমন—

দাড়ি-শ্মশু দাঁড়ি-পূর্ণচ্ছেদ কাঁটা— কণ্টক পাজি— বদমাস সাজ- পোশাক-পরিচ্ছদ পাঁজি- পঞ্জিকা কাটা– ছেদন বা কর্তন করা সাঁজ / সাঁঝ- সন্ধ্যা খাই–খাওয়া(উত্তম পুরুষ) খাঁই-লোভ | পাশ–দড়ি বা রজ্জু কোন পাঁশ- ভস্ম বা ছাই টাক— কেশহীন মস্তক ভাজ— ভাইয়ের স্ত্রী টাক— লক্ষ্য, তাক ভাঁজ— পাট, মোড়া

 

১১। সম্প্রকর্ষ বা ধ্বনিলোপ বা স্বরলোপ:

শব্দের অন্তর্গত একটি ধ্বনি বা একাধিক ধ্বনি বাদ দিয়ে আমরা কোনো কোনো শব্দকে একটু ছোট করে আনি, এতে উচ্চারণের সুবিধাও হয়। অর্থাৎ দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের হয় সম্প্রকর্ষ বা ধ্বনিলোপ বা স্বরলোপ। যেমন : উদম্বর অন্ত বা মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপকে বলা : > মুর, বসতি > বসৃতি, জানালা, জানলা ইত্যাদি। (স্বরলোপ বস্তুত স্বরাগমের বিপরীত প্রক্রিয়া)।

যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ রীতি | ধ্বনির পরিবর্তন | ধ্বনি-পরিবর্তনের সম্ভাব্য বহু ধারা | ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

 

আবার, একই ধ্বনি বা অক্ষর পাশাপাশি থাকলে যদি একটির লোপ হয় তাকে বলা হয় সমাক্ষর লোপ ངས གམ (haplology) : যেমন : বড়দাদা > বড়দা, ছোটকাকা > ছোটকা ইত্যাদি ।

আদিস্বর লোপ (Aphesis) :

ধ্বনিলোপের ক্ষেত্রে শব্দের প্রথমের স্বরধ্বনির লোপ হলে তাকে অ বলে। যেমন : অলাবু > লাবু > লাউ, এড়ণ্ড > রেড়ি, উদ্ধার > উধার > ধার। মধ্যস্বর লোপ : অগুরু > অগ্রু, সুবর্ণ > স্বর্ণ।

অন্ত্যস্বর লোপ :

ধ্বনিলোপের ক্ষেত্রে শব্দের শেষের স্বরধ্বনি উচ্চারণ থেকে বাদ গেলে তাকে অন্ত্যস্বর লোপ বলে ।

যেমন : আশা > আশ, আজি > আজ, চারি > চার (বাংলা), সন্ধ্যা > সঞঝা > সাঁঝ, বন্যা > বান, লজ্জা > লাজ, চাকা » চাক ইত্যাদি

র-কার লোপ :

আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র-কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন : তর্ক > তক্ক, করতে > কত্তে, মারল > মাল্ল, করলাম, কল্লাম ইত্যাদি।

হ-কার লোপ :

আধুনিক চলিত ভাষায় অনেক সময় দু স্বরের মাঝামাঝি হকারের লোপ হয়। যেমন— পুরোহিত > পুরুত, গাহিল > গাইল, চাহে > চায়, সাধু ? সাহু > সাউ; আরবি আল্লাহ্ বাংলা আল্লা, ফারসি শাহ্ > বাংলা শা ইত্যাদি।

অন্তর্হতি :

পদের মধ্যে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে বা অন্তর্হিত হলে তাকে অন্তর্হতি বলে। যেমন : ফাল্গুন > • ফাগুন, ফলাহার > ফলার, আলাহিদা > আলাদা ইত্যাদি।

১২। বর্ণদ্বিত্ব বা দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বতা :

অর্থের গুরুত্ব অনুযায়ী কিছু শব্দের কোনো ধ্বনির উচ্চারণে দ্বিত্ব হয়, আর সে কারণে তাদের বানানে দ্বিত্ববর্ণ আসে। একে বলে বর্ণদ্বিত্ব বা দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বতা। যেমন : সকাল > সক্কাল, মুলুক > মুল্লুক, বড় > বড্ড ছোট > ড, ছোট > ছোট্ট, কিছু > কিচ্ছু, পাকা > পাক্কা গ) পাকা ইত্যাদি।

১৩। ধ্বনিবিকার বা ব্যঞ্জনবিকৃতি :

পদের অন্তর্গত কোনো বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ ধারণ করলে তাকে ধ্বনিবিকার বা বর্ণবিকৃতি বা ব্যঞ্জনবিকৃতি বলে। যেমন: শাক > শাগ, কবাট > কপাট, লেবু > নেবু, ধোবা ধোপা, ধাইমা > দাইমা ইত্যাদি।

১৪। ব্যঞ্জনচ্যুতি :

পাশাপাশি সমউচ্চারণের দুটো ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তার একটি লোপ পায়। এ রূপ লোপকে বলা হয় ধ্বনিচ্যুতি বা ব্যঞ্জনচ্যুতি।

যেমন— বউদিদি> বউদি, বড় দাদা > বড়দা ইত্যাদি ।

১৫। ঘোষীভবন, অঘোষীভবন, মহাপ্রাণীভবন, অল্পপ্রাণীভবন (Voicing, De-voicing, Aspiration, De-aspiration):

আমরা অনেক সময় অঘোষধ্বনিকে ঘোষধ্বনি করে নিই, আবার ঘোষধ্বনিকে অঘোষ করি, তেমনি অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে করি মহাপ্রাণ বা মহাপ্রাণ ধ্বনিকে করি অল্পপ্রাণ। উদাহরণ যথাক্রমে- কাক > কাগ, গুলাব > গোলাপ, পাশ > ফাঁস, ভগিনী > বোন। এই পরিবর্তনকে আমরা যথাক্রমে ঘোষীভবন, অঘোষীভবন, মহাপ্রাণীভবন, অল্পপ্রাণীভবন বলি।

 

ধ্বনি-পরিবর্তনের সম্ভাব্য বহু ধারা:

ধ্বনি-পরিবর্তনের এই সব ধারা দিগ্‌দর্শন মাত্র। আরও অনেক রকম প্রক্রিয়াই ধ্বনি-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশেষ করে উপভাষা বা লোকভাষায়, যেমন, তেল > ত্যাল, দংশানো > ডংশানো ইত্যাদি। তা ছাড়া শুধু য়-শ্রুতি কিংবা ব-শ্রুতি নয়, স্বর ও ব্যঞ্জনের আরও নানা ধরনের শ্রুতি লক্ষ করা যায়।

 

সূত্র:

  • যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ রীতি | ধ্বনির পরিবর্তন | ধ্বনি-পরিবর্তনের সম্ভাব্য বহু ধারা | ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব | ধ্বনিতত্ত্ব । ভাষা ও শিক্ষা

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment