দরিদ্র চরিত্রবান যুবকের স্বনির্ভরতার প্রয়াস সাফল্য লাভ | গল্প লিখন | ভাষা ও শিক্ষা ,আর্থিক দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে যেভাবে কঠোর সংগ্রাম করতে হচ্ছে ছেলেটাকে, তাতে দুঃখী নাম রাখলেই যথার্থ হতো, তা না হয়ে বাপ-মা নাম রেখেছেন সুখেন। ভাগ্য ভালো, ছেলের এরকম সুখের কপাল দেখার বিড়ম্বনা থেকে পরিত্রান পেয়ে স্বর্গে গেছেন তাঁরা। পাঁচ বছর বয়সে সুখেন মা-বাপ হারানোর পর থেকে মানুষ হয়েছে এ-বাড়ি ও- বাড়ি টিউশনি করে। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারেনি সে। লেখাপড়ার জন্যে অন্তত থাকাখাওয়ার নিশ্চিন্ত আবাস থাকা চাই ।
দরিদ্র চরিত্রবান যুবকের স্বনির্ভরতার প্রয়াস সাফল্য লাভ | গল্প লিখন | ভাষা ও শিক্ষা
একদিন বইখাতা গুছিয়ে রেখে সুখেন কাজের উদ্দেশ্যে শহরে পাড়ি জমায়। তারপর জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কত কিছুই করেছে সে, কখনও চায়ের দোকানে বয়গিরি, কখনও অন্ধ ভিখারির সহাকারী, কখনও কুলিগিরি এবং আরও কত কি। কোথাও ভাগ্য থাকে থিতু হতে দেয়নি। কেউ তাকে পরিত্যাগ করেনি, সুখেনই সবাইকে ছেড়ে এসেছে। ভেতরের একটা আকাঙ্ক্ষা অবিরত তার পিঠে চাবুক হাঁকড়েছে তাড়া করে।
সুখেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যে লড়াই করতে থাকে। এখানে-ওখানে কাজ-কর্ম করে সামান্য যা পুঁজি হাতে এসেছিল, তাই দিয়ে একটা রিক্সা কিনে নেয় সুখেন। কিছু টাকা বাকি থাকে বলে রিক্সার কাগজপত্র জমা থাকে মালিকের কাছে। রাতদিন সুখেন নিজেই রিক্সা চালায়। এক মাস যেতে না যেতেই বাকি টাকাটা পরিশোধ করে সুখেন। হাড়-ভাঙা পরিশ্রমে সুখেনের দেহটা শুকিয়ে অর্ধেক হয়েছে বটে কিন্তু বছর খানেকের ভিতর টাকা জমিয়েছে লাখের কাছাকাছি। যা দিয়ে সে একটা পুরাতন সিএনজি ট্যাক্সি কেনে। পরিচিত জনের কাছে ড্রাইভিং শিখে নিয়ে পরবর্তীতে লাইসেন্সধারী ড্রাইভার হয়ে ওঠে সুখেন।
সিএনজি নিয়ে শহরময় ঘুরেফিরে সুখেনের কতরকম অভিজ্ঞতা যে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। দিনান্তে হাতে টাকা আসে, রুচিতে যা আসে তাই দিয়েই পেট পুরে খেয়ে নেয়। তবুও মনের গভীরে কোথায় যেন ছোট্ট একটা ব্যাথা অনুভব করে। ব্যথাটা যে শরীরের বা দেহের নয়, কষ্টটা যে মনের সুখেন তা বুঝেও তার হদিস করতে পারে না। মনের কোণে হাজারো কথা এসে ভিড় জমায়। নিজেই নিজের মনে প্রশ্ন করে সুখেন— কষ্টটা কী বই-খাতার জন্যে, লেখাপড়া করতে না পারার জন্যে? বাবা-মার জন্যে, আমার কেউ নেই, সে জন্যে?
বাসস্ট্যান্ডে খালি সিএনজিতে চোখ বন্ধ করে এসব কথা ভাবছিল সুখেন বাইরে কখন যেন বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল তা সে টেরই পায়নি। এক যাত্রী হুড়মুড় করে তার সিএনজিতে উঠে বসল। চমকে ওঠে সে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ভদ্রলোক বৃষ্টিতে ভিজে গেছে; কী আর করা, যাত্রীকে নিশ্চিন্তে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়াই তার কাজ। ভাড়া নিয়ে দর কষাকষিরও প্রয়োজন বোধ করাল না সুখেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই চালাতে শুরু করল। ড্রাইভিং অবস্থায় মনে মনে সিদ্ধান্ত করে সুখেন— এই টিপের পর আর সে গাড়ি চালাবে না, বাসায় ফিরে যাবে। ইতোমধ্যে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে সুখেন ঊর্ধ্বশ্বাসে বাসায় ফেরে।
সিএনজিটা বন্ধ করে পার্কিং করার সময় সিটের পেছনে কালোপানা কি যেন একটা চোখে পড়ে। একখানা অ্যাটাচি বলেই মনে হয়। কাছে গিয়ে দেখে তার অনুমানই ঠিক। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে ভদ্রলোকটিই নিশ্চি এটি ফেলে গেছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে সুখেন, ইতস্তত অ্যাটাচিটি হাতে নিয়েই নিজের ঝুপড়িতে গিয়ে ঢোকে।- আলো জ্বেলে দেখে এ্যাটাচিতে মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। পরদিন আর গাড়ি চালাতে যায় না সুখেন। অ্যাটাচি হাতে মালিকের ঠিকানা খোঁজ করে তার হাজির হতে দুপুড় গড়িয়ে যায়। এ্যাটাচি ফিরে পেয়ে ভদ্রলোক তো স্তম্ভিত।

বহুমূলবান কাগজপত্র, টাকাকড়িও একেবারে লোভ সামলানোর মতো নয়, চারটি পাঁচশত টাকার বান্ডিল যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে আছে। অ্যাটাচি খুলে টাকাগুলোর দিকে পাথরচোখে চেয়ে আছে ভদ্রলোক। তারপর হঠাৎ আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল, এ যুগেও কি এমন নির্লোভ চরিত্রবান মানুষ আছে। ভদ্রলোক খুশি হয়ে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা বকশিশ দিতে চায়।
সুখেন বলল, মাপ করবেন মশাই। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছি, মাঝ-বয়সে এসে লেখাপড়া করতে পারিনি। বই-খাতা হারিয়েছি, কিন্তু মনুষ্যত্ব বোধকে যে হারাইনি, কর্তব্যবোধকে যে উপেক্ষা করতে পারিনি আজ তা জেনে গেলাম। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমার হাতদুটো তার দু হাতে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন- তুমি অনেক শিখেছ সুখেন, আমি এম.এ পাশ করেছি, তুমি আমার চেয়েও অনেক বেশি অর্জন করেছ, লেখাপড়া করে মানুষ যা শেখে, সততা আর শ্রম দিয়ে তুমি তার চেয়েও বেশি শিখেছ, সুখেন।
এতক্ষণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলো ম্যাডাম। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। আমাকে বসতে বললেন। মুখে স্মিত হাসি নিয়ে আবারও বললেন— বেশ সুন্দর নাম তো তোমার, সুখেন। নামটা মা রেখেছেন বুঝি। আমি নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকি ।
বাবা, তুমি নিশ্চয়ই এখনো দুপুরের ভাত খাওনি। হাতমুখ ধুয়ে আস, আমরাও খাইনি, ভালোই হলো, একসঙ্গে খাওয়া যাবে। খেতে খেতে তোমার গল্প শুনব। চোখের জল আড়াল করতেই দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে দুহাত ভরে চোখেমুখে জলের ঝাপটা মারতে থাকি। এত জলের মাঝেও চোখ বেয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। দু-কানে কেবলই তাঁর ‘বাবা’ ডাকটি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন মমতাভরা কণ্ঠে এর আগে আর কেউ এমন মাতৃস্নেহে ডেকে বলেনি- ‘বাবা, তুমি নিশ্চয়ই দুপুরে খাওনি। ‘
জীবনে কতই তো না খেয়ে থেকেছি। কিন্তু কখনোই সকাল-সন্ধ্যা, দুপুরের খাওয়া বলতে কিছু মনে হয়নি। আজই প্রথম মনে হল, আমি আজ দুপুরে কিছুই খাইনি। শুধু আজই নয়, মনে হচ্ছে— জীবনের কোনো দুপুরেই আমি কিছু খাইনি। এতকাল ধরে বুকের ভিতরে যে দুঃখের পাহাড় গড়ে ওঠেছিল, একটু উষ্ণতা পেতেই মেরু অঞ্চলের বরফের মতো সে পাহাড় গলতে শুরু করেছে। আর সেই বরফগলা পানি অবিরল ধারায় গড়িয়ে পড়ছে আমার দুচোখ বেয়ে… খেতে বসে ম্যাডাম আমার জীবনের গল্প শুনতে চেয়েছিলেন। আমি বললাম, আমার জীবনের তো কোনো গল্প নেই।
আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো, এটাই আমার জীবনের একমাত্র গল্প … । গল্পে কি আর সব কথা গল্পকার খুলে বলেন? কিছু কথা থাকে গোপন, পাঠক মনে মনে সে গোপন কথার জাল বোনেন ; কিছু কথা ঘটনার আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকে, যেমন প্রদীপ্ত সূর্য মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। ভাষা দিয়ে জীবনের কতটুকু আর প্রকাশ করা যায়। সবার জীবনেই অনেক না-বলা গল্পকথা বুকের গভীরে, খুব গভীরে ঢাকা পড়ে থাকে, চিরকাল। বরফগলা পানির তলদেশে যেমন গ্লেসিয়ার থাকে, বুকের গহীনে যেমন লুক্কায়িত থাকে অন্তহীন কান্নার জল ।
আরও দেখুনঃ