ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা | ভাব-সম্প্রসারণ | ভাষা ও শিক্ষা , ভাববীজটি সাধারণত রূপকধর্মী, সংকেতময় বা তৎপর্যপূর্ণ শব্দগুচ্ছের আবরণে প্রচ্ছন্ন থাকে। নানা দিক থেকে সেই ভাবটির ওপর আলােকসম্পাত করে তার স্বরূপ তুলে ধরা হয় ভাবসম্প্রসারণে। ভাববীজটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি, এ ধরনের কবিতার চরণে বা গদ্যাংশে সাধারণত মানবজীবনের কোনাে মহৎ আদর্শ, মানবচরিত্রের কোনাে বিশেষ বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা, প্রণােদনমূলক কোনাে শক্তি, কল্যাণকর কোনাে উক্তির তাৎপর্যময় ব্যঞ্জনাকে ধারণ করে আছে। ভাবসম্প্রসারণ করার সময় সেই গভীর ভাবটুকু উদ্ধার করে সংহত বক্তব্যটিকে পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, / হে রুদ্র, নিষ্ঠুর হতে পারি তথা / তোমার আদেশে
ক্ষমা মানুষের ধর্ম। সে জন্যে অপরাধীকে মানুষ ক্ষমা করে। সেই ক্ষমার মাধ্যমে বিশ্ব বিধাতারই ক্ষমাসুন্দর রূপমূর্তি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু যেখানে বিধাতার আশীর্বাদ সেই ক্ষমা দুর্বলের স্বভাবসিদ্ধ দুর্বলতা রূপে উপহসিত হয়, সেখানে নিষ্ঠুরতাও বিধাতার কাম্য। মানুষের সংস্কারহীন অন্তরেই ন্যায়বোধের উজ্জ্বল প্রকাশ। তার বিবেকের শুভ্র পাষাণ-বেদিতে ন্যায়ের আসন পাতা।
জাগতিক সকল কর্মেই তার অন্তরের সেই বিবেক-লোক থেকে আসে ন্যায়ের অমোঘ নির্দেশ। মানুষের সেই নির্দেশ, তা যতই কঠোর হোক, নীরবে পালন করতে হয়। কিন্তু বাইরের সমাজ ও সংসারের নানা টানাপড়েনে বিবেকের নির্দেশ-পালনে আসে দুর্বলতা। সেই দুর্বলতাও মানুষের স্বভাবসিদ্ধ। তাইই ক্ষমা। সেই ক্ষমাও ন্যায়-দেবতার এক কোমল-স্নিগ্ধ প্রকাশ, বিশ্ব-বিধাতার এক সুন্দর- মধুর রূপ, বিবেকের শুভ্র সমুজ্জ্বল আর-এক অভিব্যক্তি। কিন্তু যারা দুষ্কৃতকারী, তারা সেই ক্ষমার মর্মোদ্ঘাটনে অক্ষম। তারা মানুষের হৃদয়োৎসারিত ক্ষমাকে মনে করে অক্ষমের অক্ষমতা, দুর্বলের ভীরু দুর্বলতা। তারা মহান ক্ষমাশীলের স্বর্গীয় ক্ষমাপরায়ণতাকে করে উপহাস।
সেই উপহাস যে কেবল ক্ষমাশীলের ক্ষমাপরায়ণতাকেই উপহাস, তা নয়, তা মানুষের শুভ্র বিবেকের ক্ষমাশীলতাকেই উপহাস, বিশ্ব- বিধাতার ক্ষমা-সুন্দর রূপমূর্তিকেই উপহাস। তখন স্নিগ্ধ-সুন্দর ক্ষমাকে পরিহার করে মানুষকে হতে হবে ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর। তখন ক্ষমার উপহাসকারীকে চরম আঘাত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এবং সেই নির্মম আঘাতও বিশ্ববিধাতা সমর্থিত। যে ক্ষমার মধ্যে বিশ্ব-বিধাতার প্রেম-প্রীতিঘন সুন্দর রূপের প্রকাশ, তার মর্যাদার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্য নিষ্ঠুরতাও কাম্য। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়, ক্ষমা মহতের ধর্ম, শক্তিমানের ঐশ্বর্য।

কিন্তু ক্ষমা যদি দুর্বলতার অসহায় প্রকাশ রূপে উপেক্ষিত হয়, তবে ক্ষমার মৌল উদ্দেশ্যই হয়ে যায় ব্যর্থ। তখন দুষ্কৃতকারী ক্ষমাকে উপহাস করে আরও ঘৃণ্য দুষ্কৃতকর্মে আত্মনিয়োগ করে। তখন বিশ্ব-বিধাতার বিরুদ্ধেও স্পর্ধা প্রকাশ করে সে হয়ে ওঠে বিশ্ব- মানবের প্রধান শত্রু। তখন মানুষকেই স্বহস্তে গ্রহণ করতে হবে বিধাতার অমোঘ ন্যায়ের দণ্ড। দুষ্কৃতকারীর উপযুক্ত দণ্ড বিধান করে প্রতিষ্ঠা করতে হয় ন্যায়ের অম্লান মহিমা। সেই অন্যায়ের দণ্ডবিধানের মাধ্যমে সফল হয় বিশ্ব- বিধাতার ন্যায়ধর্মের কঠোর নির্দেশ।
আরও দেখুন: