বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র – রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। এই রচনাটি আমাদের “গণমাধ্যম” রচনা সিরিজের অংশ। রচনাটি নিয়ে আপনি চর্চা করুন। এরপর নিজের মতো করে নিজের ভাষায় লিখতে চেষ্টা করুন।
Table of Contents
বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র
ভূমিকা :
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়; জীবনঘনিষ্ঠ সুস্থ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব। সুস্থ বিনোদন ছাড়া সুস্থ জীবন কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার মাত্রা দিনের পর দিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়ে চলেছে। অশ্লীলতার এ হাতছানি আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ফেলছে বিরূপ প্রভাব।
অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ চলচ্চিত্রকে উদ্ধার করতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে চলচ্চিত্রের অতীত গৌরব। নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সুন্দর ও রুচিশীল সংস্কৃতি লালন এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র:
বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র বলতে আমরা মূলত সেই চলচ্চিত্রকে বুঝি, যার অর্থায়ন, বিষয়বস্তু, নাট্যের ধরন, অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন, শুটিংয়ের পদ্ধতি এবং ছবিটির প্রদর্শন, প্রাতিষ্ঠানিক ষ্টুডিও প্রধার বাইরে করা হয়। কখনো পুরোটাই, কখনোবা আংশিক। সে ছবির দৈর্ঘ্য স্বয়ও হতে পারে, আবার দীর্ঘও হতে পারে। আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র ভিন্ন ধারার। যেমন- গোটা ছবির কাহিনীটা হচ্ছে, একটা গরুর গাড়িতে একটা লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া ‘চাকা’। কিংবা সাতচল্লিশের দেশ ভাগ পরবর্তী একটা সংখ্যালঘু পরিবারের বেদনা ‘চিত্রা নদীর পারে’। যে ধরনের কোনো বিষয়বস্তুর কথা মূলধারার চলচ্চিত্রে কল্পণাই করা যায় না। ছবি নির্মাণের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এ বিভাজনের সুস্পষ্ট নির্দেশক।
মূলধারার চলচ্চিত্র মূলত ব্যবসার জগৎ, সৃজনশীল শিল্পের জগৎ নয় । মুনাফা, বাজার চাহিদা এসবই এখানে মুখ্য বিষয়। একসময় দেশে মেইনস্ট্রীম ধারায় তৈরি ছবি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। পরবর্তীতে আর্থিক অনিশ্চয়তায় অনেক মেধাবী পরিচালক ছবি নির্মাণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে সিনেমা পরিচালনায় মেধার সংকট দেখা দেয় এবং মূলধারায় শিল্পবিবর্জিত ছবি বিনির্মাণ শুরু হয়। এ কারণে সৃজনশীল ডকুমেন্টরী ছবি স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মান পড়ে যেতে থাকে। ভালো ছবি তৈরি হলেও তার জন্য নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। আশির দশকে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। পাশাপাশি কয়েকজন নির্মাতা এ সময় সময়ের তাগিদেই ভালো কিছু করার চেষ্টা করেন। সকারের বিমুখতা, এফডিসির বাণিজ্যিক ছবির বাইরে নিজেদের উদ্যোগে কিছু ভালো কাজ এবং বক্তব্যনির্ভর সিনেমা তৈরির কাজ শুরু হয়। লেলিন বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্র যতদিন অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের হাতে থাকবে ততদিন এটি লাভের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি এবং স্ববিরোধী বিষয় নিয়ে এসব ছবি অনেক সময়ই জনতার রুচিকে বিকৃত করে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তাতে লেনিনের কথাটি প্রতিমুহূর্তেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
কারণ বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্র শিল্পীর হাত থেকে শিল্পপতির হাতে চলে গেছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশের এফডিসি হয়ে উঠেছে নিছক একদল স্বপ্ন ব্যবসায়ীর আখড়া এবং উদগীরণ করছে বাণিজ্যিক ছবি। বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব ছবি যাদের চিহ্নিত করা হয় অ্যাকশন, সামাজিক অ্যাকশন এবং সুপার অ্যাকশন ছবি হিসেবে। এ কারণে আমাদের মতো দরিদ্রা দেশে প্রতিবছর গড়ে ৭০টি ছবি মুক্তি পাওয়ার পর একটিও ভদ্র সমাজের উপযোগী নয়। এসব উপাত্তগুলোকে বিবেচনায় রেখে দর্শকদের স্বার্থে রুচিশীল, তথ্যসমৃদ্ধ, মানবিক আবেদনসম্পন্ন ছবি নির্মাণের প্রয়াসেই বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণ। মোট কথা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বিপরীতে প্যারালাল সিনেমা তৈরির একটি প্রয়াস এ বিকল্পধারার চলচ্চিত্র।
বাংলাদেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ :
বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বা বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের কথা বললে এখানকার চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কথাও উঠে আসে। লন্ডনে ১৯২৫ সালে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র সংসদ ‘The Film Society’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৫ অক্টোবর উপমহাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশীচন্দ্র গুপ্ত এবং হিরণকুমার সান্যাল এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশভাগের পরবর্তী সময়ে ১৯৩৬ সালে পাকিস্তানে “পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’ গঠিত হয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন মোহাম্মদ খসরু, ওয়াহিদুল হক, আনোয়ারুল হক খানসহ আরও অনেকে। এ চলচ্চিত্র সংসদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুস্থ ছবি প্রদর্শন, চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিকতা রক্ষা, শিল্পমণ্ডিত ছবির দর্শন সৃষ্টি ইত্যাদি। বাংলাদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের অগ্রদূত ছিলেন জহির রায়হান । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ পরবর্তী সকল ছবির প্রেরণার উৎস ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আকাশে যখন অশনিসঙ্কেত এ শিল্পকে ধ্বংসের মুখে পতিত করেছে তখন এ অবস্থা নিরসনে চলচ্চিত্রের নির্মাতা, পরিচালক, কলা-কুশলী ও অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নেমেছে। বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণে তারা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু বিকল্প ধারার ছবি ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি আমাদের দেশের দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
শর্ট ফিল্ম নির্মাতারা আমাদের সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে শর্ট ফিল্ম বা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছায়াছবি নির্মাণ করেছেন, যা সর্ব মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং সিনেমার দর্শকগণ তা সানন্দে গ্রহণ করেছে। এছাড়া প্রখ্যাত লেখক, ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, অথবা মৌসুমী পরিচালিত ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ অথবা তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদের ‘মাটির ময়না’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’ ইত্যাদি ছবি ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ।
অপরদিকে মৃণাল সেন, ঋত্মিক ঘটক, সত্যজিত রায় প্রমুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারদের ছবি এবং আমাদের জহির রায়হান, আলমগীর কবির, কবীর আনোয়ার এবং সুভাষদত্ত ও আমজাদ হোসেন নির্মিত ছবি এখনো আমাদের চলচ্চিত্রে আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে আছে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার নিয়ামত উল্লাহর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ বা ঋতিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত।
আমাদের দেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয় মুক্তিযুদ্ধ, শিশুশ্রম, নারীর অধিকার বা মানকারি সমস্যা অর্থাৎ সেসব বিষয় যা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। নির্মাণশৈলী এবং চলচ্চিত্রের ভাষার সাবলীল প্রয়োগের দিকটি বিবেচনা করলে জহির রায়হান হচ্ছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের স্থপতি ও অগ্রদূত।
১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার ‘স্টপ জেনোসাইড’ হচ্ছে এ দেশের প্রথম সার্থক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘আগামী’ হচ্ছে বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে ছবিটি সেন্সর সার্টিফিকেট লাভ করে ব্যাপক সাড়া পায়। বর্তমানেও বিকল্পধারার ছবি আমাদের সিনেমা দর্শকের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অশ্লীল ছবি দূরীকরণে ও দর্শকদের রুচিপূর্ণ ছবিতে আকর্ষণে বিকল্পধারার ছবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
১৯৮২ সালে তারেক মাসুদের নির্মিত ছবি ‘বেবেল এনজেলের’ মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র সংসদ বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণে মনোনিবেশ করে। এ সময় বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনীনির্ভর ছবি তৈরি করেন তারেক মাসুদ ‘আদমসুরত’ নামে। ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। ১৯৮২ সালে ১৬ মিমি সেলুলয়েডে তানভীর মোকাম্মেল তৈরি করেন ‘ভুলিয়া’ ছবিটি। ছবিটি কবি নির্মলেন্দু গুণ এর ‘ইলিয়’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত।
১৯৮৬ সালে মোস্তফা কামাল পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি ছবি ‘প্রত্যাবর্তন’। এছাড়া এনায়েত করিমের ‘চাকি’, খায়রুল বাশারের ‘অরণ্য’, ইসমাইল হোসেন এর ‘কাঁদে নদী কাঁদে মানুষ’, আবু সাঈদের ‘আবর্তন’, ইসমাইল হোসেনের ‘শবমেহের’, মোরশেদুল ইসলামের ‘সূচনা’ ও ‘চাকা’ প্রভৃতি ছবিগুলো খুবই নান্দনিকভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে সর্বশেষ সংযোজন ২০০২ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত ‘মাটির ময়না’ ছবিটি। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্মিত এ ছবি বাংলাদেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছে। ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি ‘ডিরেক্টস ফোর্থ নাইট’ সমালোচক পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া ২০০৩ সালে নির্মিত আনভীর মোকাম্মেলের ‘লালসালু‘। ২০০৪ সালে তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ও উল্লেখযোগ্য দুটি চলচ্চিত্র।
বিকল্প চলচ্চিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অথবা দ্বিতীয় চলচ্চিত্র যে নামেই আমরা এ চলচ্চিত্রকে অভিহিত করি না কেন বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের বিকাশে প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তের তেমন কিছুই উপস্থিতি নেই। কিন্তু যে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, বয়ে এনেছে আন্তর্জাতিক সম্মান, সে চলচ্চিত্রই আজ বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। বিশেষ করে পক্ষপাতদুষ্ট যেসব পদ্ধতির কারণে মাটির ময়না, হুলিয়া, প্রত্যাবর্তন, ঢাকা ছবিগুলো যথাসময়ে মুক্তি পায়নি সেটা খুবই দুঃখজনক।
নির্মাণ ব্যয় ও প্রদর্শন :
চলচ্চিত্র খুবই ব্যয়বহুল মাধ্যম। বিকল্প ধারার ছবিকে তাই হতেই হয় স্ব বাজেটের। যেমন….. ‘নদী, নাম মধুমতী’ মাত্র ৮ লাখ টাকায় তৈরি। আর এত স্বল্পব্যয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হওয়ার মূল কারণ ছবিটি স্টুডিওর প্রথাগত ৩৫ মিলিমিটারে ছবি না বানিয়ে ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় ছবি তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে ছবির খরচ অনেক কমে গেছে এবং সিনেমা হলের বাইরে ছবি দেখানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করা গেছে । ছবির খরচ ব্যাপকভাবে কমানোর ফলে বিকল্প ধারার পরিচালকরা নিজেরাই নিজেদের ছবির মালিক হতে পেরেছেন । অধিকার জন্মেছে নিজের সৃষ্ট পণ্যের ওপর। সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পী হিসেবে স্বাধীনতাও বেড়েছে।
বিকল্প ধারার নির্মাতাদের আরেক সাফল্য হচ্ছে নিজেদের ছবির বিকল্প বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা । সিনেমা হলের বাইরে জেলা, উপজেলা ও মফস্বল শহরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মিলনায়তনে তাদের ছবিগুলো দেখানোর ব্যবস্থা করা। আর এ ব্যাপারে বড় সহযোগী হচ্ছে স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, ফিল্ম সোসাইটি ও ছাত্র সংগঠনগুলো। এমনও হয়েছে যে, শীতে ফসল-কাটা মাঠে বড় পর্দা টাঙিয়ে নিজেরা প্রজেক্টর চালিয়ে ছবি দেখিয়েছে।
শত শত মানুষ মাটিতে বসে সেসব ছবি দেখেছে। এফডিসিতে তৈরি ছবির বায়ভার বেশি হওয়া ও নানা ভোগান্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে তারকাপ্রথা । বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তারকাদের সৃষ্টি করে। পরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হওয়া তারকাদের হাতে নিজেরাই জিম্মি হয়ে পড়ে। বিকল্প ধারার নির্মাতারা দেখিয়েছেন যে, তারকা জরুরি কিছু নয়। তাদের ছাড়াও ছবি করা সম্ভব এবং দর্শকরা সে ছবি দেখতেও আসেন।
কারিগরি দুর্বলতা :
বিকল্প ধারার সব ছবিই তেমন ভালো হয়নি। অনেক ছবির কারিগরি মান বেশ দুর্বল। অনেকে ছবি করতে এসেছিলেন কোনোরকম প্রযুক্তিগত ও নান্দনিক জ্ঞান ছাড়াই। ফলে সিনেমার ভাষা প্রয়োগে অদক্ষতা লক্ষ্য করা গেছে। অনেক ছবি হয়েছে কিছুটা টিভি নাটক ঘেঁষা। তাছাড়া কিছু ছবিতে আবেগটা বেশ কাঁচা। ফলে ছবি হয়ে গেছে প্রচারধর্মী। দর্শকের মনন ও বিবেচনাবোধের ওপর আস্থার অভাব দেখা গেছে।
![বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র রচনা [ গণমাধ্যম বিষয়ক ] বাংলা রচনা সম্ভার 3 আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news-300x225.jpg)
উপসংহার :
বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে চলেছে। বিকল্প ধারার কিছু ছবি বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে কারণ জনগণ তাদের জীবনের কিছু বড় অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এসব ছবিতে দেখেছেন, যা তারা মূলধারার ছবিতে পাননি। যেমন— একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি বিকল্প ধারার নির্মাতাদের কাছে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে। কারণ তাদের বয়সে দেখা জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা নিঃসন্দেহে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই বারবারই ১৯৭১ সাল তাদের ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে। এটা বিকল্প ধারার ছবির কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এ ধারার নির্মাতারা যে এ দেশেরই জলে-কাদায়-জনপথে বেড়ে ওঠা সন্তান এবং এই জাতির ব্যথা-বেদনা ও স্বপ্নকে ধারণ করেন তারই প্রমাণ।
শত বাধার মাঝেও বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা যে টিকে থাকতে পেরেছে বা বিকশিত হয়েছে তার কারণ তা এ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে থাকতে পেরেছে। যদি এর নির্মাতারা প্রতিষ্ঠার হাতছানিতে, অর্থের লোভে বা পুরস্কারের মোহে আদর্শবোধ থেকে বিচ্যুত হন, তাহলে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা তারা হারাবেন। আর তাহলেই এ দেশের বিকল্প চলচ্চিত্রেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। আর যত দিন তেমনটি না হচ্ছে ততদিন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান আঁধার সুড়ঙ্গে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র হয়তো একমাত্র ক্ষীণ আশার আলো।
আরও দেখুন: