চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার

চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : মানবসভ্যতার এক বিস্ময়কর আবিষ্কার চলচ্চিত্র। তা আধুনিক কালের অন্যতম সেরা শিল্পমাধ্যম ও গণমাধ্যম। আলোছায়ার খেলায়, ধ্বনিময় বর্ণিল কারুকার্যে জীবনের ভাব-ভাবনা চলমান অভিব্যক্তি প্রকাশের এ মাধ্যমটি প্রেক্ষাগৃহের রূপালি পর্দা থেকে শুরু করে টিভি ও কম্পিউটারের রূপালি পর্দায় এখন মানুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম। মানুষের ব্যক্তিমনে এবং সমাজজীবনে এ মাধ্যমটির প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অসাধারণ এবং বর্তমানে তা সমাজজীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম সেরা ধারক ও বাহক হিসেবে সমাদৃত।

চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার

চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা

পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষের কাছে এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে এবং এটি গণযোগাযোগের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সর্বস্তরের মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এর অসামান্য ক্ষমতার ফলে আধুনিক কালে সমাজজীবনে চলচ্চিত্র পালন করছে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। সমাজ-সংগঠনে ও মানুষের জীবনবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে সংগত কারণেই রোজার মেনভেলের মন্তব্য : ‘The cinema is only one element which brings some measure of influence to bear on our attitude to life.”

চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার

 

চলচ্চিত্র ও বিনোদন : গণমানুষের কাছে বিনোদনের একটি বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র। এর আগে মানুষ অবসর বিনোদনের জন্য রঙ্গমঞ্চে নাটকাভিনয় দেখত। রঙ্গমঞ্চই ছিল তখন মানুষের রসতৃষ্ণার বড় মাধ্যম। আস্তে আস্তে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটে। চলচ্চিত্র হয়ে দাঁড়ালো ঈেমঞ্চের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং রঙ্গমঞ্চের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। চলচ্চিত্রের অভিনয় প্রথমে ছিল নির্বাক। রক্ত-মাংসের প্রণচাঞ্চল্যেভরা অভিনয় থেকে মানুষের কাছে চলচ্চিত্রের অভিনয় প্রিয় হয়ে উঠল। সচল না থাকা অভিনয়ও মানুষকে বেশ আনন্দ দিত। সচল ছবির যখন প্রচলন হলো, তখন মানুষ চলচ্চিত্রের অভিনয় দেখার জন্য বেশি আগ্রহী হয়ে উঠল।

সমাজজীবনে চলচ্চিত্রের ইতিবাচক প্রভাব : অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও অন্যতম সেরা বিনোদন মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র মানুষের নতুন ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। রুচিশীল সুস্থ জীবন পরিবেশ সৃষ্টিতে, মানুষের সৎ ও সুশীল চরিত্র গঠনে, সমাজজীবনে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সম্প্রদায়গত বিভেদ, গোষ্ঠীগত হানাহানির ঊর্ধ্বে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন রচনায়ও চলচ্চিত্র হতে পারে প্রণোদনার উৎস।

হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে সঞ্চারিত করতে পারে সহযোগিতা, সম্মিলন, পরমত সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বাণী। নৈতিক- মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষামূলক কাহিনী, তথ্যচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে জনপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র সমাজজীবনে অশিক্ষা, পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমানসকে সচেতন করে সমাজ শিক্ষকের  ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ, তথ্য জ্ঞাপন ও জনচেতনার প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলচ্চিত্র জাতীয় উন্নয়নেও অবদন রাখতে পারে।

জাতীয় সংকট মোকাবেলায়, জাতীয় চেতনার সম্প্রসারণে ও জাতীয় জাগরণ সৃষ্টিতেও চলচ্চিত্র হতে পারে বলিষ্ঠ মাধ্যম। সোভিয়েত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের ক্ষেত্রে জাতীয় উদ্দীপনা ও জাগরণ সৃষ্টিতে চলচ্চিত্রের অসাধারণ ভূমিকা উপলব্ধি করেই লেনিন বলেছিলেন To us cinema is the most important of all arts. এ থেকে জাতীয় জীবনে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সহজেই অনুধাবন করা যায়।

শিক্ষা সম্প্রসারণে চলচ্চিত্রের ভূমিকা : সাধারণভাবে চলচ্চিত্রের মুখ্য ভূমিকা লোকরঞ্জক হলেও বেতার ও টেলিভিশনের মতো চলচ্চিত্রও শিক্ষাসহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাসহায়ক উপকরণ হিসেবে চলচ্চিত্র আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিমধ্যেই নিজের আসনটি পাকা করে নিয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবই-নির্ভর শিক্ষার পাশাপাশি তথ্যমূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। জীবনী ও বাস্তর ঘটনাভিত্তিক কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্য চিত্র, তথ্যচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে পরিপুরক শিক্ষা দেয়া হয়।

এর ফলে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রসার ঘটে। শিক্ষার্থীর নৈতিক, মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেগুলো খুবই সহায়ক হয় । এজন্যই আজকাল বলা হয়, চলচ্চিত্র শিক্ষার অঙ্গ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চলচ্চিত্র এখনো শিক্ষার অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। গ্রন্থনির্ভর শ্রেণীকক্ষ-কেন্দ্রিক শিক্ষার বাইরে শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত না হওয়াই এর মূল কারণ।

চলচ্চিত্র ও জনমত : জনমত গঠনে চলচ্চিত্র বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র মানুষকে যেভাবে সচেতন করে, চলচ্চিত্রও মানুষকে সেভাবে সচেতন করতে পারে। বিনোদনের মাধ্যমে জনমত গঠন করতে পারে বলে চলচ্চিত্র গণমানুষের কাছে এখনো বেশ আকর্ষণীয় ।

চলচ্চিত্র-বর্তমান প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বিভিন্ন কারণে দেশটি নানা রকম অবক্ষয়ের শিকার। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধিতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে চলচ্চিত্র। বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্রের অধিকাংশেই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে যথেচ্ছ যৌনতার ব্যবহার, কদর্য ভায়োলেন্স, অবাস্তব কাহিনী, অশ্লীল সংলাপ ও সংগীত, হাস্যকর নির্মাণশৈলী ইত্যাদি ভয়াবহ রকমে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মূল্যবোধহীন এসব চলচ্চিত্র কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে সুশীল সমাজে। যদিও এসবই উপভোগ করছে এক শ্রেণীর বিকৃতমনা দর্শক; সুযোগ নিচ্ছেন নির্মাতারা। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের কিংবা মধ্যবিত্তের মানস গঠনে ‘চলচ্চিত্র’ শব্দটিই সর্বোতভাবে বর্তনীয়।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আমাদের জাতীয় স্বার্থেই এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। প্রতিকূল স্রোতের মুখেও যে কিছু সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে না- তা নয়। এগুলোকে আদর্শ করে চলচ্চিত্রের পুনর্গঠন সম্ভব। সরকারি সেন্সর বোর্ডও এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। মোটকথা সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রই পারে মানুষের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে, তাকে কল্যাণের পথে ধাবিত করতে। সুতরাং চলচ্চিত্রের অসীম সম্ভাবনার এ নিকটি সম্পর্কে সচেতন দৃষ্টি অপরিহার্য।

চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি : চলচ্চিত্র একটি দেশ ও জাতির সংস্কৃতিরও বাহক। অভিনয় ও দৃশ্যের অবতারণা করে যে কোনো বিষয়বস্তুকে রূপালি পর্দায় পরিবেশন করা হয়। নাট্যসাহিত্যের সংজ্ঞায় বর্ণিত আছে, নাটকীয় বিষয়বস্তুর অনুকরণের নাম অভিনয়। বিষয়বস্তুর পরিস্ফুটনে সংলাপসহ কুশীলবদের পোশাক-পরিচ্ছদ, সংগীত, নৃত্যকলাসহ জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি দর্শক হৃদয় অনুভূতিরা সাড়া জাগায়। দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় বিদেশী সংস্কৃতি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অনুপ্রবেশ করায় সংস্কৃতিসেবী দর্শক-শ্রোতাদের কাছে চলচ্চিত্র অপসংস্কৃতির অন্যতম রূপালি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এজন্য সমাজসচেতন প্রযোজক চলচ্চিত্র জগতে এগিয়ে এলে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির সংরক্ষণে অবদান রাখতে পারবে ।

চলচ্চিত্রের ক্ষতিকারক দিক : চলচ্চিত্র বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অবদান হলেও তা বর্তমানে অর্থনীতিহীন বাণিজ্য সম্রাটদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্রের মহান ভূমিকাকে হেনস্থা করে তারা চলচ্চিত্রকে পরিণত করেছে বিকৃত রুচি-আশ্রিত পন্যে, পরিভোগপ্রবণ পুজিবাদী সভ্যতা ও বিভিন্ন দেশের লুটেরা ধনিকরা চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে লালন করছে বিকৃত রুচি, স্কুল যৌনাচার, উৎকট দেহপ্রদর্শন, অশালীন বেশভূষা, অভব্য বেলেল্লাপনা, লোমহর্ষক ঘটনাময় অপরাধ কাহিনী।

অর্থ, অস্ত্র, নৈরাজ্য, যৌনতা ও হিংস্রতাকে পুঁজি করে তারা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে সংগ্রামী, দেশব্রতী চেতনা থেকে সরিয়ে পরিভোগপ্রবণ সমাজের ক্রীড়নক করে তুলতে চায়। আমাদের দেশে তারুণ্যের মধ্যে সাম্প্রতিককালে যে মারাত্মক অবক্ষয় প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে পাশ্চাত্যের বাণিজ্যসর্বস্ব, রুচিহীন, চলচ্চিত্রের ব্যাপক প্রভাবই এর কারণ বলে মনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, শিক্ষা ও জনরুচির বাহন হয়ে উঠতে পারেনি । সার্বিকভাবে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও তাকে বিবেচনা করা চলে না। কিছু কিছু ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র বাদ দিলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সৎ চলচ্চিত্র বিকাশের ধারায় তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেনি।

অধিকাংশ চলচ্চিত্রই অশ্লীলতা, স্থূলতা ও রুচিশৈথিল্যের শিকার। বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই বোম্বের বাণিজ্যিক ছবির নকল। এক কথায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একটি গণবিচ্ছিন্ন মাধ্যম। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার যোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। অথচ স্বাধীন দেশের বিকাশমান গণমাধ্যম হিসেবে তা জাতির মানস গঠনের, শিক্ষা ও সুস্থ বিনোদনের অসাধারণ হাতিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা রাখে ।

উপসংহার : আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকে জনগণের স্বার্থ, আকাঙ্ক্ষা ও জাতির প্রত্যাশার পরিপূরক করে বিকশিত করা দরকার। এদেশের চলচ্চিত্রের গুণগত উত্তরণ ঘটিয়েই তা করা সম্ভব হতে পারে। স্কুল রুচি লালন করে নয়, অনাবিল আনন্দ দানের সঙ্গে শিক্ষামূলক ও জাতিগঠনমূলক উপাদানের যোজনা করে এবং মানসম্মত শিল্পকর্মের পর্যায়ে নির্মিত করে এদেশের চলচ্চিত্রের নতুন ধারা তৈরি করা দরকার।

চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার

 

তাহলে অন্ধ কুসংস্কার, মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা, বিজ্ঞান-বিমুখ মনোজড়তায় অনড় সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। বর্তমান অস্থিরতা, নৈরাজ্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের হাত থেকে জাতির উত্তরণের পথনির্দেশ করতে চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবে জাতিকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে, নতুন প্রজন্মের মানস গঠনের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র কার্যকর অবদান রাখতে পারবে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment