ধূমপানে বিষপান | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

ধূমপানে বিষপান | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : ধূমপান এক ধরনের নেশা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক জটিল রোগের মূলে, সেসব রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং রোগ নিরাময়ের অন্তরায় হিসেবে এ নেশাকে বিশেষভাবে দায়ী করছে। ধূমপানকে আমাদের দেশে যদিও বিষপান হিসেবে অভিহিত করা হয় তবুও অধুনা বিজ্ঞাপনের কারসাজিতে ধূমপান বিশেষ ধরনের জীবনরীতির মর্যাদা হিসেবে প্রচারিত হওয়ায় তরুণপ্রজন্ম ব্যাপকভাবে ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

ধূমপানে বিষপান | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

ধূমপানে বিষপান

 অথচ ধূমপান এতই ক্ষতিকর যে এটা বিষপানের চেয়েও মারাত্মক। কারণ বিষপানে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটলেও ধূমপানে মানুষ ঝুঁকে ঝুঁকে মরে। আর তাই ধূমপানের ক্ষতিকর দিক উপলব্ধি করে কোনো এক সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘Drink poison but leave smoking’.

ধূমপানে বিষপান | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

ধূমপানের ইতিহাস : ধূমপানের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল রাজদরবারে যে রাজকীয় মেজাজে আলবোলায় তামাক সেবন করা হতো তার সাক্ষ্য বহন করছে মোগল চিত্রকলা। দীর্ঘকাল ধরে সুগন্ধি তামাক সেবন ছিল নবাবি ঘরানার আভিজাত্যের প্রতীক। ইংরেজ আমলে রাজবাড়িতে ও জমিদার বাড়িতে মনিব ও হুজুরদের তামাক পরিবেশনের জন্য হুঁকাবরদার ও ছিলিমদার রাখা হতো। পরবর্তীকালে বাবু কালচারের অঙ্গ হয় তামাক সেবন । কালক্রমে সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে তামাকের নেশা। সে নেশার আধুনিক সংস্করণ বিড়ি, সিগারেট, পাইপ, চুরুট।

ধূমপানের উপকরণ : ধূমপানের মূল উপকরণ তামাক ও গাঁজা। তামাক পাতা শুকিয়ে কুচো করে তার সাথে রাব বা ঝোলাগুড় মিশিয়ে এক ধরনের মণ্ড বানানো হয়। ঐ মণ্ড কঙ্কেতে সাজিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে হুঁকোর সাহায্যে ধূমপান করা হয়। আর তামাকের গুঁড়ো আরো কিছু উপাদানের সাথে মিশিয়ে বিড়ি বা সিগারেট তৈরি করা হয়। তাতে আগুন ধরিয়ে তার ধোঁয়া পান করা হয়। এই হলো ধূমপানের প্রক্রিয়া। ধূমপানের নানা কায়দা তামাক, বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা, চুরুট, পাইপ ইত্যাদি । সাম্প্রতিককালে হেরোইন, ব্রাউন গুগার জাতীয় ড্রাগও নেশাগ্রস্তরা ধূমপানের মতোই ব্যবহার করে।

ধূমপানের সপক্ষে যুক্তি : ধূমপানের পক্ষে ধূমপায়ীরা অনেক যুক্তিই খাড়া করেন। আলস্য ও শ্রান্তি কাটাতে নাকি ধূমপান দারুণ কাজ করে। কাজে জোগায় নতুন উদ্যম ও প্রাণশক্তি। সিগারেটে টান দিয়ে ভাবতে বসলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান নাকি চলে আসে মাথায়। ধেয়ার রিং বানাতে বানাতে চিন্তামগ্ন হওয়ার আমেজের নাকি কোনো তুলনাই হয় না । আর অবকাশের মুহূর্তকে মধুর আবেশে ভরিয়ে দিতে সিগারেটের নাকি জুড়ি নেই।

ধূমপান ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া : ধূমপানের সপক্ষে যতই যুক্তি খাড়া করা হোক, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, ধূমপানের প্রতিক্রিয়া এক অর্থে বিষপানের চেয়েও মারাত্মক। কারণ, বিষয় ক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু ঘটে দ্রুত কিন্তু ধূমপানে মানুষ ঝুঁকে ধুঁকে মরে। ধূমপানে ফুসফুসের ক্ষতি হয়, কারণ বিষ মিশ্রিত ধোঁয়া সরাসরি ফুসফুসে গিয়ে ফুসফুসকে পীড়িত করে। সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্যান্সারের মুখ্য  কারণ । ধূমপান কাশি, হাঁপানি ইত্যাদি বক্ষব্যাধি এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। শরীরের স্নায়ুব্যবস্থাকে দুর্বল ও অবশ করে এবং এর ফলে শরীরে নানা জটিল রোগের উপসর্গ সৃষ্টি হয়।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সার ছাড়াও ল্যারিংস-এর ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, মূত্রথলির ক্যান্সার, অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানের কারণে প্রতি বছর সোয়া লাখেরও বেশি লোক হৃদয়ন্ত্রের রক্তনালী সংক্রান্ত হৃদরোগে মারা যায়। ধূমপায়ীদের পেপটিক আলসার সহজে নিরাময় হয় না। ধূমপান বহুক্ষেত্রে ওষুধের ভেষজ কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ফলাফল বদলে দেয়। ধূমপায়ী নারীদের মধ্যে মৃত ও কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেশি। অনেক সময় ধূমপায়ী নারীদের গর্ভজাত শিশুরা নানারকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে ।

ধূমপান ও মানসিক প্রতিক্রিয়া : ধূমপান সুস্থ মানসিকতার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। ধূমপানের ফলে যে শারীরিক ক্ষতি হয়, তা ক্রমান্বয়ে সুস্থ মানসিকতাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া ধূমপানের অভ্যাস অনেক মানসিক অসুস্থতার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয়ে তা ক্রমান্বয়ে নেশায় পরিণত হয়।

প্রকৃতপক্ষে, ধূমপানের ক্রমাগত নেশাই ধীরে ধীরে মানুষকে মাদকাসক্তের দিকে নিয়ে যায়। এজন্য বলা হয়েছে, ‘Smoking is the first step of intoxicant’. এক নির্ভরযোগ্য গবেষণায় দেখা গেছে, সমবয়স্ক ও সমপর্যায়ের ধূমপায়ীদের মধ্যে আচরণের অস্বাভাবিকতা অনেক বেশি। ধূমপায়ী মানুষ সহজেই ধার-কর্জ, এমনকি অন্যের কাছে হাত পাততেও দিধাবোধ করে না। মানুষের ব্যক্তিত্বের জন্য এটা খুবই ক্ষতিকর।

ধূমপান ও আর্থিক অপচয় : আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ব্যাপক সংখ্যক লোকের দু’বেলা আহার জোটে না সেখানে ধূমপান খাতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় সামাজিক স্বার্থের প্রতিকূল। ধূমপান খাতে অপচয় অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সংকটের সৃষ্টি করে। যিনি নিয়মিত সিগারেট পান করেন তার এ খাতে মাসিক অপচয় হয় কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার টাকা। এ অপচয় না হলে তা পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টিতে বা কল্যাণমুখী কাজে ব্যয় করা সম্ভব হয় । সিগারেটপায়ীর অসুস্থতার খাতেও কম অর্থ খরচ হয় না ।

ধূমপানে সমাজ দূষণ : ধূমপানকে এক ধরনের সামাজিক অপরাধ বলা চলে। এর ফলে ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজজীবন দারুণভাবে কলঙ্কিত হয়। ধূমপায়ীয় ভিতর এক ধরনের অপরাধবোধ বিরাজ করে। ফলে দেখা যায়, তরুণরা বয়স্কদের সামনে কিংবা নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্মুখে ধূমপান করতে সংকোচ বোধ করে। ধূমপানের ফলে পরিবেশও দূষিত হয়। বাসে-লঞ্চে রেলে ধূমপানের ফলে সাধারণ যাত্রীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে বাতাস দূষিত হয় এবং বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া অন্যের মুখে লাগলে মানসিক বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়। ধূমপানের ফলে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়।

ধূমপান বিরোধী আন্দোলন : ধূমপানের কুফল অনুধাবন করে বিশ্বব্যাপী ধূমপান বিরোধী আন্দোলন (Anti-smoking movement) গড়ে উঠেছে। বিশ্বে বিভিন্ন দেশের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও জনাকীর্ণ স্থানে প্রকাশে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতিসংঘ “বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফিফা, আইসিসিসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থা সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ ‘আধূনিক’, ‘প্রত্যাশা’ ও অন্যান্য সংগঠন ধূমপান বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করছে।

ধূমপানে বিষপান | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

ধূমপান বিরোধী আইন : সরকার ধূমপান নিয়ন্ত্রণকল্পে সম্প্রতি আইন প্রণয়ন করে আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছে। গত ১৫ মার্চ ২০০৫ তারিখে ধূমপান ও তামাক দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এ আইনের আওতায় প্রকাশ্যে পাবলিক স্থানে ধূমপান ও তামাক দ্রব্য ক্রয়বিক্রয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ আইনে তামাক দ্রব্যের সব ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং আইন লঙ্ঘন করার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

প্রতিরোধের উপায় : ধূমপানের অভ্যাস ছাড়া তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় । অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী ডাক্তারের পরামর্শে ধূমপান ছেড়ে দিতে সক্ষম হন। সুতরাং সচেতন ইচ্ছা থাকলে ধূমপান ছাড়া সম্ভব। ধূমপান নিবারণের ক্ষেত্রে পশ্চিমের দেশগুলোতে নানা পদক্ষেপ গৃহীত হওয়ায় ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে সে ধরনের উদ্যোগ-আয়োজন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও ধূমপান প্রতিরোধ ও নিবারণে শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টি করেই অগ্রসর হতে হবে। সেজন্য সরকারি উদ্যোগ যেমন দরকার তেমনি দরকার ব্যাপক বেসরকারি তৎপরতা। এজন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে :

১. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সভা-সমিতি, সেমিনার ও রেডিও-টিভিতে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক ব্যাপকভাবে তুলে ধরা;

২. হাটে-বাজারে, যানবাহনে, পত্রপত্রিকায়, বেতার-টেলিভিশনে ধূমপানের যে কোনো বিজ্ঞাপনকে নিষিদ্ধ করা। কারণ, বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় সিগারেটসেবীদের জীবনযাপনের এমন লোভনীয় ধাঁচ তুলে ধরা হয়, যা উঠতি প্রজন্মের দর্শকদের খুবই অনুকরণীয় বলে মনে হয় ;

৩. সিনেমা, থিয়েটার, টেলিভিশনে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের অভিনয়াংশে ধূমপানের দৃশ্য সচেতনভাবে বর্জন করা । কারণ, এসব দেখেই ছোটরা তা অন্ধভাবে অনুকরণ করে;

৪. শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধূমপানবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির জন্য শিক্ষাক্রমের কোনো-না-কোনো পর্যায়ে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পাঠদানের ব্যবস্থা করা;

৫. ধূমপানের সাথে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন খাতে ব্যাপক কঠোরতা আরোপ;

৬. বয়স্কদের দেখাদেখি ছোট ছেলেমেয়েরা যেন অনুকরণ প্রবণতা থেকে ধূমপানে আসক্ত না হয় সেজন্য সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলে এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা;

৭. সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায়, বিশেষ করে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের ধূমপানবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্তকরণ;

৮. সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাউকে ধূমপানে আপ্যায়িত না করা এবং ধূমপানের অপকারিতা সম্পর্কে অবহিতকরণ এবং এ অভ্যাস ত্যাগ করায় উদ্বুদ্ধকরণ;

৯. অফিসে, যানবাহনে, সিনেমা হলে, জনসভায় এবং সব ধরনের লোকসমাবেশে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ;

১০. সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধূমপানবিরোধী সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 উপসংহার: ধূমপান সুদীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এক ব্যাপক নেশা। সিগারেট ও তামাক সামগ্রী উৎপাদন, বিজ্ঞাপন ও বিপণন আইন করে নিষিদ্ধ করে এ অভ্যাস রাতারাতি বন্ধ করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ, এ নেশার উৎপাদন শিল্প, বিজ্ঞাপন ও ব্যবসায়ের সাথে জড়িত হাজার হাজার পরিবারের রুটি-রুজি। সরকারের এক বিরাট রাজস্ব আয়ও আসে এ থেকে। তাই রাতারাতি না হলেও আইনের ক্রমিক কঠোরতা আরোপ করে এবং পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করে এ নেশাকে আমাদের সীমিত ও নির্মূল করতে হবে। সুস্থ-সবল জাতি গঠনে ধূমপান পরিহারের কোনো বিকল্প নেই।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment