অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি দক্ষ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনের উপকরণের সুষম বণ্টন, উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ, দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং দ্রুত শিল্পায়নের জন্য একটি সুসমন্বিত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অত্যাবশ্যকীয় ভৌত অবকাঠামো হিসেবে কাজ করে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা
সর্বোপরি, বর্তমান বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ স্থাপন একান্ত জরুরি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন।
বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশ পরস্পরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত এ যোগাযোগ ব্যবস্থা। সম্ভাব্য উৎপাদন, বণ্টন, মূল্য নির্ধারণ, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ফলেই বিশ্বের দেশগুলো আজ খুব কাছাকাছি এসে গেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন প্রত্যেক দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে। অবশ্য দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখেই যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রাচীনকাল থেকে নদীই এদেশে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অপরদিকে, মরুভূমির দেশে সড়ক যোগাযোগ, পার্বত্য দেশে বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে সংযোগ ঘটে। এতে আধুনিক শহরায়নের সুফল গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাও একটি কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা। নদীপথে সহজেই পণ্যসামগ্রী পরিবহন করা যায়। যেখানে সড়ক যোগাযোগের সুব্যবস্থা নেই সেখানে নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা বিশেষ সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। রেল যোগাযোগ একটি নির্ভরশীল ব্যবস্থা, যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে যার গুরুত্ব সর্বাধিক। বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থায় সারা বিশ্বের সাথে সহজে সংযোগ সাধন সম্ভব। এ প্রসঙ্গে টেলিযোগাযোগের কথাও উল্লেখযোগ্য। এসব মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই দেশ ও সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়তা করছে।
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা : বাংলাদেশে নৌ, রেল, সড়ক ও বিমান পথের সম্মিলনে বর্তমানে একটি সুষ্ঠু যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। নিচে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
সড়ক যোগাযোগ : সড়ক যোগাযোগ বাংলাদেশের জনপরিবহনের প্রধান মাধ্যম। দেশের প্রতিটি জেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু, রূপসা সেতু, মেঘনা সেতু, বুড়িগঙ্গা সেতু, ধরলা সেতু প্রভৃতির কল্যাণে বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০০৫ সালের জরিপ অনুযায়ী পাকা ও কাঁচা মিলিয়ে বাংলাদেশে মোট ২ লাখ ৪১ হাজার ২৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও জনপথ রয়েছে। সড়ক পথে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, লরি, মোটরগাড়ি, টেম্পুসহ অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবহন চলাচল করে। তাছাড়া রিকশা ও অন্যান্য মনুষ্যচালিত যান শহর ও গ্রাম-গঞ্জে চলাচল করে। দ্রুত গমনাগমন ও পণ্য পরিবহনের আদর্শ মাধ্যম হচ্ছে সড়ক পথ।
সড়ক পরিবহন : স্বাধীনতার পর বিগত ৩৪ বছরে বাংলাদেশে দুই লক্ষ একচল্লিশ হাজার কিলোমিটারের (কিমি) অধিক বিস্তীর্ণ এক সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যা ছিল মাত্র ৪ হাজার কিমি। পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সড়ক পরিবহন খাতের এ সম্প্রসারণের ফলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অন্যান্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় এর অবদান দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রেলপথ : বিগত শতকের শুরুতে বাংলাদেশে রেলপথ গড়ে ওঠে। দেশের কয়েকটি জেলা বাদে সব জেলা রেল যোগাযোগের নেটওয়ার্কভুক্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ২৮৫৪.৯৬ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ৬৬০ কিলোমিটার ব্রডগেজ, ৩৬৫ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ও ১৮২৯.৭৪ কিমি মিটারগেজ রেলপথ।
যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে জামতৈল থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ বসানোর কারণে উত্তরবঙ্গের সাথে রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকায় সরাসরি রেল যোগাযোগ গড়ে উঠেছে । রেলপথে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহন আরামদায়ক, নিরাপদ ও তুলনামূলকভবে কম ব্যয়সাপেক্ষ। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারের একটি অন্যতম প্রাচীন সেবাধর্মী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যা দেশের আর্থ- সামাজিক তথা শিল্পোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি পরিবেশ বান্ধব, নিরাপদ এবং সুলভে মালামাল পরিবহনে সক্ষম একটি নির্ভরশীল মাধ্যম।
নৌপথ : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সব মিলিয়ে এদেশে মোট নদীর সংখ্যা ২৩০টি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী যোগাযোগ মাধ্যম হলো নৌপথ। দুই ধরনের নৌপথ এদেশে বিদ্যমান। যথা— ১. সমুদ্র পথ তথা আন্তর্জাতিক নৌপথ ও ২. নদী তথা অভ্যন্তরীণ নৌপথ। সমুদ্র পথে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন করা হয়।
সমুদ্র পথে যোগাযোগের মাধ্যম হলো চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রবন্দর ও মংলা সমুদ্রবন্দর। অপরদিকে, রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৬টি জেলাসহ শরিয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীর যোগাযোগের সহজতম মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। বাংলাদেশের প্রধান নদীবন্দরগুলো হচ্ছে ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঝালকাঠি, ভৈরব ইত্যাদি। নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় খুব কম বলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে ট্রলার ও বার্জ যোগে ভারী পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে।
বিমান পথ : বাংলাদেশের জাতীয় বিমান সংস্থার নাম ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দর। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংখ্যা ৩টি এবং অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হলো ৫টি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট হলো দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দর বর্তমানে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের ১৮টি এয়ারলাইন্স এর বিমান পরিচালনা করছে। সরকারি বিমান সংস্থা ছাড়াও ৪টি বেসরকারি বিমান সংস্থা অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর, বরিশাল প্রভৃতি অন্যতম
অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স দেশের অভ্যন্তরে ও বর্হিবিশ্বের সাথে আকাশ পথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সীমিত সম্পদ নিয়ে বিমান তার ১৪টি উড়োজাহাজের মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ বিমান বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ৮টি এবং আন্তর্জাতিক ২৬টি গন্তব্যে সার্ভিস পরিচালনা করছে। আন্তর্জাতিক গন্তব্যের মধ্যে বিমান সার্কভুক্ত দেশে ৫টি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৪টি, প্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে ২টি, মধ্যপ্রাচ্যে ১টি, ইউরোপে ৫টি এবং উত্তর আমেরিকার ১টি গন্তব্যে সার্ভিস পরিচালনা করছে। বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ ও অপারেশনাল সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রুট পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের যাত্রীদের সুবিধার জন্য চট্টগ্রাম/সিলেটকে যুক্ত করে মধ্যপ্রাচ্যে কতিপয় ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।
টেলিযোগাযোগ : আধুনিক বিশ্বে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বিস্ময়কর বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মূলত টেলিযোগাযোগ তথা তথ্যপ্রযুক্তির অব্যাহত সম্প্রসারণে সারা পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফ্যাক্স, টেলেক্স প্রভৃতির মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশের সাথে বাংলাদেশ থেকে স্বল্পতম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। সম্প্রতি বাংলাদেশ অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের সাথে যুক্ত হয়ে তথ্য মহাসরণির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলার মধ্যে ডিজিটাল টেলিফোন সংযোগ রয়েছে।
অধিকাংশ উপজেলাতেই ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি জেলায় ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে গেছে এবং অতি শীঘ্র তা প্রতিটি উপজেলায় ছড়িয়ে পড়বে। বর্তমান তথ্য প্রবাহের যুগে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা একটি উৎপাদনশীল ও লাভজনক শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। এ সার্ভিস সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ছাড়াও তথ্যের দ্রুত আদান প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিটি স্তরেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও সার্ভিসের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বেশ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
টেলিফোন সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে ১৯৯২ সন হতে সারাদেশে কার্ডফোন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ১৯৯১-৯২ সনে কার্ডফোনের সংখ্যা ছিল ১৫৩টি, ২০০৩-০৪ সনের ডিসেম্বর, ২০০৪ পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে ১৫১৯টিতে। কার্ডফোন ছাড়াও অপারেটর ট্রাংক ডায়ালিং (ওটিভি)’র মাধ্যমে গ্রাহকগণ দেশ-বিদেশ হতে সরাসরি ডায়াল করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কথা বলার সুবিধা পাচ্ছেন। উচ্চগতির ডাটা আদান-প্রদান ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানের লক্ষ্যে ১৩টি জেলা শহরে মোট ২৩টি ডিজিটাল ডাটা নেটওয়ার্ক নোড স্থাপন করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশের সকল জেলায় এবং ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ আছে এমন উপজেলায় ইন্টারনেট সার্ভিস সম্প্রসারণ করা হয়েছে। স্বল্পমূল্যে ১০টি দেশের সাথে সরাসরি টেলিযোগাযোগ লক্ষ্যে ‘০১২’ সার্ভিস প্রবর্তন করা হয়েছে। গ্রাহকদের উন্নততর নির্বিঘ্ন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড ঢাকার রমনা, গুলশান ও শেরে বাংলা নগরে ওয়ান পয়েন্ট সার্ভিস সেন্টার চালু করেছে। এর ফলে টেলিফোনের ত্রুটি ও অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ, টেলিফোন বিল ও ডিমান্ড নোটের টাকা পরিশোধ ইত্যাদির জন্য সম্মানিত গ্রাহকগণকে এক অফিস হতে অন্য অফিসে ছুটোছুটি করতে হয় না। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো সার্ভিস সেন্টার খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

উপজেলা পর্যায়ে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী/আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে বিটিটিবি’র ‘সম্পদ সংরক্ষণ ও সেবা’ খাতের আওতায় ৯২টি উপজেলায় ক্ষুদ্রাকার ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ স্থাপনের কাজ চলছে এবং ডিসেম্বর, ২০০৪ পর্যন্ত ‘সম্পদ সংরক্ষণ ও সেবা খাত’ এবং চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিটিটিবি সর্বমোট ১৬৫টি উপজেলায় ও ০৮টি গ্রোথ সেন্টারে ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছে। বিটিটিবি’র উপজেলা ও গ্রোথ সেন্টারে ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন প্রকল্পের আওতায় শীঘ্রই অবশিষ্ট উপজেলায় ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হবে। ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ এর গ্রাহকগণ দেশব্যাপী সরাসরি ডায়ালিং ও আইএসডি সুবিধা ছাড়াও ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে।
১০ (দশ) লক্ষ টিএন্ডটি মোবাইল (প্রথম পর্যায়ে ২.৫ লক্ষ) ফোন স্থাপন প্রকল্পের আওতায় পাবলিক সেক্টর হতে মোবাইল ফোন সুবিধা গ্রহাকের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ডিসেম্বর, ২০০৪ মাসে মোবাইল এক্সচেঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। মোবাইল ফোন সার্ভিস পরিচালনার জন্যে ইতোমধ্যে টেলিটক নামে একটি স্বতন্ত্র কোম্পানী গঠন করা হয়েছে। মার্চ, ২০০৫ থেকে এ মোবাইল ফোন বাজারে ছাড়া হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই স্পার ট্রান্সমিশন লিংকসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন অপটিক্যাল * ফাইবার লিংক ও অন্যান্য কয়েকটি স্থানে স্পার লিংক স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ : ডাক বিভাগ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান । এ প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে ৯৮৬০টি (জানুয়ারি, ২০০৪ অনুযায়ী) পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ডাক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
ডাক বিভাগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের কাছে ন্যূনতম ব্যয়ে নিয়মিত ও দ্রুততার সাথে ডাক সেবা প্রদান করা । সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে ডাক বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে এ সেবা পরিচালনা করে আসছে। ডাকসেবা প্রদানের পাশাপাশি অর্থ, তথ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে ডাক বিভাগ শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যকার বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে।
ডাক দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি ডাক বিভাগের মূল কাজ। এর পাশাপাশি ডাক বিভাগ জনগণের জন্য আরো অনেকগুলো সেবা প্রদান করে । ডাক বিভাগের নিজস্ব সার্ভিস সমূহ নিম্নরূপ :
জিইপি সার্ভিস, ইএমএস সার্ভিস, ই-পোস্ট, ইন্টেল পোস্ট, মানি অর্ডার সার্ভিস, রেজিষ্টার্ড সংবাদপত্র, বুক পোস্ট, পার্সেল সার্ভিস, বীমা সার্ভিস, ভ্যালুপেয়েবল সার্ভিস, রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস, ডাক দ্রব্যাদি (দেশীয় ও আন্তর্জাতিক) গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি ।
তথ্যপ্রযুক্তি : যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বব্যপী বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বর্তমান বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এখাতে অগ্রগতি ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ খাতকে খ্রান্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা’ মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে এবং এ নীতিমালার আলোকে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-এর খসড়া মন্ত্রীসভা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে এবং আইসিটি সেক্টরের বিকাশে ও দেশে উৎপাদিত সফটওয়্যারের মেধাস্বত্ত্ব সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় বিধান সংযোজন করে কপিরাইট আইন ২০০০ সংশোধন করা হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে একটি পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিতরণ ও শিক্ষকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সে চালু করা হয়েছে এবং এ সব কোর্সের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এক বছর মেয়াদি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৪০০ জন এ ধরনের ডিপ্লোমা অর্জন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।
এ খাতের বিকাশের লক্ষ্যে আইসিটি ইন্টার্নীশীপ কর্মসূচিও চালু করা হয়েছে। দেশে আইটি সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগ ও স্থানীয় আইটি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই টেক পার্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্তগ্রহণ করা হয়েছে এবং দেশে সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশের জন্য ঢাকার কাওরান বাজারে আইসিটি ইনকিউবেটর স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ই-গভর্ন্যান্স চালুর বিষয়ে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়সহ ৮টি মন্ত্রণালয় এবং ৬টি বিভাগীয় শহরে এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে সফটওয়্যার এবং আইটি এনাবলড সার্ভিসেস রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের সফটওয়্যার ব্যবহারকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো নোকিয়া, জাপান এয়ারলাইন্স, বিশ্ব ব্যাংক, এইচপি, মার্কিন পোস্টাল/এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট।
যে ধরনের সফটওয়্যার/আইসিটি এনাবলড সার্ভিস রপ্তানি হচ্ছে তা হলো : গেইমিং সফটওয়্যার, ভিডিও নেটওয়ার্ক এবং এনিমেশন, ওয়েব হোস্টিং, এক্সএমএল ও ওডিবিসি ডেটাবেইজ ড্রাইভার, মেইল-ট্রাকিং সিস্টেম, ম্যানেজমেন্ট ও মনিটরিং সফটওয়্যার, কাস্টমস বিজনেস এপ্লিকেশন কন্ট্রাক্ট প্রোগ্রামিক সার্ভিস, ওয়েব কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট, ডাটা কনভার্সন ও ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস ইত্যাদি। বর্তমানে ৫০টিরও বেশি সফটওয়্যার ফার্ম/আইসিটি কোম্পানি তাদের উৎপাদিত সফটওয়্যার এবং আইসিটি এনাবলড সার্ভিসেস ৩০টি দেশে রপ্তানি করছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি বিভিন্নভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ- ব্যবস্থা যথেষ্ট অবদান রাখছে। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য। পণ্য চলাচল, ব্যবসায় সংক্রান্ত উপকরণের গতিশীলতা, কাঁচামাল ক্রয় ও পণ্য বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পণ্যের বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে যোগাযোগ- ব্যবস্থা সহজ হতে হবে। দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাতকরণ এবং বিদেশে রপ্তানির জন্য বন্দরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে।
সুষম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অব্যাহত রাখার বিষয়টিও যোগাযোগ ব্যবস্থার উৎকর্ষের ওপর নির্ভরশীল। দেশের আপনকালীন জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য এবং দ্রুত পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়া আবশ্যক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মূল্যবান সম্পদ আহরণের সুযোগ ঘটে উত্তম পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রণ্ডিতে সাহায্য করে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্যও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ সহায়ক। এসব দিক বিবেচনা করলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি : বাংলাদেশ একটি ঘনবসিতপূর্ণ স্বল্প আয়তনের দেশ। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার সব ধরনের মাধ্যম থাকলেও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে তা ব্যাপক ও উন্নত করা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজও হয়নি। যমুনা সেতু নির্মাণ হলেও রেল যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। বরং তা সীমিত হয়ে পড়ছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিককালে দেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং এর সুফল অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে এ দেশ সম্পৃক্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক অবদান রাখছে।
উপসংহার : জাতীয় জীবনকে সবদিক থেকে গতিশীল করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশে উন্নত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে জাতীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যার অবসান ঘটবে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে শহরের সরাসরি সংযোগ ঘটবে। অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে গ্রামীণ সমাজের মানুষের। সেজন্য অনুৎপাদনশীল খাত থেকে অর্থ সাশ্রয় করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা দরকার। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে অগ্রগতি ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব “নয়।
এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে বৈদেশিক বিনিয়োগ নির্ভরশীল। এ গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতি বছরই এ খাতে বরাদ্দ যেমন বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং তেমনি নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এ খাতকে আরো সমৃদ্ধ ও যুগোপযোগী করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে এ খাতসমূহের উন্নয়ন বাজেট ছিল যেখানে ৩০৯৭.৯৩ কোটি টাকা এবং ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এ বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯৬৮.৪১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে ।
আরও দেখুন: