বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ | বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ | ভাষা ও শিক্ষা

বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ | বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ | ভাষা ও শিক্ষা , বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ আছে যেগুলো ভুলভাবে আমরা বাক্যে প্রয়োগ করি। ঠিক অর্থ বা ব্যবহার না জানার কারণে এমন ঘটে। এমন কিছু শব্দ নিচে দেয়া হল :

বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ | বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ | ভাষা ও শিক্ষা

অত্র : ‘অত্র’ শব্দের অর্থ “এখানে”। যত্র- যেখানে, তত্র- সেখানে, যত্রতত্র- যেখানে সেখানে। তাই অত্র বললে  ‘এই’ বোঝাবার কারণ নেই। যেমন – ‘এই অফিস’ অর্থে ‘অত্র অফিস’ লিখলে ভুল হবে।

উল্লেখিত / উল্লিখিত : উৎ + লিখিত উল্লিখিত, উল্লেখিত নয়। ‘উৎ’ মানে ওপরে বা আগে, আর লিখিত মানে “যা লেখা হয়েছে”। তা হলে উল্লিখিত শব্দের অর্থ হল উপরে লিখিত’ বা ‘পূর্বে লিখিত। তাই ‘উপরে উল্লিখিত” বা উপরোল্লিখিত’ বা ‘পূর্বোল্লিখিত’ লিখলে ভুল হবে। কেবল উল্লিখিত লেখাই যথেষ্ট।

বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ | বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ | ভাষা ও শিক্ষা

 

প্রেক্ষিত : ‘প্রেক্ষিত’ শব্দ এসেছে ‘প্রেক্ষণ’ থেকে। ‘প্রেক্ষণ’- বিশেষ্য পদ, অর্থ- দৃষ্টি। এ থেকে তৈরি হয়েছে বিশেষণ পদ ‘প্রেক্ষিত’ অর্থ- দর্ণিত বা যা লেখা হয়েছে, এবং প্রেক্ষণীয়’ অর্থ- যা দেখা উচিত বা যা দেখতে হবে।

ফলে perspective বা background অর্থে পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে চাইলে ‘প্রেক্ষিত’ শব্দ লিখলে চলবে না, লিখতে হবে ‘পরিপ্রেক্ষিত’।

হইল / হল : ক্রিয়াপদের যে সব রূপের উচ্চারণ এ-ধ্বনি দিয়ে শেষ হয়, সেসব শব্দ কীভাবে আমরা লিখব? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথাতেই দেয়া যায় ক্লিয়ারূপটির চেহারা সাধু ভাষায় যেরকম তার ওপর যাবৎ রূপের বানান নির্ভর করবে। যেমন- হল, হাল হলো, হোলো, হোল, একই শব্দের পাঁচ রকম বানান। চলিত বা সাধু ভাষার এই ক্রিয়াপদের সাধুরূপটি হচ্ছে হইল’। এই ‘হইল’ শব্দটি চলিত ভাষায় আসতে গিয়ে শুধু ‘ই’ হারিয়েছে। সুতরাং শুদ্ধ বানানটি হবে- হল।

ফলশ্রুতি : ফল, পরিণাম, অর্থে ‘ফলশ্রুতি’ শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। ‘ফলশ্রুতি’ শব্দের অর্থ— পুণাকর্ম করলে তার যে ফল হয় তা শ্রবণ বা তার বিবরণ। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে ‘শ্রুতি’র সঙ্গে পুণ্যকর্মের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। এই ফল। ফলাফল পরিণতি / পরিনাম- এসব শব্দ বোঝাতে ফলশ্রুতি লিখলে ভুল হবে।

সহসা :  ‘সহসা’ শব্দের মানে- হঠাৎ, অকস্মাৎ, অতর্কিতভাবে। আজকাল এই শব্দটি শীঘ্র, তাড়াতাড়ি, সত্ত্বর ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ভুল।

চলাকালীন সময়ে / থাকাকালীন সময়ে : ‘কাল’ শব্দের বিশেষণ হল ‘কালীন’, এর অর্থ- সময়ে। যেমন মৃত্যুকালীন প্রার্থনা, যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক মন্দা। তাই ‘চলাকালীন’ শব্দের অর্থ চলার সময়ে, চালু থাকা কালে। ফলে, “চলাকালীন সময়ে মানে দাঁড়াবে চলার সময়ে সময়ে। তাই “চলাকালীন”- এর পরে ‘সময়ে’ লেখা বাংলা ও অর্থহীন, ফলে বর্জনীয়।

উদ্দেশ / উদ্দেশ্য : উদ্দেশ শব্দে বোঝায় হদিস, খোঁজ, লক্ষ্য। যেমন

ক. কার উদ্দেশে একথা বলা হল কেউ বুঝতে পারল না।

খ. নদী যায় সাগর উদ্দেশে’।

গ. তাঁর পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে এই গ্রন্থ উৎসর্গিত হয়েছে।

উদ্দেশ্য শব্দের অর্থ : অভিপ্রায় বা মতলব, তাৎপর্য, প্রয়োজন। যেমন :

ক. আমার কাছে এসব কেন বল? তোমার উদ্দেশ্য কী খুলে বল।

খ. সাবধানে থেকো। লোকটা সুবিধের নয়, উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করে না।

গ. ভদ্রলোক ফালতু কথা একেবারেই বলেন না। তিনি যখন এ-কথা বলেছেন, তখন বুঝতে হবে-এর কোনো উদ্দেশ্য আছে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

লক্ষ / লক্ষ্য : আমরা সকলেই জানি যে, ‘লক্ষ ‘ শব্দের অর্থ ১০০ হাজার এবং লক্ষ্য’ মানে উদ্দেশ্য বা দেখা। আমরা যা জানি না তা হল, উদ্দেশ্য বা দেখা অর্থে লক্ষ্য ও লক্ষ দুটো বানানই ঠিক, তবে বাক্যে এদের প্রয়োগ করার মধ্যে ভিন্নতা আছে। উদাহরণ দেওয়া যাক :

ক. আমার লক্ষ্য দেশের উন্নতি করা। (উদ্দেশ্য অর্থে)

খ. নিজের ঘরসংসারের দিকে তার কোন লক্ষ্য নেই। (দৃষ্টি, নজর অর্থে)

গ. নিজের ঘরসংসারের দিকে সে কোনো লক্ষই করে না। (দৃষ্টি, নজর অর্থে)

অর্থাৎ দৃষ্টিপাত করা, মনোযোগ নেওয়া অর্থে এই শব্দের বানান দু রকম হচ্ছে।

বোধ হয় / বোধহয় : ‘বোধ হয়’ অর্থ- মনে হয়। আর বোধহয় অর্থ- সম্ভবত। যেমন :

ক. আমার বোধ হয়, সে নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছে গেছে। শরীরটা ভাল বোধ হচ্ছে না, মনে হয় জ্বর আসবে।

খ. তুমি বোধহয় আজ আর অফিসে যাচ্ছে না। কি, ঠিক বলি নি?

আজ বোধহয় ঝড়বৃষ্টি হবে, এমন গুমোট যে গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।

ভারি / ভারী :

ক. ভারি মিষ্টি আম, একটু চেখে দেখ। লোকটা তো ভারি বজাত মিথ্যে করে আমার নামে লাগিয়েছে।

খ. এত ভারী জিনিস আমি বইতে পারব না।

প্রথমেই এত ভারী কাজ একে দিও না, অভিজ্ঞতা আরেকটু হোক।

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে : ‘ভারি’ অর্থ- অত্যন্ত, অত্যধিক, দারুণ, আর ‘ভারী’ অর্থ— গুরুতার ওজনদার, দায়িত্বপূর্ণ।

এমনই (উচ্চারণ : অ্যামোনই) :

ক. ওর ছেলেটা এমনই পাষণ্ড যে নিত্য বৌ পেটায়।

খ. বেচারা এমনই ভদ্দরলোক যে ধার দিয়ে নিজের টাকা নিজে চাইতে পারে না।

(অর্থ প্রকাশ করছে : এতই, এই পরিমাণ, এই রকম)

এমনি (উচ্চারণ : এম্ নি ) :

ক. পরীক্ষা পাস কি এমনি হয়, রীতিমতো পড়াশোনা করতে হয়।

খ. তুই সকালে বড়ুয়াদের বাড়ি গিয়েছিলি? -হ্যাঁ। কেন?- না, এমনি মনে হল, কোন বিপদ-আপদ

শব্দটি আসলে “অমনি’। কথা ভঙ্গিতে রূপভেদে এমনি’ হয়ে গেছে। শব্দটির উৎপত্তি ‘অমন’ শব্দ থেকে। অমন / অমনি এমনি / এমনিই— সবেরই অর্থ ‘অকারণে’।)

এক রকম

ক. শোনো, শাড়ি যা কিনবে, সব এক রকমের কিনো, নইলে দু বোনে আবার কাড়াকাড়ি করবে।

খ. রাজশেখর বসুর অভিধান এক রকম, কাজী আবদুল ওদুদের অন্য রকম, আবার হস্তিরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরটা আরেক রকম।

উল্লিখিত ক উদাহরণে ‘এক রকম’ মানে same type, সমধর্মা, খ উদাহরণে ‘এক’ অর্থ আক্ষরিকভাবে এক one,

ফলে  ‘এক রকম’ বলতে one type বোঝাচ্ছে।

তার পর

মাহবুব- -উল আলম সেই যে নিষ্ঠার সঙ্গে কলম ধরেছিলেন তার পর থেকে সে কলম ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ফলে ‘এক রকম’ বলতে one type বোঝাচ্ছে। ক. ছুটি কাটাচ্ছি, হাতে একরকম কোনো কাজ নেই, পরিপূর্ণ বিশ্রাম আর কী। খ. মানুষের সহাশক্তি অসীম, শত দুঃখশোকেও মানুষ মরে না, দিন একরকম কেটেই যায়।

তারপর

ক. তুই আগে এই অঙ্কটা করবি, তারপর করবি এই অক্ষ, তারপর সবশেষে করবি এটা। কেমন? ঠিক তো?

খ. আমি তাকে টেলিফোনে খবরটা দিয়ে তারপর তো হাসপাতালে ছুটলাম।

(“তারপর’ অর্থ then, কোনো কিছুর অব্যবহিত পরে, বোঝাচ্ছে।)

 

বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ | বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ | ভাষা ও শিক্ষা

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment