আলোচনা সভার প্রধান বক্তা হিসেবে ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা , মে দিবসের তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা-সভার প্রধান বক্তা হিসেবে ভাষণ রচনা |
আলোচনা সভার প্রধান বক্তা হিসেবে ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
মান্যবর প্রধান অতিথি এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ,
অবিস্মরণীয় মৃত্যুঞ্জয়ী শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পাইস-এর প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি কথা দিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করছি : ‘এমন সময় আসবে যখন কবরের অভ্যন্তরে শায়িত আমাদের নিশ্চুপতা জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বাঙময় হবে এবং তারা শ্রমিকশ্রেণীর বিজয়লাভের শেষ সংগ্রাম পর্যন্ত লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
সুধীবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর সেদিনের সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যর্থ হয় নি তাঁদের এই আত্মদান। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক স্মরণীয় অধ্যায়। ‘মে দিবস’ পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে সুধী, সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের শ্রমের ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি ও দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীতে যে আন্দোলন হয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তা আজ বিশেষভাবে স্মরণীয়।
চাকরিরত যে-কোনো দেশের যে-কোনো মানুষ স্মরণীয় সেই আন্দোলনের সুফল ভোগ করছেন। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থাপনা এখন প্রায় সবদেশেই প্রতিষ্ঠিত। মে দিবস, আজ তাই হাজার হাজার শ্রমিকের পায়ে চলা মিছিলের কথা, আপসহীন সংগ্রামের কথা। মে দিবস দুনিয়ার শ্রমিকের এক হওয়ার ব্রত। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। মে দিবসের অর্থ শ্রমজীবী মানুষের উৎসবের দিন, জাগরণের গান, সংগ্রামে ঐক্য ও গভীর প্রেরণা। মে দিবস শোষণ মুক্তির অঙ্গীকার, ধনকুবেরের ত্রাস, দিন বদলের শপথ। সুধীবৃন্দ, আজ ১ মে, ‘মে দিবস’। এই দিবসটি একদিনেই আন্তর্জাতিক চেহারা পায় নি।
এর পেছনে যে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে অনেক রক্তঝরার কাহিনী, তা আপনাদের কম-বেশি সবারই জানা। তবু আমি একটু পিছনের দিকে যেতে চাই, আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই মে দিবসের মূল ঘটনাগুলো। আপনারা জানেন যে, মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য—- শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়। আর এই আন্দোলনের সূচনা। হয়েছিল দেড়শ বছর আগে (১৮৫৬) অস্ট্রেলিয়াতে। আট ঘণ্টা শ্রম দিবস— এই দাবিকে কেন্দ্র করেই আন্দোলনের ! সূত্রপাত। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু করে।
ব্যাপক আন্দোলন চূড়ান্তরূপ লাভ করে ৩ ও ৪ মে। কিন্তু । আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করার জন্য পুলিশ গুলি চালায় এবং ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। সেই সঙ্গে বহু শ্রমিক আহত | হয়। গ্রেফতার হয় অগণিত শ্রমিক। অগাস্ট স্পাইস, এ্যালবার্ট পারসন, অ্যাডলফ ফিশার ও জর্জ এনগেলকে প্রাণদণ্ড | দেয়া হয়। লুইস লিংগ বন্দি অবস্থাতেই আত্মহত্যা করেন। শ্রমিক আন্দোলনের এই গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণীয় করে। রাখার জন্য ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বের সকল দেশেই মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয় মহান মে দিবস।
সুধী, মে দিবস হল দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংকল্প গ্রহণের দিন। এই সঙ্কল্প হল সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপসাধন। পুঁজিবাদী দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দৃঢ় অঙ্গীকার। মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তা- চেতনায় এনেছে এক বৈপ্লবিক তাৎপর্য। লেনিন মে দিবসকে ব্যবহার করেছিলেন শ্রমিকশ্রেণীর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। তারই সার্থক পরিণতি ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবে। মে দিবস দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ, দুনিয়ার শ্রমিক এক হওয়ার উজ্জীবন মন্ত্র।

সুধীমণ্ডলী, ১৯৮৬ সালে ঐতিহাসিক মে দিবসের শতবর্ষ শেষ হয়েছে। মে দিবসের এই দীর্ঘ শতবর্ষের আলোয় অনেক অন্ধকার দূর হয়েছে। সংগ্রামী শ্রেণির সামনে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত। দৃঢ় হয়েছে শ্রমিক সংহতি। বিশ্বের এক- তৃতীয়াংশ মানুষ আজ রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। কিন্তু এখনও জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত নয়। মুক্ত নয় সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজও প্রবল, পরাক্রান্ত। এখনও তার নির্লজ্জ রণ-হুংকার থামে নি। তাই দুনিয়া জুড়ে মে দিবসের যে বিজয় অভিযান সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ও পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর বৈপ্লবিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামী চেতনা ও চরিত্র ই শ্রমজীবীর ভূষণ।
মে দিবস আজ আর শ্রমিকের কাজের ঘণ্টা কমানো দাবির আন্দোলন নয়। মে দিবস আজ দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংগ্রামের দিন, সৌভ্রাতৃত্বের দিন, নতুন করে শপথ গ্রহণের দিন। মে দিবস এখন শ্রমিকশ্রেণীর সামনে নতুন ঊষার স্বর্ণ দুয়ার। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দুর্লভ এক সম্পদ। সুধী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাজ এবং বিশ্রামের একটি সুষম ব্যবস্থাপনা থাকা বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর অগ্রগতিতে যে সমস্ত ব্যবস্থাদি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে শ্রম এবং বিশ্রাম ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য। তবে কাজের পরিপ্রেক্ষিতে মজুরি নির্ধারণের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে।
মহান মে দিবসের চেতনা সরকার, মালিক ও শ্রমিকের মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবো- এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা। সম্মানিত সুধীবৃন্দ, এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার বক্তব্য শোনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।
আরও দেখুন: