সভার বক্তা হিসেবে ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা , ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সভার বক্তা হিসেবে ভাষণ |
সভার বক্তা হিসেবে ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সভার সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ, সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । আজ ৮ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। সাক্ষরতার প্রার্থনা মানুষের জন্মজন্মান্তরের। সভ্যতার সূচনার দিনেও তার প্রার্থনা ছিল অন্ধকার থেকে আলোতে যাওয়ার। তারপর কত শতাব্দী অতিক্রান্ত হল। আজও মানুষের সেই আদি প্রার্থনা অপূর্ণ থেকে গেল। অথচ সভ্যতার ইতিহাস এক জায়গায় থেমে থাকে নি। মানুষ পেয়েছে নব নব সমৃদ্ধ দিগন্তের সন্ধান।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ একে একে জয় করেছে আকাশ মাটি পাতাল। সংগ্রহ করেছে জীবনের প্রয়োজনীয় সব উপকরণ। তবু বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন আজও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকল। এখনও তাদের জীবন শুধু দিন যাপনের গ্লানি, নিরক্ষরতার অভিশাপে পঙ্গু। তাদের জীবনে কোনো জিজ্ঞাসা নেই। উত্তরও অজানা। আধুনিক সভ্যতা ভূগোলের দূরত্বকে সরিয়ে দিয়েছে। পৃথিবী আরও কাছের হয়েছে। তাই আজ অনেক সমস্যাই আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল নিরক্ষরতা সমস্যা। নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের তাৎপর্য নিহিত।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ, আপনারা অবগত আছেন যে, জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। উন্নত বিশ্বের জন্যে তা তেমন তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচিত না হলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্যে তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে আমাদের দেশে এই দিবসটি সার্বিক নিরক্ষরতা দূরীকরণে আমাদের জবাবদিহিতার ভূমিকা দাবি করে। এ প্রসঙ্গে সাক্ষরতার দিক থেকে আমাদের অবস্থানটা জানা প্রয়োজন। ‘সবার জন্য শিক্ষা গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট, ২০০৫’-এ বলা হয়েছে যে, বিশ্বে শুধু বয়স্ক নিরক্ষরতার সংখ্যা প্রায় ৮০০ মিলিয়ন, যা বয়স্ক জনসংখ্যার ১৮.৩ শতাংশ। বিশ্বের নিরক্ষরদের মধ্যে প্রায় তিন ভাগের দু ভাগই মহিলা (৬৪%)।
আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চল, দক্ষিণ এবং পশ্চিম এশিয়ায় (যেখানে সাক্ষরতার হার মাত্র ৬%) সবচেয়ে বেশি নিরক্ষর জনসংখ্যা রয়েছে। বিশ্বে বয়স্ক নিরক্ষরের ৭০% (৫৬২ মিলিয়ন) এর বেশি বাস করে নয়টি দেশে— ভারত (৩৪%), চীন (১১%), বাংলাদেশ (৬.৫%) এবং পাকিস্তান (৬.৪%)। ২০০০ সালের এপ্রিলে ডাকারে ১৬৪টি দেশের সরকার সম্মিলিতভাবে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছেন। আমাদের দেশে ২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য শিক্ষার শ্লোগান তোলা হয়েছিল এবং ২০০৬ সালের মধ্যে সবাইকে সাক্ষর করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হলেও তা আজও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি।

সুধী, আমাদের দেশে সরকারি হিসেবে শতকরা ৫৮ ভাগ লোক শুধু নাম লিখতে পারে। বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ লোক পুরোপুরি নিরক্ষর। দেশের প্রায় আট কোটি লোক নিরক্ষর বলে অনুমিত। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশকে অশিক্ষিত রেখে একটি দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের দেশে সাক্ষরতা দিবস পালনের উপযোগিতা অনেক বেশি। উল্লেখ্য যে, সাক্ষরতার ধরন সম্পর্কেও আমাদের বিবেচনা করতে হবে। কেননা, সাক্ষরতার “সঙ্গে জীবন ও জীবিকার ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে।
সেজন্য এখন শুধু স্বাক্ষর করতে পারলেই সাক্ষর বোঝায় না, এখন সাক্ষরতা বলতে লেখাপড়া হিসাব-নিকাশের এমন একটা মান বোঝায়- যা অর্জনের মাধ্যমে জীবিকার উপায় বের করা সম্ভব। তাই এখন সাক্ষরতার পাঠ্যক্রমে জীবনের বৃত্তি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রধান অন্তরায় নিরক্ষরতা। আধুনিক বিশ্ব যখন প্রতিমুহূর্তে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক, দ্রুত ও বহুমুখী অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলছে তখন তার সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না।
এর মূল কারণ হল নিরক্ষরতা। উপরন্তু উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাবে আমাদের বিপুল জনসংখ্যা জনশক্তিতে পরিণত হচ্ছে না। বস্তুত সবার জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্য সমূহের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে সরকারের নীতিমালার ওপর। বর্তমানে দেশে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় পর্যায়েই সাক্ষরতা কার্যক্রম চলছে। সরকার শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দ দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। যেমন : বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম, গণশিক্ষা, মসজিদ শিক্ষা, অষ্টম শ্রেণি (পরে কলেজ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে) পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা, ছাত্রীদের উপবৃত্তি।
প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ, প্রতিটি উচ্চবিদ্যালয় এবং কলেজে ডাবল শিফট চালু করা ইত্যাদি প্রধান। প্রিয় সুধীসমাজ, সারা বিশ্বে ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে সাক্ষরতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। তার পাশাপাশি নানা আয়োজন থেকে কিছু কিছু দিক্নির্দেশনাও দেয়া হয়- যা সাক্ষরতার সম্প্রসারণে সহায়ক হয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস সম্পর্কে সচেতন নয়। এর জন্যে এ দিবসটির কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যেন জনগণ এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে।
এর জন্যে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে এবং যারা নিরক্ষর তাদের কাছে এ দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে, বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের ন্যায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি সাক্ষরতার ওপরেই নির্ভর করে। তাই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরার মাধ্যমে এর সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
আরও দেখুন: