ভাষণের কাঠামো বা ভাষণের বিষয়বস্তুর পর্যায় | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

ভাষণের কাঠামো বা ভাষণের বিষয়বস্তুর পর্যায় | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা , একটি সার্থক ভাষণকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। অথবা একটি সুন্দর ভাষণ লিখতে গেলে ভাষণটিকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন :

ভাষণের কাঠামো বা ভাষণের বিষয়বস্তুর পর্যায় | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

১. সম্ভাষণ ২. ভূমিকা বা সূচনা বা প্রস্তাবনা ৩. মূল বক্তব্য ৪. উপসংহার

১. সম্ভাষণ : যে কোনো ভাষণের জন্যে সম্ভাষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লক্ষ রাখতে হবে, বক্তার সম্ভাষণটি যেন শ্রোতাদের মনের ওপর প্রভাব বিস্তারের পটভূমি রচনা করতে পারে। সভায় যেহেতু বিভিন্ন শ্রেণির লোক, যেমন— সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, সাধারণ অতিথি ও সাধারণ দর্শক-শ্রোতা থাকেন, তাই মর্যাদা বা গুরুত্ব অনুসারে তাঁদের সম্বোধন করতে হবে। পরিস্থিতি, পরিবেশ ও দর্শক-শ্রোতার ওপর নির্ভর করে সম্ভাষণ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন : মাননীয় প্রধান অতিথি, শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সমবেত সুধীবৃন্দ / মাননীয় সভাপতি ও উপস্থিত সদস্যবৃন্দ / শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ, মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ ও ছাত্র-ছাত্রী ভাই ও বোনেরা / মাননীয় সভাপতি ও প্রিয় এলাকাবাসী / সংগ্রামী সাথি ও বন্ধুগণ / সংগ্রামী সাথিরা / আমার প্রাণপ্রিয় সংগ্রামী বন্ধুরা ইত্যাদি।

 

ভাষণের কাঠামো বা ভাষণের বিষয়বস্তুর পর্যায় | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

 

প্রথমত, সভার সভাপতিকে [প্রধান অতিথি থাকলে প্রধান অতিথিকে] এবং শ্রোতৃমণ্ডলিকে যথোচিত সম্ভাষণ করে ভাষণের সূচনা করতে হয়। ‘সম্মানিত সভাপতি’ [প্রধান অতিথি থাকলে], ‘মাননীয় প্রধান অতিথি’ এবং ‘সমবেত সুধীবৃন্দ’ বলে সাধারণত সম্ভাষণ পর্ব সেরে নেওয়া হয়। কোনো সমিতির সভা হলে ‘শ্রদ্ধেয় সভাপতি এবং মাননীয় সদস্যবৃন্দ’- এভাবে সম্ভাষণ করা উচিত।

ভোজসভা বা অনুরূপ কোনো সভানুষ্ঠান হলে সম্ভাষণ করতে হবে ‘মাননীয় অতিথিবৃন্দ’– এইভাবে। একই বক্তৃতা বা ভাষণে বক্তব্যের বিষয়কে স্পষ্ট ও জোরালো করার জন্যে, অথবা বক্তার আন্তরিক ভাবকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে কিংবা ভাষণের বিষয়বস্তু দর্শক- শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যে বক্তব্য বিষয়ের একটি অংশ শেষ করার পর আরেকটি অংশ উপস্থাপনের পূর্বে একই সম্ভাষণকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দিয়ে ব্যবহার করে থাকেন।

যেমন— ‘আমার প্রাণপ্রিয় সাথী ও বন্ধুরা’- এই সম্ভাষণটিকে বক্তা বক্তব্যের মধ্যে পুনরায় ‘সংগ্রামী সাথী ও বন্ধুগণ’ বা ‘সংগ্রামী সাথিরা’ বলে ব্যবহার করে থাকেন। অনেকসময় একই ভাষণের কয়েকটি বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করতে গিয়ে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যেও বক্তা একাধিক সম্ভাষণ ব্যবহার করে থাকেন।

২. সূচনা বা ভূমিকা বা প্রস্তাবনা : ভাষণের পরবর্তী অংশ হল সূচনা বা ভূমিকা। এই অংশে সম্ভাষণের পর সভার বা ভাষণের মূল উদ্দেশ্যের কথা বিবৃত করে মূল বক্তব্যের পূর্বাভাস দিতে হয়। অর্থাৎ একপ্রান্তে অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ, অন্যপ্রান্তে মূল বক্তব্য; বক্তৃতার সূচনা অংশ এই দুটি প্রান্তের মধ্যে সংযোগের সেতু রচনা করে দেবে। সূচনা পর্বের মাধ্যমেই শ্রোতাদের নিয়ে যাওয়া হয় মূল বক্তব্যের মধ্যে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তা এ-অংশে সভার আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে থাকেন। স্মরণ রাখতে হবে যে, সূচনার ওপরই সমগ্র ভাষণের গাম্ভীর্য নির্ভর করে। তাই এই অংশে এমন ধরনের বাচনভঙ্গির অবতারণা করতে হবে- যাতে শ্রোতৃবৃন্দ খুব সহজেই ভাষণের মূল বিষয় শ্রবণ করার জন্যে কৌতূহলী হন এবং ভাষণের প্রতি আকৃষ্ট হন। যাই হোক, এই অংশ মূল বক্তব্য বিষয়ে অনুপ্রবেশের সিংহদ্বার।\

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

৩. মূল বক্তব্য : ভাষণের সর্বাপেক্ষা মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বক্তব্য অংশটি। চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও স্পষ্টতা ভাষণের অন্যতম গুণ বলে বিবেচিত হয়। শ্রোতাদের মনের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই অংশটিকে যুক্তিগ্রাহ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা প্রয়োজন। স্মরণ রাখতে হবে, মানুষ নিছকই বুদ্ধিশীল প্রাণী নয়, তার জীবনে আবেগের একটি বৃহৎ স্থান আছে। তাই বক্তৃতা শুধুই যুক্তিনিষ্ঠ হলে চলবে না; প্রভাব বিস্তারের জাদুকরী শক্তির জন্য চাই আবেগের মিশ্রণ। শেক্সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে সিজারের হত্যার পর ব্রুটাস যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা প্রধানত ছিল যুক্তিধর্মী। সে যুগের রোমান অধিবাসীরা কিন্তু অ্যান্টোনিওর আবেগধর্মী ভাষণেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, বক্তাকে উপস্থিত শ্রোতাদের শিক্ষা, মনমানসিকতা ইত্যাদি বিচার করেই বক্তব্য বিষয় উপস্থাপিত করতে হবে এবং সেই সঙ্গে বিষয় অনুসারে বক্তৃতা কখনো আবেগধর্মী কখনো যুক্তিধর্মী হবে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে ভাষণ যেন নীরস না হয়ে পড়ে। চিন্তাশীলতার সঙ্গে আবেগের মেলবন্ধন ঘটলে ভাষণের চমৎকারিত্ব বৃদ্ধি পায়। যুক্তিশৃঙ্খলার উপস্থাপনা এবং আবেগের বারিবর্ষণের প্রয়োজনে কোনো কবি-সাহিত্যিকের কিংবা কোনো নেতা- মহাপুরুষের সুভাষিত বাণীমঞ্জরীর দু- একটি প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করলে ঈপ্সিত ফল লাভ করা যায়। কিন্তু স্মরণীয়, এক্ষেত্রে ভুল উদ্ধৃতি বক্তব্যের ভাব-মূর্তিটিকে একেবারে বিনষ্ট করে দিতে পারে।

 

ভাষণের কাঠামো বা ভাষণের বিষয়বস্তুর পর্যায় | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

 

সংশয় থাকলে তেমন কোনো উদ্ধৃতি পরিহার করাই উত্তম। শ্রোতাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্যে বক্তব্য বিষয়কে ক্রমপর্যায়ে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে যে, উপস্থাপিত বিষয়গুলোর উল্লেখ যেন এলোমেলো না হয়। তাই একটি বিষয়ের সঙ্গে পরবর্তী বিষয়ের যোগসূত্র স্থাপন করেই বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। অল্প কথার মধ্য দিয়ে ভাষণের মূল বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করতে পারলে বক্তব্যকে অযথা দীর্ঘ না করাই বাঞ্ছনীয়, এতে শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি

৪. উপসংহার / সমাপ্তি : এই অংশে মূল বক্তব্য বিষয়ের সারকথা অর্থাৎ ভাববস্তুটি অত্যন্ত শিল্পচাতুর্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করে বিদায়ী সম্ভাষণের মাধ্যমে সমাপ্তির ছেদ রেখাটি টেনে দেওয়া হয়। উপসংহারের মধ্যে বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটে বলে এখানেই ভাষণ পূর্ণতা পায়, তাই আবেগময় ভাষায় এই উপসংহার টানলে উপস্থাপিত বিষয়টির আবেদন শ্রোতার মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। প্রসঙ্গত আর একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে, ভাষণের সমাপ্তি যেন বক্তব্যের পারম্পর্য রক্ষা করে আসে, আকস্মিক যেন না হয় সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

আরও দেখুন:

Leave a Comment