যে ঘটনা কখনো ভোলা যায় না | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা ,
যে ঘটনা কখনো ভোলা যায় না
(রেল গাড়িতে একদিন ও অন্ধ ফেরিওয়ালা)
একজন অন্ধলোক প্রায়শ দুয়ার ভিখারী। অন্য দশ জনের মতো সহজ স্বচ্ছন্দ গতি সে নয়। উৎপাদনে উপার্জনে, অন্ধ অক্ষমকে ভিক্ষুকের হাত বাড়িয়েই জীবিকার নিত্য দোলায়মান দুর্বল ডালপালা ধরতে হয় ধরে থাকে; এতোদিন স্বাভাবিক বলে তা-ই দেখে অভ্যস্ত হয়েছি। কিন্তু সেদিন ট্রেনযাত্রায় একেবারে ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন হলো। এতোদিনের বদ্ধ ধারণাটুকু মুহূর্তেই ভেঙে চূড়মার হয়ে গেল। এক অন্ধ ফেরিওয়ালার জীবনসংগ্রাম দেখে বদলে গেলো আমার জীবন-জিজ্ঞাসার নানা চিত্রপটের অভিজ্ঞতা। ট্রেনে একজন অন্ধলোক, ফেরিওয়ালা। দেখলাম ওর হাতে টিনের কৌটা কিংবা এবড়ো থেবড়ো টিনের থালা, কোম্পানির জিনিস।
মুখে ওর ধর্মবোধ সঞ্চারী রকমারি গজল কিংবা একঘেয়ে বেহেশত বিক্রির ফিরিস্তি নয়, বাস্তব দ্রব্যের গুণাগুণ ব্যাখ্যা। আহূত বিরক্ত না হয়েও যে জীবন সংগ্রামের পরিচয় পেলাম তাতে করেই মনে হলো ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থাকলে বিত্তহীন হয়েও চিত্তজয়ী গৌরবের অধিকার লাভ করা যায়। ফেরিওয়ালারা সাধারণত অখ্যাত কোম্পানির জিনিসপত্র ফেরি করে কথার তোড়ে মুখের জোড়ে বাকজাল বিস্তার করে, ওরা লেকচার করে। অবাক মুগ্ধ সম্মোহিত যাত্রী, পথচারীরা সস্তা স্বল্প সময়ে বেশি উপকার অধিক ফল লাভের জন্য কেনে তাদের কাছ থেকে দাঁতের মাজন, দাঁতের ব্যথা কিংবা অন্যসব রকম ব্যথা-বেদনার আশ্চর্য মলম, তেল, সাবান, কলম, চিরুনী, বই, খাতা আরও কত কি রকমারী জিনিস।
অন্ধ লোকটি একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে ভিড় ঠেলে অত্যন্ত বিনীত ভদ্র কণ্ঠে দাঁড়াবার জায়গা করে নিয়েই শুরু করলো- আচ্ছা স্যারেরা, জনাব আপনাদের যাত্রা শান্তিপূর্ণ শুভ হউক, আপনারা চুপচাপ বসে আছেন, টুকটাক আমার দু-একটা কথা শুনে যান, যাত্রা আনন্দের হউক। প্রথমে মুসলমান ভাইদের প্রতি আচ্ছালামু আলাইকুম, হিন্দু ভাইদের প্রতি আদাব এবং অন্যান্য জাতি ভাইদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। সম্মানিত সাহেবরা, যাত্রী ভাইয়েরা— ট্রেনে আজকে ভীষণ ভিড়। যেখানে দশজন ভদ্রলোক থাকেন, সেখানে একজন ডবল ভদ্রলোক থাকেন। সুযোগ পেলে সবাইকে চক্ষুদান করতে পারেন। যার যার মাল-সামানের প্রতি লক্ষ রাখুন, পকেট সামলে রাখুন। নিজের মাল পাচার হয়ে গেলে রসিদ পাবেন না।
জুতো- স্যান্ডেল নিচে রেখে কেউ পা তুলে উপরে বসবেন না, ট্রেনে আজকাল বিলিতি ইঁদুর উৎপাত করছে। চেইন সিস্টেম ঘরি থাকলে কেউ হাত জানালার বাইরে রাখবেন না— ট্রেনের গতিবেগ তিরিশ মাইল হলে আপনার ঘড়ি উল্টোদিকে ষাট মাইল গতিবেগে চলে যাবে— আপনি সামলাতে পারবেন না। তারপর সে একটু কেশে নিয়ে আসল ‘লেকচার’ ঝাড়বার কায়দা করতে লাগলো। যাত্রীরা ততক্ষণ ভিড় ঠেলাঠেলির বিরক্তি, বিদ্বেষ ইত্যাদি সত্বেও ফেরিওয়ালার প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন।

অন্ধ লোকটি শুরু করলো— “আমার কাছে আছে স্যার টক-মিষ্টি-ঝাল-কমলালেবুর লজেন্স, অমুক কোম্পানির বিখ্যাত চকলেট-লজেন্স। এক- একটা লজেন্স মুখে নিন- মনে হবে স্যার এই গাড়িটা যেনো দার্জিলিং মেল, আপনার মনে হবে স্যার, আপনি ছাতকের কমলালেবুর বাগানে বসে বসে কমলালেবু খাচ্ছেন; আপনার মনে হবে রাজশাহীর ফজলী আম খাচ্ছেন। একটা লজেন্স মুখে নিন, মনে হবে, স্যার আপনার এক গালে পদ্মা নদী, আরেক গালে যমুনা নদী দারুণ ঢেউ খেলে। আপনার মনে হবে স্যার আপনি মেশকোজাফরান দেয়া সুস্বাদু ঠাণ্ডা সরবত খাচ্ছেন ইত্যাদি বাক্য জালে সহজেই শ্রোতৃমণ্ডলী অভিভূত হলো।
ভিক্ষুকের হাত কোনো কালেই সংগ্রামী হাত নয়। অন্ধ লোকটি শ্রেষ্ঠ বাগ্মীর ন্যায় শ্রোতৃহৃদয় জয় করেছে। জীবন সংগ্রাম ওরও আছে, কিন্তু কঠিন ও কঠোর যতোই হোক, মর্যাদাবান পেশাগত জীবনকে এমন সুন্দর মহৎ করতে পারে কজনে? আজকে কতো ফালতু অজুহাতে কতো শিক্ষিত সভ্য ব্যক্তিইতো অসৎ অসুন্দর উপায়ে জীবিকা অর্জন করছে। দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি, মজুতদারী, চোরাচালানী করে কতো মহামান্য ব্যক্তিই জীবন সংগ্রামে জয় লাভের চেষ্টা করছে; তারা সমাজজীবনে সৃষ্টি করছে কি কঠিন সঙ্কটের আবর্ত। সে তুলনায় এই অন্ধ ফেরিওয়ালা? অন্ধত্বের অভিশাপ মানবিক মর্যাদাবোধকে ওর হত্যা করতে পারেনি।
জীবন সংগ্রামে জয় পেতে তাঁর কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। অদম্য স্পৃহা, থেমে যায় নি জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও। সে নিজের কথা বলতে গিয়েও পরের কথা ভোলেনি। ওর চোখ নেই, কিন্তু চক্ষুসমানদের সে সাবধান করে দেয়, কেননা মানুষের বিরুদ্ধে ওর কোনো আগ্রাসী মনোভাব নেই। তাই তাঁর জীবন সংগ্রাম ভয়ঙ্কর নয়, কুৎসিত নয়, সর্বতোভাবে সুন্দর, মানব-মনোহর— অতি সুন্দর। জীবনের সুন্দর এই অভিজ্ঞতাটুকু জীবন-খাতায় চিরদিনের জন্য লেখা রইলো।
আরও দেখুন: